দিলবালে, দুলহানিয়া ও গুটিকয় পার্শ্বচরিত্র
----------------
কৌশিক বাজারী
“...বাহিরে কি বৃষ্টি নামিয়াছে?
জানালার বাহিরে রাত্রির অন্ধকার ঘন হইয়া আসিয়াছে । মধ্যে মধ্যে বহুদূরবর্তী
দিগন্তমেঘে মৃদু মেঘগর্জন আবহের ন্যায় বাজিয়া বাজিয়া শ্রুতিকে অভ্যস্ত করিয়া
তুলিতেছে, ফলত তাহার ধ্বনি এখন আর কর্ণকুহরে বাজেনা তেমন ধারা, এমন ঘটনা চলিতেছে
সেই সন্ধ্যা থাকিতেই, গুরু গুরু মৃদু বাদ্যের সহিত মধ্যে মধ্যে হাওয়ার আবহ।
বৃক্ষদিগের, মনুষ্যদিগের ঘর-দুয়ার, পাতা, প্রশাখা, খড়খড়ি, জানালার পুরাতন পাল্লা
আর উড়ন্ত পর্দা এবং প্রাচীন লৌহ সোপানের জটিল
আবর্তের মধ্য দিয়া কখনো দ্রুত কখনো বা ধীর লয়ে বাতাসের বহিয়া যাওয়ার একটানা
ধ্রুপদী আবহ । এই চলিতেছে। ধৃতিমান অন্ধকারের মধ্যে দেশলাই জ্বালাইয়া
জ্বালাইয়া মোমবাতি খুঁজিয়া ফিরে, কিয়ৎ দূর অগ্রসর হয়, পুনরায় নিভিয়া যায়, পুনরায়
জ্বালায়, অগ্রসর হয়, সহসা দু অঙ্গুলিস্থিত জ্বলন্ত শলাকার আলোয়, নিভিয়া যাওয়ার ঠিক
পূর্ব মুহূর্তে উড়ন্ত পর্দার পিছনে, খুলা ও অন্ধকার জানালার পার্শ্ববর্তী বিজিতার মুখমণ্ডল
লালভ আভায় জ্বলিয়া উঠে, রহস্যের মতন অতঃপর নিভিয়া যায়..। মুহূর্তেক আলো ও পরক্ষণের
ধূ-ধূ অন্ধকার দুজনার মধ্যে এক হাওয়ার প্রবাহ ঘটাইয়া দেয়। ধৃতিমান আর শলাকা
জ্বালাইবার চেষ্টা করে না। বিজিতা সহসা অন্ধকার হইয়া বলিয়া উঠে
--থাক, এই ভাল...
তাহার মনের মধ্যে একটা গুরুগুরু চলিতেছিল। তাহা আলোর স্পর্শে যদি ফাটিয়া
পড়ে ? এই আশঙ্কা হইতে সে মুক্তি পাইতে চাহিয়া আপাত অন্ধকারকেই বাছিয়া লইতে চায়। ধৃতির
হাল ছাড়িয়া দেওয়া সে অন্ধকারে দেখিতে পায় না। ধৃতিও অন্ধকারের মধ্যে তাহাকে নিঃশব্দ
সমর্থন দিয়া দেয়। সেও জানলার নিকটে গিয়া দাঁড়ায়, হ্যাঁ, বৃষ্টি নামিয়াছে...
রাত্রির চরাচর জুড়িয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইলে
অন্ধকারের দৃশ্যপটও পাল্টাইতে শুরু করে। এতক্ষণের নিকষ-শ্যাম-আঁধারের মধ্য হইতে এক
রহস্যময় ধোঁয়াটে আলোকাভাস দেখা যায় জানলা দিয়া। পৃথিবীতে অলৌকিক এই আলোর উৎস
সম্বন্ধে এখনো পর্যন্ত কিছুই জানা যায় নাই। ধৃতি সেই আলোর দিকে তাকাইয়া থাকে আর
শব্দ গোনে। বৃক্ষ ও তাহার পত্র নিঃসরিত জলের পতন ধ্বনি, কার্নিশের উপর জলের পতন
ধ্বনি, পাইপ বাহিয়া নিচে, পথপার্শ্বে জল বহিয়া যাবার শব্দ, কোথাও কোনো টিনের উপর
টুং টুং ধ্বনি, সমস্ত সুর তাল মিলিয়া একটা মন খারাপ করা সুগন্ধি ও জটিল হাওয়ার
পরিবেশ তৈরী হইতে থাকে।
অন্ধকারের মধ্য হইতে বিজিতা হঠাৎ কথা কহিয়া ওঠে—এখন আমি কোথায় যাবো ধৃতি ?
ধৃতিমান এই প্রশ্নটাকেই এতক্ষণ
ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত, সেই অমোঘ প্রশ্ন, সেই নিশ্চিত প্রসারিত তলোয়ার উত্থাপিত
হইল...”।
...
...বাইরে কি বৃষ্টি শুরু হল?
অনিমেষ বুকের উপর বইটা মুড়ে রেখে
একবার পর্দা-টানা বন্ধ নিশ্ছিদ্র জানলাটার দিকে চায় । ঘরের মধ্যে একটা টিউব
জ্বলছে। সিলিং পাখা ঘুরছে সর্বোচ্চ গতিতে। বাইরে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের ঝাঁ-ঝাঁ শেষ
দুপুর চলছে। না, বৃষ্টি নয় তাহলে। বহু পুরনো সিলিং পাখাটা মাঝে মাঝে এমন ঝিরঝির
বৃষ্টির মতো শব্দ দেয় । অন্যমনস্ক অনিমেষকে ধন্দে ফেলে দেয় । তাহলে বৃষ্টি নয়!
গল্পেরবই-এর বৃষ্টি-ছাঁট ? হাঃ হাঃ হাঃ বিজিতা-ধৃতিমান...।
হঠাৎ তার ঘেমে ওঠা শরীরে পাখার বাতাস লেগে শীত শীত করে। এই ঝাঁ ঝাঁ গরমে
শীত শীত ভাব তাকে একবার ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। শরীর খারাপ হবে নাকি? একটা অজানা
ভয় তাকে একবার পাক মেরে চলে যায়। অনিমেষ হাত ওয়ালা গেঞ্জিটা টান মেরে খুলে ঘরের
কোনে জমা করা স্তূপীকৃত জামাকাপড়ের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেটা খানিক দূরে অঞ্জুর ঠাকুর
আসনের কাঠের চুড়ায় গিয়ে ঝুলে পড়ে। অনিমেষের হাসি পেয়ে যায় অযথায়। সে উঠে গিয়ে সেটা
যথাস্থানে রাখে। অঞ্জুর পরিপাটি ঠাকুরের আসন এখন বাসিফুলে ম্যাড়ম্যাড় করছে।
প্লাস্টিকের কিছু উজ্জ্বল ফুল সাজানো, সেখানে হালকা ধুলোর আস্তরণ। আসনের কাঠের
চুড়োয় ঝিকমিক আলো জ্বলা টুনি লাইট। টুনি বলে কি ওগুলোকে? এখন আর টুনি বলে না
বোধহয়। অনিমেষ ভাবে; আজ বিকেলে বাজার যাবে কিনা ? রান্নাঘরে উঁকি মেরে একবার
সবজির ঝুড়িটা দেখে নেয়। সেখানে একটা টিকটিকি চুপ করে আছে, দুটো শুকনো আলু আর
পেঁয়াজের খোসা উড়ছে। অথচ তার বাজারে যেতে
ইচ্ছে করেনা। ...খুব যে আকস্মিক বজ্র পাতের মতো ঘটনা তাও নয়। অঞ্জু যে চলে যাবে,
যেতেই পারে যে কোনো দিন, এমন একটা হাওয়া ছিলোই। কিন্তু সত্যিই চলে যাওয়াটা যে
কেমন, সেটা জানা ছিলো না , এমন কি এখনো ঠিক মতো উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি অনিমেষ।
বরং বেশ একটা হালকা ভাব লাগছে। --যা: শালা, যাবোনা বাজার, শুয়ে থাকবো, হাওয়া খাবো…। অনিমেষ নীল পাঞ্জাবীর পকেটে মানি ব্যাগ হাতড়ায়, মানিব্যাগের সাথে
একগুচ্ছ কাগজ, ছেঁড়াখোঁড়া উঠে আসে, বাসের–ট্রেনের টিকিট, ছিলিমপুর টু
মহিমগঞ্জ, দোকানের ফর্দ, একটা ছাপানো কার্ড, ‘দেবেশ চন্দ্র ঘোষাল,
ইন্টিরিয়ার ডেকোরেটার, ফোন-৯৪৭৫....’ মহিমগঞ্জ অঞ্জুর দাদার বাড়ি,
গত সপ্তাহে গিয়েছিল দুজনেই, ট্রেনে আলাপ দেবেশ চন্দ্র ঘোষালের সঙ্গে। মানিব্যাগে
টাকা আছে এখনো কিছু...। ধৃতি আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে দেবেশ
চন্দ্রকে ছুঁড়ে ফেলে। ফেলে দেওয়ার আগে পুরনো ফর্দটাতে চোখ বুলায়—ধারা সরষে তেল ১লি, অলিভ ওয়েল, সিমুই চার প্যাকেট, শ্যাম্পু পাতা
বারোটা, রবিন ব্লু, হুইসপার রেগুলার...। এগুলো কি আনা হয়েছিল?—ভাবে অনিমেষ। ভাবতে ভাবতে বিছানায় লম্বা হয়। পাশ ফেরে। বিছানায় পিঠের
নিচে শক্ত বোর্ডের খোঁচা লাগে। ...বইটা, যার মধ্যে বিজিতা-আর ধৃতিমান...
মাথার অনেক উপরে ভারী একটা প্রাচীন লৌহসেতুর উপর দিয়া একটা মালবাহিকা লৌহশকট ধীর ও
গুরুগম্ভীর চালে চলিয়া যাইতে থাকে বহুক্ষণ ধরিয়া। সেতু হইতে বহু নিচে নদীর বালুকা মিশ্রিত
বিক্ষিপ্ত শ্যামলিমা, যার উপর দিয়া হাঁটিয়া যায় তাহারা দুইজন। রেলগাড়ির গুমগুম
আবহের মধ্য হইতে তাহারা কথা কহে। দুই জনেই পরস্পরের কথা অর্ধেক শুনিতে পায়, অর্ধেক
পায়না...
ধৃতি : শুভময়ের সমস্ত কাহিনী তুমি মুছে ফেলতে পার কি বিজিতা...?
বিজিতা : সমস্ত কাহিনীই যেখানে
অপমানের আর অপরিচয়ের তাকে মুছে ফেলতে পারলে বেঁচে যেতাম ধৃতি...
ধৃতি : কিন্তু, বিজিতা, কাহিনী
মাত্রই বহুমাত্রিক, সেখানে শুধু অপমান আর অপরিচয় তো নয়... এতগুলো বছর, সূর্যাস্ত ও
চন্দ্রোদয়, হাওয়ার রাত, বর্ষণমুখরতা... আর ...তাছাড়া... যেখানে চলেছ সেখানেও তো
অপরিচয় ?
বিজিতা : তবু সেই যে অনিশ্চিত, সে এক
খেলা, কি বলো ধৃতি ?
ধৃতি : তবু ভালো, তোমার ঠোঁটে কৌতুক এসেছে...
বিজিতা: জীবনের পাঁচ-পাঁচটা বছর তো
অনেকটা সময়, তাই না ?
ধৃতি মনে মনে ভাবিতে থাকে , এই পাঁচ বৎসরেও তোমাদের কোনো সন্তান নাই কেন
বিজিতা। তাহা হইলে হয়তো তোমায় এভাবে একাকী অনন্যপায় হইতে হইত না...
বিজিতা যেন বা ধৃতির মনে মনে বলা
কথার জবাব দিয়া উঠে—আসলে এমন একটা সময়, একটা জীবন,
পেরিয়ে এলাম, সেখানে কোনো সৃষ্টি নেই, সম্ভাবনা নেই, সন্তান যা শ্রেষ্ঠ সৃজন,
সেখানে এলো না ধৃতি...
রেলসেতুর উপর মালগাড়িটার শেষ কামরাটিও ওপারে মিলাইয়া গেলে চরাচরের মধ্যে একটা দৈনন্দিন নীরবতা নামিয়া আসে
। দুজনেই খানিক নীরব থাকিবার পর ধৃতি কহে :
চলো ঐ গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, রোদে রক্ত পর্যন্ত ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে...।
কিছুদূরে শিলাবতী নামের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। একটা কদম্ব বৃক্ষের ঝিরিঝিরি
ছায়ায় আসিয়া দাঁড়ায় দুইজনা। প্রতীকী কদম্ববৃক্ষের মধ্যদিয়া তির্যক শ্লেষের মতো রৌদ্র
আসিয়া পড়িয়াছে তাহাদের গায়ে। এরূপ মনে হইতেই বিজিতা এইবার সামান্য শব্দ করিয়াই হাস্য
সম্বরণ করে । ধৃতি কৌতূহলে তাহার মুখের পানে চায় । বিজিতা উপর পানে চায়। বর্ষার
প্রথম কদম্বপুষ্পের ঘ্রাণ। তথাপি এখন ত প্রবল রৌদ্র, বর্ষা কোথা ... তবু হায়, প্রকৃতি
অসময় বুঝে নাই... বিজিতা ধৃতির কাঁধে বিচরণরত একটা কাঠপিঁপড়া তাহার আঁচল দিয়া আলগোছে ঝাড়িয়া ফেলে...
--জানো, ধৃতি, শুভময়দের বাড়িতে শুধু
কাচের পুতুল, ঠাকুর ঘরেও কাচের পুতুল...আমার শাশুড়ি সারাদিন পুতুল খেলেন...
--শুভময়দের বাড়ি ! সে কোথায় বিজিতা
...?
...বইটা বন্ধ করতেই বহুদূর
থেকে একটা অচেনা গলায় ডাক শুনতে পায় অনিমেষ। --অনি—অনি—অনি । কেউ তাকে ডেকে ডেকে চলে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে জানলা খুলে বাইরে তাকায় সে, দেখে, শেষ
দুপুরের রোদ রাস্তায়, গ্রীস্মবিকেলের শুনশান পথে একটা অবাঙালী ফেরিওয়ালা, কাঁধে
ঝোলা, অদ্ভুত দেহাতি-হিন্দী টানে হেঁকে যাচ্ছে—অনি—অনি-- । অনেক ভেবেও অনিমেষ বুঝতে পারেনা কি বস্তু ফেরী করছে সে ! ‘অনি’ই বা কি বস্তু !
অনিমেষ পাজামার উপর একটা
হাফ-পাঞ্জাবী চড়িয়ে রাস্তায় নামে। বিকেলের আলো রাস্তায় তার ছায়া কে দীর্ঘতর করে
নিয়ে গেছে বহুদূর। দীর্ঘ ধড়ের উপর কোথায় তার মাথা অনি নিজেই খুঁজে পায়না। সে
হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে সে ছিলিমপুর স্টেশনের মোরাম বিছানো প্লাটফর্মের একেবারে
শেষের দিকের ফাঁকা বেঞ্চিটায় এসে বসে। পাশেই একটা বিশাল রাধাচূড়া। তামাটে হলুদ
ফুলে ছেয়ে আছে, যদিও তার হলুদ রং এখন আর হলুদ নয়। হলুদ নয় কেননা সূর্য অস্ত গেছে ।
সন্ধ্যা পূর্ব দিগন্তের উপর মাটি থেকে কিছুটা ওপরে আঁধার ঘনিয়ে থমকে আছে। দেখছে,
পশ্চিম এখনো প্রস্তুত নয়। সেখানে সূর্য বিদায়ের পর শেষ ছটাদের স্তিমিত কলরব । এখন বিকেলও নয়, সন্ধ্যাও নয় ! এক অন্যতর
সন্ধিকাল! তাই রাধাচূড়া ছাইবর্ণ, তবু অভ্যস্ত মানুষের চোখ তাকে হলুদই দেখে।
রাধাচূড়া গাছটার তলায় একটা
পাখমারা পরিবার এই অবেলায় উনুনে জ্বাল দিচ্ছে। লোকটা চিত হয়ে সন্ধ্যা আকাশের দিকে
চেয়ে শুয়ে আছে মাটিতে । পাশে ছেঁড়া নোংরা কানিতে জড়ানো একটা চারমাসের বাচ্চার
কঙ্কাল। তার বুকের পাঁজরে লোকটার অজানিত হাত। যে মেয়েটা জ্বাল দিচ্ছে সে এর মা, কত
বয়স হবে ? ১৭-১৮ । দেখে মনে হয় ৪০-৪৫ । রুগ্ন, চোয়ালের হাড় বার করা। মেয়েটার সঙ্গে
অনিমেষের একবার চোখাচোখি হয়। অনিমেষ লক্ষ্য করে তার চোখ ধ্বক করে জ্বলে ওঠে একবার।
এদের জীবন সম্পর্কে আমাদের মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজে নানান গল্প রয়েছে। কেউ বলে
পাখমারা, কেউ বলে ইরানি। ইরানি যে কেন বলে এদের অনিমেষ ভেবে পায় না। আর এদের দলের
পুরুষরা নানা জীব জন্তু পাখি শিকার করে বেড়ায় বটে, তবে তাদের মূল উপার্জন সম্ভবত
চুরি, হাতসাফাই। মেয়েরা দিনেরবেলা পথে ঘাটে ট্রেনে নানান পশরা ফেরি করে বেড়ায় আর
রাত্রে শরীর। এদের দলে নাকি নারী পুরুষের অবাধ সম্পর্ক। যা কিছু অবাধ, ভদ্রসমাজে তাই তো অবৈধ। অথবা সবই হয়তো আমাদের দূরত্ব জনিত অজ্ঞান কল্পনা—অনতি দূরে, রেল লাইনের ওপারে তাদের খুলে নেওয়া তাঁবু গুলির দিকে
চেয়ে ভাবে অনিমেষ। এরা হঠাৎ হঠাৎ কখনো এসে জোটে রেল লাইনের ধারে, তারপর একদিন আবার
হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।
রাধাচুড়া গাছের নিচে ফিরে চেয়ে
দেখে লোকটা আকাশের দিকে সেই এক ভাবে চেয়ে আছে স্থির। লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমেষ
আকাশের দিকে চায় । ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে ।
পূবদিকে যেখানটা বেশী ঘনিয়েছে, সেখানে একটা তারা। রাতের প্রথম তারা !
ট্রেনের ভোঁ শুনে তাকিয়ে দেখে হলদিয়া-আসানসোল ঢুকছে। ফাঁকা ফাঁকা ট্রেন । এ লাইনে
এতদূর অবদি ভিড় আসে না। এবার তো পশ্চিম রাঢ়, রুক্ষ, মানুষজন কম। ট্রেনের জানলায় ঘর
ফিরতি মানুষের পরিশ্রান্ত মুখ। এপাশের জানলায় দুটি মানুষের মাঝখান দিয়ে ওপাশের
জানলার হলুদ আকাশ। অনি দেখে; মানে, হঠাৎ তাদের দেখে ফেলে একটা জানলায়, মুখোমুখি ধৃতিমান-বিজিতা।
বিজিতার মুখ থমথমে। ধৃতিমান উদাস । হাওয়ায় উড়ছে বিজিতার চুল, তার অলক এসে পড়ছে
চোখের উপর । বিজিতা বাঁ হাতে চোখের উপর থেকে আনমনে চুল সরায় আর সেই মুহূর্তে অনির
সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় তার । বিজিতা চোখ কি অচেনা নারীর মতো চায়? অনি আত্ম
সঙ্কোচে ইতস্তত চোখ ফেরায়, ভাবে—গল্পের নারী কি একাকী পাঠককে
একবার দেখে নিয়ে তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত চিনে নিতে পারে? সে বিপন্ন বোধ করে। এক
মুহূর্ত। ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়। অনি অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় । দেখে,
পাখমারা পরিবারটা ট্রেনের পাশে পাশে ছুটছে
আর ট্রেনের ইঞ্জিন দ্রুত গতি তুলে একটার পর একটা কামরা তাদের পেরিয়ে
যাচ্ছে। লোকটার কোলে নোংরা কাপড়ে জড়ানো
সংসার । তার মেয়েটা অনেক পিছনে আছাড় খেতে খেতে দৌড়চ্ছে, কোলে সেই জীর্ণ কঙ্কালসার
বাচ্চা। তার মাথা দৌড়ের তালে তালে ঝাঁকাচ্ছে, অনি শিউরে ওঠে, ওর ঘাড় সোজা হয়েছে
তো? লোকটা ভারী পুঁটলি নিয়ে পিছনে তাকায়,
ভাবে—পৌঁছতে পারবে কিনা, হিসেব কষে, তারপর
ক্রমশ গতি বাড়তে থাকা ট্রেনের একটা দরজার ভিতরে তার পুঁটলি ছুড়ে দেয়, হাতল ধরে লাফ
মেরে উঠে পড়ে। শেষ কামরার শেষ দরজা। মেয়েটা হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসছে, তার আঁচল
খসে গেছে, বুক খোলা ছেঁড়া নোংরা ব্লাউজ, শুকনো দড়ির মতো অষ্টাদশী স্তন ডাঁয়ে বাঁয়ে
পেন্ডুলামের মতো দুলছে। অনি পিছনে ফিরে
তাকায় । রাধাচূড়া গাছের তলার একটু আগের সেই সংসার শূন্য পড়ে আছে । তিনটে ইটের উনুন
থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছে কেবল। লোকটা এক হাতে দরজার হাতল ধরে অন্য হাত বাড়িয়ে
ধরে । মেয়েটা বাঁ হাতে বাচ্চা সামলে ডান হাত বাড়ায়। মধ্যে খানের দূরত্ব কমতে থাকে,
আর একটা হকার চেঁচিয়ে জোকার দেয়—আ-বে দিলবালে দুলহানিয়া
বে...। মেয়েটার হাত ধরে ফেলে লোকটা। যাত্রীরা হেসে ওঠে, পাখমারা পরিবারটিও হাসে,
রেলের কামরায় বাচ্চাটা কোল বদল হয়। বিজিতা একবার চমকে উঠে দিলবালে ও দুলহানিয়াকে
দেখে নেয় আর ট্রেন প্লাটফর্ম থেকে ধক-ধক শব্দে বার হয়ে যায় পশ্চিমের দিকে। যেখানে
প্রায়ান্ধকার দিগন্তে কিছুক্ষণ পূর্বের সূর্যাস্ত এখনো বর্ণময় হয়ে আছে।
খুব ভাল লাগলো
উত্তরমুছুন