সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৬

নীল পানকৌড়ি


নীল পানকৌড়ি


 কৌশিক বাজারী


অনেক দিন পর আজ বিদিশাকে দেখলাম স্বপ্নেদূর থেকে দেখলাম, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে একটা রঙিন ছাতায় রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেমেয়েদের অপেক্ষার একটা একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে দেখলেই বোঝা যায় তার অপেক্ষারত চোখ ও দেহভঙ্গি সেই বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিদিশাএমনি তে সে বরাবর একটু চাপা ও গভীর স্বভাবের ,গম্ভীর নয় যদিও ক্লাসের অনান্য মেয়েরা ওর চাপা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এেঁটে উঠতে পারতো না অনার্সের ক্লাস চলত একটু বেশীক্ষণ ধরেই ওর ক্লাস শেষ হওয়া অব্দি আমি আপেক্ষা করতাম কলেজের দোতলার করিডোরেএখান থেকে লীলাসায়রের একটা অংশ দেখা যায়ঐ দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কেটে যেত, লীলাসায়রের জলে ঝাঁকে ঝাঁকে বালীহাঁস উড়ে আসত শীতকালেবিদিশা বলত; ওরা নাকি সমুদ্রসারস, সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসছে এই খানে প্রেমের সন্তানের জন্মদিতে রঞ্জনবাবুর ক্লাস থাকলে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে একটা স্নেহের হাসি উপহার দিয়ে যেতেনকোনোদিন হয়ত অল্প দাঁড়িয়ে বলে যেতেন; ‘তোমাদের পত্রিকা দেখলাম, আমার লেখাটায় বেশ কিছু প্রিন্টিংমিস্টেক রয়েগেছে, পরেরবার আমায় প্রুফটা একটু দেখিয়ে নিও...অবশেষে ওদের ক্লাস থেকে একে একে বেরিয়ে আসত সকলেকেউ কেউ মুখ চেনা, যারা প্রতিদিন আমার অপেক্ষার কথা জানে, তারা চাপা ঠাট্টার সুরে  বলত:বিদিশা ? ঐ যে , পিছনে, আরেকটু দাঁড়াও...দেখতাম বিদিশা সরকার কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে আসছে হাসি মুখে
   আজ অনেক দিন পর তাকে স্বপ্নে দেখলামভেবে ছিলাম ভুলে গেছিঅথচ বিস্মৃতি কোন অতল প্রান্তথেকে ধীর পায়ে হেঁটে এসে সে অপেক্ষা করছে আজ আমার জন্য ! সে কিছু বলতে চায় আমায় ?
   সামনের মাসে সম্বিতের বিয়েহ্যাঁ, অনেকটা বেশী বয়সেবিদিশা কি খবর পেয়েছে ? সে কিছু জানাতে চায় আমায়? জানাতে চায় কোনো পুরনো গোপন দলিল ? কিন্তুকি কথা তাহার সঙ্গে, তার সাথে সে তো বছর পনেরো আগেই বিয়ে করে বর নিয়ে সাত সমুদ্র পারের এক রূপকথা শহরে চলে গিয়েছিল ! যাওয়ার আগে আমরা জানতেও পারিনি সব কথা শুধু কয়েক দিন আগে এসে বলেছিল:বিয়ে, ...চললামতারো আগে বহুদিন ধরে সম্পর্ক আলগা হয়ে গেছে তখন ছিল একটা সময়, প্রথম জীবনের বণর্মাধুর্য্য উঠে গিয়ে স্বাধিষ্ঠান খুঁজে নেওয়ার কাল  একটা সময় যাদের ছাড়া জীবন মিথ্যে বলে মনে  হত, মনে হত আমাদের এই দ্বীপ ছাড়া আর সমস্ত জগৎ ভুল পথে দৌড়চ্ছে, মনে হত; এই দ্বীপের বালুকা থেকে একদি সোনা খুঁজে পাওয়া যাবে--- সেই দ্বীপ একদিন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল সেই ভুল পথের জগৎময়, সারা ভারত ভারতবর্ষ জুড়ে...
   সম্বিত গান্ধীনগরে  এন.আই.ডির সহকর্মী অধ্যাপিকাকে বিয়ে করবে স্থির করেছে সম্প্রতি একমাথা লালচে চুলের, ফর্সা, মাঝারি হাইটের সম্বিত এখন টেঁকোপ্রতিদিন নিয়ম করে কলেজে বেরোবার আগে গালে আর মাথায় রেজার চালায়একটা সম্ভ্রম জাগানো চেহারা হয়েছে তার। --এসব কথা বিদিশা জানে ?
   আজ কুড়ি কুড়ি বছরের পর স্বপ্নে দেখলাম বিদিশা সেই ময়ুরকণ্ঠি রঙের ঘাগরা চুড়িদার টা (কুড়ি বছর আগের ফ্যাশন) পরে দাঁড়িয়ে আছে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে,--যা ছিল একদিন আমাদের ভেঙে যাওয়া দ্বীপভুমির একটা অংশ


   সমস্ত স্বপ্নের মতো এই স্বপ্নটাও নিতান্ত অসময়ে ভেঙে যায়ঘুম ভেঙে উঠে দেখি আমার পাঁচ বছরের পুত্র তার মায়ের সাথে বেরোবে বলে রেডি হচ্ছে  ছেলে আমায় জেগে উঠতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে; ‘বাবা উঠে গেছিস? চল তুইও যাবি আমার সঙ্গে মা আমি আর তুই...চল
--না ,বাবা যাবে না, উঠে এসো,পোষাক নষ্ট হবে, উফ্ এই ছেলেটা...
-- না , বাবা যাবেই...
-- না সোনা , আমি যাবো না, তোমরা যাও, আমার বাড়িতে কাজ রয়েছে..
ছেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়টাটা করেউষাআমার বৌ, বেরোবার সময় বলে যায়
--রান্না ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দিওআজ দুপুর বেলা আবার বেড়াল এসেছিলআমি সন্ধের পরেই বাবাই কে নিয়ে ফিরবোবিকেলে বাজারে বেরোবে তো?
--বেরোবো...
--(হুইস্পারিং টোনে) একটা হুইস্পার এনোতো, এক্সট্রা লার্জ
--তুমি তো বেরোচ্ছোই...
বৌ একটা বিরক্তির চাউনি হেনে চলে যায়মানেওটা তোমার দ্বায়ীত্ব

  ওরা বেরিয়ে যেতেই একলা ঘরে শেষ দুপুরের চৈত্রমাস যেন অনেক দিন পর জানলা দিয়ে হাত বাড়ালএখন আর ঋতু পরিবর্তন খেয়াল রাখিনা বহুদিন হল, চোখে পড়েনা কখন শীতের ধুসরতা কেটে গিয়ে শান্ত সজিনার ফুল ঝরে গেল, এই ছোট্টো শহরের সীমানা ছাড়িয়ে পলাশের উল্লাস দেখতে যাওয়া হয়না বহুদিনশুধু এই রক্ষণশীল সমাজের মাথায় যেদিন দোল পুর্ণিমার চাঁদ খেলা করে, সেদিন বুঝি বসন্ত পার হয়ে গেলভেতরে বহু পুরনো প্রায় বিবর্ন ফটোগ্রাফের মতো একটা মন্দ লাগা বেজে ওঠে
   আজ হঠাৎ এই ফাঁকা ঘরে অনেক দিন পর একটা সর্বমঙ্গলা বাতাস এসে জানলার পর্দাগুলো এলোমেলো করে দেয়কুড়ি বছর আগে লীলা সায়রের কিনারে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে এরকম হাওয়া দিতঅশত্থ গাছের হলুদ পাতা গুলো উড়ে যেত সায়রের জলের উপর দিয়েউড়ে উড়ে বহুদূর গিয়ে জলে পড়ততারপর ভেসে ভেসে যেত জলের ঝিলমিলের সাথে
বিদিশা বলত—‘ঐ দেখ, নীল পানকৌড়িআমার খুব ইচ্ছে হত ঐ সময় বিদিশার হাত ধরে বলি; ‘নীল পানকৌড়ি ! হয় নাকি রে ! ...তুই বললে সত্যি মনে হয়অথচ তা বলা যায় না কখনোই , অন্তত কুড়ি বছর আগের মূল্যবোধে তা ছিল অসম্ভববিদিশা আমার নিজস্ব প্রেমিকা নয় আমি এক মধ্যস্থতাকারী মাত্র সে সম্বিতের প্রেমিকা হতে চায় লালচে চুলের ফর্সা সদাহাস্য সম্বিতদারুন ছবির হাতগত বছর কলাভবনে চান্সপেয়ে চলে গেছে সে এখন শান্তিনিকেতনেআমি সুমিত, কালো রোগা চেহারা নিয়ে সম্বিত হয়ে বসে থাকি বিদিশার পাশেঅশত্থ গাছের থেকে টুপটাপ জীর্ন পাতা গুলি ঝরে পড়ে বিদিশার কোলে চৈত্রবাতাস মাঝে মাঝে বিদিশার চুল নিয়ে খেলা করেআমি ঝোলা থেকে গোলাপীখাম বার করিআমার ঠিকানায় সম্বিতের চিঠি আসেবিদিশার চিঠিবন্ধখাম বিদিশাকে দিইবিদিশা আনমনে নেড়েচেড়ে আমার হাতে দেয়, বলে; ‘তুই পড়, পড়ে শোনা...আমি ইতস্তত করি, তার পর মধ্যস্থতাকারীর মতো নিরপেক্ষ স্বরে সম্বিত হয়ে সেই চিঠি পড়িআমার কণ্ঠ কি কেঁপে কেঁপে যাচ্চে...?
  “... এখানে এখন বর্ষাকালআম্রকুঞ্জে ধারা বর্ষণ চলছেগতকাল বৃক্ষরোপন উৎসব হয়ে গেল বিদিশা বর্ষাকালে শান্তিনিকেতনের এক অজানা অপরূপ রূপ আছে, জানোএখন মেঘ মাথায় নিয়ে ভাঙাখালের কিনারে বসে আছিসারা বছর যে ভাঙাখাল শুকনো পড়ে থাকে, বর্ষায় সেখানে খরস্রোত বয়ে যায়দেখো বিদিশা, আমার চারিদিকে খোয়ায়ের পাড় ভাঙছে, ধারা নামছে, আমি ভিজে যাচ্ছি, তুমি কোথায় বিদিশা... 
 বিদিশা আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে;-- ‘ আমার মিথ্যেকথা ভাল্লাগেনা সুমিত...
  আমি থতমত খাই, পড়া থেমে যায়
--মানে?
--মানে এসব কথা সম্বিত সত্যি লিখেছে ?
--হ্যাঁ, বর্ষার শান্তিনিকেতন তো এমনই শুনেছি...
--সে তো বিঞ্গাপিত সত্য ক্লাস টেনের রচনা বই তেই পাওয়া যায়, ওখানে যেতে হবে কেনো...
--কি বলছিস...?
--তাছাড়া আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এই লেখা হস্টেলের অন্ধকার বিছায় বসে লেখা...ভাঙাখালের কথা বানানো...
--তাতে কি , হয়তো দুদিন আগে গিয়েছিল, বা পরে...
--তাহলে মিথ্যে লিখবে কেন ?
--মিথ্যে কেনো হবে ?
--মিথ্যে মিথ্যেই... এই যে তুই বসে আছিস, পাশে, সম্বিতের লেখা পড়ে শোনাচ্ছিস...এইটা, এইটা বরং অনেক বেশী সত্যি। (একটু থেমে, খানিকটা যেন অন্য মনে) সারা বছর শুকনো, খরা বর্ষাকালে আমি খরস্রোত নিয়ে কি করবো সুমিত...? আমি আসছি...
   বিদিশা তার লাল মেয়েলি সাইকেল নিয়ে সায়রের পাড়ের রাস্তা দিয়ে চলে যায়সর্বমঙ্গলা বাতাস সায়রের কালো ঝিলমিল জলে ঢেউ তোলে নীল পানকৌড়ি ডুব দেয়, মাছ পায় না, উড়ে যায়...


   ....                   ....                    ....

   

    সন্ধের বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি মা-ছেলে বাড়ি ফিরেছেছেলের মায়ের হাতে হুইস্পারের প্যাকেট দিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসিসামনের দেয়ালে একটা সস্তার ঘড়ি ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ভেতরের দিকে এগোচ্ছেছেলে পাশের ঘরে সুর করে পড়ছে—“তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্না ঘরের চালে, ...দূরে কাদের ছাদের পরে ...ছোট্টো মেয়ে রোদ্দূরে দেয় বেগনী রঙের শাড়ি...না:, সুরটা কেমন যেন পাল্টে গেছেআমাদের ছোটোবেলায় অন্য সুর ছিল এই কবিতা টার ! মনে করার চেষ্টা করি মনকে স্থির করার চেষ্টা করিএকটা সিগারেট ধরায় টেবিলে বসেজানলাটা খুলে দিইদূরে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের পরেও একটা বহু পুরানো কালচে লাল আভা ছড়িয়ে রেখেছে কেউদত্তদের ভাঙা পরিত্যক্ত বাড়ির উঠোনেও অযথা নেমে আসছে সন্ধেসেই সন্ধেও অনেক পুরোনোএকদিন এরকম এক পুরোনো সন্ধেবেলায় এই জানলার পর্দা সরিয়ে বিদিশা বলেছিল;-- এটা পশ্চিম দিক? তোর এই জানলায় প্রতিদিন সূর্যাস্ত হয় ?’ জানলার মরচে পড়া গরাদে মাথা ঠেকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল; ‘আমাদের বাড়িতে কোনো পশ্চিমের জানালা নেই জানিস...সূর্যাস্তও নেইআর সূর্যাস্ত না থাকলে, বল, সে বাড়িতে পাখিদের উড়ে যাওয়া থাকে কি ?
  
    আমি জানলাটা পুনরায় বন্ধ করে দিই উষা আর আমার ছেলের মধ্যে ফিরে যেতে চাই আমিতবু অভিশাপের মতো কেন ফিরে ফিরে আসছে ভাঙা স্বপ্নসূত্র...!
 সেদিনের লীলাসায়রের নীল পানকৌড়ি উড়ে যাওয়ার পর, তার পরের সপ্তাহেই কি ? মনে পড়েনা ঠিককুড়ি বছর পূর্বের স্মৃতি পারম্পর্য রেখে ফিরে আসেনাপরের সপ্তাহে বা পরের মাসেই... সম্বিত বাড়ি এসেছেবিজন ও বাড়ি এসেছে সে কলকাতা রবীন্দ্রভারতীর আর্টের ছাত্রমূলত বিজনদের বাড়িটায় ছিল আমাদের বৈকালিক আড্ডার পিঠ
   সেদিন বিকেলে বিজন একটা ২/২ ক্যানভাসে এক্রেলিক চড়াচ্ছিলবিদিশা এসেছেবিজনের পিঠোপিঠি বোন জয়ীতার সঙ্গে তার খুনসুটির সম্পর্কদেখে মনে হয় খুশ মেজাজশুধু সম্বিত একা লাগোয়া ব্যালকনোতে গম্ভীর হয়ে অযথায় চেয়ে আছে দূরে নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের চুড়ার দিকেএই সম্বিত কখনোই মনের ভাব চেপে রাখতে পারেনাতার ভেতরের উত্তেজনা চেহারায় ফুটে ওঠে
  আমি বিজনদের বাড়ি আসার পথে মধুদার গুমটি থেকে দুটো পান কিনেছিলামমাঝে মাঝে পান খেতে বেশ লাগেএকটা আমার , অন্যটা বিজনের নিজের পানটা মুখে পুরে অন্যটা বিজনের দিকে বাড়িয়ে দিইবিজন পান চিবাতে চিবাতে রঙ চড়ায় ক্যনভাসেএকবার আমার দিকে তাকিয়ে সম্বিতের প্রতি ইঙ্গিত করেতাকে ঐ ভাবে বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে বসি;
--কিরে, মুড্ অফ ?
--চিল দেখছি, নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের চুড়ায় চিলে বাসা বেঁধেছে...
--যা: শালা... এত দূর থেকে দেখতে পেলি !
--চল মন্দিরে যাবি ? কাছে থেকে দেখে আসি...
--সে কি? এখানে সবাই রয়েছে, বিদিশা এসেছে, ধূমল আসবে এক্ষুণি...
   এমন সময় বিদিশা ধীর পায়ে  ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়যেন সম্বিত নেই , এমন ভাবে বলে;
--সারা বছর শুকনো খরা আমার ভাল্লাগে না সুমিত, কখন বর্ষা আসবে,খরস্রোত হবে , তার জন্য আমি বসে থাকব কেনো?
   বুঝি, এই কথার উদ্দেশ্য আমি নইঅন্য কেউ কিন্তু সে ত কাছেই রয়েছেতবে আবার আমায় কেনো ? একটু থেমে বিদিশা বলে;
--আমার জন্য পান আনিস নি সুমিত ?
--তুই পান খাবি...?
--খেতাম...
--আচ্ছা আনছি দাঁড়া, তোরা বস, সম্বিত তুই খাবি তো...?
বিদিশা আমার জামা খামচে ধরে, আমাকে বসায়, নিজেও বসেবলে;
--না, যেতে হবে নাতোর মুখের থেকে দে...
এই সময় আমি অদ্ভূদ একটা ভুমিকম্পের গন্ধ পাই মুখে বলি ;
--ধুৎ, এঁটো পান...
--আমরাতো কোনোদিন এঁটোর বিচার করিনি সুমিত...এই দেখ, আমি তোর থেকে নিচ্ছি, কোনো বাধা দিতে পারবিনা তুই...
 
  নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের অবাক চিল আর লীলা সায়রের থেকে উড়ে আসা সন্ধের নীল পানকৌড়ি (সেই একবারই দেখেছিলাম) কালচে নীল আকাশের পথে উড়ে যেতে যেতে দেখেবিদিশা সরকার তার শুকনো খরা ঠোঁট দিয়ে সুমিত সিদ্ধান্তর অপুষ্ট ফাটা ঠোঁট থেকে লাল মিঠাপান শুষে নিচ্ছেপানকৌড়ি অবাক বিস্ময়ে আকাশের গা থেকে খসে যেতে যেতে পুনরায় উড়ে যায় পূর্ব দিগন্তের দিকে, যেদিকে বাসায় তার অপেক্ষার পুরুষ পাখিটি


....                        .....                   .....

 


    উষা মশারি টাঙাচ্ছিলবাবাই পাশের ঘরে সিঙ্গেল খাটিয়ায় বই পত্তরের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেওকে নিয়ে এসে এঘরে শুয়িয়ে দিই উষা মশারির ধার গুঁজতে গুঁজতে বলে;--সন্ধেবেলা তোমার বন্ধু সম্বিত ব্যানার্জী ফোন করেছিল
--হ্যাঁ ,ওর বিয়ে তো, কিছু বলল...?
--এমনি খবর নিচ্ছিল, ছেলে কেমন আছে, এই সব...
--বিশেষ কিছু ?
--না:, বলল তোমকে মেল করেছে, দেখতে...
সম্বিত মাঝে মাঝে মেল করে, ওর সদ্য আঁকা কোনো ছবি পাঠায়, ফটোগ্রাফঅথবা কবিতাহ্যাঁ, সম্বিত এখনো লেখে


....                     ....                        ....



এই মফস্বল শহরের দুর্বল সার্ভারের চাকা ঘুরতেই থাকেসম্বিতের মেইলের সাথে তিনটে এটাচমেন্ট ফাইলডাউনলোড হচ্ছেউষা মশারির ভেতর থেকে বলে;
--আচ্ছা, সম্বিত ব্যানার্জীর কি একটা এ্যাফেয়ার ছিলো না...?
--হুঁ...
-- সে এখন কোথায় ?
--জানিনা...
--জানোনা সত্যি !(উষার গলায় তাচ্ছিল্যের সুর) বেশ, আমি শুয়ে পড়লাম, আলোটা নিভিয়ে দিও...


  এ্যাটাচমেন্ট ফাইলে দুটো ফটোগ্রাফএকটা নদীর ছবি, অন্যটা একটা ব্রীজ, সম্ভবত ঐ নদীর উপরেইআর তিন নম্বরটা একটা বিদেশী কাগজের আর্টিকেলএর অংশ
  কিন্তু এটা কোন নদী ? কোথায় ? আরে ... ওগুলো কি ? পাখির ঝাঁক ! নদীর কিনারা জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বসে আছে ডানা মুড়েযেন বহুযুগের ধূসর পাতা থেকে উড়ে আসা , আবছা দেখা যায় তার ধূসর নীলচে-রুপালী রং...!
    জুম ইন্ , জুম ইন্, ...নীল পানকৌড়ি !

   আর্টিকেলের বাংলা তর্জমা :
২৪শে মার্চ, ২০১৩ , মায়া টাইমস্
আজ ভোর সাড়ে ছটা নাগেদ এক অদ্ভুদ দুর্ঘটনার কারনে কশেরু নদী কতৃর্পক্ষ কশেরু ব্রীজের একটি লেন প্রায় ২৫মিনিট বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়খবরে প্রকাশ এক মহিলা তার গাড়ি সহ সেতুর রেলিং ভেঙে নদীতে পড়ে যানপুলিশ এখনো পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পায় নিপ্রবল ভাবে ক্ষতি গ্রস্ত গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছেনিখোঁজ মহিলা ভারতীয় নাগরিক শ্রীমতী বিদিশা সরকারের বেঁচে থাকার আসা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তদন্তরত পুলিশ অফিসার...

--উষা -- উষাউষা...
--কি হলো ? আস্তে, বাবাই উঠে পড়বে...
--তুমি কখনো নীল পানকৌড়ি পাখি দেখেছো উষা ?
--এতো রাতে কি শুরু করেছো বলতো...?
--তোমাকে বিদিশার কথা বলেছিলাম ?
--তোমাদের সেই বান্ধবী ?
--হ্যাঁ, দেখো, আমারা কেউ বিশ্বাস করিনি অথচ ও প্রায়ই বলত এক নীল পানকৌড়ি পাখির কথাঐ দেখএটা এক সাতসমুদ্র পারের নদী কিনারদেখো, তার আঘাটায় বসে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে নীল পাখি, পানকৌড়িঐ অতদূর সাতসমুদ্র পারে গিয়ে সে নীল পানকৌড়ির দেখা পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলএত বছর ধরে কি সে তবে নীল পাখির খোঁজে অর্ধেক পৃথিবী ফিরছিল ? আমরাতো কবেই ভুলে গেছি সেই পাখির কথা! ভেবেছি ওসব গল্পের পাখি, জীবনের সাথে তার হয় নাকো দেখা ! শুধু জীবনের অসতর্ক বিশেষ মুহুর্তে সে গল্পের মিনারে উড়ে আসে, মুহুর্তেই উড়ে যায়সে মুহুর্ত ভুলে যাওয়া ভালোআমাদের সমৃদ্ধ সংসারে তার কোনো উড়ে আসা নেই  বিদিশা সেই পাখির দেখা পেয়ে গেছেতার ক্যামেরায় পাওয়া গেছে এই দুটি ছবি...শোনো উষা, এবার যেকোনো দিন, আমাদের যেকোনো অসতর্ক নিদ্রার ভেতর সে উঠে আসবেআমার, সম্বিতের, অথবা তোমারো নিদ্রার ভেতরে , উষা...! এমন কি সম্বিতের সেই অনুদ্দিষ্ট অচেনা নারীর নিদ্রার ভেতরেও উঠে এসে সে জানাবে; নীল পানকৌড়ি পাখির দেখা সে পেয়েছেযাদের হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হয়ে গেছে, তারা আর সে পাখির পায় নাকো দেখা...উষা, জাগো, আজ রাতে ঘুমিয়ে পোড়ো না...



.....                 .....             .....


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন