![]() |
ছবি: বাসুকি দাশগুপ্ত |
হাঃ হাঃ জীবন আমি তোমার থেকে পালাতে গিয়ে এ কোন দরজা দিয়ে
এসে পড়েছি তোমারই ভিতরে !
নারাণ দা
১.
গতবছর এরকম সময়েই বোধহয়,নারাণদা অসুস্থ। সুদেবদা আর আমি গিয়েছিলাম নারাণদার বাড়ি । এত এত বার করে ফোনে বলেছেন... এর আগে নন্দন-চত্বরে দেখা হয়েছিল একবার, সেই আলাপের দিন । নারাণদা ফোনে বলেছিলেন;' আমায় চিনতে পারবে তো ? আমি মাথা থেকে পা অব্দি সাদা কিন্তু', বলে হাসলেন । আমি বললাম 'আমায় চিনবেন কিভাবে ?' নারাণদা বললেন ' 'আপন সন্তানকে চিনতে পারেনা যে, সে পিতা নয় গো...।'
তারপর এই তো সেদিন সুদেবদা আর আমি যখন তাঁর বাড়ি পৌঁছলাম, নারাণদাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বাইরের ঘরে নিয়ে আসা হল । মুখে সেই অনাবিল হাসি । আমি কাছে এগিয়ে যেতেই জড়িয়ে ধরলেন, আমার ডান হাতে অনেকগুলো চুমু খেলেন, নারাণদার লালা লেগে গেল আমার হাতের পাতায় । ছলছল চোখে বললেন, কৌশিক , কি-যে আনন্দ হচ্ছে আজ, জানো, কতদিন কারো সাথে কথা বলিনি... তোমরা এসেছো...বলো আবার আসবে তো...?
নারাণদা তাঁর কবিতা ও গল্প সমগ্র উপহার দিলেন, প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে দিলে—‘আমার শেষ বয়সের সন্তান কে’!
আমি বললাম--হ্যাঁ নারাণদা, নিশ্চয় আসবো...।
বলেছিলাম, কিন্তু আর যেতে পারিনি, কথা হয়েছে ফোনে মাঝে দুয়েকবার, তারপর ...
"দু:খ পেতে এসেছি।
দু:খ পেতে এসেছি বলেই আনন্দশঙ্খ
উলুধ্বনি এবং লাবণ্যভরা আকাশ
দু:খ-উপবাসে মেলেনি অক্ষর
অক্ষরবিহীন হৃদয়, ও-হ্--
না কাঁদে না কাঁদে না দোলে
একি মহাজীবন হতে পারে ?
ও গো দেহপ্রভু
ও গো শুভমৃত্যু
ও গো বৃদ্ধস্মৃতি
এখানে এই শ্যামশ্রীঘরে আমার দু:খপ্রাশন
এখানে দু:খান্তেষ্টি
দু:খ আমার পুত্রের দেওয়া অন্নজল
দু:খই যাত্রা ।"
নভেম্বর ১৬, ২০১৩
---
২.
আজ সকাল সাড়ে সাতটায় দেখা হল সুকুমারের সাথে, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ওন্দাগ্রাম স্টেশনের প্লাটফর্মে, দুমিনিট, আমাদের মধ্যে পত্রিকা, বই হাত-বদল হল। পুরুলিয়া থেকে সুকুমার যাচ্ছে কলকাতা, নারাণদার স্মরসভায় উপস্থিত থাকতে । সেই সভায় নারাণদা ছাড়া আরো অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবে । নারাণদার সাথে কিন্তু দেখা হবে না কারুর...।...আমার যাওয়া হলনা এবারেও...নারানদা বলেছিল; 'আসবে তো আবার ...?' আমি যাইনি, এখনো গেলামনা, অজুহাত; ছেলের পরীক্ষা। পাঁচ বছরের ছেলের আবার পরীক্ষা...! প্লাটফর্ম ছেড়ে ট্রেনটা সুকুমারকে নিয়ে চলে গেল...
মোবাইল বাজছে....
--হ্যালো ??
--এত ভুলে যাও কেন ??
-- হ্যালো, কে ??
-- আসবো বলে আর তো এলেনা...?
--হ্যালো !!!
--দেখো আমি তোমার চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছি...তুমি বুঝতে পারছো...?
--এ কার কণ্ঠস্বর ! হ্যালো...হ্যালো...
--শুনতে পাচ্ছো..."দীর্ঘতম কাহিনীতে অন্ধত্ব একান্ত জরুরী'... কৌশিক!'
--নারাণদা...!
নভেম্বর ২২, ২০১৩
মনখারাপের বিষয়বস্তু
মন খারাপের কোনো প্রকৃত বিষয় বস্তু নেই । এই যেমন, এখন অন্ধকার রাত্রি। বসে আছি। জনহীন ধূ-ধূ অন্ধকার রাজদরবারের মাঠ । ছোট ছোট ঝোপঝাড়গুলো কিছুদূরে খক্কোশের মতো হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে। হাওয়ায় হাওয়ায় তাদের হাহাকার ভেসে আসে। আমার এখন আর ভয় লাগে না। আগে যখন ছোটো ছিলাম, তখন ছোটকাকার কোমর জড়িয়ে বসে থাকতাম এইখানে। খুব ভয় পেতাম। দূরে মাঠের একধারে বটগাছটা বিশাল এক হাতির অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথার উপরে জোনাকির সংসার উড়ে যাচ্ছে । আরো আরো উপরে জ্বলছে তারা, তারামণ্ডলী । উড়ে যাচ্ছে ছায়াপথ, তারারসংসার। সেখানে বয়ে যাচ্ছে আকাশগঙ্গা নামে এক নদী। খুব মন দিয়ে কান পাতলে এই পৃথিবীতে বসেও তার কুলু-কুলু নির্জন শোনা যায়। ...খুব ছোটবেলায় আমাকে তারা চেনাতো একজন লম্বা মত মানুষ। --ঐ দ্যাখ, সপ্তর্ষি মণ্ডল। ঐটা দেখেছিস ...? তিনটে ফুটকি ( এখন সেইদিকে তাকিয়ে ভাবি, তিনটে ফুটকি মানে তিনটে জীবন্ত মহাতারা!)... কোমরে বেল্ট আঁটা...তলোয়ার, হ্যাঁ ঐটা কালপুরুষ । ...আমি কালপুরুষ দেখছি। ঠাকুমা বলেছিল, কালপুরুষ দেখলে ঘরে অমঙ্গল হয় । আমি অমঙ্গল দেখছি। কত তারা! কত! কত্ত! কোনটা মঙ্গল ? কোনটা অমঙ্গল ? আমার মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছে । লম্বা মতো মানুষটি বলেছিল; -- এইযে তারা দেখছিস , এগুলোই সব নয়, আরো,আরো আছে, তাদের আমরা দেখিনা । আমাদের দৃষ্টি চলে না সেখানে, তবু হয়তো একদিন দেখতে পাবো তাদেরও । হয়তো আমরা পাবো না, আর কেউ দেখা পাবে তাদের । আর এই যেগুলো দেখছিস, ...এগুলো হয়তো বা নেই । আমার ছোট্টো মাথা । বুঝছিনা কিছুই। নেই মানে! দেখতে পাচ্ছি, অথচ নেই ! –না নেই। এরা হয়তো বা সবাই নেই আর। এরা শুধুই আলো । উৎসহীন আলো। যাদের উৎস হয়তো বা কবেই হারিয়ে গেছে । ওগুলো ধাঁ-ধা, ওগুলো নষ্ট তারা । ...আমি নষ্ট তারা দেখছি, নষ্ট তারা... নষ্ট তারা...আমি আরো ছোটো হয়ে যাচ্ছি—ক্ষুদ্র—ক্ষুদ্রতর—আমি মিশে যাচ্ছি জোনাকির সংসারের ভিতর...।
এখন সেই লম্বা মতো মানুষটির সাথে দেখা হয় না বহুদিন । সেই ঘরে বাস করে একটা অন্য লোক। দূর থেকে দেখি সে তার নোংরা বিছানায় শুয়ে থাকে ব্রহ্ম-একাকী । লোকটা প্রতি রাতে প্রতিটি তারার মধ্যবর্তী ফাঁক গুলি গোনার চেষ্টা করে । আর ফাঁকা অংশ মানে যেহেতু শূন্য, এবং শূন্যের যেহেতু কোনো স্তর ভেদ নেই, আমার হাসি পেয়ে যায় ।...আমি উঠে দাঁড়াই মাঠের মধ্যিখানে । পাছার ধুলো ঝাড়ি দু’হাতে। আমি ফিরে আসছি ভাঙা সাইকেলে চেপে। নাহ্, আমার তো মনখারাপ লাগছে না ...!
২.
চারে চোর চুরি করে, পাঁচে প্যাঁচা গাছের ডালে...। ছোট্ ছোট্... এক পায়ে ছুট,পা নামাবি না – মার্বেল খেলা । শাঁখের মার্বেল। সাদা , ধবধবে সামান্য চ্যাপ্টা মতো। কমলা লেবু আর পৃথিবীর মতো, তার উত্তর-দক্ষিণ একটু চাপা। আমার লাক্কি মার্বেল। বাঁ হাতের দু’আঙুলে ধরে ডান হাতের তর্জনীর উপর রেখে পিছনে টানমেরে সামনে উদ্দিষ্টের দিকে ছুঁড়ে মারার অলৌকিক কৌশল রপ্ত হচ্ছে। এ গলি, সে গলি—পাড়ার সমস্ত গলি চেনা হয়ে যাচ্ছে । ঐ-তো বকুলগাছ, ডলিদিদিমনির বাড়ি, ঐযে ভাঙ্গা সাবিত্রী মন্দির, কত পুরানো ভেঙেপড়া পাত কুয়ো, মা, তুমি এখানেই জল নিতে আসো ? মা, আমি সাবিত্রীতলা শিখে গেছি। –ছোট্ –ছোট্, পা নামাবি না একদম... ঐ, আমার লাক্কিটা হারিয়ে গেল। দিলীপদার দোকানে কাচের বয়াম ভর্তি সাদা শাঁখের-মার্বেল। আমি লোলুপ তাকিয়ে থাকি আর একেকটা মার্বেল শূন্যে উড়ে যেতে যেতে চোখ টিপে যায়। আমার পকেট স্বপ্নে ভারি হয়ে যায় । আমি ঘুম থেকে উঠে মার্বেল খেলি বিছানায় বসে –একা একা । অথচ লাক্কিটা আর ফিরে এলো না । কোথায় হারিয়ে গেল ? কোনো সহ-খেলুড়ের হাত সাফাই? ভোম্বল? টিঙ্কু? শিবু? কে কে? তাহলে কি সে কোনো অন্ধকার ফাটলের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল ? সে কি অন্ধকার ফাটলের খাঁজে আজীবন আটকে থাকা শৈশব ? আমি খুঁজছি, খুঁজছি ৩০বছর আগের ছোটো হয়ে যাওয়া জামার পকেটে । বয়ের ব্যাগ, কাঠের বাক্স, কৌটো, খুঁজছি ৩০বছর আগের বিকেলের রাস্তায়, আখড়ার পাড়ের সেই আকন্দঝোপের দিকে --কিভাবে কিভাবে ? মনে পড়ছে না, মনে পড়ছে না কিছুতেই...
আমার মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে...
ঐ বুঝি কেউ হাসে
মানুষের নানান অবস্থার মধ্যে দুটি রূপ স্পষ্ট। এক-বালক অবস্থা আর দুই—পরিণত অবস্থা। বালক অবস্থা কেমন ?
বৌ কে তার স্কুলে আনতে গেছি । গেটের বাইরে ঘন্টা পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ঘন্টা পড়ল, হুড়মুড় করে সব বেরিয়ে আসছে উত্তাল বালক-বালিকা। কেউ গুঁতিয়ে আগে পথ করে, কেউ চালাকি করে, কেউ পিছনে পড়ছে, ঠেলছে—সবার মুখেই হাসি, উজ্জ্বল ঝলমলে। হাট করে খোলা লোহার গেট। সবাই বেরোচ্ছে। একজন এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশে তাকিয়ে দেখল শিরিশ গাছটাকে। তার একটা ডাল নিচু হয়ে পাঁচিল পেরিয়ে রাস্তায়। সে উঠে পড়ল গাছে। ডাল ধরে পাঁচিল টপকে ঝুপ করে পড়ল রাস্তায়। তার দেখা দেখি আরো দু একজন...।
এই হল বালক স্বভাব । সোজা পথ পড়ে আছে, সে যাবে না। ওতে আনন্দ নেই। সে যাবে একহাঁটু ধুলো মেখে, কাঁটাঝোপ ভেঙে।
এদিকে ব্যাকরণের মাস্টারমশাই, গোস্বামীবাবু তেড়ে এলেন—এ্যাই কেরে ? এটা নরেশ কাপড়ির ব্যাটা নাকি ? দাঁড়া তোর বাপ কে বলি... --পরিণত লোক। বালক স্বভাব ভুলে গেছেন।
মানুষ যখন সবজান্তা হয়ে যায় তখন তার বালক স্বভাব মরে যায় । সে আর কোনো কিছুতেই আনন্দ পায় না। কোনো ঘটনাই তাকে আকর্ষণ করেনা। সে তখন কৌতূহলহীন, নিরানন্দ এক জ্ঞানভাণ্ড! সে হাসে না , কাঁদে না, আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসে না—হ্যাঁ গো কি হয়েছে, ছেলে না মেয়ে ?
সে শুধু ভয় পায়, --ঐ বুঝি কেউ হাসে..।
খেলা
খেলাধুলা জিনিষটা হিসেব-বাজদের জন্য নয় । জগতের যত কুট হিসেব এখনো যাদের মগজে মরচে ফেলেনি, খেলাধুলার অধিকার একমাত্র তাদেরই । এই ক্রিকেট খেলার কথায় ধরুন । ডাঁটাকলমির ডাণ্ডা দিয়ে আমরা স্ট্যাম্প বানাতাম তখন । বরেন কাঠমিস্ত্রিরি বাটালি দিয়ে দারুণ সুন্দর একখানা হাতা (ব্যাট) বানিয়ে দিয়েছিল । আমরা পাড়ার রাস্তায় অথবা প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠে খেলতাম । ইস্কুলের পিছনে শাঁখারিডোবা , সেখানে বৈশাখ জৈষ্ঠি বাদে সারা বছর জল থাকতো । ইস্কুলমাঠে খেলার সময় (মানে সেই সময়) জলিলদার জানালায় মারতে পারলে চার । দত্তবাড়ির পাঁচিলে লাগলে দুই, পাঁচিল টপকে ভিতরে পড়লে আউট, বল আনতে হবে ব্যাটসম্যান কে । ( দত্তদের বেল্ট বাঁধা নেড়িটা এমন গাঁগায়, যেন ব্যাটা এ্যালসিসিয়ানের বাচ্চা) । আর ইস্কুলবাড়ির পিছনে শাঁখারি ডোবায় পড়লে খেলা সেদিনকার মতো শেষ। ওদিকে আমরা বিকেল বেলাতেও যাই না। আমরা মানে ছোটোরা । বিদ্যুতের ছোটো ভাইটা কেন যে গিয়েছিল... দূর থেকে দেখে ছিলাম ও ভাসছে, শাঁখারিডোবার পানার উপর । ডোবার চারদিকে বড়দের ভিড়, বড়দের পা’এর ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখলাম, বিদ্যুতের ছোটো ভাইটা ভাসছে ...। ...দিলুদা ছিল আমাদের আইকন। ও: সেকি কব্জির জোর ! রানুদিদিদের আড়াইতলা বাড়ির চিলেকোঠা টপকে পিছনের পরিত্যক্ত আধাজঙ্গুলে মাঠে গিয়ে পড়ত তার ছক্কা। বল খুঁজে পাওয়া যেত না । দিলুদা দরাজ হেসে নতুন বলের পয়সা দিত । আমরা জানতাম ঐ চিলেকোঠার জানলার পিছনে রানুদিদি ঠিক লক্ষ রাখছে এইসব। রানুদিদি দিলুদার জানেমন । দিলুদা জান দিয়ে খেলত। না , দেশ ফেস এর জন্য নয় । মেরা ভারত মহান টহান তখনো আমরা শুনিনি । দিলুদা রানুদিদির জন্য জান দিয়ে খেলত । আর আমরা সবাই দিলুদার জন্য জান দিয়ে খেলতাম । না, আমাদের কোনো ম্যাচ ফিক্সিং ছিলো না .... আমরা কেউ শচীন বা ইন্ডিয়া হইনি...!!!
----
সন্দীপন ও ত্রয়ী
“... আমি যে মাঝে মাঝে বলি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ এই ত্রয়ীর মধ্যে আমরা যদি শরৎচন্দ্রকে না পেতাম তাহলে বাংলা সাহিত্যের ভাল বই মন্দ হত না––সে অনেক দুঃখে বলি। শরৎচন্দ্র ওঁদের মত বড় মাপের লেখক ছিলেন না, তাতে কী হয়েছে! সে তো অনেকেই নয়। আসলে, এমন একটা ভিখারি ভাষা বানিয়ে দিয়ে গেলেন, যে ভাষার কাছে মানুষের আর চাইবার কিছু থাকল না। যে জন্যে আজ চারিদিকে এত কাহিনীকার, এত দন্তহীন গল্পদাদু। এত মহেশ”—সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ।
...যদিও আমরা বলি যে বঙ্কিম রবীন্দ্র শরৎ। তবে বঙ্কিমকে যেমন বাংলাভাষার রাজকীয়তার শিখরে রাখা হয় , সেই ভাষার সঠিক ব্যাবহার বাংলায় পরবর্তীতে কমই হয়েছে । দু একজন বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর কমলকুমার প্রবোধ সান্যাল ছাড়া । যদি হত তাহলে বাংলা ভাষা আজো শুধুই একটি অপরিচিত তৃতীয় বিশ্বের ভাষামাত্র হয়ে থাকত না । অথচ শুরুতেই সে পেয়েছিল বঙ্কিম কে! এ গর্ব নয়, আক্ষেপ !
... শরৎচন্দ্রের চরিত্রেরা যখন আটপৌরে ভাষায় কথা বলে ওঠে, সাধারণ দৃষ্টিতে হয়তো তা তখন সেই চরিত্রটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে । কিন্তু তার অভিঘাত সামান্যই, যাকে সন্দীপন বলছেন 'ভিখারি ভাষা'। অথচ সন্দীপন বোধহয় ভুলে গেলেন শ্রীকান্তের চারটি পর্বে ভবঘুরে এক অদ্ভুত মায়ারস সৃষ্টির কথা। যা আমাদের নিজস্ব, বাংলা ভাষায় এমন মায়া পরবর্তীতে আর সে ভাবে হল না কখনো। ....আবার উল্টোদিকে সন্দীপন সম্পর্কেও কথাটা সত্যি । তিনি একটা বাদশাহী ভাষা দিলেন আমাদের । তার জাঁক জমকে, চুনিতে পান্নাতে ঠেসে দিলেন তার গদ্য কে । তার ভেতরের প্রাণ মরে পড়ে রইলো, তিনি টের পেলেন না । কারণ তার ভাষার স্মার্টনেস, চুনি পান্না সমস্তই আমদানিকৃত । কোনোটিই তার ঘরের সামগ্রী নয় । সবচেয়ে আফসোসের কথা তিনি যে মূর্তি গড়লেন, শেষ পর্যন্ত তার চক্ষুদান করতেই ভুলে গেলেন ...। এই কায়দাসর্বস্ব মৃতভাষা লইয়া আমরা কি করিব সন্দীপন !
. মৃত ভাষা আর জীবিত-প্রাণবন্ত ভাষার উদাহরণ : যদি সতীনাথ, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, বিভুতি কে ছেড়েও দিই, তাঁর সমসাময়িক মনীন্দ্র অথবা কমলকুমারের আর উল্টোদিকে সন্দীপনের গদ্য পাশাপাশি রাখা যায়, খুব সহজেই বোঝা যাবে বিষয়টি । ‘বঙ্কিম-রবীন্দ্রের পাশে যেমন বেমানান শরৎ’ ! -- সন্দীপন ঠিকই বলেছেন ...
জমি ও বৈকালিকস্বপ্ন
অবশেষে ওন্দাগ্রামের সন্নিকটে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে দুইবিঘা টাঁড়জমি কেনা মনস্থ করিয়াছি । প্রবল গ্রীষ্মে সেই জমির উপর দিয়া ধূ-ধূ গ্রীষ্মবায়ু প্রবাহিত হয়, জমি লাল কাঁকুরে, তথা ল্যাটেরাইট । উহাতে লোহার পরিমাণ কিঞ্চিদধিক । অল্প সূর্যালোকেই উত্তপ্ত হইয়া উঠে । অত:পর নগ্নপায়ে মাটিতে পা’ রাখা দুষ্কর হইয়া উঠে । আবার ভরা বর্ষার কালে সেই মাটির ঢালে ঝরঝর শব্দে প্রবাহিত হয় আকাশের জল । বছর ভর তৃষ্ণায় মাটি কিছুটা শুষিয়া খায় বাকিটা গড়ায়ে গড়ায়ে চলিয়া যায় বহুদূর, গিয়া, দক্ষিণের এক প্রাকৃতিক খালে গিয়া পড়ে । খাল গিয়া মিশিয়াছে বিড়াই নদীতে । আমার অতদূর গিয়া কাজ নাই । আমার (অদ্যাপি আমার নহে) এই দুইবিঘা জমির কিনারে কাশের গুচ্ছ উঁকি মারিতেছে । ভাবিতেছি কাশগুলি রাখিয়া দিব । উহাদিগের জন্য কিঞ্চিত জলের ব্যবস্থা করা উচিৎ । দুই বিঘার একবিঘা মূলত আম, কাঁঠাল, শিরিষ, কদম্ব, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া তে ভরা থাকিবে আর অবশ্যই সোঁদালবৃক্ষ দুইখানি । বাকি টুকু সম্বৎসর জুড়িয়া সব্জিচাষে ব্যয়িত হইবে । জমিটির এক কোনায় একটি নলকূপ ।এবং অন্যপ্রান্তে একটি ছোট্টো পুকুর খনন করিবার গোপন ইচ্ছা পোষণ করিয়া থাকি যদি খুব কি মন্দ হইবে ? পুকুর ছাড়া তো শালুক ফুল সম্ভবে না?
আর হ্যাঁ, একখানা দুই কুঠুরির মাটির ঘর । এখানকার ল্যটেরাইট মাটি পাথরের পারা । অক্ষয় অমর শীতল । বিদ্যুতের খুঁটি বহুদূর , ভাবছি সোলার লাগাইব । কারণ দুইখানা কুঠুরির একখানা কিছু বই পত্র-পত্রিকার আশ্রয় স্থল এবং পাঠকক্ষ । বন্ধু-বান্ধবরা আসিবেন, এই কক্ষেই তাঁহারা অবস্থান করিবেন ।
যাই হোক, জমিটি ক্রয় করিলেই হয় এইবার...
------
লোকে তো ভেড়ুয়া বলবে...
হালকা হালকা শরত কালীন সন্ধ্যার বাতাস বয়ছে। আকাশে একটা চাঁদ। কাঁসার থালার মতো । আহা।
বৌ বলল--ওহ্ ক্লাসিক...
আমি বললাম--দাঁড়াও, আগে দাদাকে জিজ্ঞেস করে নি,,,
--মানে ???
--না, মানে, চাঁদের আলো ক্লাসিক না উত্তরাধুনিক সেটা নিশ্চত করা দরকার...তুমি বললে ক্লাসিক,পরে দেখা গেল উত্তরাধুনিক,,,পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকা দরকার ...বৌ বলছে বলেই হুঁ দিলাম…লোকে তো ভেড়ুয়া বলবে...
কায়দার কবিতা
কবিতা ও কায়দার মধ্যে একটা আড়াআড়ি বিভাজন দরকার । যদিও ‘কবিতা’র কোনো সংজ্ঞা হয় না একথা আমরা বলে থাকি প্রায়শই। তথাপি কবি ও গুণীজন অনেকেই ‘কবিতা’ কী বস্তু তার নানা ইঙ্গিত ও ইশারা রেখে গেছেন । খুব বেশী পড়াশোনা না করেও অন্তত জীবনানন্দ প্রণীত ‘কবিতার কথা’ নামের একটি আস্ত পুস্তকের কথা আমরা জানি। সেখান থেকে একটু পাঠ নেওয়া যাক বরং –“সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়--- কিম্বা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়,যে মনে হয়, --এই সমস্ত জিনিষ ই অনেকদিন ধরে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে,আরো অনেক দিন পর্যন্ত, হয়ত মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদ্গীরণের ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভূতির সৃষ্টি হয় ।"
আমরা আপন আপন সাধ্য মতো তাঁর ইশারা ও ইঙ্গিত বুঝেছি, তারপর বলেছি “কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয় না” । আর এই অসংজ্ঞার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি ‘কায়দা’ ! এখন কবিতা বেশী কায়দাগুলোকে দেখিয়েও বলা হচ্ছে –এসব সংজ্ঞাতীত পরম ব্রহ্ম! এখন কথা হল যা কিছু কবিতা, তাকে ভাঙলে আমরা কি পাবো ? উত্তর হল—কিছুই না। এমন কি কবিতা পোড়ালে তার অবক্ষেপ হিসেবেও কিছু পড়ে থাকেনা। আর তখন ই তা হয়ে ওঠে পরম, অদাহ্য। শুধু পাঠক তা হৃদয়ঙ্গম করার পর কখনো কখনো হয়তো বা এক ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী মহাশূন্যের নিচে নিজেকে একাকী আবিষ্কার করে কিঞ্চিৎ থমকে দাঁড়ায় । হয়তো এটুকুই।
প্রশ্ন এই—কায়দার কবিতা থেকে কায়দা খুলে নিলে আমরা কি পাবো ?
---
অনামী কবি
নাম না জানা কবিরাই মূলত কবি ।
পৃথিবীতে যদি কখনো মানুষ একা হয়ে যায়, যদি একজন কবি ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ না থাকে তার রচনা শোনার--- তখনো কি সে লিখবে কবিতা ? না । কবির একজন পাঠক প্রয়োজন, একজন মাধুরী ! একজন প্রেমিকা। হ্যাঁ, একজন মাত্র। যার জন্য সে রচনা করবে কাব্যমালা...প্রেমের কবিতা, তার হৃদয়গাথা...।
শোনো মাধুরী, নাম না জানা কবিরাই মূলত কবি। তুমি জানো আমার কবিতা, ব্যাস্, এটুকুই, যখনি পাঁচজন জেনে ফেলবে আমার নাম...তখন আমি আর কবি নই।
কবির জীবন মূলত অকবি হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস...নইলে প্রকাশের কিইবা প্রয়োজন...
কবি ও ঈশ্বর
ঈশ্বর : তুই কে ?
--- : এজ্ঞে আমি কবি ।
ঈশ্বর : কবি ! কোথায় তোর কবিতা ?
--- : এজ্ঞে ফেসবুকে ...
ঈশ্বর : সে আবার কোন বস্তু রে !!! এ্যাই, ফেসবুক কিরা ???
--- : এজ্ঞে ফেসবুক জানেন না ! (খানিক আমতা আমতা করে)... মানে যখন যা খুশী মনে এল, লিখে পোস্ট দিলাম। রাস্তায় ভিখারি পয়সা চাইচে, খ্যাচ্-- ছবি তুলে পোস্ট দিয়ে দিলাম, দুপুরে শ্রাদ্ধবাড়ির ছবি আর রাত্তে বিয়ে বাড়ি পোস্ট কল্লাম । বিয়ে ভেঙে গেল, তাও পোস্ট কল্লাম...
ঈশ্বর : অ, পোস্টাপিস ! তাই বল..
--- : এজ্ঞে না, মানে...
ঈশ্বর : যা বেরা, তুই ঢপের চপ কবি...
.......
.......
: এ্যাই তুই কে ?
: (স্মার্টলি) আম্মো কবি
: কোথায় দেখি তোর কোবতা ???
: (একটু ঘাবড়ে) আমি দেশে লিখি
: তোর কোন দেশ ?
: এজ্ঞে পশিমবঙ্গ...
: লেখা কৈ ?
: এজ্ঞে আমি বাণিজ্যিক পত্রে লিখি তো...
: সেটা কিরকম ?
: মানে , আমি লিখি, ওরা পয়সা কড়ি পুরুস্কার টুরুস্কার দেয় আর কি...
: থালে তোকে বেচুবাবু না বলে কবি বলবো কেন রা? যে বেরো, তুই শো কজ হলি...
.....
.....
(ছাগলদাড়ির প্রবেশ)
: তুই আবার কে !!!!!!!
: (শাহেনশার ‘রিস্তে মে তেরা বাপ লাগতা হুঁ’ স্টাইলে দাঁড়ি চুলকে)
কবি, লিটিলম্যাগ করি (আবহ: ডন ডন ডন ডন )
(ঈশ্বরের পতন ও মুর্চ্ছা )
চমক
একসময় ‘চমকে দেওয়া’ টা অপরাধ জগতের একটা ভাষা ছিল। এখনও আছে কি? কে কাকে ‘চমকে’ দিল, কে কতটা ‘চমকে’ গেল—এই দিয়ে চমক দাতার ওজন মাপা হয়। এমনটা পড়তাম প্রায় সংবাদপত্রে , সেই ভাষা ব্যবহার করে লেখা গল্পে উপন্যাসে। নবারুণ ভট্টাচার্য সহ অনেকের রচনাতেই প্রায়শই এদের মুখের ভাষা শোনা যায়। অর্থাৎ চমকে দেওয়া মানে ভয় দেখানো। চমক জিনিষটা হঠাৎ ছাড়া হয় না। যা আবহমান, যা চিরাচরিত, যা শাশ্বত সেখানে তো কোনো চমক নেই। তা নিতান্তই মেঠো, গ্রাম্য অথবা মহাজাগতিক...। মহাজাগতিক শুনে চমকাবার কিছু নেই। এখানে চমক নয়, যা আছে তা অনন্ত বিস্ময়। এক মানব, দুই মানব, তিন মানব জীবনে তা শেষ হওয়ার নয়...।
হঠাৎ চমকে যাওয়া মানে তো ভয় পাওয়াই ? তাই না? একটু নরম অর্থে, চমকদার, জেল্লাদার ব্যাপারগুলোও তাই আসলে। আর ‘হঠাৎ চমক’ ব্যাপারটাই হল অচানক। অর্থাৎ আগে থেকে জানা থাকলে আর কোনো চমক নেই। আর সেই কারণেই একই চমক বারবার কাজে লাগে না। তখন চমকদাতাকে নিত্য নতুন চমকের আমদানি করতে হয়।
...তা হ্যাঁ গা উত্তরাধুনিকতা, তুমার চমক আর কদ্দিন গা ?
ওয়াইপার
...সেই বর্ষার শুরু থেকে ভাবছি , চশমার কাচে একটা ওয়াইপার লাগাব, সে হয়ে আর ওঠে না । বৃষ্টিতে স্কুটার নিয়ে বেরোলেই দু'চোখ ঝাপসা, কাচ ঝাপসা, সামনে গরুরগাড়ি নাকি দশচক্রট্রাক কিছুই বোঝা যায় না, আর রাত্রি হলে তো কথাই নেই-- তখনই কথাটা মনে পড়ে । সে যাহোক, ছোটো কাকা তার চশমাতে বেশ কয়েকদিন হলো এই ব্যবস্থাটা লাগিয়েছে । দারুণ উপকারি, সেই থেকে আমাকেও উস্কাচ্ছে -- লাগিয়ে লে, তুই তো বাইক চালাস, কাজে দিবেক...। ...সুন্দর ব্যবস্থা, দুটি কাচের জয়েন্ট থেকে দুটো ছোট্টো ছো্ট্ট ওয়াইপার, কোনো ব্যাটারি নেই কিচ্ছু নেই, শুধু নাকের ফুটোর সামনে দুটো ক্ষুদ্র টারবাইন । শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সামনে পিছনে ঘোরে...ব্যাস ওয়াইপার চালু, বৃষ্টিতেও চশমা ঝকঝকে । এটা আমার ছোটোকাকার আবিষ্কার । এখনো কোনো পেটেন্ট পায়নি ।চাইনা বাজার দখল করার আগে দয়া করে বন্ধুরা জানাবেন কি কেউ, কি ভাবে পেটেন্ট পাওয়া যায় ? জিনিসটা সত্যিই উপকারি ! (পরীক্ষা প্রার্থনীয়)
( এই কথাগুলো ফেসবুকে পোস্ট করার পর বিজ্ঞানী দেবল দেব এসব কথা সত্যি ভেবে কিভাবে পেটেন্ট পাওয়া যাবে তা জানিয়ে বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছিলেন! এমন সরল মানুষ! আমি খুব লজ্জিত হয়েছিলাম।)
-----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন