ভাবনার সমানাধিকার ও পর্নোগ্রাফী
কৌশিক বাজারী
...সেটা নয়ের
দশকের প্রথম দিক।
তখন বোধহয় আমার একাদশ শ্রেণী। গ্রাম মফস্বলের পাড়া মহল্লাগুলি তখন ভরে উঠছে ভিডিও
পার্লারে। কোথাও ত্রিপল খাঁচিয়ে, কোথাও বড় একটা হলঘরের ভেতরে চলছে রমরম করে ‘ভিডিও শো’। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো সিনেমা তখন
চলে আসছে আমাদের এই ছোট্ট শহরে। মাত্র দুটাকার বিনিময়ে মিঠুন-শ্রীদেবীর
ঝুমতারারারা । আর দুপুরবেলা ইংরেজী সিনেমা! হলিউডি ইংরেজী সিনেমার প্রতি একটা
চোরাটান ছোটবেলা থেকেই। ‘আলাদীন’, ‘বর্ন ফ্রি’ এসব তো দেখেছি চ্যারিটি শো-এ। একদিন
দুপুরের শো-তে ঢুকে পড়েছিলাম সেইরকম একটা ভিডিও পার্লারে। একটা রদ্দি ইংরেজি
সিনেমা প্রায় দেড় ঘণ্টা দেখে উঠে আসতে যাচ্ছি, একজন পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল। আরে
এটা শেষ হলে তাপ্পর তো আসল সিনিমা। বসে যা । মিনিট খানেকের ভিতর শুরু হল সেই ‘আসল সিনিমা’! না, উঠে আসতে পারিনি। তখন আমার বয়স সতেরো
বৎসর। সেইদিনের ঘটনা আজো হুবহু মনে আছে এতদিন পরেও। সেই বিবমিষা, সেই কাঠ হয়ে
যাওয়া শরীর, সেই উত্থিত ও মৃত সাপের মতো ঠাণ্ডা লিঙ্গ... তারপর সারাদিন বাড়ি ঢুকতে
না পারা। গা বমি বমি ভাব। রাত্তিরে এক প্রকাণ্ড অপরাধ-বোধ ভেতরে নিয়ে মাথানিচু করে
বড়ি ফেরা, রাতের খাবার খেতে না পারা আজো ভুলিনি। মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে
পারিনি তিনদিন। এসব হয়তো অতি-মধ্যবিত্ত প্রতিবেশে বেড়ে ওঠা আমার সেই বয়সের
মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। এখন সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। সময় নিজেই অনেক সপ্রতিভ
এখন!
সেইসময় ভেসে যেতে যেতে একটা হাত যদি আমায় ধরে না ফেলত কি হ’ত আমি জানি না। বাসুকীদার হাত। সদ্য
কলাভবন থেকে ফিরে আসা বাসুকি দাশগুপ্ত। আমরা বলি বাস্কাদা। তার কাছে প্রথম দেখলাম
বার্থ অফ ভেনাসের সেই চিরকালীন নগ্নতা। মদিগ্লইয়ানির সেই নগ্ন শায়িত নারী। দেখলাম
প্রচুর প্রচুর প্রিন্ট, খাজুরাহো তার নির্মান আর হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলা এক
ভারতবর্ষ! আমার ঠাণ্ডা ও মৃত লিঙ্গ পুনরুজ্জীবিত হল অতি ধীরে। বানিজ্যমূল্য থেকে
বহুদূরের সেই নগ্নতার ঐশ্বর্য্য আমাকে পুনর্জীবন দিল বোধহয়।
পর্নোগ্রাফী কী বস্তু? দেখেছিস কখনো?
বাসুকিদার এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকলাম। তিনি বোধহয় প্রথম এত খোলামেলা আলোচনা করলেন
বিষয়টা আমাদের সাথে। আমার সাথে হয়তো আরো
কেউ কেউ ছিল বন্ধুরা । তিনি দেখালেন যে পর্নোগ্রাফী কোনো
শিল্প তো নয়ই বরং অতি-অশৈলী, শিল্প তথা জীবনের উল্টো একটা একটা ব্যাপার। এর সাথে বার্থ অফ
ভেনাসের নগ্নতার তুলনা হয় না। তুলনা হয় না
খাজুরাহোর যৌবন উৎসবেরও
।
এখন এই বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কথাটা গণ-হিস্টিরিয়ার
মধ্যেও জোর গলায় বলা দরকার। না হলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা মিথ্যে হয়ে
যায়। মায়ের সঙ্গে সন্তানকে ,
বাপের সঙ্গে মেয়েকে
শুয়িয়ে দেওয়া কোনো শিল্প নয়। চাইল্ড পর্নোগ্রাফী
(দেখিনি কখনো, ভাবতেও
পারিনা) তো নরকের অধম । আরো আছে, এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম—
নর-নারীর দেহ-ভোগের সম্ভব অসম্ভব সমস্ত বিকৃতির চুড়াগুলি পেরিয়ে মানুষ যখন ক্লান্ত,
তখন তার সামনে নাকি এসে গেছে ‘ক্যানিবালিজম’। শেকলে বাঁধা জ্যান্ত নারীমাংস
ভক্ষণের এ্যনিমেটেড পর্নোগ্রাফী! এবার তাহোলে কোথায় দাঁড়াব হে বন্ধুগন! তো
এসবও কিন্তু আমেরিকার তৈরি ! অনেকেই বলছেন—ভাই, সবকিছুর মধ্যে বামপন্থীদের
মতো আমেরিকান ভুত দেখার কোনো অর্থ হয় না। না,
আমি যদিও কোনো প্রথাগত বামপন্থী রাজনীতিতে শিক্ষিত নয় সেভাবে, তবু বলতে
বাধা নেই, এ শুধু আমেরিকা-প্রসূত বানিজ্যনীতির ভুত নয়, বরং নিখাদ বর্তমান এবং সুদূর
প্রসারিত ভবিষ্যতও। কারণ পর্নোগ্রাফী যদিও আমেরিকার সাথে সাথে ব্রাজিল, লাতিন
আমেরিকার দেশগুলি সহ এশিয়া এমনকি ভারত ও এই পোড়া বাংলাতেও নির্মিত হয়ে চলেছে তবু বলব এই অ-শৈলী একান্ত ইতিহাসহীন
তথা সংস্কৃতিহীন সেই আমেরিকা প্রসূতই। যাদের বানিজ্যনীতি সমগ্র বিশ্বজুড়ে এক
পোষাক, এক খাদ্য, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, একরকম বানিজ্যিক-যৌনতার এক অদ্ভূত কিমাকার
ঐক্যের প্রচারক।
যদিও আদিকাল থেকেই সব দেশেই আদিরসের চাহিদা
ছিল জনমানসে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য যোগানও ছিল সকল স্থানেই, সেই সকল আদিরসের
ভাণ্ডার ইতিহাস খুঁজলে পাওয়াও যায় এখনো। তবু তা এই আজকের লাস-ভেগাস অধ্যুষিত
পর্নগ্রাফীর থেকে বহুলাংশে ভিন্ন। ‘বটতলার সাহিত্য’
অভিধাটি আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। অপরিচিত নয় আমাদের দেশীয় সাহিত্যগুলি। তার ভেতরে
নর-নারীর শরীর মিলন, কাম ও শরীরী বর্ণনা অপ্রতুল নয়। তৎকালীন পট শিল্পেও অপ্রতুল
নয় শরীর-মিলনের চিত্র, তবু এইসবের ভেতরে রসবোধ মরে যায় নি কখনো। প্রেম মরে যায় নি
কখনো। প্রেম ও প্রেম-প্রসূত কামই ছিল সেইসবের ধাত্রী। তা
সে প্রেম যত প্রাকৃতই হোক। এখন যা আর কোথাও নেই। লাস-ভেগাস এসে সব প্রেম নিয়ে গেছে।
নারীকেও...।
এসব
তাহলে আগ্রাসন নয়? তাহলে
আফিমের বিরুদ্ধে চৈনিক বিল্পব সেও তো ভুল প্রমাণিত হবে? তার পরেও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার
নিজের ঘরে বসে পর্নগ্রাফী দেখবেন নাকি আর্টফিলিম দেখবেন সেটা তার একান্ত
ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। সেখানে কারো খবরদারী না থাকাই উচিৎ। কিন্তু
তৎসহ আরো কিছু কথা মাথায় রাখা উচিৎ আমাদেরো। যথা
আমাদের রুচি কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? ভারত সরকার নাকি মার্কিন বানিজ্যবাদ নাকি অতিগেরুয়া
শিক্ষা ?
নাকি হাজার বছর আমি
পথ হাঁটিতেছি ? আমরা জানিনা। আমরা
জানিনা ৬০% সরকারি ভাবে সাক্ষরের দেশে গন জাগরণ কিভাবে বা সম্ভব হবে? কতজনের হাতে আন্তর্জাল আছে জানিনা। তার
ব্যবহারকারী শিক্ষিতের হারে কত শতাংশের
মধ্যে পড়েন জানিনা। এই ৬০% এর মধ্যে কতজন নিজস্ব মত
প্রকাশের
স্বাধীনতার মানে
বোঝেন তাও জানিনা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষিত প্রগতিশীল
ফেসবুকার, যিনি পর্নো দেখার অধিকার সাংবিধানিক কিনা সে বিষয়ে তাঁর সুসংবদ্ধ চিন্তা
ভাবনা লিপিবদ্ধ করতে পারেন তাঁর সমৃদ্ধ ভাবনা দিয়ে, সেই একই অধিকারে বলবর্তী হয়ে
নির্ভয়া কাণ্ডের সেই বাস ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরেরাও কি একইরকম যুক্তি দেখানোর
ক্ষমতায় আসীন, আজো? এই ভারতবর্ষে ? আমরা যে অধিকারের জন্য লড়াই করছি, সেই একই
বস্তু আরেক জনকে লালসা, ধর্ষণ, হত্যা ও ফাঁসিকাঠের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো?—এই হল আমাদের ভারতীয় গণতন্ত্রের
কূটাভাস-জনিত ট্র্যাজেডি! ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন বাণিজ্যিক
ছবি নির্মাতাদের আর সমান্তরাল ছবি
নির্মাতাদের সমান সুযোগ দেওয়া হোক, আমি নিশ্চিত আমারা জিতে যাব। সেই
সমান সুযোগ আমরা পাইনি।‘ভারতীয় ছবিতে কি চুম্বন অনুমোদিত হওয়া
উচিৎ?’
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন – ‘চুম্বন এমন একটা বড় প্রশ্ন নয় যাকে নিয়ে
মাথা ঘামাতে হবে। ভারতীয় ঐতিহ্যের যে প্রকৃতি তাতে আমার মতে স্ক্রিনে চুম্বন দেখানো
উচিৎ নয়’।
হ্যাঁ, এই কথা বলেছিলেন শ্রী ঋত্বিক ঘটক মহাশয়। ‘চলচ্চিত্র ,মানুষ এবং আরো কিছু’ দ্রষ্টব্য। । তিনি সম্ভবত অজন্তা ইলোরা
খাজুরাহো পরবর্তী হাজার বছরের পরে পরিবর্তিত সমাজবাস্তবতা মাথায় রেখেই কথাটি
বলেছিলেন। কথা হল সেই ‘ঐতিহ্য’! যা সমাজ নিরপেক্ষ নয়। লাস-ভেগাস
অনুমোদিত ‘ঐতিহ্য’ আর ভারতীয় সমাজ-বাস্তবতা এক নয় কখনোই। কিন্তু
তারপর আরো বহুদূর সময় পেরিয়ে গেছি। ভারতীয় সংস্কৃতির দ্রুত বদল ঘটেছে। চুম্বন এখন
অচ্ছুৎ নয়। এবং বর্তমানে এই ‘চুম্বন’ নর-নারীর প্রেমেরই প্রতীক। কিন্তু
প্রেমহীনতা কোনো দেশেই কোনো কালেই বাঞ্ছনীয় হতে পারেনা। চুম্বন এসেছে কিন্তু বাণিজ্যিক
ও সমান্তরাল ছবি নির্মাতাদের মূলধনগত সমানাধিকার আসেনি। হাতে রইলো পর্নোগ্রাফী। তখন
কিন্তু বাণিজ্যিক সিনেমাও এত পর্নোগ্রাফীক হয়ে ওঠেনি।
যাই হোক সেই পর্নোগ্রাফী ব্যান করা হল, এটাও রাজনীতি, আবার শুনছি তুলে নেওয়া হবে,
তাও রাজনীতি। ভাবনার সমান অধিকার কবে পাবো? ভাবনার সমান অধিকারের কথা ভাবাও কি হয়েছে কখনো?
.
(রচনাটি বাংলা সংবাদপত্র ‘এই সময়’এর কোনো এক রবিবারে প্রকাশিত)
*
কৌশিক বাজারী
মাড়ুই বাজার/বিষ্ণুপুর/বাঁকুড়া/৭২২১২২
ফোন—৯৪৭৫৬৮৩৫৫৬
Email—koushik.bazari@rediffmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন