শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৬

ভিক্ষাপাত্র খানি এবং... (তিনটি টুকরোগদ্য)





ভিক্ষাপাত্র খানি এবং...

কৌশিক বাজারী

ধ্যান থেকে ঝাণ। ঝাণ থেকে ঝেন। ঝেন থেকে জেন। জেন প্রাচীন ভারত থেকে চীনে জাপানে গিয়েছে। জেন যোগসাধনা বৌদ্ধধর্ম থেকে এসেছে। মতবাদ শেষ পর্যন্ত সব তত্ব মনন পার হয়ে যায়, সত্য বোধ আর বোধিদৃষ্টির কথা বলে। হঠাৎ জাগিয়ে তোলা এর লক্ষ্য। যদি কোনো জেন সাধককে প্রশ্ন করা হয় জেন কী, তার উত্তরে তিনি হয়তো চুপ রে থাকবেন। এই মৌনই জেন বুদ্ধ একবার ধর্মদেশনার সময় শ্রাবকদের কিছু না লে সদ্য উপহার পাওয়া একটা ফুলের তোড়া সামনে উঁচুতে তুলে ধরে ছিলেন : শুধু এই ছিল তাঁর সেবারের উপদেশ।
(ভূমিকা: জেন গল্প, জেন কবিতা/বীতশোক ভট্টাচার্য)



. ভিক্ষাপাত্র খানি
   অনাথ পিণ্ডদ সূতা কে সে? তার নাম মনে পড়ছে না অথচ তার নামটা এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন। এই সময়, এই কাল তাকে চায়। আমি তাকে কতদিন ধরে ডাকছি। অথচ নাম মনে পড়ছে না। কি নামে ডাকব তাকে ? আপনাদেরও মনে পড়ছে কি কারো ? যদি না মনে পড়ছে, তাও তাকে ডাকুন, সকলে-মিলে ডাকলে ঈশ্বর পর্যন্ত নড়ে উঠেন শুনেছি। আর তিনি, অনাথপিণ্ডদের কন্যা, তিনি তো ভিখিরির কন্যা ভিখিরি মাত্র অন্তত আজ, এই ভুলসময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ভ্রান্ত বোধ এছাড়া আর অন্য কিছুই ভাবতে পারে না। অথচ একমাত্র তিনিই উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একা। যখন অমিতাভ অবলোকিতেশ্বরের পদ্ম-পাপড়ির মতো আঁখিদ্বয় অশ্রুভারানত। যখন নগরের সকল শ্রেষ্ঠী, বণিক, রাজন্যবর্গ সকলেই লজ্জাবনত। তখন।

   দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে, জাগিয়া উঠিল হাহারবে, বুদ্ধ নিজ ভক্তগনে, শুধালেন জনে জনে, তোমরা লইবে বলো কে-বা, ক্ষুধিতের অন্নদান সেবা। তখন সমস্ত নগরীর অভিজাতবর্গ অধোবদন রইলেন। এই সুবিশাল শ্রাবস্তী নগরীর পথ আজ শবদেহের শয্যা, আর পথের পাশে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের হাহাকারমিছিল। ক্ষরা অজন্মায় রিক্ত মানুষের দল এসে দখল করেছে ব্যস্ত রাজপথ। তারা মরছে। আর সচ্ছল শহুরে মানুষ বুদ্ধের দিকে চেয়ে আছে। নগরের অভিজাতদের ঘরে রয়েছে পর্যাপ্ত অন্নের যোগান। তবু কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সেই আগ্রাসী দুর্ভিক্ষের গ্রাস রোধ করা সম্ভব না। সকলেই প্রায় আপন আপন অপারগতার কথা জানিয়েছেন বুদ্ধকে। তাই সকলেই অধোবদন।  দেখে বুদ্ধ স্বয়ং লজ্জিত, ব্যথিত সেই সভায় একেবারে পিছনের দিকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন চীর বাস পরা, মলিন, অশ্রুময়ী এক নারী, শীতবায়ু ঝরঝর শব্দে হলুদ পাতার রাশি উড়িয়ে নিয়ে গেল। বুদ্ধ নিজেও বুঝি আজ শীতার্ত, তিনি সেই নারীর দিকে চাইলেন তার হাতে ভিক্ষাপাত্র। তিনি ভিখারি অনাদপিণ্ডদের কন্যা। বুদ্ধের শিষ্যা। তিনি বললেনহে অমিতাভ, যদি আশীর্বাদ করেন তাহলে আমি এই গুরুভার নিজ দায়িত্বে বহন করতে পারি। আমাকে আদেশ করুন। এতক্ষণে, বোধিপ্রাপ্ত বুদ্ধের যেন বা দ্বিতীয় বার বোধিলাভ হল। তিনি করুন নয়নে একবার শ্রাবস্তীর শবদেহাকীর্ণ পথ, আর একবার সেই ভিখারিনীর ভিক্ষাপাত্রটির দিকে চাইলেন। তার মুখে ফুটে উঠল করুণ স্মিতহাস্য।
    অন্যদিকে, সকলে, শ্রেষ্ঠী আর বনিককুল বিস্ময়ে হতবাক। কি বলছো তুমি?  এতো গূঢ় গুরু-ভার, সমস্ত নগরীর মানুষের অন্নভার তুমি মেটাবে কি ভাবে হে ভিখারিনী
   তখন সেই মেয়েটি বলেছিলআমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে, তোমরা চাহিলে সবে, পাত্র অক্ষয় হবে, ভিক্ষা অন্নে মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।এই বলে সে তুলে ধরে ছিল তার ভিক্ষাপাত্র খানি।
   আমি তাকে খুঁজছি তাকে বড় প্রয়োজন। তার বোধি, তার ভিক্ষাপাত্রখানি বড় প্রয়োজন।



. পথ চলা...

   সিন্ধু সভ্যতামিশরীয় সভ্যতাচৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি সভ্যতাগুলোর কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস বই- পড়ে আসছি। এই সভ্যতাশব্দটির প্রকৃত অর্থ কি ? কোনো দিন কোনো মাস্টার মশাই ইশকুলের দিনগুলোতে ভাল করে বুঝিয়ে দেননি। আমরাও যা বুঝেছিলাম পুস্তকাকারে এই এক একটি অধ্যায়ের নাম সভ্যতা পরে যখন বিদ্যালয়ের ছাদ খুলে গেল, দেয়াল ভেঙে গেল, তখন সেখানে এসে দাঁড়ালেন অন্য সব মাস্টার মশায়েরা। তারা সবাই নানা কথা বলে গেলেন। বুদ্ধ, চৈতন্য, রবীন্দ্রনাথ হয়ে জীবনানন্দ, বিনয়  আরো কত নাম না জানা মানুষ, পথে ঘাটে মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকায় শিখিয়ে গেল অনেক কথা। ধীরে ধীরে একথা বোঝা গেল—‘সভ্যতাপ্রকৃত পক্ষে পথ চলা। পা ফেলা মানুষ তার আগের অবস্থান থেকে এক পা আরো সামনে এসে দাঁড়ালো। তার পুরানো অভ্যাস, পুরানো আবাস, পুরানো জীবনযাত্রা, আচার, এবং পুরানো পোশাক ছেড়ে সর্বোপরি নতুন প্রেমে ভালবাসায় সামনে এসে দাঁড়ালো।
   এইভাবে ক্রমশ এগিয়েছি হয়তো আমরা। আগুন-তামা-ব্রোঞ্জ-লোহা হয়ে ক্রমে মোবাইলফোন নামক এক ক্ষুদ্র দৈত্যের বশ হয়েও তো বেশ আছি প্রেমে অপ্রেমেও ভালো আছি আর সকলের অগোচরে, আশ্চর্যজনকভাবে, ভয়ঙ্করভাবে আমরা পিছনে বয়ে নিয়ে এসেছি আমাদের বিস্মরণ! বয়ে নিয়ে এসেছি প্রচীন জিঘাংসা, রণকৌশল, অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার মতো প্রিয় সাধ আর অস্ত্রের তীক্ষ্ণতার মতো ফালা ফালা অন্ধকার প্রকোষ্ঠগুলো। কিছু মানুষ প্রেম ভালবাসার কথা বলে বলে এগিয়েছে, আত্মকেন্দ্রিকতার থেকে তারা জগতসভার দিকে নিয়ে গেছে মানুষকে, আর সাথে সাথে তারি পিছনে, অন্ধকারে বুকে হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে চোরাগোপ্তা চলতে চলতে  আজ সেও এসে দাঁড়িয়েছে সে আদিম। যার থেকে উত্তরণের নাম সভ্যতা সে এসে দাঁড়িয়েছে সভ্যতার সামনে মাথা উঁচু করে। অপ্রস্তুত সভ্যতাকি লজ্জা পাচ্ছে? মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে তার? এবার কি সে জায়গা বদল করবে? লুকিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অন্ধকারে সমাজের অলক্ষ্যে এগোতে হবে তাকে? আর সমাজ ? সেই বা কার সাথে যাবে ? সমাজএই ব্যক্তিটি যেহেতু সংখ্যা গরিষ্ঠের সাথে সর্বদায় থাকতে পছন্দ করে, সে থাকবে মুক্ত দিনের আলোতেই অন্ধকারের সাথে। আর সমাজ বিচ্যুত সভ্যতাকে বেছে নিতে হবে অন্ধকার!এরকম হয়। যুগের বাঁকে বাঁকে, কখনো কখনো। তখন দাউদাউ জ্বলতে থাকে বৌদ্ধস্তুপ, শাস্ত্র-রাশি তখন সন্তান সন্ততি সহ ক্রুশবিদ্ধ মানুষের হত্যাদৃশ্য উপভোগ করে মানুষ। লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের নগরীকে মুহূর্তে নিক্ষেপ করা হয় অগ্নিকুণ্ডের ভিতর। আর মাতৃগর্ভ থেকে ছিঁড়ে আনা ভ্রূণ অবাক বিস্ময়ে দেখে শিশুদের হত্যা-দৃশ, পৃথিবীর পথে আর মাতাকে গমন করে অয়দিপাউস।



. বোধোদয় কথামালা
   তুমি যে-ভাবে বলছসে তো একটা পথ, ঠিকই তবে সত্যি বলতে কি, পথে বড় বেশী কথা বলা হয়ে গেছে।  তার কথা এত বেশী না বললেও হতো। এইবার এটা বাদ দেওয়া দরকার রস নাই নিংড়ে আর। চোখের মণির ভেতরে আমূল বসে যাচ্ছে ফিনফিনে ব্লেড বাদ দাও সব ছবি।

   বরং আমাদের বাড়ি আজ তোমার নেমন্তন্ন। ছবি দেখাই এসো। মায়ের নিজস্ব হাতে নিড়ানো উঠানে জবাগাছ। মনে পড়েজবাফুল লাল ? খড়ির আলপনা চলে গেছে উঠান পেরিয়ে ঘরের পিছনে সেই সবুজ পুকুর। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে এখানে দাঁড়ালে বারো বছর আগের খুকুদির কথা কথা পড়ে।একদিন নির্জন দুপুরে সে ঠিক উঠে আসবে জল থেকে। তার গায়ের ঝরা জলে ভিজে যাবে পথ।
  সেই পথ।
  ভালো না ?
ভালো বা মন্দ কিছু নয়। এটাই পথ...
   আরো অনেক রকমের পথ আছেতবু কেউ কেউ আলো লিখতে বারবার অন্ধকার লিখে ফেলে। অপার অন্ধকারের ভেতরেও একপ্রকার পথ থাকে। সেখানে আলো বাঁকা হয়ে পড়ে। আমাদের মনুষ্য-চোখ তার সন্ধান পায় না।
   একদিন এরকম একটা বাঁকা আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছিলো খুকুদিদের টিনের বাড়ির দোতলার মাটির কোঠায়। সেখানে সে তখন এক-পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে আপাদ মস্তক। শীত-ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছিল। আর খুকুদির এক সুদূরের কাকা অন্ধকারের বাঁকা আলোয় সেই ঘাম গ্রীষ্মের কাকের মতো খেয়ে ফেলছিল নি:শেষে। সেই দৃশ্য আমি দেখিনি কখনো, তবে হুবহু তা জানি ...
   সেইথেকে খুকুদি আর আমার সঙ্গে খেলে না। কখনো দেখি পুকুরের পাড়ে ঝুপসি বাঁশঝাড়ের নিচে একা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমি কাছে গেলে বলে-- চলে যা। কাছে আসবি না।
--কি হয়েছে তোর খুকুদি ?
-- আমি স্নান করিনি অনেক দিন।
--তো করে নে পুকুরে নেমে...
--না। ওখানে হবে না...
--তাহলে ?
   খুকুদি চুপ করে থাকে। তার চোখের কাজলের নিচে  কিসের কালো দাগ? গভীর হয়ে আছে? তার বাদামী চোখ হলুদ হয়ে আছে কেন? আমি বলিআয় আমাদের বাড়ি, খেলবি ? খুকুদি হঠাৎ আমায় হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। আমার বছর বারোর মাথা হাতে নিয়ে চোখ-বন্ধ আদর করে খুকুদি। সেই আদরের ভেতর একটা নি:শেষ চলে যাওয়া ছিল। যা শিশুরাই বুঝতে পারে। হয়তো আমিও বুঝতে পেরে ছিলাম। আমি খুকুদির মুখের দিকে চেয়ে বলিচলে যাবি?
--হ্যাঁ...
--আর খেলতে আসবি না?
--না।
   তারপর যেদিন সেই বাঁকা অন্ধকার আলো খুকুদির শরীরের ভিতরে নড়ে উঠলো, সেদিন খুকুদি আবার সেই টিনের দোতলা মাটির ঘরের কোঠায় উঠে গিয়েছিল। যেখানে সে পড়া মুখস্ত করত ইস্কুলের। একা। আর নেমে আসেনি কখনো।
সে দিন আমরা সবাই খেতে বসেছি বারান্দায়। মা ভাত বেড়ে দিয়ে উঠে গেছে। উঠোন খুঁটছে চড়াই।
সেদিন বাবা খাবার আসরে কোনো প্রথাগত গল্প বলেনি...
মা- খুব গম্ভীর, আমায় আর দু-মুঠো বেশী ভাত খেতে বলেনি সেদিন....
আকাশে কলাইকুণ্ডার দুটো বিমান অকস্মাৎ উত্তরের দিকে উড়ে গিয়েছিল নিয়মিত...
আর সেদিন আমি খুব ভালো ছেলে, কেউ কেন জানি সারাদিন বকে নি  আমায়...
     খুকুদিদের টিনের চালের কোঠা থেকে দেখা যায় আমাদের পিছনের এই পুকুরঘাট।  ...আজ সেই বাঁকা আলোর, সন্ধান না-জানা, না-আলোর পথ ধরে আমি এসে পড়েছি আমাদের পুকুরের ঘাটে। খুকুদি উঠে আসছে আমার সেই বালকবেলার ভেতর। তার সারা গা থেকে জল ঝরছে, তিরিশ বছর ধরে জমে থাকা জল, ঝরছে। এই অতীত দৃশ্য যদি মিথ্যা হয়, তবে আমার ছেলেবেলা মিথ্যা। কোন গর্ভ থেকে, শরীরের কোন অন্তঃস্থল থেকে, কোন বোধহীন জগত থেকে এই দৃশ্য উঠে আসছে ? আমি জানিনা।
  



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন