শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৬

অন্ধকার, কেঁপে কেঁপে উঠছি ! :: (গৌতম বসু'র একটি কবিতার পাঠ)





অন্ধকার, কেঁপে কেঁপে উঠছি ! :: (গৌতম বসু' একটি কবিতার পাঠ)





প্রথম পাঠ :

 শ্রাবণ
অন্ধকার কেঁপে কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের প্রহারে, নিমেষের জন্য তার নত মুখের একপাশ প্রকাশিত হয়,আবার ঘন তমসা এক ভীষণ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কয়েক মুহুর্ত বয়ে যায় মেঘের পাতায়-পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে চলে আকাশের  জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরো একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে? ক্ষয়ে আসা,ভেঙেপড়া আয়ুর প্রান্তে তপ্ত পাথর ফলকের মত' এই দাঁড়িয়ে থাকা,অদৃশ্য নতমুখ তাঁর ধুয়ে যায় ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে এতদিন পড়ে থাকা দীর্ঘবিরতিগুলি,নক্ষত্র গননার কাজ! অকস্মাৎ, আরো একবার আলোর পর্বত মাথার উপর  ভেঙে পড়ে ; দৃষ্টি শক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ করেন আমায়, দেখি নিচে, বহু নিচে, রসাতল! সূয্যি দত্ত লেনের দাবার রোয়াক থেকে ডেকে উঠছি, 'বিভূতিদা বৃষ্টি আসছে!' আাঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসী ছুটে ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে, রাজেনদের পায়রার ঝাঁক একসাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজানা পৃথিবীর দিকে

                                                                                                              (কবি: গৌতম বসু : গ্রন্থ : রসাতল )

   এক তামস, সান্ধ্য,লোকান্তরের চিত্রনাট্য যা গুরুমস্তিষ্কের চারপাশে এক বলয় নির্মাণ 'রে অতি ধীরে নির্বিকল্প ধ্রুব দৃশ্যের দিকে যেতে থাকে ক্রমশ শ্বাসরুদ্ধকারী এক রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে ,দৃশ্যপরম্পরা থেকে।। 'অন্ধকার কেঁপে কেঁপে উঠছে'...থেকে  শুরু 'রে...'আবার ঘন তমসা'--পর্যন্ত এসে 'এক ভীষণ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কয়েক মুহুর্ত কেটে যায় দর্শকের/পাঠকের থমথমে অন্ধচরাচরে এক প্রত্যক্ষত দর্শকের ক্লাইম্যাক্স-আততি যেন দর্শকের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার উর্দ্ধে চলে যায় ধীর, শান্ত, টানা, ধারাবাহিক আবহ, --- চরাচর ব্যাপী এক গম্ভীর ধ্বনি প্রক্ষেপণে গুমরে গুমরে উঠি, পেটের ভিতরে এক স্তব্ধতা তৈরী হয়

মেঘের পাতায় পাতায় বৃষ্টি অস্থির, পায়ের নিচে গড়িয়ে চলে আকাশের জল; আমরা পারব কি নির্বিঘ্নে আরো একটি বজ্রপাত পেরিয়ে যেতে ?

 সংশয় গভীরতার মধ্যবিন্দুতে এসে দাঁড়াই অনির্দিষ্ট ভ্রমণের অন্তে নিরুদ্দেশ খাদের কিনারে এসে দাঁড়াই একবার কালো আদিম আকাশে ,একবার নিচে... অনন্ত খাদের গভীরে দৃষ্টিফেলে দেখি,--

ক্ষয়ে আসা ,ভেঙেপড়া  আয়ুরপ্রান্তে তপ্ত পাথরফলকের মত এই দাঁড়িয়ে থাকা অদৃশ্য নত মুখ তাঁর ধুয়ে যায় ধুয়ে যায় আমাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে এতদিন পড়ে থাকা দীর্ঘবিরতিগুলি, নক্ষত্র গননার কাজ

  এতক্ষণে এই নাট্যের এক স্পষ্ট স্থান-বর্ণনা পাওয়া গেল,--'ভেঙে পড়া আয়ুর প্রান্তদেশ' প্রথম দৃশ্যের পর এই মধ্যবিরতির কাছাকাছি পুণরায় 'তাঁর' দৃশ্যফুটে উঠল কে? কে এই ()দ্বিতীয় চরিত্র ! অন্ধকার অমাময়ী এক রহস্য ছবি, মুহুর্ত বিদ্যুৎ-ঝলকে যাঁর দৃশ্যায়ন ঘটে শুধুতাও তার নত মুখের একপাশ মাত্র,অকস্মাৎ...

অকস্মাৎ আরো একবার আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙেপড়ে; দৃষ্টি-শক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ করেন আমায়,দেখি ,নিচে,বহুনিচে, এই রসাতল!

   ...বোধহয় কিছু ঘটে গেল সংগোপনে, একেবারে শেষদৃশ্যে... অনাদি অনন্তের দোঁহে দোঁহাকার 'শরীর' ছুঁয়ে যাওয়ার মতো এই দৃশ্যের দৃশ্যহীনতা শুধু মুখরিত হয়ে ওঠে তিমির রাত্রির গাঢ়তায়,...কারণ প্রত্যক্ষত নায়ক/দর্শক এখন অন্ধ...এক পর্বত-প্রমান মুহুর্ত আলোয় তিনি স্পর্শ করেন 'আমায়'...এইখানে যুগপৎ ছলকে ওঠে আলো-অন্ধকার ...

.
এই অবধি কবিতাটি পাঠের সময়, অর্থাৎ পাঠ চলা কালীন মনশ্চক্ষে যা দেখা গিয়েছিল,--- সেই সব লিখে রাখা গেল এরপর পরের অংশ যদিও কবিতাটি সম্পূর্ণ টানা কম্পোজে ধাপহীন নিরেট গাঁথুনির মতো ছাপা, অরর্থাৎ 'পরের অংশ' কথাটি সম্পূর্ণ এই পাঠকের কল্পনা কারণ,---'...নিচে,বহুনিচে, এই রসাতল !' লিখে ফেলার পর কবিতাটি সম্পূর্ণত মোহনার মুখে এসে পড়ে তবু এর পরেও গতিজাড্যের ন্যায় একটি প্রবাহ সমগ্র মস্তিষ্ক-আধার জুড়ে অনুরণিত হতে থাকে  এবং কবিতাটি গড়াতে থাকে নিচে, ক্রমশ, অজানা পৃথিবীর দিকে...

সূয্যিদত্ত লেনের দাবার রোয়াক থেকে আমি ডেকে উঠছি, 'বিভূতিদা ,বৃষ্টি আসছে !'

  এযাবৎ সমগ্র কবিতাটির আবহ-প্রেক্ষিতে অন্ধকার যেন কিছুটা ফিকে ! যেন সান্ধ্য তামস অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসেছি,জগৎ ক্রমশ দৃশ্যমান (অনুরণণ ক্রমশ স্বাভাবিক পথেই ক্ষীণ হতে থাকে)

আঁচলের খুটে মাথা ঢেকে টুকুমাসী ছুটে ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে

আরো, আরো স্পষ্ট, প্রায় দিনের বেলার মতো ---

রাজেনদের পায়রার ঝাঁক একসাথে তীরবেগে নেমে যাচ্ছে অজানা পৃথিবীর দিকে

যেন জাতিস্মরের মুখে মোহময় আলো ফুটে উঠল 'জাতিস্মর' শব্দটিই মনে হোল, কারণ রাজেনদের পায়রাগুলি নেমে যাচ্ছে 'অজানা পৃথিবীর দিকে' এই পর্যন্ত তবুও 'বিদ্যুতের প্রহারে নতমুখের একপাশ' --- থেকে --- 'রাজেন দের পায়রার ঝাঁক' --- একেবারে অন্য এক জগৎ, অন্য আলো,যেন দুই ভিন্ন নাট্যাংশের একজন কুশীলব,যেন বা দুই ভিন্ন কবিতারি অংশ
আচ্ছা কবি গৌতম নিজে কি বলছেন? --
"ওপর থেকে ভুত হয়ে গিয়ে সে যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে মরে ভূত 'য়ে গেছে...নিচে বহু বহু দুরে তার পরিচিত পৃথিবীর দৃশ্য দেখে সমস্তই কেমন অচেনা মনে হচ্ছে আমি ভুত হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু আমার পাশে আরেক জন আছেন,যিনি ভুত নন,(...নিমেষের জন্য তাঁর নত মুখের একপাশ প্রকাশিত হয়...)কিন্তু তার বিষয়ে আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না"

                        (গৌতম বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার : বীরেন্দ্র নাথ রক্ষিত 'তিরপুর্ণি' ৫ম সংখ্যাসম্পাদক- সুদেব বক্সী)

অথচ এমনো হয়; 'তাঁকে' ঘিরেই নির্মিত হয়ে উঠছে কবিতাটি,তাঁকে ঘিরেই কবিতার সান্ধ্য আবহ,এবং তারও অধিক কবিতার তিমির-নির্মাণ...যা অকস্মাৎ সূয্যিদত্ত লেনে এসে আছড়ে পড়ে ভেঙেচুরে যায় যেন, যেন দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রান্তে ঘরে ফিরছে অভিযাত্রী দল, নেমে আসছে তারা, ঘর পৃথিবীর অতি নিকটে, চোখের সম্মুখে এসেও ভেঙেপড়ছে পরিভ্রমণ,দীর্ঘ অনুসন্ধিৎসা...

দ্বিতীয় পাঠ :

এর পরেও কিছু কথা থেকে যায় কবিমনেরগভীর অতল থেকে স্বতোৎসার প্রকাশের কোনো নিয়ন্ত্রন অন্তত প্রথম পর্বে থাকেনা,এমনটাই সত্য নির্মাণ তার পরের পর্ব কখনো ককনো নির্মাণ চলে মনান্তরালে, কখনোবা সাদা কাগজের সমক্ষে অত;পর সেই সৃষ্টি প্রতিষ্ঠা এইখানে একটি পর্বের সমাপ্তি পাঠকের সাথে যার কোনো যোগ সম্পর্ক নেই

            সুতরাং পাঠকের মনে দ্বন্দ-বিনির্মান চলতেই থাকেএইবার মনে হচছে দ্বিতীয় অংশটিই বীজ নয় তো? অর্থাৎ প্রথম অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটি মূল কবিতার প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিত মাত্র ! যেখানে কবি প্রেতের দৃষ্টিতে (ভুত হয়ে গেলে যেখানে খুশী উড়ে বেড়ানো যায় !)  অনেক উপর থেকে দেখছেন ফেলে আসা জন্মের সূয্যিদত্ত লেন,দাবার রোয়াক,হয়ত তিনি এক সময় সদস্য ছিলেন রোয়াকের,বিভুতিদা খুব স্নেহ করতেন,বৃষ্টি আসছে, তাই তাকে সাবধান করে দেওয়া টুকু মাসী অথবা পায়রার ঝাঁকের আড়ালে রাজেন নামের ছেলেটি হয়ত তার কোনো এক সময়ের সঙ্গী আর পায়রার ঝাঁকের তীরবেগে নেমে যাওয়া বহুদুরে,কবির বর্তমান অলঙ্ঘ অবস্থান থেকে নিচে,অজানা পৃথিবীর দিকে এক তমসাবৃত চিরশ্রাবণরাজ্যের ঝমঝম অঞ্চল থেকে তিনি দেখছেন  এইসব 'বিভুতিদা বৃষ্টি আসছে...'--- এই সাবধান বাণী উচ্চারণর ইচ্ছা তাঁর বায়বীয় শরীর থেকে নির্গত হতে পারছেনা,শুধু তার ইচ্ছাটুকু নিয়ে তিনি ভেসে আছেন তিনি আর অন্য একজন,যাঁকে তিনি চেনেন না বিভুতিদা,টুকুমাসী বা রাজেনের মতো তিনি আলোকিত ননবিদ্যুতের আলোয় তার নতমুখের একপাশ মাত্র প্রকাশিত হয়...অকস্মাৎ...আরকিছু নয়

তৃতীয় পাঠ:

এই পাঠ কবি তার নিজস্ব ঈশ্বরের,একান্ত , (...যাঁর নত মুখের একপাশ মাত্র প্রকাশিত, সেই রহস্যময়??)...হয়ত এই পৃথিবীর তৃতীয় পাঠকের নয়...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন