শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

“অভ্র ও আবির” : একটি কবিতা জীবন






অভ্র ও আবির : একটি কবিতা জীবন

কিছুই দেবে না


           শুধু উচাটন করে
                          চলে যাবে বসন্ত বাতাস...



 কবি সুদেব বকসীর পরিচয় কখনোই সেভাবে উচ্চকিত নয়, তিনি-মানুষটির মতোই তাঁর কবিতার বইগুলিও খানিক মুখ-লুকোনো স্বভাবের। তাঁকে আভিধানিক অর্থে না হলেও প্রচলিত বাংলা অর্থে বলা যায় স্বভাব রোমান্টিক এক কবি মানুষ । যিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে এক অর্থে জীবনকেই সাজিয়ে তোলেন। জীবনের, প্রতিদিনের যাপনের ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ সব ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা, সেখানে কোথাও কোনো চমৎকার, কোনো উচ্চরোল, কোনো ঝঙ্কার ছাড়াই তাঁর কথাগুলি অতি সহজভাবে দেখি বসে থাকে। কখনো উদাসীন, কখনো বিষন্ন, অভাবিত কখনো । হয়তো জবাগাছের মতো অতি সাধারন এক গাছের পাতায় রোদ এসে পড়েছে। জবা পাতা খসে পড়ছে পাশের পুকুরে, সেখানেও রোদএই এক দৃশ্য। হয়তো পাশের বাড়ির আইবুড়ো মেয়ে একদৃষ্টে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, এ সবই তাঁর কবিতার বিষয়হীনতা হয়ে ওঠে কখনো বা। তিনি তাঁর অতি সাধারন কথাগুলিই স্বীকার করে ফেলেন তাঁর লেখায়
প্রত্যেকটা ঘটনাই সাধারণ
                          শীত ও হেমন্তের মধ্যবর্তী অস্বস্তি

 আর এভাবেই কোনো একটি লেখা ধীরে ধীরে কবিতার দিকে অগ্রসর হয়...।
  সমস্যা হল যিনি খুব কাছের মানুষ, তাঁর নামের পাশে পদবী ব্যবহার অস্বস্তিকর। বার বার কবি বলাটাও। কারন সুদেবদা কে সুদেবদা বলতেই অভ্যস্ত প্রায় কুড়ি বছরেরো বেশী সময় যাবত। তাই এই লেখাতেও তাঁকে সুদেবদাই বলতে হবে। নাহলে লেখা এগোবে না...।
  তো যে কথা বলছিলাম। সুদেবদার এই কবিতাগ্রন্থটির ভেতর সুস্পষ্ট একজন ঈশ্বরী আছেন। এই যে বইটির কথা বলছি, অভ্র ও আবির , অন্তত এই বইটির ছত্রে ছত্রে সেই ঈশ্বরীকেই  আমরা প্রত্যক্ষ করি বারবার । দেখি, তাঁকে ছোঁয়ার চেষ্টা, বোঝার চেষ্টা, কখনোবা তাঁকে লুকোনোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন কবি। অথচ যে প্রথাগত প্রেমের কবিতা আমরা এতদিন ধরে চিনি, এ হয়তো সেই প্রেমের কবিতা নয় ! বরং কোনো বৃহত্তর জীবন প্রেমের দিকেই  আমাদের নিয়ে যেতে চান তিনি। আর সেই সম্পর্ক উন্মুক্ত করতে গিয়ে, তাঁকে, সেই ঈশ্বরী অথবা দেবী, তাঁকে এক অপার রহস্যে আড়াল করেন । অথচ মানুষের ছদ্মবেশে  সেই দেবীই কবিতার মধ্যে ফিরে ফিরে আসেন, এক রহস্য-আঁধার রচনা করেন।

যতবার কাছে যায়, থেমে যায়
                      দূরে গেলে গান বেজে ওঠে
এ কোন্ ঘুমন্ত স্বপ্ন, কুহেলিকা, মানুষের ছদ্মবেশে
                                               খেলে
লুকোচুরিযে যাকে পাবে না তার সঙ্গে গিয়ে ফিরিয়ে আনবেই
যতবার কাছে যাই নিথর গলার স্বর, মৃদু শ্লেষ্মা, ভিজে নি:শ্বাস
যতবার সরে আসি সুবাতাসবাগেশ্রী সাধে কণ্ঠধ্বনি
                যে যাকে পাবেই তাকে দূরে ঠেলে দেয়

   আর সেই আঁধার-রহস্যের ভেতর আমাদের ছোটো ছোটো ব্যাথা-কাতরতা, বিষন্নতা অথবা শুধুই নীরবতা কোথাও বা ঘনিয়ে ওঠে আমাদের মনের ভেতর। তাকে ফেলে দেওয়া যায় না, আবার বয়ে বেড়ানোও যায় না। ভারী লাগে। বোঝা দুর্বহ হয়ে ওঠে কখনো। তখন সেই বোঝা কোথাও নামানো প্রয়োজন। কোথায় নামাবো সেই বোঝা? একলা পথে নামা মানুষ, কার হাতে সেই বোঝা দুদন্ড রেখে জিরিয়ে নেব? তখন সেই বোঝা আজীবনের সঙ্গী হয়ে যায়। মানুষ ধীরে ধীরে তাকে ভালবেসে ফেলে। আমাদের বিষন্নতাগুলি, ব্যাথাগুলি নুপুরের নিক্কনের মতো, কখনো বা স্তব্ধতার মাঝে বেজে বেজে ওঠে।

তাকে নয় তার মন চাওয়াসেই
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গরব,
                  মনোবলে মনোবলে ভেঙে যাওয়া
হয়তো এমন হিমশৈলে পরশের সাধে নিজেকে ভাসিয়ে
                           শোভা দেখা
দুই কূল, ফেনা, লবনাক্ত জলের রহস্য

স্বপ্নে দেখা জনপদ, ধু ধু হাওয়া, পরিত্যক্ত জেটি
    সেখানে দাঁড়িয়ে ছায়ামূর্তির মতো তুমি ডাকো
                                      আমার ক্রন্দন
  সেই নিক্কনের সুর ভেতরে নিয়ে একজন একলা মানুষ,  এক অজানা মনখারাপের ভেতর হেঁটে যাচ্ছেন। কোথাও জিরিয়ে নিচ্ছেন অল্প। তার অর্থ এই নয় যে তিনি পরাজিত কোনো প্রাণ। বরং জয়ী হবার কোনো বাসনাই তার ছিলো না কখনো। তার অর্থ আবার এ-ও নয় যে তার জীবনে কোনো যুদ্ধ ছিলো না। বরং সেই যুদ্ধে বারবার পরাজয়ই এক রহস্যময় জয় এনে দিচ্ছে তাঁকে। এই এক অসামান্য বোধ নিয়ে সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা হেঁটে চলেছে।

অনেক হেরেছি
                গ্লানি এসে বসে আছে মনের বেদীতে
এই যদি জীবনচণ্ডিকা
                 পূজা দিই বিক্ষোভের ছলে,
                                   অসাড় জয়ের ব্রত মেনে
একথা জানে না কেউ জয় আমার প্রাণের দেবতা...

   যদিও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা হেঁটে যাওয়া’—কথাটা বড় বানানো মনে হয়। বড় বেশী কাব্য-সাহিত্য আলোচনার মতো । আসলে তাও না। সুদেবদা থাকেন সেই বেহালার দিকে। শুনেছি সেখান থেকে রোজ তার কর্মস্থল পাড়ি দিতে হয় অটো-বাস-ট্রেন নানা রকম যানে চড়ে কলকাতা শহরটাকে মাঝামাঝি দুভাগ করে অন্য প্রান্তে আরো দূর চলে যেতে হয় । সারাটা পথ তো কবিতার খাতার সফেদ পৃষ্ঠা নয়! আমি ভাবি, ঐ দুরন্ত ভীড় ঠেলে পথ ঠেলে একজন মানুষ চলেছেন। তাঁর মাথার মধ্যে কিন্তু কোনো ভীড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই , চিৎকার হুল্লোড় নেই, হয়তো ট্রেনের চাকা আর রেলের ঘর্ষণ জনিত ধ্বনি, জানলা দিয়ে বাওড়ের বাতাস, তাঁকে এক অন্য আবহ, এক শান্ত কোলাহল, অন্য এক ঘোর এনে দিচ্ছে

 এই ঘোর, তুমি সেই ঘোরের প্রস্তুতি
তোমার দৃষ্টি দিয়ে সাজিয়েছি তন্ময়তা
                  শ্রুতি দিয়ে স্তব্ধতার সাজ
সংকোচ ভেঙে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চুমকি গুলি
          একে একে তুলে নিয়ে লজ্জা-ও সাজায়

গভীর গহন দিনে ঢাকা-পড়া সজ্জিতকরণের কাজ
              প্রতিপদে সন্ধ্যায় সব খুলে যায়

   একটা যাত্রা, একটা গমন, টের পাওয়া যায়, শেষ পর্যন্ত। কোনো বিশেষ একটা কবিতায় হয়তো নয়। সমগ্র গ্রন্থ, অথবা একজন কবির জীবনী জুড়ে তবু ধীরে ধীরে সেই যাত্রাপথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্রমশ। যেখানে যাত্রাটাই মূল হয়ে ওঠে, পথই যেখানে মঞ্জিল, উদ্দেশ্যের চেয়ে তার পথ, পথের পারিপার্শ্ব, গল্প পার হয়ে একটা প্রস্তুতি


 এরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে তোমার বাড়ি
                     --এটাই তো দারুণ

রাস্তাই পাড়, পাশ দিয়ে নদী
নদীর জলের ঢেউতোমার স্মৃতি
                চিক চিক করছে, কখনো তোমার অশ্রু মনে হয়

ঢেউ দিয়েঢেউ দিয়ে তুমিও থামিয়ে দিচ্ছ ছলাৎছল
                রাস্তার গতি, আমি যাচ্ছি

অপরিকল্পিত এই পাড়-ভাঙাতুমি প্রস্তুত হয়েছো?

  ২০১০সালে সুদেবদা যখন এই কবিতাগুলি লিখছেন, তখন তিনি পঞ্চাশ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর সেই প্রথম কবিতা পুস্তিকাটি বাদামী কুঁজোর কথা তিনি ফেলে এসেছেন বহুদূরে। সেখানে যে কবিতাগুলি ছিলো, সেগুলি যখন লিখছিলেন তখন আমাদের পরিচয় ঘটে, সেটা আমার শহর বিষ্ণুপুরে। সেই সমস্ত বইটি জুড়ে বিষ্ণুপুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এই অভ্র ও আবিরে এসে কবির যাত্রাপথ একটা কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, তাঁর পরের গ্রন্থ পঞ্চানন্দ খ্যাপার থানে তে  হয়তো একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে। পরে সেই কথা কোথাও বিস্তারিত বলার ইচ্ছে থাকলো।

অভ্র ও আবির ।। সুদেব বকসী ।। ২০১০ ।। সপ্তর্ষি প্রকাশন ।। কলকাতা ।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন