উপাসনা: গান্ধারীর আবেদন;পাঠ ২০১২
কৌশিক বাজারী
নিন্দা ! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠ রুদ্ধ করি ।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মোর পাদপীঠ তলে । দুর্যোধন পাপী
দুর্যোধন ক্রুরমনা,দুর্যোধন হীন---
নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন;
রাজদণ্ড স্পর্শকরি কহি মহারাজ
আপামর জনে আমি কহায়িব আজ
দুর্যোধন রাজা,দুর্যোধন নাহি সহে
রাজনিন্দা-আলোচনা,দুর্যোধন বহে
নিজ হস্তে নিজ নাম।
আজ তাহলে বিশ্ব ব্যাপী সেই দিন !যখন আমরা সকলেই আজ রাজা দুর্যোধনের উপাসক ! ব্যক্তি,সমাজ,দল,রাষ্ট্র প্রত্যেকেই আপন প্রেক্ষিতে দুর্যোধন। আর আমরাই পাণ্ডব,আমরাই হস্তীনাপুরবাসী, প্রত্যেকেই আপন ধ্বজা উড়িয়ে ছুটেছি...
এ এক পরম ধাঁ-ধাঁ, আমাদের প্রত্যেকের পিতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ।শুধু শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুজন পাশে নেই কারো,সঞ্জয়,বিদুর নেই,পিতামহ ভীষ্ম নেই... পরমাত্মীয় কৃষ্ণ আজ কোনো দলে নেই । এরকমই কথা ছিল তবে ...।
এরকমই কথাছিল,অযোধ্যায়,লঙ্কায়,মায়ানমারে? কথা ছিল ,খ্রীষ্টজন্মভূমি আজ ধ্বংস হবে খ্রীষ্টের নামে ? নাকি মুখরা নগরীর স্পর্ধিত রসনা দৃঢ়বলে চেপে সৃষ্টি করা হবে ত্রাস,'হিমালয় শিলা থেকে সাগর অবধি আমি ছুড়ে দিই ত্রাস/আমার কি এসে যাই,বাঁচে কি বাঁচেনা ইতিহাস...'
যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র পিত:,যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্র সনে নখদন্তে নহিক সমান,
তাই ব'লে ধনু:শরে বধি তার প্রাণ
কোন্ নর লজ্জা পায়?মূঢ়ের মতন
ঝাঁপদিয়ে মৃত্যু-মাঝে আত্মসমর্পণ
যুদ্ধ নহে।জয়লাভ এক লক্ষ তার।
অর্থাৎ,সেই কপট দ্যূতে জয়লাভ অব্যাহত আজোবধি । ইরাকে কোনো পরমাণু অস্ত্র ছিলোনা, মায়ানমারের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা কখনো সহিংস ছিলোনা, ছত্তিসগড়ের প্রশাসন ব্যতীত প্রতিটি মানুষ হত্যায় বিশ্বাসী(!) এমত মনে করার কারণ ছিলোনা। তবু,হায় হাসি,হায় দেবদারু,জয়লাভ এক লক্ষ তার...।
আরো কোথায় কোথায় জয়লাভ একমাত্র লক্ষ ? যিশু বললেন,ক্ষমা করো,ভালোবাসো। চার্চের সুউচ্চ চুড়া বললো নিচু হও,আশ্রিত হও আমার পদতলে। ঋষিগণ বললেন,অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।মন্দিরের সুগম্ভীর গম্বুজ মুখ বুজে রইলো কারুকার্যময় মিনারের দুর্ধর্ষ পতন দেখেও...আতংকে চিৎকার করে উঠল নষ্টমাতৃভ্রূণ--- মাতা--মাতা--মাতা...
এই বার মাতা গান্ধারীর প্রবেশ ঘটবে কি মঞ্চে ? নষ্ট অন্ধ পিতার সামনে বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝার মতো, আলুথালু...
ধর্ম নহে সম্পদের হেতু
মহারাজ,নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু;
ধর্মেই ধর্মের শেষ।
ধর্মেই ধর্মের শেষ ? আর কিছু নয় ?
এগারো বছরের বালিকাটি জানতোনা সে কথা । এমন কি ধর্মের শুরু কোথায়, কোন পৃষ্ঠায়,কিতাবে,সে সবও অজানা ছিল তার। শুধু শরীরে গোপন রোগের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় তার দিন গুজরান, পাকস্থলীর খিদে আরো বেশী শীর্ণ করে তাকে। বহু কষ্টার্জিত দুর্মূল্য সুষম দুধ টুকু বল্কে নিতে জড়ো ক'রে এনে ছিল ছেঁড়া খোড়া টুকরো কাগজ, কাগজে মুদ্রিত ছিল কোরান-শরীফ !!
এতোই সাহস,সে সবও অজানা ছিল তার?
বোঝেনি সে ধর্মেই ধর্মের শেষ নয়, তাই দুধ নয়,মুখে তার ধর্ম-রক্ত উঠে আসে ঝলকে ঝলকে...।
অন্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্র বিকার গ্রস্তের মতো চিৎকার করে ওঠে --
--অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন,তোরে লয়ে প্রলয় তিমিরে
চলিয়াছি ; বন্ধুগন হাহাকার রবে
করিছে নিষেধ ; নিশাচর গৃধ্রসরে
করিতেছে অশুভ চিৎকার ; পদে পদে
সংকীর্ণ হতেছে পথ; আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর;
..........
নাই সম্মুখের দৃষ্টি,নাই নিবারণ
পশ্চাতের,শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের ?
ধর্মেই ধর্মের শেষ নয়। রাজধর্ম আর গণরাষ্ট্ররধর্ম এক নয়। তাই ধর্মের বোমারু বিমান উড়ে আসে দর্শন বাহিত হয়ে । সেই মুদ্রিত দর্শন বলে ; সাম্রাজ্যের মুদ্রানীতি চাঙ্গা হলে, তার ঝরে পড়া প্রসাদের নিচে হাত পাত' ।
একে বলে রাজধর্ম !
সেই চুঁইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রাজ-প্রসাদে যদি না ভরে পেট,বুক,যদি ধর্ম এসে না দেয় সান্ত্বনা, যদি বুভুক্ষু শীর্ণ প্রজা হাতে তুলে নেয় প্রতিঘাত, যদি রাজ-ধর্ম, রাজ-নীতি শাসকের লৌহ পোশাকের নিচে অন্ধকারে পিচ্ছিল ঘর্মাক্ত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়.... তবে শ্বাপদের প্রশ্বাসে জেগে ওঠে দুর্যোধন...
পিছনে অন্ধ পিতা সেই প্রশ্বাসের শব্দ শুনে যুগপৎ পুলকিত - শিহরিত হয় ---
নাহি জানে
জাগিয়াছে দুর্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন,
ঘনায়ে এসেছে আজি তোদের দুর্দিন।
রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়
ঘনিষ্ঠ কঠিন। দেখি কতদিন রয়
প্রজার পরম স্পর্ধা-- নির্বিষ সর্পের
ব্যর্থ ফণা আস্ফালন, নিরস্ত্র দর্পের
হুহুংকার ।
একটি সম্পূর্ণ বিশ্বদেশ, একটি পরিপূর্ণ কাল, এক অমোঘ তমসার দিকে ডুবে যাচ্ছে... এই টালমাটাল কালখণ্ডে এক অন্ধপিতা তার অন্ধ স্নেহ নিয়ে ধরে আছে হাল... অনির্দেশ,
আমরা তার অক্ষম সওয়ারী...
রাজদণ্ড, অর্থনীতি , দম্ভ আর ক্ষমতার অতি-সরল আবর্তে ধর্ম এক মুমূর্ষু শশক , তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।প্রাণ ভয়ে ভীত সে নিজেই । অস্তিত্ব সংকটে জীর্ণ সে জানে 'ধর্মেই ধর্মের শেষ' নয় ।
তার গুহ্য দ্বারে রাজদণ্ড, আমূল-মুদ্রা তার ধরে আছে ঝুঁটি...ক্ষমতার দম্ভে তার বাক রোধ হয়ে গেছে কবে।
যেদিন মাতা কে নিক্ষেপ করা হল আগুনের মাঝে , মাটিতে কবর হল তার,সেই দিন শুরু,সেই অতীত, প্রতীক, রূপক সব খাঁ খাঁ খুলে গেছে আজ ।আর কোনো পর্দা নেই, আব্রু নেই,ধর্মের বিকৃত ক্লোন আজ ভয়ংকর অট্টহাসি হাসে...প্রাচীন প্রবাদের মতো আজো ধর্ম এক গুঁফো মাস্তান...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন