কোটি কোটি মাইল খাঁ খাঁ শূন্যতা...
কৌশিক বাজারী
...এই যে নদীতীরে প্লাবনভূমি উদ্ভাস, গত জন্মের
পিকনিকের আয়োজন, খুব ভোরবেলা উঠে পুলওভার, শাল, মাফলার জড়িয়ে
এক কমলা রঙের রোদের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ।তারপর সারা দিন শুধু সূর্যের উত্তাপ,
প্রখরতা
আর ঘটনার স্রোত
। নদীতীরে সেই
যা যা হয় ; এক
মৎসকন্যার সাথে দেখা হয়ে গেল, তার রূপালী শরীর অসামান্য রসিকতায় আমার দু'চোখ ঝলসে
দিয়ে গেল ।দুই চোখ যেন
ইহকাল
- পরকাল । আমার পরকাল
বলে কিছু নেই এই বালক বয়সে, ত্রি-নয়ন বলেও কিছু নেই তাই
বর্তমান বলেও আর কিছুই রইলো না এই পিকনিক জীবনে...
এখন পৃথিবীর সন্ধ্যাবেলা । গুরুদাসপুর
মোড়ে সমস্ত মানুষ অন্তিম একা । গুরুদাসপুর বরাবর কুপি-জ্বলা, ধোঁয়াটে,
ক্ষয়াটে এক গঞ্জের মোড়...। কেরোসিন কুপি থেকে উদ্গত কালো ধোঁয়ায় তৈরি অন্ধকার গঞ্জের আনাচে কানাচে
, এর
মাঝে এক মধ্যকিশোর
এসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায়,-- 'টাটকা মারমেড আছে,ভালো দাম...'।
মারমেড, মারমেড, মৎসকুমারী -- বুকের মধ্যে বাতাস ছলাৎ করে ওঠে ।
উল্লাস, ধর্ষকাম ও যৌনতা মিশ্রিত মৎসকন্যার মাংসের ওম বড় প্রিয় স্বাদ হ'য়ে উঠেছে
আজকাল ...।
এর মধ্যে কোথাও ঈশ্বরের উদাসীন হেঁটে
যাওয়া নেই...
কে এই ঈশ্বর ? ঈশ্বর আসলে
কী ? তিনি
পুরুষমানুষ নাকি নারী ? পুরুষের যা যা থাকে,যথা; শিশ্ন ও পেশীবহুলতা,-- সেসব ঈশ্বরের
নেই। অথবা নারীর
স্নেহ ও সহনশীলতা
এসবও বড় মানবিক। তাহলে
ঈশ্বর আসলে কী ? ঈশ্বরএকটি বালুঘড়ি যাকে মাঝে মাঝে উল্টে নিতে হয় ! তাহলে কবিতা কী কবির ঈশ্বরী ? ঈশ্বর
অবিশ্বাসী কবিরা কি আপত্তি জানাবেন ?
মহামানবেরা বলেন; ঈশ্বর দৃষ্ট নন। তিনি প্রতিভাত হন। যেমন আলো...। আলো স্বয়ং
অদৃশ্য, তথাপি সমস্ত জগত আলোতেই দৃশ্যমান । কবিতাও দৃষ্ট
নয় সকলের কাছে...। হয়ত,
সাতটি
তারার তিমিরে আপনি যতখানি ঘোর নিমজ্জমান, আপনার সৎ ও প্রকৌশলী মেজমামা
ততটাই গম্ভীর বিরক্ত...
২.
বন্ধু, কবি,সুদেবদা
[বক্সী] একবার
এক একান্ত আড্ডায় বললেন,-- 'ঈশ্বর আছে কি নেই, সে কথা বড় কথা নয়, ঈশ্বরের
প্রয়োজন আছে' । একজন
অগ্রজ কবি যখন একথা বলেন, তখন আমার মতো ঈশ্বর-স্পর্শহীন মানুষেরও তার প্রেক্ষিতটুকু
তলিয়ে দেখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উপরের কথা গুলো তারই প্রেক্ষিত...
আসলে আমাদের জীবনের চর্যার
একদিকে-- দেবতা, ভগবান,আল্লা,কালী,মণ্ডপ,বাজনা,রথ,পথ,মূর্তি,ধর্ম ও জিরাফের এক প্রবল খিচুড়ি । অন্য দিকে
গ্লোবালাইজেশন্,উত্তরাধুনিকতা,ভোগবাদ,দারিদ্র-বিলাস
['বিকল্পহীন
পুঁজিবাদ' আর
দিশাহীন
রিপাবলিক-বাদ। এক
উত্তরাধুনিক ধাঁ-ধাঁ র মতো ধুলায় মিশে যাচ্ছে সাম্য ও মৈত্রীর ধারনা...,
যা
সারা পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারত,তা সারা
পৃথিবীতে আন্ডার গ্রাউন্ড হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ...] এর মাঝে হয়ত কখনো তাকে দেখতে
পাওয়া যায়, হাওড়া-মেদিনীপুর
লোকালের বিষণ্ণ
কামরায় নাজেহাল ভিড়ের মধ্যে ঝুলতে ঝুলতে চলেছেন-- তার হাতে একখানি বাঁধানো
পুস্তক...
-- প্রভু, নিবেদন ছিল...
-- হ্যাঁ ভাই, ...তবে ঐ প্রভু
শব্দটা আর ব্যাবহার না করাই ভালো, ওতে আমার বরাবরই
আপত্তি ছিল,আর
তাছাড়া ওটা বড্ড ফিউডাল গন্ধযুক্ত...
--আপনার হাতে ওটা...?
--রবীন্দ্রনাথ...না, কবিতা নয়...
-- ??
-- এগুলো খেলা ভাঙার খেলা...।(একটু দম
নিয়ে) ওর শেষ বয়সের খেলা। দীর্ঘজীবনের ক্ষোভ,অপমান,অবদমন,উচ্ছ্বাস,বিষণ্ণতা,ব্যর্থতার
সমবেত টেনশন-আততি। সত্যি
বলতে,এখানে উনি আমাকেও
ছাড়িয়ে গেছেন প্রায়। এখন
আমি এই পুস্তক ,এই ব্যর্থ প্রিন্ট ধরে ধরে তাকে অনুসরণের চেষ্টা করছি...এতো শুধু ছবি নয়,
এ যেনও
আমারই
হার মানা হার...
৩.
তাহলে কবিতা কী ? সে তো দৃষ্ট নয়। ভাষা,
বর্ণমালা,
আঙ্গিক...
তার আধার মাত্র, অথচ আধেয় যে , সে কোথায় ? আলোচনা থেকে
কোনো আলো নেই। প্রবন্ধের
সাধ্য নেই তার ভার বহনের। এ এক অসম্ভব খেলা। আসলে সে এমনই এক স্বয়ংসিদ্ধা,যার স্বরূপ সে নিজেই। একজন কবি
তাই
সরাসরি কবিতাকেই প্রশ্ন ক'রে বসলেন--
'কবিতা
কেমন আছো ?
--যেমন
থাকে ভালবাসার মানুষ, অপমানে '
৪.
জনগণের কোনো ঈশ্বর
নেই । আসলে থাকতে
পারে না । আমাদের যা
কিছু আছে সবই দেবতা আর দেবত্বর এস্টেট ।
কোন এক
পাড়াগাঁর কবি শীতল বিশ্বাস একদিন অবাক বিস্ময়ে হাজির হয়ে বলল,--দাদা ,
এই যে
ফি-বৎসর বৈশাখেই নিত্যানন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়, এর মূল অনুষ্ঠান
নাকি গ্র্যান্ডের বলরুমে ...? আমি তাকে থামিয়ে বলি ,নারে দাদা,ওটা বলরুম নয়
ব্যাঙ্কোয়েট...। শীতল
বলল,জানো
দাদা আমার ভাবলেই কেমন গা বমি বমি ভাব হয়। বললাম,
এসব
বলিস নি ভাই, বলতে
নেই,ওসব
দেবভোগ্য জিনিষ,দুধে-গম,দুর থেকে নমস্য...।
এসবই
একান্ত আমাদের পাড়াগেঁয়ে কথা । কিন্তু এই এক আজব ব্যাপার
পুরস্কার ।
এটা
এখনো ঠিকঠাক বোধগম্য হয়না আমার। শব্দটা লক্ষ করুন, 'পুরস্কার'
! 'সম্মান'
নয়
কিন্তু, । এই পুরস্কার
শব্দটাই তো
আপত্তি জনক । এতো
আপাদ-মস্তক ফিউডাল,সামন্ততান্ত্রিক ।
সভাকবি
গোবিন্দলাল একখানি রাজ-প্রশস্তি রচনা করিয়াছেন, মহারাজ শুনিয়া মুগ্ধচিত্ত
হইলেন,--অহ্,একি বর্ণনার
ছটা, একি
ঘটনার ঘনঘটা,একি
ঝংকৃত ব্যঞ্জনা...। তিনি
পুরস্কার স্বরূপ কবিবর প্রতি তিন-ছড়া মুক্তার মালা গলা হতে খুলে
নিক্ষেপ করলেন। ধন্যি
রাজার পুণ্যি দেশ। কবিবর
ধন্য হলেন।
তো এই হল
পুরস্কার প্রদানের মোদ্দা কথা ।এখানে কবি বা কবিতার প্রতি সম্মান পথপ্রদর্শনের
কোনো প্রশ্নই নেই । শুধু
মহারাজের নিজের প্রয়োজনেই অনুষ্ঠানটিকে বর্ণময় করে তুলতে হয়। --যেমন শব্দ-বাজী,
যেমন
পূজা মণ্ডপ, যেমন
আপন ঢাক...।সবি পরম-পূজ্য
দেবতা আর দেবত্বর এস্টেট । এখানে কবিতা অথবা ঈশ্বরীর কোনো ভূমিকা নেই।
এর বিপরীতে
একটা কথা খুব প্রচলিত আছে। দারিদ্র-বিলাস। 'আমার এ ভাঙা ঘরে প্রিয় অন্ধকার" । অর্থাৎ এই যে
আমার নেই,
এই নেই
টা কেই মহান ক'রে দেখানোর দার্শনিক প্রক্রিয়া । অর্থাৎ তুমি
যা অর্জন
করতে পারো নি,মনো-জাগতিক
কারনেই তুমি তার বিরোধিতা করবে । LCD, ফ্ল্যাট,কার,ব্যলান্স, অবৈধ নম্বর, সশব্দ-গামবুট,কিম্ভুত কিমা
ও কাবাব হড্ডি
বিহীন, -- তুমি
শেখোনি কিভাবে অর্জিত হয়, তাই বিরোধিতা তোমার কাম্য,ফাটা থালা আর ভাঙা ছাদের গর্ব
তাই তোমার শিল্পের বিষয়,তোমার দারিদ্র-বিলাস। তাহলে...
...যা
সব দেখিনি
দেখলাম না, দূর জীবন দূর অনেক দূর কোটি কোটি
মানুষের
নগরী বিমান সিংহাসন বরফের স্তূপ মাইলের পর মাইল
মাঠ মহাসাগর সে সব স্বপ্নে ছিল হয়ত, তবু,দুঃখ নেই ।
এই যা দেখলাম বল ক্লান্ত জীর্ণ ঘর দোর কখনো কর্দমাক্ত
কখনো ফেটে যাওয়া রাস্তাঘাট--ফুলহীন ধন্যবাদহীন
এই যে গড়ানো জীবন এও ত এক প্রকার জীবনই বল !
বিমানের জানালাই ব'সে যারা শহরের পর শহর পার হয়ে
যায়
তারা আরো বড় জীবন দেখে ? বল,আরো আরো অনেক
তীব্র আরো
অনেক দ্রুত এক জীবন ?
হয়ত দেখে ! কিন্তু আমাদের এই স্তব্ধ জীবন কেঁচো
কেন্নোর সঙ্গে কাদায় মাখানো জীবন তারা দেখে কি
বল ?
বল এও ত একপ্রকার জীবনই তাই না ?...
... একী, এতো ভূদেব দার কবিতা ! বাঁকুড়ার কবি ভূদেব কর আমার গদ্যে উঠে
আসছেন কেন
? এতো
প্রায় ভর করেছেন দেখছি । আর আপনিই বা এসব কবিতা লিখছেন কেন মশাই, আপনার তো
সাতমহলা বাড়ি, পুষ্পক রথ সবই বিদ্যমান ! তবুও আপনার এই কবিতায় ঈশ্বরের
স্পর্শছিল কেন...! ?
শুনেছি
একজন
মানুষ ছিলেন । কোন
এক ঠাকুরপুকুরে ছিল তার বাড়ি । তিনি ছিলেন গণিতজ্ঞ তাঁর মস্তিষ্ক নির্মিত গণিত সূত্র গুণী
মহলে একদা ছিল আলোড়নের বিষয় । ছাত্রাবস্থায় এক প্রখ্যাত
প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর প্রথম । তথাপি
শেষাবধি কি হ'ল
! তবু সে দেখিল কোন ভূত ! ঐশ্বর্য বৈভব থেকে বহুদূরে কেটে গেল দীর্ঘ জীবন । তিনি বৃদ্ধ
হলেন । তাঁর
চশমা ভেঙে গেল । তিনি
অন্ধকার হাতড়াতে লাগলেন । তিনি পুনরায় অন্ধকারের স্তর নির্মাণ করলেন, জীবনভর'র । ফিরে এসো
চাকায় তিনি ঈশ্বরীর বিকল্প নির্মাণ করেছিলেন একদা, তবু, হায় হাসি হায় দেবদারু, মানুষ নিকটে
গেলে প্রকৃত
সারস উড়েযায়...
৫.
আসলে গম্ভীর কথা ত কিছু
নেই । গাম্ভীর্যের
ভান কিছু আছে । সবই
কথার কথা ।
কলমের
মুখে ঈশ্বর
এসে বসলেন ডানা মুড়ে, আঙুলেরও ঈশ্বর দর্শন হল তৎক্ষণাৎ,এইবার
মস্তিষ্কে
বিদ্যুৎ খেলে যাবে অহরহ,-- এই ত হয় । কবিতা আরো অনেক অনেক ভাবে রচিত হয় । যেমন একবার
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের লেন্সের উপর ঈশ্বর এসে বসেছিলেন অবাক বিস্ময়ে
। বুদ্ধদেবের
খেয়াল ছিলনা । তখন
চরাচর জুড়ে সশব্দ হাহাকারের মতো ভেঙে ভেঙে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ । ওয়াইড্ লেন্স
জুড়ে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি । একটি শিশু, বিন্দুবৎ,
জলের
ধারে বসে বালি খুঁড়ছে ---
--- 'কী করছিস রে বুধা আ আ আ...' দীর্ঘ প্লুতস্বর অনুরণন বাজিয়ে
চলে।
--- 'পাখি পুঁতছি বাবা , পাখি পুঁতলে পাখি গাছ হয়...'
...ঈশ্বর দেখলেন বাংলাভাষার এক অভিনব সেলুলয়েড পোয়েট্রি ...।
৬.
এই যে সূর্য আর পৃথিবী,এই যে অলৌকিক ঔজ্বল্যময় আলোর উৎস আর
পরিদৃশ্যমান জগত,এরমাঝে কোটি
কোটি মাইল খাঁ খাঁ শূন্যতা । এর ত একটা নাম প্রয়োজন,এই শূন্যতারও একটা নামের অধিকারী
হতে হয়।আর অলস,
নিষ্কর্মা,
প্রতিশ্রুতি-হীন
পৃথিবীর
মানুষেরা তার নাম নিয়ে ভাবিত হয় । সেই শূন্যতার নামকরণে চিন্তিত হয়।
এই যে আলো আর জীবনের সংযোগকারী শূন্যতা ! একে
যদি কবিতা বলি ???
.
(২০১০ এর শীতকালে লেখা। ছোটো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
Bhalo laglo
উত্তরমুছুনদারুন ! আগাগোড়াই দারুন ! শুধু 'ফিরে এসো চাকা'-র অংশটা সামান্য আরোপিত লাগল । সামান্য ...
উত্তরমুছুনপুরোটাই আরোপিত রে ভাই। বানিয়ে বানিয়ে লিখি তো :)
মুছুন