শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৬

।। পুণ্য-তীর্থে আলোক-স্নান ।।




।। পুণ্য-তীর্থে আলোক-স্নান ।।
           কৌশিক বাজারী


1.     টেলিফোনে কথপোকথনঃ শুক্রবারঃ বিষ্ণুপুর
..........................................................
-- আলোকদা, আগামী রবিবার কলকাতা যাবো, একটু সময় পাবো হাতে, আপনার সেদিন যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তাহলে আপনার বাড়ি যেতে পারি যাবো ?
- আরে হ্যাঁ হ্যাঁ অসুবিধে তো নেই- তুমি এসো, ভালো লাগবে (দু'জনে তো থাকি, নির্জনতা বন্ধু...) আমার বাড়ি চিনতে পারবে ?
-সুদেবদাও (সুদেব বক্সী) যেতে পারে সঙ্গে...
-  হ্যাঁ , সুদেব সুদেব বড় ভালো ছেলে, ওর বইটা (অভ্র আবীর) পেয়েছি,খুব ভালো হয়েছে, …এসো, তোমরা এসো...
রবিবারঃ বালীগঞ্জ ষ্টেশন
সুদেবদা বালীগঞ্জ ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে একমনে বিপুল বালুকা রাশির মধ্য হইতে চেনা বালুকণাটি কে খুঁজছিলেন হয়ত, আমি হাত নাড়লাম...
আমি  - সাড়েবারোটা বাজে,পৌঁছতে পৌঁছতে একটা বাজবে ওনারা কখন খেতে বসেন ,সুদেব দা ?
সুদেবদা  - আর বোলোনা, আমি ফোন করেছিলাম,বৌদিই (কবি-জায়া)ধরলেন, একরকম ভালই হল,সরাসরি জিজ্ঞেস করেনিলাম -- 'বৌদি আপনারা কখন খেতে বসেন ?'
আমি  - ইস্, একটা বিচ্ছিরি সময়ে গিয়ে পৌঁছব...
সু  - বললেন , ' আড়াইটের মধ্যে বসে পড়ি'আমি বলেছি ,একটু অসময়ে গিয়ে পৌঁছব,একটা-দেড্ডা হবে আমাদের',বললেন, 'আরে, এসোই না,...
৩৪,নন্দীবাগান,হালতু, ১২,,২০১২ দুপুর একটা
'যে বাড়িতে এসেছি
সে বাড়িতে এই আমার প্রথম আসা'
--আলোক সরকার
(কবি-জায়া দরজা খুললেন)
সু  - কেমন আছেন বৌদি...
-- আরে এসো এসো, তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন উনি (আমি , সুদেবদা, চরণ স্পর্শে উদ্যত হলে উনি নিরস্ত করলেন, গ্রহণ করলেন ) একটা ডাবল,দুটো সিঙ্গেল,কাঠের সোফাছোট্টো কাচ ঢাকা টেবিল মাঝখানেসামনের দুটো কাঠের সেল্ফে সুন্দর ভাবে গোছানো বই পত্র-পত্রিকাবেশ কিছু স্মারক, সবই কোনো ছোটো-পত্রিকা গোষ্ঠির সম্মান স্বরূপ...সবই সুন্দর গোছানো ! আমি বিস্ময় প্রকাশ করে ফেললাম,--এতো সুন্দর গোছানো ! সুদেবদা বলল, সবই বৌদিই করেন...বুঝলাম, গেরস্থালী জোড়া প্রেমময় করস্পর্শ...
কবি এলেন একে ঠিক 'প্রবেশ' বলা যাবে না দেয়াল ধরে ধরে .ঈষৎ কম্পিত পদক্ষেপে, প্রায় ভেসে ভেসে এসে পৌঁছলেন তিনি আমি আর সুদেবদা ডাবল্ ,উনি সিঙ্গেলের একটায় বসলেন মনে হল তাঁর 'আবির্ভাব' ঘটল
... ... ...

   কথা কিভাবে শুরু হল মনে নেই কোন কথা থেকে কোন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছে কথার সূত্র, সেও উদ্ধার অসম্ভব --ধরা আছে শূন্যতায়, নিরাবয়বে, যা আলোকদার নিজস্ব দর্শন

  তিনি বললেন,-- বিষয়-হীনতাই কবিতা ! কবিতার আবার বিষয় কি ? সামাজিক কবিতা,ধর্মীয় কবিতা,ঐতিহাসিক কবিতা,...এসব হয় নাকি ? এই যে সমাজ-রাজনৈতিক মানুষের চাওয়া-না পাওয়া, অপ্রাপ্তি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ --এসব প্রবন্ধের বিষয় হতে পারে, হয়ও কবিতায় এসব কেন ? কবিতা অন্যকিছু, এসব নয় অথবা দার্শনিক কোনো তত্ব! তাই বা কবিতা হবে কেন বড় জোর 'বাণী' বলা যায় তাকে কবিতা হল তাই, যা সমকাল কে স্পর্শ করে থাকবে না
   
    আমি আমার মত 'রে বুঝলাম বুঝলাম,কবিতা সমকালকে অতিক্রম 'রে কিভাবে মহাকালের অংশ হয়ে যায় কবিতায় মহাজাগতিক আলো কোনো বিষয় নয়, কবিতাই মহাজগৎ আবার কবিতাই মহাকালচক্র, মহাকালের রস নির্যাস সব কি বুঝলাম...! আবেগ নিয়ন্ত্রিত আবেগ কিভাবে কাব্যের মধ্যে এসে পড়ে...! বিষয়ের থেকে শুরু 'য়ে কিভাবে বিষয়কে অতিক্রম করে ছুঁয়ে ফেলে অরূপ...!

বললেন--- এই যে কত মানুষ,তাপিত, শোকগ্রস্ত, সন্তানহারা কেউ,...শোক মানুষকে আবেগ তাড়িত করেছে, আবেগের কারণ একটি বিষয় কিন্তু বিষয় কবিতা নয় এক দশরথ রাজার পুত্র শোক ! ছেলে বনবাসে চলে যাচ্ছে, সেই শোক মানুষ হাজার হাজার বছর মনে রেখেছে সে কি বিষয়ের জন্য ?               না কাব্য ! সেই মহাকাব্য মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে, স্থায়ী হয়েছে...
"রবীন্দ্রনাথ অকাতরে লিখে গেছেন কত নাম, কত ব্যক্তি, তাদের ধরে ধরে একখানা করে কবিতা লিখেছেন, লিখতে হয়েছে, যে বিবেকানন্দের সঙ্গে আজীবন ব্যক্তিত্বের সংঘাত, তাকে নিয়েও লিখেছেন একটি কবিতা এসব কিছুনা পড়লেই বোঝা যায়

   ... অথচ দেখো, -- 'গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা...'সোনার তরীপড়েছো...'কবিতা' পত্রিকায় তুমুল বিতর্ক, আলোচনা...এই কবিতার তত্ত্ব কি ? দর্শন কি ? --- তা রবীন্দ্রনাথ কি বললেন ! বললেন, --এতো বর্ষার রূপ,বর্ষা-প্রকৃতির কবিতা হিসেবেই একে দেখা ভালো...
অর্থাৎ আবার সেই 'অপ্রমাণের' খেলা,আবার সেই 'অনির্দেশ' যা কথার সূত্রে রবীন্দ্রনাথে এসে পৌঁছল...



নিস্তব্ধতা বিষয়ে আমার যা কিছু বলা
সবই বিরুদ্ধ পক্ষের বলা
নিস্তব্ধতা স্বার্থপর হতে শেখেনি
নিস্তব্ধতা নিঃস্বার্থ হতে শেখেনি
যা কিছু স্বার্থপর নয়নিঃস্বার্থ নয়
তাকে ভয় পাই
সে বড় ভয়ংকর নিঃসম্বল
গাছ মাটির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে--
গাছ নিজেকে প্রমাণ করে
যা কিছু নিজেকে প্রমাণ করছে না
যা কিছু প্রমাণিত হবার অবকাশ নেই
যা কিছু কেবল একটা থাকা,--একটা বর্তমান
তার মতো স্বর্গ মর্ত জোড়া হাঁ আর কার
     
        --- অপ্রমাণ, নিভৃতলোক আলোক সরকার

   "একবার দাদা (অগ্রজ,কবি অরুণ কুমার সরকার) এসে বললো,,তোর কবিতা পড়ে বুদ্ধদেব বসু কি বলেছ শোন ,বলেছে ; 'আলোক সরকারের কবিতা পড়ে আমার একটি স্নায়ুও উত্তেজিত হয়না ' আমি বললাম, 'শুনে খুশী হলাম,আমিতো বুদ্ধদেব বসুর জন্য কবিতা লিখিনা ...'"
--এই হল সেই সমকাল বুদ্ধদেব বসু=তৎকালীন সমকাল
যে সমকালের থেকে তিনি বরাবর দূরত্ব রচনা করেছেন তাঁর কবিতায়,জীবনে 'জীবনশব্দ টি সচেতন ভাবেই বলা তাঁর আত্মজীবনী 'জ্বালানী কাঠ জ্বলো' সেই সমকাল কে অস্বীকারের এক দীর্ঘ-কাব্য,যাপিত জীবনের ভাষ্য মাত্র নয় দোর্দণ্ড প্রতাপ 'কবিতা' পত্রিকার সমকালীনতা থেকে দূরে 'রচনা' করতে চেয়েছেন 'শতভিষা'

   একটি উদ্ধৃতি : বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা ,যার প্রতি তৎকালীন তরুণ কবিদের শ্রদ্ধা এবং আস্থা গভীর ছিল সেই সময় তা- আর নতুন কবিদের কাব্য ভাবনা এবং কাব্য কলা বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিল না, সেই সময়কার তরুণ কবিদের কবিতার সংকলন 'সমকালীন বাংলা কবিতা' সমালোচনায় নতুন যুগের সঙ্গে 'কবিতা' পত্রিকার ব্যবধান স্পষ্ট হয় অবশ্য তরুণ কবিরা অনেকেই 'কবিতা' লেখক ছিলেন, এমন কি 'শতভিষা' যে সমস্ত তরুণ কবিদের রচনা প্রকাশে আগ্রহী ছিলো তাদের লেখাও মাঝে মাঝে প্রকাশিত 'তো 'কবিতা'য় কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' সেই সেই ধরণের কবিতা বিষয়েই পক্ষপাত প্রমাণ করতো যা তিরিশের দশকের কবিদের- প্রতিধ্বনি, নতুন কোনো কাব্য আন্দোলন যে শুরু 'তে পারে এমন ধারণা 'কবিতা' পত্রিকার ছিল না এই অবস্থায় 'শতভিষা' যা আধুনিকতাকে প্রবহমান অর্থেই একদিক থেকে গ্রহণ করেছিল, তার প্রকাশ যে বিশেষ প্রয়োজনের ছিল যেটা বুঝতে পারা যায়
-আলোক সরকার ('শতভিষা' রজত জয়ন্তী বর্ষ, ১৩৮৩ সংখ্যা 'দাহপত্র' পত্রিকায় আংশিক পুনর্মুদ্রিত অংশ থেকে)

প্রসঙ্গ অন্যান্য  -
আমি  - আলোক দা,টেলিফোনে আপনার কণ্ঠস্বর অনেক তরুণ ...
আলোক সরকার  -হ্যাঁ , আমিতো তরুণই নই কি ...? (হাসি)
আমি  - বিষ্ণুপুরে একজন কবি আছেন ,জানেন, বিকাশ দাস? তিরাশি বছর বয়স হল তিনি এখনো মাঝে মাঝে, কোনো বিকেলবেলা, কাঁধে ঝোলা নিয়ে উপস্থিত 'য়ে বলেন ,--চলো কৌশিক ,তোমার স্কুটিতে চড়ে জঙ্গল বেড়িয়ে আসি, দ্বারকেশ্বর নদ দর্শন করে আসি...
..  - তাই নাকি !... আচ্ছা, বিকাশ দাস বিষ্ণুপুরে থাকেন ?
আমি  - হ্যাঁ, ওখানকারই মানুষ...
..  - হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় একবার আটখানা কবিতা ছাপা হয়েছিল, মনে আছে উনি আমার একজন পছন্দের কবি খুব ভালো লেখা ...অনেক পরে 'অনুবর্তন' 'তিরপুর্ণি'তে ওঁর কিছু লেখা পড়ে ছিলাম
সুদেবদা  - তিরপুর্ণি' প্রথম সংখ্যায় একটা বড় গুচ্ছ ছিল,'আড়ালে থাকা বিশিষ্ট কবিদের নিয়ে ', তারপরেও...
..  - এখন আর লেখেন না কেন ?
আমি  - লেখেন তো , রোজই লেখেন ...
..  - দেখিনাত, ছাপাতে চান না ?
আমি  - না না তা নয়, চাইলেই দেন
সুদেবদা  - আসলে কলকাতার সম্পাদকরা তো খোঁজও পান না সেভাবে,উনিও সে ভাবে এগিয়ে আসেন নি কখনো,আর এই বয়সে...
..  - ঠিকই তো , ঠিকইতো...
সুদেবদা  - কৌশিকের 'মিরুজিন' পত্রিকায় ওঁর 'দেশ রাগে বাজো' নামে একটি সংকলন কাব্যগ্রন্থের আকারে ছাপা হয়েছে ...
..  - হ্যাঁ, হ্যাঁপড়েছিতো, খুব ভালো কবিতা ... ... দেশ পত্রিকায় একবার ওনার একটি চিঠি ছাপা হয়েছিল, সে বহু দিন হল , আমার মনে আছে এখনো, সেখানে উনি আমার নাম উল্লেখ করেছিলেন ...
আমি  - কত বছর ? মানে আপনার তখন কত বয়স হবে ?
..  - বছর তিরিশ বয়স হবে তখন আমার আমি ভাবলাম, দেশ পত্রিকায় প্রথম আমার নাম ছাপা হল, তাও একজন অন্য কবির চিঠিতে (হাসি)...এই ভাবে মনে রয়ে গেছে বিষয়টা...
(কবি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন, তারপর...) ...নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের খবর শুনেছো তো...খুবই অসুস্থ...এতো ভালো মানুষটা...এতো বড় মন...তার কবিতা পড়ে দেখো... বোঝা যাবে সব... অথচ চিরকাল আড়ালেই রয়ে গেলেন...কেউ তো যোগ্য সম্মানটুকু জানালো না... অথচ এতো এতো পুরস্কার, চারিদিকে ছড়াছড়ি...কেউ তো ডাকতেই পারতো... কখনো ডাকেনি...
আমি সুদেবদা  - আসলে ,আলোকদা, এসব পুরস্কার, দাতা গ্রহীতা, সবের পিছনে প্রায় অনেক সময় যা থাকে,সেই চিরাচরিত বিভাজন, লবি,'তুমি কোন দল'--এসব এখন সবাই জানে...
..  - (একটু গলা তুলে, ভেতর ঘরে কবি-জায়ার প্রতি) এই, তুমি কি ফ্রি রয়েছো? বইটা এক কপি এনতো কৌশিক, তুমি তো পড়নি, তোমাকে দেব...নিভৃতলোক
আমি  - আলোকদা, বই এর প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে,তখন আমি একাদশ শ্রেণীর ছাত্র একবার , একবারইসজ্ঞানে  চুরি করেছিলাম...
..  - ... ???
আমি  - একটি কবিতার অনুষ্ঠানে, তাদের বই-এর স্টল ছিল, সেখান থেকে একটি মোটা বই চুরি 'রে ছিলাম...
..  - ...???
আমি  - 'আলোক সরকারের কবিতা সমগ্র'
..  - কোন খণ্ড ?
আমি  - সম্ভবত, দ্বিতীয়...
সুদেব দা  - তাই নাকি !(হাসি) কোথায় ? কাদের স্টল ?
আমি  - বাঁকুড়ায়, 'কবিতা পাক্ষিকের' বার্ষিক অনুষ্ঠানে ...
(সকলের হাসি)
আলোক দা  - বই চুরির মধ্যে কোনো পাপ নেই আমরা তো কত ভাবে বই চুরি করি... পড়তে নিয়ে ফেরৎ দিই না... এই নাও 'নিভৃতলোক' দেখো,আমার হাতের লেখা কেঁপে যাচ্ছে সিগ্নেচার কিন্তু ঠিক আছে, তাই না...!!!
(কবিস্পর্শময় কাব্যগ্রন্থটি শ্রদ্ধায় গ্রহণ করি উঠে দাঁড়াই আমি সুদেব দা অনুমতি নিই আলোকদারকাছে আড়াইটে বাজে এতক্ষণ কবি-দম্পতি কে অভুক্ত রাখার জন্য মার্জনা চাইনি আর যখন উঠে আসছি, আশি -উত্তীর্ণ কবির চোখ কোনো অজানা শ্রান্তিতে বুজে এসেছিল-তিনি সে অবস্থায় ঘাড় নাড়লেন )
--এসো ভাই
--প্রণাম...
[এই রচনার সকল সংলাপ আপন পারম্পর্য বজায় রেখেছে সর্বদা তা বলা যাবে না হয়তো টেলিফোনে কথোপকথনের কোনো অংশ কবি-কক্ষে হয়ে ছিল ,অথবা কঅবি-সম্মুখে বলে যে কথা লিখিত হল তার কোনো অংশ হয়তো ফিরে আসার পর টেলিফোনে ...অর্থাৎ এই রচনা কোনো সাক্ষাৎকার নয়,বরং বলা ভালো ,--- তীর্থ দর্শনের গাল-গপ্পো...,আর তীর্থযাত্রীরা যে মিথ্যাচারের পাপ করেনা সে কথা তো পুরাণ-সিদ্ধ ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন