শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

উজানি কবিতা : ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা (কবি গৌতম চৌধুরীর কবিতার পাঠ)




উজানি কবিতা : ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা  (একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া)

(কিছু দিন পূর্বে এক কর্মপোলক্ষে কলকাতা সহরে গিয়ে টেলিফোনে অগ্রজ কবি গৌতম চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি টেলিফোনে তাঁর বাড়ির সহজ পথ, বাস, রুট পথের নাম ইত্যাদি বলে বলে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন উত্তর-কলকাতা থেকে হাওড়ায় তাঁর বাড়ি যাওয়া কতটা জলবরাবর। আর আমার মাথা ততই গুলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ঠিক হল রবীন্দ্রসদন, ঐ জায়গাটি আমার পূর্ব পরিচিত। এবং সেদিন বিকেলে তাঁর ক্ষীণ কন্ঠ এবং আমার প্রায় বধির বাঁমকর্ণের  ও কলকাতার ভীড়ের অপূর্ব কলকাকলির মেলবন্ধন সহ সেদিনের চা-চক্র প্রায় চক্রান্তে রূপান্তরিত হলেও এক সুন্দর বিকেল অতিবাহিত হয়েছিল । পরে বাড়িতে ফিরে দেখা গেল তিনি আমায় যে সব উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সদ্য প্রকাশিত এই বইটিও রয়েছে।–“উজানি কবিতা)




কালান্তক, কেন মেল গ্রাস
      এ-জীবন বড় ক্ষুদ্র                আদি অন্তে নাহি সূত্র
বহে কাল মহা রুদ্র
নিরখিয়া মনে লাগে ত্রাস
...
   ... আমি  আশ্চর্য হয়ে পাঠ করি আর দেখিপ্রতিটি উজানি কবিতার ভেতর এক তৃতীয় সম্ভাবনা রুদ্ধ রয়েছে ।  যে সম্ভাবনা প্রকৃতার্থে অসম্ভাব্যের শিল্প । যেমন প্রতিটি জগত-অণুর মধ্যে রয়ে গেছে ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা। সেই খবর জগত অথবা অণুর গোচর নয় কখনো। আর এই সমগ্র বিশ্ব-জগতও তো সেই অসম্ভাব্যের শিল্প মাত্র। যা হওয়ার ছিলো না, যা হওয়ার কথা কোথাও লুকানো ছিলো না, অথবা যা হয়ে ওঠাই ছিল একমাত্র নিয়তি, তাই অসম্ভাব্যের শিল্প! কে আমার পিতা-মাতা, কে আমার সন্তান? কেন তারা আমারই পিতা-মাতা-সন্তান, আমায় কে বলে দেবে ? জগত মূলত তাই...    
   একদিন একটা ধূমকেতু সূর্যের শরীর ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ব্রহ্মা তাঁর বাঁমহাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নেওয়া সূর্যের খানিকটা ছিনিয়ে আনলেন। সে-ই আমাদের সৌর জগত! সেখানে একটা অতি সাধারণ টুকরো তিন নম্বর স্থানে তার জায়গা করে নিল। সূর্যের আলো উত্তাপ রোদ শৈত্য সমস্ত মিলে সেখানে একটা অশ্চর্য রামধনু তৈরী করল। আর সে নিজে সাড়ে ছেশট্টি ডীগ্রি হেলে রইল, জল বাতাস মেঘ মাটি আর মহা সমুদ্র তৈরী করল। সেই অতি সাধারণ খণ্ডটি আর সাধারণ রইলোনা! কেন? এই হল সেই অসম্ভাব্যতার শিল্প। এসব না হলেও চলত, তবু হল...।
  উজানি কবিতাগুলিতেও রয়েছে সেই তৃতীয় মাত্রার ইঙ্গিত। কবি ও কবিতা নিরপেক্ষ এক অসম্ভাব্যতা, যা সূক্ষ্ম ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠ।

    উজানি কবিতা একটি কাব্যগ্রন্থের নাম। সেখানে একাধিক অধ্যায় রয়েছে। যেমন একটি অধ্যায়--ও মাঝি, সুন্দর মাঝি। কোনো এক মাঝি কে উদ্দেশ্য করে রচিত এই কবিতাগুলি যখন আমরা পাঠ করি, তখন মনে প্রশ্ন জাগেকে এই মাঝি? দুর্গম গিরী কান্তার মরুর সেই কান্ডারীই কি এই ছদ্মবেশী আপাত শান্ত সুন্দর মাঝি? নাকি সে অন্য কেউ অন্য কোনো আকাশগঙ্গার দেশের চির রহস্যাবৃত কোনো নাও-এর আঁধার নাইয়া ? পাঠমাত্র দ্বন্দ তৈরী হয় । দ্বন্দ সঙ্গত কারনেই, কারন উজানি কবিতার কবি আমাদের পূ্র্ব পরিচিত গৌতম চৌধুরী। যেহেতু জানি সেই অমায়িক, শান্ত, ক্ষীণকণ্ঠী সত্তর দশকীয় ঋজু শালবৃক্ষের ন্যায় কবিটিকে। যিনি একদা বাংলা সংস্কৃতির জগতে বিপ্লব ঘোষণা করেছিলেন। এবং তাঁর সতীর্থরা অনেকেই কালের স্রোতে নানান চরভূমিতে ঠেকে গেলেও যিনি আজো সমভাবে সঞ্চরণশীল এবং গতিময়। তাই তার উজানি কবিতা পাঠ কালে তাঁর পূর্ব পরিচয়ও মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে মানসপটে।  এবং কবিতাগুলি আমাদের এক চরম ও এক অন্যতর পরম প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় কখনো কখনো।

...
সপ্তঋষি ফেলে ছায়া      ভাসে নৌকা মহা মায়া
সুন্দরিয়া মাঝিরে বোলাই
ওগো মাঝি, ও অপার     লুক্কায়িত কেন আর
দেখা দাও, জ্বালো দিয়াশলাই
জ্বলাই গোপন টেমি    কেঁপে ওঠে চক্রনেমী
সেই ঘোর আবর্তে ঝাঁপাই
এই হল সেই পরম দ্বন্দ! একদিকে ঐ-- সপ্তঋষি ফেলে ছায়া / ভাসে নৌকা মহা মায়া / সুন্দরিয়া মাঝিরে বোলাই / ওগো মাঝি, ও অপার...  এই অপারের হাতছানি ।
      অন্যদিকে আবার মাঝি যেন এই পৃথিবীর মাটির ঘরের কোনো মুশকিল আসান মানুষ। যে আমাদের পথ দেখাবে অন্ধকারে --    লুক্কায়িত কেন আর / দেখা দাও, জ্বালো দিয়াশলাই / জ্বলাই গোপন টেমি  /  কেঁপে ওঠে চক্রনেমী...   এই যে গোপন টেমি, এই যে দিয়াশলাই, এই যে চক্রনেমীর কেঁপে ওঠা, আর সেই ঘোর আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়া, আমাদের আরো কিছু প্রতীক ও অন্যতর কথা অবচেতনে মনে পড়িয়ে দেয় ।  মনে পড়িয়ে দেয়ইনি গৌতম চৌধুরী। সামাজিক সাম্যের দর্শনে বিশ্বাসী কবি ! তাই কি সর্প্তষির জিজ্ঞাসা ছাড়িয়ে, মহা তরঙ্গের দিকে নৌকা ভাসাতে গিয়েও তাকে ছেড়ে যায় না এই মহা মায়ার মতো প্রতীকগুলি ?

ভুলিনি কিছুই, ভুলে গেছি শুধু ইচ্ছে  
পেরিয়ে এসেছি দোজখের আভা মহাথির অণুবিশ্বে
চিনেছো আমায়?’—প্রশ্নের ছায়াগুচ্ছ
ঝরে গেছে ভাঙা মিনারে-দেউলে, তবু মৃদঙ্গ উচ্ছল
তবু সুড়ঙ্গ ছুঁতে চায় মহাপ্রান্তর...
  
    এই রচনা একান্তই পাঠপ্রতিক্রিয়া, কোনো আলোচনা নিবন্ধ নয়। একটি গ্রন্থ পাঠকালে মনান্তরালে যে আলো-ছায়া খেলে যাচ্ছিল, তার লিপিরূপ মাত্র।
    মনে হচ্ছে বহু দিক থেকে ঘুরে ফিরে এই গ্রন্থের কবিতাগুলির অবলোকন প্রয়োজন। যেমন কোনো প্রাচীন স্থাপত্যের, তার শরীরের কারুকাজ গুলির ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। কোথাও মাথা ভাঙা কোনো যক্ষীর মূর্তী আমাদের এক যুদ্ধ-ইতিহাসের কথা বলে, আবার কোথাও মানব মানবীর রমণ দৃশ্যে বিহ্বল হয়ে পড়িসেই রকম এক স্থাপত্য। যা বিমূর্ত, অক্ষরে মাত্র রচিত। এইভাবে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে আমরা মূল স্থাপত্যের কিছু দূরে এক বিমূর্ত প্রশ্নের নির্জন ভগ্ন চাতালে এসে দাঁড়াই। যার সাথে এই কাব্য-স্থাপত্যের হয়তো কোনো আপাত সম্পর্ক নেই। অথবা হয়তো কখনো ছিল...। শ্রেণী-সংগ্রাম যদি মানব প্রেমের একটি রূপভেদ মাত্র হয়, তাহলে ভারতীয় তথা প্রাচ্য আধ্যাত্মবাদ থেকে তা কতখানি দূরের পথ? নাকি একই লক্ষ্যের ভিন্ন পথ মাত্র? সেই প্রশ্ন
   জানি এটি একটি জতিলতম বিষয়। প্রশ্ন সেখানেই। কে এই সুন্দর মাঝি? তিনি কি কান্ডারী হুসিয়ারের কান্ডারীমাত্র, নাকি এই মহাশূন্য, মহাকাল, মহাকালসমুদ্রের ওপারে বসে থাকা আকাশগঙ্গার কোনো ভৌতিক (ভুতুড়ে নয়) কান্ডারী ?
   কেন এইরূপ প্রশ্ন? প্রশ্নের উপর প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মার্ক্সীয় মানব মুক্তি আর আধ্যাত্মবাদকে আমরা বরাবর দুটি ভিন্ন মেরুতে রেখেই অবলোকন করেছি। আর এদুটিকে মিলিয়ে ফেললে, গুলিয়ে ফেলা হয় বলেই জেনেছি। অথচ একটা বিষয় আমরা খেয়াল করিনি একদিকে লড়াকু মানব মুক্তি ও অন্যদিকে রমেন্দ্র সুন্দর কথিত ভারতীয় সূর্যাস্ত থেকে আত্মা বা স্পিরিট টুকু সরিয়ে নিলে যা পড়ে থাকে তা একই বস্তু, যা মূলত স্বার্থান্বেষী অনুশাসন মাত্র।
   অজাতশত্রু রাজা হল যবে পিতার আসনে আসি সেদিন কিভাবে পিতার ধর্ম শোনিতের স্রোতে মুছিয়া ফেলিল রাজপুরি হতে সেই কাহিনী আমরা জানি। বৌদ্ধ শ্রমণেরা মার খাচ্ছে, তাদের জীবিত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশি আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। স্তূপ ভেঙে জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে মন্দির। আর শ্রমণেরা টুঁ-শব্দটি করছেন না। এই স্তব্ধতাই প্রতিবাদ, --আত্মা, জেন, স্পিরিট...।
  কিশোর ক্ষুদিরামকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে স্নান করানো হচ্ছে। খাবার দেওয়া হচ্ছে। ওজন নেওয়া হচ্ছে। আর আশ্চর্য ভাবে লক্ষ করা হচ্ছে তার ওজন বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। তার মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, আর সে বলছে মনে মনে—‘মা আবার ফিরে আসবো তোর কোলে...।---আত্মশক্তি, স্পিরিট...
   আবার দেখা যাচ্ছে বলিভিয়ার জঙ্গলে একদল বিপ্লবী আত্মগোপন করে আছে। গ্রামাফোন শোভিত সুখীগৃ্হকোন ছেড়ে, রবিবারের মদ ও নিরুপদ্রব মাংসের জলসা ছেড়ে, পিতা মাতা স্ত্রী কন্যা এবং সংসারের যাবতীয় সুখের বালিশ ছেড়ে তারা কাঁটার উপর শুয়ে  আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে...কেউ তাদের জোর করেনি যদিওকি বলবো একে? স্পিরিট ছাড়া?

গিলে ফেলি দিন রাত্রিও করি পান
কামড়ে কামড়ে, চুমুকে চুমুকে, তাবৎ
ভাঙা হাড় গোড় ফেরি করি, সেরিবান
রক্তের মেঘে তবু জেগে ওঠে শ্রাবণ

অথবা

এই কি তবে সফর নামার নিরেট প্রাপ্তি
নীল আঁধারের ঝরনাধারায় রুদ্ধ
তবুও শূন্য খোঁজার ছলে শূন্যে লাফ দিই
হয়তো উড়াল মহাপাতাল অবধি

  এ শুধুই ভোগ অথবা দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ থেকে উৎসারিত যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না । যা অপরের জন্য, সত্যের জন্য মৃত্যুকে পর্যন্ত উপেক্ষা করতে শেখায়। জীবন উজ্জ্বল, উজাগর হয়ে ওঠে।
   উপরোক্ত কথা গুলি বার বার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে এলো উজানি কবিতার স্থাপত্য শৈলীর সামনে বসে থেকে। যা শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র এই জীবন থেকে এক মহাজীবনের দিকে, এক অনু থেকে এক মহাবিশ্বের (আক্ষরিক অর্থেই, মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের মাঝের যে কোনো শূন্য কালো বিন্দুটিও যে লক্ষতারার সমাবেশ, তা এই ক্ষুদ্র যতি চিহ্নের মতো মানব জীবনে বার বার ভুলে যাই) দিকে কেবলি যেতে চায়, আমাদের নিয়ে যেতে চায়।
      এ-জীবন বড় ক্ষুদ্র                আদি অন্তে নাহি সূত্র
বহে কাল মহা রুদ্র
...

   উদাহরণত, যে কোনো পাতা উল্টে যে কোনো রচনা পাঠককে পড়ানো যেতে পারে, আর কিছু নয়--

দুখানি বলদ ছুটে চলে যতিহীন
একটি আমার অমোঘ রাত্রি, অন্যটি ভাঙা দিন
সাথ কেঁদে মরে দুটি ঘুরন্ত চাকা
অমাবস্যার গহন আমার, আমারই পূর্ণ রাকা
অনন্ত ঘুমে নিচে শুয়ে আছে পথ
সে বুঝি আমারই শয়ন মুদ্রাসন ধেকে সংবৎ
গ্রাম অরণ্য প্রান্তর নদীতীর
চলেছে শকট স্বপ্নে আমার উন্মাদ গম্ভীর
সঙ্গে চাবুক, লণ্ঠন, চিড়েগুড়
যা-কিছু আমার শৃঙ্খল আর মুক্তির অঙ্কুর
সবই আছে, তবে আরোহীটি কিনি বটে ?
কেউ নেই শুধু ছইয়ের আড়াল, কিংবদন্তি রটে...


(গ্রন্থ: উজানি কবিতা / কবি: গৌতম চৌধুরী / মনফকিরা / ২০১৪)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন