[এই রচনাটি ২০১১সালে এই রাজ্য তথা পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পট বদলের সময়ে লেখা। সেই সময়ের সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর বিষয় হলেও মূল বিষয়টি আরো ভেতরের এক ধ্বংসকাল। ওই সময় 'একক মাত্রা' নামক একটি সাময়িক পত্রে মুক্তগদ্য বিভাগে রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল।]
“নিয়নসভ্যতা
অথবা
একটি
চাষাড়ে
গপ্পো”
‘...নিয়ন আলোয় পণ্য হল যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’
একটি ব্যক্তিগত গদ্য রচনার অভিপ্রায়ে শূন্য কাগজের সম্মুখীন হওয়া মাত্র উপরোক্ত কাব্য খণ্ডটি ভীষণ শেলের মতো আছড়ে পড়ল যেন এই পৃষ্ঠার উপর। শ্রী শঙ্খ ঘোষ বহু পূর্বেই
যা
অত্যন্ত
বিষাদের
সঙ্গে
বলেছিলেন
আমাদের। বোঝা যায়, বৈশ্যতন্ত্র তখনই কতখানি প্রকট
হয়ে
উঠতে
শুরু
করেছিল। এবং তার পরেও বহু ব্যক্তিগত গান, ব্যক্তিগত প্রেম ও বিষাদ নানা ভাবেই রূপময় হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতির উঠোনে। মনে আছে জয় গোস্বামী
যখন
একবার
চূড়ান্ত
বিষাদাক্রান্ত
হয়ে
লিখলেন-‘...সাহস হয় না আর কবিতা
লেখার’
তখনও
একবার
স্তব্দ্ধ
হয়ে
গিয়েছিল
চরাচর,
বাতাস
প্রবাহ
মূহূর্ত
থমকে
গিয়েছিল,
আকাশ
অগ্নিময়
ও
আগুন
ম্রিয়মাণ হয়েছিল,
-আশাকরি,
পাঠকের
মনে
আছে
সে
প্রসঙ্গ। এগুলো হয়তো পরাধীনতার সমগ্রতা নয়, খণ্ডরূপ মাত্র। সমসময়ের
দুজন
প্রধান
কবির
দু’টি বিচ্ছিন্ন
কবিতার
লাইন
এখানে
অসংলগ্ন
ভাবে
ব্যবহৃত
হ’ল, আকস্মিক
ভাবেই। আপাত-অসংলগ্ন হলেও কোথাও বোধহয় একটা যোগসূত্র রয়ে গেছে। পরাধীনতার
যোগসূত্র। দ্বিতীয়টির প্রেক্ষিত খুব সোজাসুজি। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন অন্ধ জাতীয়তাবাদ সহ সাধারণের ওপর ভয়ঙ্কর
মৃত্যু
ও
অন্ধকার
সহ
নেমে
আসে,
বেঁচে
থাকাটাই
যখন
হাহাকারের
মতো,--কেউ কেউ তখন বিরুদ্ধ-বারুদ
সহ
বন্দুক
তুলে
নেন,
কেউ
রাস্তায়
নামেন,
আর
কবি
তখন
অশ্রু
লেখেন...হ্যাঁ,
যখন
বেঁচে
থাকাটাই
হাহাকারের
মতো...।
এই প্রসঙ্গে তাহলে একটা সিনেমার গল্প বলি। পাঠক, যাঁরা দেখেছেন সিনেমাটি, তাঁরা সেই ‘দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড্ পায়জামা’ ছবিটির শেষ দৃশ্যটি মনে করুন। যেখানে কাহিনীর নায়ক, ১২/১৩বছর বয়সের এক বিষণ্ণ বালক ব্রুনো । ব্রুনো । হিটলারের জল্লাদ বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের পুত্র সন্তান। স্বভাব-গম্ভীর পিতার সঙ্গে যার দেখা হয় কদাচিৎ, আরো দুর্লভ, বাবার আদর মাখা হাসিমুখ। বন্ধুহীন এক দুর্গের মতো বাড়ির ভেতরে প্রায় বন্দিদশা তার। যাদের সাথে দেখা হয়, বাবার ‘বন্ধু’রা, প্রত্যেকেই যন্ত্রবৎ। যন্ত্রবৎ হাসি ও হাসির মহড়া দর্শকের বিবমিষা জাগায়। বন্দি ব্রুনো বাইরের আলো খোঁজে। মেঝে থেকে অনেক-উঁচুতে, ঘরের মধ্যে এক ঘুলঘুলি পথে উঁকিমারে সে, দেখতে পায়, দূরে, জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটি বাড়ি ও বসতির আভাস, কিছু মানুষের অস্পষ্ট চলাচল আর মাঝে মাঝে ধূসর আকাশে পাকিয়ে ওঠা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। হ্যাঁ, বধ্যভূমি। যার আশ্রমিক নাম ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’! যার দায়িত্বে আছেন ব্রুনোর বাবা। ঘটনাচক্রে ব্রুনো এক বন্ধু পেয়ে যায়, যে ঐ বধ্যভূমির বাসিন্দা, তারি সমবয়সী এক হতভাগ্য ইহুদি বালক। বাড়ি থেকে লুকিয়ে বন্ধুর কাছে পালিয়ে বেড়ায় ব্রুনো। ক্যাম্পের কাঁটাতারের দুই দিগন্তে দুই ভিন্ন পৃথিবীর বালকের বন্ধুত্বের ছবি বলেই ভ্রমহয় প্রথমত। তারপর শিশুসুলভ কৌতূহলে ভর করে একদিন ব্রুনো বন্ধুর দেওয়া পোশাক( ইহুদি বন্দীদের জন্য বহুবার বহু ছবিতে দেখা সেই ‘দ্য স্টাইপড্ পায়জামা’) প’রে কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকে পড়ে সেই অজানা অন্ধ-ভূমিতে। অত:পর শেষ দৃশ্য। প্রায় সাদাকালোর কাছাকাছি, ধূসর নীলচে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দৃশ্যায়ন সমগ্র পর্দা-জুড়ে। যেখানে সুবিশাল এক অন্ধকার কক্ষের মধ্যে বৃদ্ধ আর শিশুদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে পোশাক খুলে ফেলতে। নগ্ন মানুষ গুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অন্যতর অন্ধকার গুহার দিকে... ... প্রচণ্ড গম্ভীর, বুকের দেয়াল ফাটানো শব্দে বন্ধ হ’য়ে যায় ভারী নিশ্ছিদ্র লোহার দরজা, ঠাণ্ডা লোহার অর্গল আড়াআড়ি উঠে আসে দরজার বুকে। নাৎসীপ্রহরী শেষবারের মতো আই-হোলে চোখ রেখে দেখে নেয়... ... দৃশ্য জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে, স্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত পর পুনরায় ধাতব-শীতল-ধূসর আধো-অন্ধকার আলোয় দেখা যায় পূর্বের সেই বিশাল কক্ষ, সারা ঘর জুড়ে নিস্তব্ধ নিশ্চুপ অসাড় পোশাক গুলি ঝুলছে... ‘দ্য স্ট্রাইপড্ পায়জামা’...।
হ্যাঁ। ‘... হিমালয় শিলা থেকে সাগর অবধি আমি ছুঁড়ে দিই ত্রাস/আমার কি আসে যায় বাঁচে কি বাঁচেনা ইতিহাস...।’ এ হোল সেই অকৃত্রিম স্বৈরশাসনের দম্ভ। যেখানে রুটির পরিবর্তে, ছুড়ে দেওয়া হয় ত্রাস, এবং এটাকেই একটা পদ্ধতি হিসাবে স্থাপন করা হয় দেশ জুড়ে-শাসনপদ্ধতি। সমগ্র বিশ্ব ইতিহাস জুড়ে বারে বারে এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আজও ঘটে। এবং আজ আরো অনেক সুচারু রূপে ঘটে। এতই সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ তার অবস্থান, যে তাকে, সেই দম্ভ ও ত্রাস, খালি চোখে দেখাও যায় না সব সময়, যদিও তা রয়েছেই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে, আরো গভীর ভাবে, জনসাধারণের মস্তিষ্কের ভেতরে শেকড়-প্রশাখা সহ গেঁথে যাচ্ছে তার অবস্থান। ভয় এখানেই। যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, যার সাথে লড়াই করা যায় না, এমনকি প্রতিবাদ অথবা আত্মরক্ষা পর্যন্ত অসম্ভব,-এটাই সিস্টেম। তাহলে, এখনতো আর একে স্বৈরতন্ত্র বলা যায় না। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষ লড়াই করেছে, এখনো শেষ হয়নি সেই লড়াই। চলছে। দেশে দেশে স্বৈর শাসন ভেঙে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন আর নেই। ভূতপূর্ব উপনিবেশ গুলি স্বশাসন পেয়েছিল... ... এখন আবার ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ল সেই সাধারণের শাসন, সবার চোখের অলক্ষ্যে এক কুটিল নিঃশব্দ অট্টহাস্যের মতো করাল গ্রাসে চলে গেল গণ-স্বাধীনতা। মগজও ভাবনার অধিকার, প্রায় সকলের অজ্ঞাতেই চলে গেল এক অভিনব শাসন পদ্ধতির অধীনে। স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী, অনেক বেশী সূক্ষ্ম এবং ভয়ঙ্কর এই পদ্ধতির কোনো নামকরণ হয়নি এখনো। আমরা একে বলব-‘বৈশ্যতন্ত্র’। (যদি ছাপার ভুলে ‘বেশ্যাতন্ত্র’ ছাপা হয়, তথাপি, হাজার কুর্নিশ জানাব ছাপাখানার ভূত কে) যা এখন এই নতুন সহস্রাব্দে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সর্বজনসম্মতিক্রমে। কারণ এই ব্যবস্থায় কাউকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় না, পেটের ভ্রূণ ত্রিশূলে গেঁথে উল্লাস হয় না, বীজিতের মুণ্ডু নিয়ে মিছিলের প্রশ্নই নেই এখানে,-সুতরাং কোন কবি ইতিহাস বাঁচা না বাঁচার প্রশ্ন গিলে ফেলতে বাধ্য হন, কোন কবি ‘সাহস হয় না আর কবিতা লেখার’- এই কথা বলার প্রাসঙ্গিকতাও হারিয়ে ফেলেন, অথবা অশ্রু নিঃশব্দ হয়ে যায়, বাধ্যত।– এই তন্ত্রের মূলে যা আছে তা মগজকে অধিকার করে রাখার কৌশল ও প্রযুক্তি। যে কৌশল বলে-‘জগত নয় পৃথিবী’, ‘আনন্দ-শান্তি’ নয় ‘সুখ’, ‘শাকান্ন’ নয় ‘মহাভোজ’, ত্যাগের আনন্দ হাস্যকর প্রতিপন্ন হয়ে গেছে বহুপূর্বেই, জীবন ও চর্যার মূলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোগ, স্বাধীনতার আনন্দ নয় বরং আরামের অধীনতাই শ্রেয়, “কথার কাজ’না হয় পরে হবে এখন কাজের কথাটা হয়ে যাক’। জগতে আনন্দযজ্ঞে আমাদের নিমন্ত্রণ তাই আজ মিছে। এ হোল নিয়ন আলোর অন্ধকার। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সৃজন, মনন, প্রেম ও বিষাদের ভেতর বৈশ্যতন্ত্রের তীব্র তল্লাশি। এবং এ এমন এক ধাঁধাঁ, যেখানে সমগ্র বিশ্বের, সাম্যবাদী, গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমপন্থী প্রায় সকল রাজনৈতিক মতাবলম্বী শাসকবৃন্দ সকলেই প্রায় একমত এবং প্রত্যেকেই বৈশ্যতন্ত্রের পদলেহনকারী। সুতরাং একরকম নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, যে, আজ সারা পৃথিবীতে কোথাও, জনগণের বা সাধারণের শাসন নেই আর। আরো একটু পরিষ্কার করে ভাবলে দেখা যাবে, একসময় সমাজ, অর্থনীতি, ও সার্বিক লোক-শিক্ষার নিয়ন্ত্রা ছিল রাষ্ট্রনীতি। এখন স্বয়ং রাষ্ট্রনীতির নিয়ন্ত্রা এই বৈশ্যতন্ত্র। এইবার কথার সপক্ষে, সোজাসুজি, কিছু উদাহরণের দিকে চলে যাবো আমরা। পশ্চিমবঙ্গ নামক এই রাজ্যের আপামর সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীর( এঁরাই সেই সাধারণ ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’, যে অর্থে একদা শ্রী অশোক মিত্র মহাশয় তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় ‘আমি ভদ্রলোক নই’ বলে ফেলার জন্য এদের কাছেই বিস্তর গালি-গালাজ খেয়েছিলেন। এবং অবশই এই নিবন্ধ লেখক ও এই নিবন্ধের সম্ভাব্য সমগ্র পাঠক, নিশ্চিত ভাবেই ঐ ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’র, এবং একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, এর বাইরে কোনো একশ শতাংশ কৃষক, কোনো একশো শতাংশ শ্রমিক অথবা কোনো একশো শতাংশ প্রলেতারিয়েতের হাতে এই লেখা পৌঁছানোর সম্ভাবনা প্রায় একশো শতাংশ অনিশ্চিত। যদি পৌঁছে থাকেও কখনো, তাহলে ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষিতে তাঁর শ্রেণী অবস্থান সর্ম্পকে একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে না।)
এখন একটাই মহাভাবনাচক্র,- বৃহত্তর জনস্বার্থে(অর্থাৎ বৈশ্যতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কল্পে) অধিগৃহীত কৃষিজমি, যা একসময় সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয়েছিল, তার মধ্যে কিয়দংশ জমির(চারশো একর)মালিক নাকি জমি দানে অনিচ্ছুক ছিলেন। এখন পরিবর্তিত সরকার সেই ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিতে চান।ভাবনা এই, তাঁরা তা ফেরৎ পাবেন কি না? এ এক মহা অনিশ্চিতচক্রও বলা যায়। যদি পায়, তো, তারা কারা? আরো অনিশ্চিত, ঠিক কারা কারা ‘অনিচ্ছুক’, এবং কারাই বা ‘ইচ্ছুক’? এ এক মহান ধাঁধাঁ। বৈশ্যতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত এক ভারতীয় প্যারাডক্স। যারা ‘অনিচ্ছুক’ তাঁদের কথা না হয় বোধগম্য হোল। কিন্তু যারা ‘ইচ্ছুক’, তারা কারা? স্ব ইচ্ছায় চোদ্দপুরুষের ভিটে মাটি কারা ছেড়ে দিচ্ছে বৈশ্যকুলপতি শ্রেষ্ঠীর হাতে? তাঁদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, আদৌ স্বনিয়ন্ত্রিত কিনা ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল, এবং আছে। বলপ্রয়োগ, ভীতিপ্রদর্শন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা ছেড়ে দেওয়া যাক। তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়- যা মানুষের মগজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্যবাদী নেতা ও প্রশাসক-প্রধান বললেন,-‘চাষির সন্তান কি চিরদিন চাষিই থাকবে...?’ – এই বাক্যবন্ধের মধ্যে যুগপৎ দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছি আমরা। ১. চাষ অর্থাৎ কৃষিকাজ ততখানি সম্মানীয় জীবিকা নয়, আর্থিক ও সামাজিক কোন ভাবেই। এবং ২. বৈশ্যতন্ত্রের প্রতি সীমাহীন আস্থা ও অনুরাগ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিমের রামা কৈবর্তের শ্রেণী অবস্থান এতদিনেও কিছুই পাল্টায়নি। নাকি পাল্টেছে! রামা তার জমিখানি তুলে দিয়েছে শ্রেষ্ঠীর হাতে। শ্রেষ্ঠীর কারখানা-গৃহের দুয়ারে রামা আজ বন্দুক হাতে দারোয়ান, লাঙলের বদলে বারুদহীন বন্দুক, মন্দ কি! রামার টালির ঘরে রঙিন TV সেট, রামার ছেলে পিলে কেজি ইস্কুলে যায়, হ্যাট, ক্যাট বলতে শিখেছে, রামার বৌ চুলে দু টাকার শ্যাম্পু মাখে হপ্তায়। রামার ভাঙা পাতরে রাঙা ভাতের স্বাধীনতা হয়তো গিয়েছে কিন্তু আরামের অধীনতায় রামা গর্বিত। চাষির ছেলে চিরদিন চাষি থাকবে নাকি! উদাহরণ ২. সাম্যবাদী সরকার তার ভুলের মাসুল স্বরূপ সরে যেতে বাধ্য হ’ল। ক্ষমতায় এলেন, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী জননেত্রী। স্থান: ঐ পশ্চিমবঙ্গ। নেত্রীর কর্মকুশলতা সর্বজন বিদিত। তিনি বললেন প্রতিশ্রুতি মতো ‘জমি-দানে অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যা কিছু করনীয়, করা হ’ল। প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হোল সত্যই ‘অনিচ্ছুক’ ও ‘ইচ্ছুক’ কৃষকের সংখ্যা নিরূপিত কি হ’য়ে গেছে? ‘চারশো একরে’র হিসাব, সেতো বিগত সরকারের, সত্যই কোন মানুষ আছেন, যে স্বইচ্ছায় নিজের মাটি, যে মাটি সোনার বাড়া, সেই মাটি বাবুর হাতে তুলে দিতে সম্মত হবেন, শুধু এই কারণে যে তাহলে বাবুর বাগানখানি ‘প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা’? না, নেত্রী বলেছেন বাকী জমি ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ ব্যাবহার করা হবে, কোনো বণিক শিরোমণির হাতেই অর্পিত হবে, হ্যাঁ, ‘সাধারণের স্বার্থে শিল্প হবে’। অর্থাৎ, সেই বৈশ্যতন্ত্রের স্বার্থেই, আরো সুষ্ঠুভাবে প্রতিস্থাপনের লক্ষেই, ফিরিয়ে দেওয়া হবে ‘চারশো একর’।
বঙ্কিম বলেছিলেন, ‘এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞাসার আছে, কাহার এত মঙ্গল...’- হে পাঠক, এই ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে চিনতে পারছেন কি? এখন ‘মঙ্গল’ এই সুমধুর প্রাচীন বাংলা শব্দটির ব্যাবহার অস্তমিত, পরিবর্তে এই মঙ্গলেরই কিছু বিকৃত, বিকলাঙ্গ রূপ আমরা চিনি আজ, যথা- উন্নয়ন, যথা- ডেভেলপমেন্ট। বৈশ্যতন্ত্র ঐ ‘মঙ্গল’ শব্দটি ভুলিয়ে ছেড়েছে।
৩. কৃষক ও কৃষির প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ তৈরি করতে আমরা শিখিনি, উপরন্তু প্রয়োজনের কথাটুকুও ভুলেছি। তাছাড়া সামান্য চাষার কথা কে আর কবে ভেবেছে। হাঁটু অবধি ধুতি, খালি গা, কাঁধে লাঙল, খালি পা, ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে সানন্দ ভারতীয় কৃষিজীবীর এই কল্পদৃশ্য যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয়, আদতে বাস্তব আরো সুকঠিন। যা খালি চোখে দেখা যায় না, তা, ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে তার বুকের ঘুষ ঘুষে জ্বর, হাঁটু অবধি কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সরীসৃপ, হাত ও পা’য়ের আঙুলের ফাঁকে অমসৃণ ক্ষত, জীবাণু সংক্রমণ, আর্সেনিক, পার্থেনিয়াম...- এদের সাথে খালি হাতে লড়াই আজও অব্যাহত, এখনো, স্বাধীনতার এত বছর পরেও। ইংরেজ কে আমরা সর্বজনীন ভিলেন হিসেবে জানি বরাবর। তাদের বিদায় ষাটবছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তথাপি আমাদের দেশের কৃষকদের মাথায় এখনো একটি টোকা জুটল না কেন? শরীরে বৃষ্টি নিরোধক, হাঁটু অবধি জুতো? এসব ভাবনা কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? থাক তাহলে, বরং কিছু সদর্থক গল্প শোনা যাক।
বৈশ্যতন্ত্রের বিপরীত গল্প। বাকুঁড়া জেলার এক প্রত্যন্ত, জঙ্গলঘেরা, রুক্ষ গ্রাম পাঁচাল। চাষবাস এ অঞ্চলে বরাবরই সীমিত, বর্ষায় উপচে পড়া নদী আর গ্রীষ্মে খরায় পীড়িত গ্রাম। সেখানে দেবল দেব মহাশয় একটি বীজ-ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করলেন, সঙ্গে গবেষণাগার। দেবল বাবু দশ গাঁয়ের মানুষের সাথে মিশে গেলেন, তিনি মানুষকে দেখালেন ‘রাসায়নিক’ প্রয়োগ ছাড়াই জৈবসার মাত্র প্রয়োগে ফসল ফলানো যায়। কীটনাশকের পরিবর্তে তিনি দেখালেন, ফসলের ক্ষেতের মধ্যে পাখিদের বাসার বন্দোবস্ত প্রয়োজন, ক্ষতিকর পোকা-মাকড় পাখিরাই ভালো চেনে। তিনি দেখালেন অসংখ্য দেশীয় বীজধান,যার অধিকাংশ বর্তমানে লুপ্ত প্রায়। দেবল বাবুর সংগ্রহাগারে রয়েছে ‘যুগল’, ‘সতীন’, ‘অসিতকর্মা’,- সহ প্রচুর লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় দেশীয় বীজধান। ‘যুগল’- একটি ধানের ভেতর, অর্থাৎ ‘যুগল’ চাষ করলে প্রতিটি ধানের ভেতর পাওয়া যাবে দু’টি চালের আধার। ‘সতীন’ ধানটির ভেতর রয়েছে তিনটি চাল, মধ্যিখানে লম্বা বড় আকৃতির একটি চাল, আর তার দু’পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির দুটি চাল, যেন স্বামীর দুই পাশে দুই ‘সতীন’। অসিত কর্মকার নামের এক চাষির কাছে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এমন এক বীজের, যা বহু পূর্বেই লুপ্ত হ’য়ে গিয়েছিল বলে সকলের ধারনা। সেই ক্ষুদ্র সংগ্রহ থেকে দেবল দেব ধীরে ধীরে সেই বীজের চাষযোগ্য সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন। ঐ কৃষকের নাম অনুসারে সেই হারিয়ে যাওয়া ধানের নাম ‘অসিতকর্মা’। পাঁচাল গ্রামের নিকটে ‘বসুধা বিজ্ঞান বীথী’ এক প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ, যার প্রাণপুরুষ শ্রী দেবল দেব একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জীববিজ্ঞানী। এই কাজে আত্মনিয়োগের জন্যই কোন স্থায়ী ও লোভনীয়, মসৃণ জীবনের হাতছানি তথা, বহুজাতিক বৃহৎ সংস্থার চাকুরী গুলি তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এবং জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞান আলোচনা চক্রগুলিতে অংশগ্রহণ বাবদ যেটুকু উপার্জন হয় , তার প্রায় সমস্তটাই তিনি ব্যয় করেন এই কাজে । বর্তমানে উড়িষ্যার কোরাপুটে এই একই ধরণের এক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন এবং বর্তমানে অধিকাংশ সময় তিনি সেখানেই অতিবাহিত করছেন । মেনে নিতে অসুবিধে হলেও , বৈশ্যতন্ত্রের বিপরীতে এই একক প্রচেষ্টাগুলিই সম্ভবত পথ । লড়াই বললে সঠিক অনুধাবন সম্ভব নয়, বরং বলা ভাল, আপন কর্মের প্রতি ধ্যানস্থ মানুষ । সর্বক্ষেত্রেই রয়েছেন এমন মানুষগুলি, এবং এদের হাতেই চেতনার পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ আরো বহুদূর অগ্রসর হয়ে যাবে । এই রচনা এক বহু প্রচীন কবির রচিত একটি বাক্যাংশ দিয়ে শেষ করতে ইচ্ছে করছে ।
...ঈশ্বরের নির্জনতায় যেভাবেই হোক, যারা বারবার তোমাকে ফেরায়—
এই প্রসঙ্গে তাহলে একটা সিনেমার গল্প বলি। পাঠক, যাঁরা দেখেছেন সিনেমাটি, তাঁরা সেই ‘দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড্ পায়জামা’ ছবিটির শেষ দৃশ্যটি মনে করুন। যেখানে কাহিনীর নায়ক, ১২/১৩বছর বয়সের এক বিষণ্ণ বালক ব্রুনো । ব্রুনো । হিটলারের জল্লাদ বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের পুত্র সন্তান। স্বভাব-গম্ভীর পিতার সঙ্গে যার দেখা হয় কদাচিৎ, আরো দুর্লভ, বাবার আদর মাখা হাসিমুখ। বন্ধুহীন এক দুর্গের মতো বাড়ির ভেতরে প্রায় বন্দিদশা তার। যাদের সাথে দেখা হয়, বাবার ‘বন্ধু’রা, প্রত্যেকেই যন্ত্রবৎ। যন্ত্রবৎ হাসি ও হাসির মহড়া দর্শকের বিবমিষা জাগায়। বন্দি ব্রুনো বাইরের আলো খোঁজে। মেঝে থেকে অনেক-উঁচুতে, ঘরের মধ্যে এক ঘুলঘুলি পথে উঁকিমারে সে, দেখতে পায়, দূরে, জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটি বাড়ি ও বসতির আভাস, কিছু মানুষের অস্পষ্ট চলাচল আর মাঝে মাঝে ধূসর আকাশে পাকিয়ে ওঠা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। হ্যাঁ, বধ্যভূমি। যার আশ্রমিক নাম ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’! যার দায়িত্বে আছেন ব্রুনোর বাবা। ঘটনাচক্রে ব্রুনো এক বন্ধু পেয়ে যায়, যে ঐ বধ্যভূমির বাসিন্দা, তারি সমবয়সী এক হতভাগ্য ইহুদি বালক। বাড়ি থেকে লুকিয়ে বন্ধুর কাছে পালিয়ে বেড়ায় ব্রুনো। ক্যাম্পের কাঁটাতারের দুই দিগন্তে দুই ভিন্ন পৃথিবীর বালকের বন্ধুত্বের ছবি বলেই ভ্রমহয় প্রথমত। তারপর শিশুসুলভ কৌতূহলে ভর করে একদিন ব্রুনো বন্ধুর দেওয়া পোশাক( ইহুদি বন্দীদের জন্য বহুবার বহু ছবিতে দেখা সেই ‘দ্য স্টাইপড্ পায়জামা’) প’রে কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকে পড়ে সেই অজানা অন্ধ-ভূমিতে। অত:পর শেষ দৃশ্য। প্রায় সাদাকালোর কাছাকাছি, ধূসর নীলচে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দৃশ্যায়ন সমগ্র পর্দা-জুড়ে। যেখানে সুবিশাল এক অন্ধকার কক্ষের মধ্যে বৃদ্ধ আর শিশুদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে পোশাক খুলে ফেলতে। নগ্ন মানুষ গুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অন্যতর অন্ধকার গুহার দিকে... ... প্রচণ্ড গম্ভীর, বুকের দেয়াল ফাটানো শব্দে বন্ধ হ’য়ে যায় ভারী নিশ্ছিদ্র লোহার দরজা, ঠাণ্ডা লোহার অর্গল আড়াআড়ি উঠে আসে দরজার বুকে। নাৎসীপ্রহরী শেষবারের মতো আই-হোলে চোখ রেখে দেখে নেয়... ... দৃশ্য জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে, স্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত পর পুনরায় ধাতব-শীতল-ধূসর আধো-অন্ধকার আলোয় দেখা যায় পূর্বের সেই বিশাল কক্ষ, সারা ঘর জুড়ে নিস্তব্ধ নিশ্চুপ অসাড় পোশাক গুলি ঝুলছে... ‘দ্য স্ট্রাইপড্ পায়জামা’...।
হ্যাঁ। ‘... হিমালয় শিলা থেকে সাগর অবধি আমি ছুঁড়ে দিই ত্রাস/আমার কি আসে যায় বাঁচে কি বাঁচেনা ইতিহাস...।’ এ হোল সেই অকৃত্রিম স্বৈরশাসনের দম্ভ। যেখানে রুটির পরিবর্তে, ছুড়ে দেওয়া হয় ত্রাস, এবং এটাকেই একটা পদ্ধতি হিসাবে স্থাপন করা হয় দেশ জুড়ে-শাসনপদ্ধতি। সমগ্র বিশ্ব ইতিহাস জুড়ে বারে বারে এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আজও ঘটে। এবং আজ আরো অনেক সুচারু রূপে ঘটে। এতই সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ তার অবস্থান, যে তাকে, সেই দম্ভ ও ত্রাস, খালি চোখে দেখাও যায় না সব সময়, যদিও তা রয়েছেই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে, আরো গভীর ভাবে, জনসাধারণের মস্তিষ্কের ভেতরে শেকড়-প্রশাখা সহ গেঁথে যাচ্ছে তার অবস্থান। ভয় এখানেই। যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, যার সাথে লড়াই করা যায় না, এমনকি প্রতিবাদ অথবা আত্মরক্ষা পর্যন্ত অসম্ভব,-এটাই সিস্টেম। তাহলে, এখনতো আর একে স্বৈরতন্ত্র বলা যায় না। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মানুষ লড়াই করেছে, এখনো শেষ হয়নি সেই লড়াই। চলছে। দেশে দেশে স্বৈর শাসন ভেঙে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন আর নেই। ভূতপূর্ব উপনিবেশ গুলি স্বশাসন পেয়েছিল... ... এখন আবার ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ল সেই সাধারণের শাসন, সবার চোখের অলক্ষ্যে এক কুটিল নিঃশব্দ অট্টহাস্যের মতো করাল গ্রাসে চলে গেল গণ-স্বাধীনতা। মগজও ভাবনার অধিকার, প্রায় সকলের অজ্ঞাতেই চলে গেল এক অভিনব শাসন পদ্ধতির অধীনে। স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী, অনেক বেশী সূক্ষ্ম এবং ভয়ঙ্কর এই পদ্ধতির কোনো নামকরণ হয়নি এখনো। আমরা একে বলব-‘বৈশ্যতন্ত্র’। (যদি ছাপার ভুলে ‘বেশ্যাতন্ত্র’ ছাপা হয়, তথাপি, হাজার কুর্নিশ জানাব ছাপাখানার ভূত কে) যা এখন এই নতুন সহস্রাব্দে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সর্বজনসম্মতিক্রমে। কারণ এই ব্যবস্থায় কাউকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় না, পেটের ভ্রূণ ত্রিশূলে গেঁথে উল্লাস হয় না, বীজিতের মুণ্ডু নিয়ে মিছিলের প্রশ্নই নেই এখানে,-সুতরাং কোন কবি ইতিহাস বাঁচা না বাঁচার প্রশ্ন গিলে ফেলতে বাধ্য হন, কোন কবি ‘সাহস হয় না আর কবিতা লেখার’- এই কথা বলার প্রাসঙ্গিকতাও হারিয়ে ফেলেন, অথবা অশ্রু নিঃশব্দ হয়ে যায়, বাধ্যত।– এই তন্ত্রের মূলে যা আছে তা মগজকে অধিকার করে রাখার কৌশল ও প্রযুক্তি। যে কৌশল বলে-‘জগত নয় পৃথিবী’, ‘আনন্দ-শান্তি’ নয় ‘সুখ’, ‘শাকান্ন’ নয় ‘মহাভোজ’, ত্যাগের আনন্দ হাস্যকর প্রতিপন্ন হয়ে গেছে বহুপূর্বেই, জীবন ও চর্যার মূলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোগ, স্বাধীনতার আনন্দ নয় বরং আরামের অধীনতাই শ্রেয়, “কথার কাজ’না হয় পরে হবে এখন কাজের কথাটা হয়ে যাক’। জগতে আনন্দযজ্ঞে আমাদের নিমন্ত্রণ তাই আজ মিছে। এ হোল নিয়ন আলোর অন্ধকার। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সৃজন, মনন, প্রেম ও বিষাদের ভেতর বৈশ্যতন্ত্রের তীব্র তল্লাশি। এবং এ এমন এক ধাঁধাঁ, যেখানে সমগ্র বিশ্বের, সাম্যবাদী, গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমপন্থী প্রায় সকল রাজনৈতিক মতাবলম্বী শাসকবৃন্দ সকলেই প্রায় একমত এবং প্রত্যেকেই বৈশ্যতন্ত্রের পদলেহনকারী। সুতরাং একরকম নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, যে, আজ সারা পৃথিবীতে কোথাও, জনগণের বা সাধারণের শাসন নেই আর। আরো একটু পরিষ্কার করে ভাবলে দেখা যাবে, একসময় সমাজ, অর্থনীতি, ও সার্বিক লোক-শিক্ষার নিয়ন্ত্রা ছিল রাষ্ট্রনীতি। এখন স্বয়ং রাষ্ট্রনীতির নিয়ন্ত্রা এই বৈশ্যতন্ত্র। এইবার কথার সপক্ষে, সোজাসুজি, কিছু উদাহরণের দিকে চলে যাবো আমরা। পশ্চিমবঙ্গ নামক এই রাজ্যের আপামর সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীর( এঁরাই সেই সাধারণ ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’, যে অর্থে একদা শ্রী অশোক মিত্র মহাশয় তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় ‘আমি ভদ্রলোক নই’ বলে ফেলার জন্য এদের কাছেই বিস্তর গালি-গালাজ খেয়েছিলেন। এবং অবশই এই নিবন্ধ লেখক ও এই নিবন্ধের সম্ভাব্য সমগ্র পাঠক, নিশ্চিত ভাবেই ঐ ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’র, এবং একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, এর বাইরে কোনো একশ শতাংশ কৃষক, কোনো একশো শতাংশ শ্রমিক অথবা কোনো একশো শতাংশ প্রলেতারিয়েতের হাতে এই লেখা পৌঁছানোর সম্ভাবনা প্রায় একশো শতাংশ অনিশ্চিত। যদি পৌঁছে থাকেও কখনো, তাহলে ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষিতে তাঁর শ্রেণী অবস্থান সর্ম্পকে একশো শতাংশ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে না।)
এখন একটাই মহাভাবনাচক্র,- বৃহত্তর জনস্বার্থে(অর্থাৎ বৈশ্যতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন কল্পে) অধিগৃহীত কৃষিজমি, যা একসময় সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয়েছিল, তার মধ্যে কিয়দংশ জমির(চারশো একর)মালিক নাকি জমি দানে অনিচ্ছুক ছিলেন। এখন পরিবর্তিত সরকার সেই ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিতে চান।ভাবনা এই, তাঁরা তা ফেরৎ পাবেন কি না? এ এক মহা অনিশ্চিতচক্রও বলা যায়। যদি পায়, তো, তারা কারা? আরো অনিশ্চিত, ঠিক কারা কারা ‘অনিচ্ছুক’, এবং কারাই বা ‘ইচ্ছুক’? এ এক মহান ধাঁধাঁ। বৈশ্যতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত এক ভারতীয় প্যারাডক্স। যারা ‘অনিচ্ছুক’ তাঁদের কথা না হয় বোধগম্য হোল। কিন্তু যারা ‘ইচ্ছুক’, তারা কারা? স্ব ইচ্ছায় চোদ্দপুরুষের ভিটে মাটি কারা ছেড়ে দিচ্ছে বৈশ্যকুলপতি শ্রেষ্ঠীর হাতে? তাঁদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, আদৌ স্বনিয়ন্ত্রিত কিনা ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল, এবং আছে। বলপ্রয়োগ, ভীতিপ্রদর্শন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা ছেড়ে দেওয়া যাক। তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়- যা মানুষের মগজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্যবাদী নেতা ও প্রশাসক-প্রধান বললেন,-‘চাষির সন্তান কি চিরদিন চাষিই থাকবে...?’ – এই বাক্যবন্ধের মধ্যে যুগপৎ দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছি আমরা। ১. চাষ অর্থাৎ কৃষিকাজ ততখানি সম্মানীয় জীবিকা নয়, আর্থিক ও সামাজিক কোন ভাবেই। এবং ২. বৈশ্যতন্ত্রের প্রতি সীমাহীন আস্থা ও অনুরাগ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিমের রামা কৈবর্তের শ্রেণী অবস্থান এতদিনেও কিছুই পাল্টায়নি। নাকি পাল্টেছে! রামা তার জমিখানি তুলে দিয়েছে শ্রেষ্ঠীর হাতে। শ্রেষ্ঠীর কারখানা-গৃহের দুয়ারে রামা আজ বন্দুক হাতে দারোয়ান, লাঙলের বদলে বারুদহীন বন্দুক, মন্দ কি! রামার টালির ঘরে রঙিন TV সেট, রামার ছেলে পিলে কেজি ইস্কুলে যায়, হ্যাট, ক্যাট বলতে শিখেছে, রামার বৌ চুলে দু টাকার শ্যাম্পু মাখে হপ্তায়। রামার ভাঙা পাতরে রাঙা ভাতের স্বাধীনতা হয়তো গিয়েছে কিন্তু আরামের অধীনতায় রামা গর্বিত। চাষির ছেলে চিরদিন চাষি থাকবে নাকি! উদাহরণ ২. সাম্যবাদী সরকার তার ভুলের মাসুল স্বরূপ সরে যেতে বাধ্য হ’ল। ক্ষমতায় এলেন, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী জননেত্রী। স্থান: ঐ পশ্চিমবঙ্গ। নেত্রীর কর্মকুশলতা সর্বজন বিদিত। তিনি বললেন প্রতিশ্রুতি মতো ‘জমি-দানে অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যা কিছু করনীয়, করা হ’ল। প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হোল সত্যই ‘অনিচ্ছুক’ ও ‘ইচ্ছুক’ কৃষকের সংখ্যা নিরূপিত কি হ’য়ে গেছে? ‘চারশো একরে’র হিসাব, সেতো বিগত সরকারের, সত্যই কোন মানুষ আছেন, যে স্বইচ্ছায় নিজের মাটি, যে মাটি সোনার বাড়া, সেই মাটি বাবুর হাতে তুলে দিতে সম্মত হবেন, শুধু এই কারণে যে তাহলে বাবুর বাগানখানি ‘প্রস্থে ও দীঘে সমান হইবে টানা’? না, নেত্রী বলেছেন বাকী জমি ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ ব্যাবহার করা হবে, কোনো বণিক শিরোমণির হাতেই অর্পিত হবে, হ্যাঁ, ‘সাধারণের স্বার্থে শিল্প হবে’। অর্থাৎ, সেই বৈশ্যতন্ত্রের স্বার্থেই, আরো সুষ্ঠুভাবে প্রতিস্থাপনের লক্ষেই, ফিরিয়ে দেওয়া হবে ‘চারশো একর’।
বঙ্কিম বলেছিলেন, ‘এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞাসার আছে, কাহার এত মঙ্গল...’- হে পাঠক, এই ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে চিনতে পারছেন কি? এখন ‘মঙ্গল’ এই সুমধুর প্রাচীন বাংলা শব্দটির ব্যাবহার অস্তমিত, পরিবর্তে এই মঙ্গলেরই কিছু বিকৃত, বিকলাঙ্গ রূপ আমরা চিনি আজ, যথা- উন্নয়ন, যথা- ডেভেলপমেন্ট। বৈশ্যতন্ত্র ঐ ‘মঙ্গল’ শব্দটি ভুলিয়ে ছেড়েছে।
৩. কৃষক ও কৃষির প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ তৈরি করতে আমরা শিখিনি, উপরন্তু প্রয়োজনের কথাটুকুও ভুলেছি। তাছাড়া সামান্য চাষার কথা কে আর কবে ভেবেছে। হাঁটু অবধি ধুতি, খালি গা, কাঁধে লাঙল, খালি পা, ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে সানন্দ ভারতীয় কৃষিজীবীর এই কল্পদৃশ্য যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয়, আদতে বাস্তব আরো সুকঠিন। যা খালি চোখে দেখা যায় না, তা, ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে তার বুকের ঘুষ ঘুষে জ্বর, হাঁটু অবধি কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সরীসৃপ, হাত ও পা’য়ের আঙুলের ফাঁকে অমসৃণ ক্ষত, জীবাণু সংক্রমণ, আর্সেনিক, পার্থেনিয়াম...- এদের সাথে খালি হাতে লড়াই আজও অব্যাহত, এখনো, স্বাধীনতার এত বছর পরেও। ইংরেজ কে আমরা সর্বজনীন ভিলেন হিসেবে জানি বরাবর। তাদের বিদায় ষাটবছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তথাপি আমাদের দেশের কৃষকদের মাথায় এখনো একটি টোকা জুটল না কেন? শরীরে বৃষ্টি নিরোধক, হাঁটু অবধি জুতো? এসব ভাবনা কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? থাক তাহলে, বরং কিছু সদর্থক গল্প শোনা যাক।
বৈশ্যতন্ত্রের বিপরীত গল্প। বাকুঁড়া জেলার এক প্রত্যন্ত, জঙ্গলঘেরা, রুক্ষ গ্রাম পাঁচাল। চাষবাস এ অঞ্চলে বরাবরই সীমিত, বর্ষায় উপচে পড়া নদী আর গ্রীষ্মে খরায় পীড়িত গ্রাম। সেখানে দেবল দেব মহাশয় একটি বীজ-ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করলেন, সঙ্গে গবেষণাগার। দেবল বাবু দশ গাঁয়ের মানুষের সাথে মিশে গেলেন, তিনি মানুষকে দেখালেন ‘রাসায়নিক’ প্রয়োগ ছাড়াই জৈবসার মাত্র প্রয়োগে ফসল ফলানো যায়। কীটনাশকের পরিবর্তে তিনি দেখালেন, ফসলের ক্ষেতের মধ্যে পাখিদের বাসার বন্দোবস্ত প্রয়োজন, ক্ষতিকর পোকা-মাকড় পাখিরাই ভালো চেনে। তিনি দেখালেন অসংখ্য দেশীয় বীজধান,যার অধিকাংশ বর্তমানে লুপ্ত প্রায়। দেবল বাবুর সংগ্রহাগারে রয়েছে ‘যুগল’, ‘সতীন’, ‘অসিতকর্মা’,- সহ প্রচুর লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় দেশীয় বীজধান। ‘যুগল’- একটি ধানের ভেতর, অর্থাৎ ‘যুগল’ চাষ করলে প্রতিটি ধানের ভেতর পাওয়া যাবে দু’টি চালের আধার। ‘সতীন’ ধানটির ভেতর রয়েছে তিনটি চাল, মধ্যিখানে লম্বা বড় আকৃতির একটি চাল, আর তার দু’পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির দুটি চাল, যেন স্বামীর দুই পাশে দুই ‘সতীন’। অসিত কর্মকার নামের এক চাষির কাছে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এমন এক বীজের, যা বহু পূর্বেই লুপ্ত হ’য়ে গিয়েছিল বলে সকলের ধারনা। সেই ক্ষুদ্র সংগ্রহ থেকে দেবল দেব ধীরে ধীরে সেই বীজের চাষযোগ্য সংগ্রহ গড়ে তুলেছেন। ঐ কৃষকের নাম অনুসারে সেই হারিয়ে যাওয়া ধানের নাম ‘অসিতকর্মা’। পাঁচাল গ্রামের নিকটে ‘বসুধা বিজ্ঞান বীথী’ এক প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ, যার প্রাণপুরুষ শ্রী দেবল দেব একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জীববিজ্ঞানী। এই কাজে আত্মনিয়োগের জন্যই কোন স্থায়ী ও লোভনীয়, মসৃণ জীবনের হাতছানি তথা, বহুজাতিক বৃহৎ সংস্থার চাকুরী গুলি তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এবং জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞান আলোচনা চক্রগুলিতে অংশগ্রহণ বাবদ যেটুকু উপার্জন হয় , তার প্রায় সমস্তটাই তিনি ব্যয় করেন এই কাজে । বর্তমানে উড়িষ্যার কোরাপুটে এই একই ধরণের এক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন এবং বর্তমানে অধিকাংশ সময় তিনি সেখানেই অতিবাহিত করছেন । মেনে নিতে অসুবিধে হলেও , বৈশ্যতন্ত্রের বিপরীতে এই একক প্রচেষ্টাগুলিই সম্ভবত পথ । লড়াই বললে সঠিক অনুধাবন সম্ভব নয়, বরং বলা ভাল, আপন কর্মের প্রতি ধ্যানস্থ মানুষ । সর্বক্ষেত্রেই রয়েছেন এমন মানুষগুলি, এবং এদের হাতেই চেতনার পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ আরো বহুদূর অগ্রসর হয়ে যাবে । এই রচনা এক বহু প্রচীন কবির রচিত একটি বাক্যাংশ দিয়ে শেষ করতে ইচ্ছে করছে ।
...ঈশ্বরের নির্জনতায় যেভাবেই হোক, যারা বারবার তোমাকে ফেরায়—
কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি থেকে, থাক’ সতর্ক তাদের বিষয়ে,
তোমাকে যারা দেয় নানাবিধ আস্বাদের
তোমাকে যারা দেয় নানাবিধ আস্বাদের
আরাম, ভুলিবে দেব প্রার্থনাও, দিব্য অনুভব!
বন্ধুরাও শত্রু হতে পারে, আর শত্রুরাও, কখনো-বা, প্রকৃত বান্ধব...
বন্ধুরাও শত্রু হতে পারে, আর শত্রুরাও, কখনো-বা, প্রকৃত বান্ধব...
--জালালউদ্দীন রূমী । জন্ম:
অধুনা
আফগানিস্তান,
১২০৭—১২৭৩ খ্রী
: (অনু:
অনির্বাণ
ধরিত্রীপুত্র)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন