মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬

বাংলা কবিতার মেঘে তনুভূত জল

বাংলা কবিতার মেঘে তনুভূত জল ;
নব্বই ও তারপরের কবিতায় আধ্যাত্মিকতা...


“আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি...”
--জীবনানন্দ।



ত্রিকাল মায়ার ঘেরে পড়ে গেছে এ পৌণ্ড্রবর্ধন
অতীত সুবর্ণময়, বঙ্কিম স্বভাবে যাকে ছেনে
ভবিষ্য হীরকখণ্ড নির্মাণ করেছে চাঁদবেনে,
অধুনা সেও নাকি ভিখারিনী, পড়ে পাওয়া ধন
হঠাৎ হাওয়ার সাথে, কলমের তাই উজ্জীবন।

জাগরণে বিভাবরী থমকি থামিল কোথা এসে?
কালের গভীরে কেউ বাদ্য করে মৃদঙ্গ ত্রিতাল,
কালের অজস্র মুখে অসংখ্য কালের মুখ মেশে,
অনেক কালের বুকে শুয়ে পড়ে কাল ভালোবেসে--

এ কোন প্রবল ধাঁধা, রহস্যের পাথারে বাঙালী
ভাসায় কাব্যের স্রোত, কাল বুঝে অথবা না বুঝে?
ব্যাকরণ ডুবে যায় কালের অতল আনখুঁজে,
কেবল ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে ইচ্ছাময়ী কালী”।।
(অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়/ গ্রন্থ: শাক্ত চতুর্দশপদী)

আধ্যাত্মিকতা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার কোনো যোগ্যতা আমার মতো অজ্ঞেয়বাদীর আছে কিনা জানি না। এই অজ্ঞানতা প্রথমেই স্বীকার করে রাখা ভালো। সাম্প্রতিক কালের কিছু কবিতা পাঠ করতে করতে আমারা বরং সেই দিকে, সেই পথের সন্ধানে যাবো, যেখানে—“কেবল ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে ইচ্ছাময়ী কালী” ।     এই তো! এখন পংক্তিটি একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়ে গেল এই মুহূর্তে। ইচ্ছাময়ী আমাদের ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে, অর্থাৎ যে যেরকম ভাবে তাকে ভেবে নেব, আপন করব—এই আর কি।
   তবু বাংলা কবিতার একটা আবহমান রূপ যেন এই পংক্তি ক’টির ভিতর  সংহতি খুঁজে পাচ্ছে। বাংলা কবিতার আবহমান রূপ মানে কি? কাব্য-রূপের আবার আবহমানতাই বা কি? এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবু কাব্য-ভাষা বদলাতে বদলাতে যেদিকেই যাক তার অন্তঃস্থলে রয়ে গেছে সেই আদি ইচ্ছাময়ী, তার উপস্থিতি ব্যতীত কাব্যদেহ প্রাণহীন। এই প্রাণ, এই প্রতিষ্ঠাই কাব্যের আধ্যাত্মিকতা কিনা তা ভাবনার বিষয়। জীবনানন্দ যেমন বলেছেন--–“সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়--- কিম্বা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়,যে মনে হয়, --এই সমস্ত জিনিষই অনেকদিন ধরে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে,আরো অনেক দিন পর্যন্ত, হয়ত মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরাণ রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদ্গীরণের ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভূতির সৃষ্টি হয় ।"—তো এই অনুভূতি আধ্যাত্মিক অনুভূতি কিনা তিনি পরিষ্কার করে বলেন নি কোনোদিন। তবু , এই যে তিনি বললেন ‘...কোথাও যেন রয়ে যাবে’—এই যে প্রায় প্রশ্ন বোধক অনন্ত, এই অনন্তই হয়তো বা সেই , যাকে আমরা কোনোদিন সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। এবং পারি না বলেই তা অশেষ! আবহমান! বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক কবিতার বিষয়ভিত্তিহীনতা ও ভাষার জাগলিং-এর গড্ডালিকার দিকটি বাদ দিলে কাব্যমাত্রই অনুভূতি প্রসূত। যা মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে বলে মনে হয়। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় যেমন বলেছেন—‘কালের অজস্র মুখে অসংখ্য কালের মুখ মেশে,/অনেক কালের বুকে শুয়ে পড়ে কাল ভালোবেসে’ ।


    তেমনি বাংলা কবিতার নব্বইএর দশক একটি বিশেষ কালখণ্ড, যার বিশেষত্ব এই যে, সে আশির দশকের পরবর্তী দশক এবং শূন্য দশকের পূর্ববর্তী। এছাড়া সমস্তটাই আবহমানতা। তবু আমাদের কারো কারো কাছে এই কালখণ্ডের কি অপরিসীম ব্যঞ্জনা! অর্থাৎ আমরা যারা কেউ কেউ এই দশকটিতে পৃথিবীকে চিনতে শিখেছিলাম এক নতুন চোখে। নবীন বয়সের উচ্ছ্বাসে। সে হল আমাদের কবিতাবেলার কৈশোর --তাই তাকে পারিনা এড়াতে। তো এইসময় যে সকল কবি বাংলা কবিতার জগতে পা রেখেছিলেন, এবং জয় করেছিলেন, সত্যি বলতে তাদের বেশীর ভাগই এক-দশকের ব্যবধানে অন্তর্হিত প্রায়, প্রথম বাল্য-প্রেমের মতো কবিতা তাদের ছেড়ে গেছে বহুদিন। আরো কেউ কেউ যারা অভ্যাসের বশে রয়ে গেছেন তারাও ম্রিয়মাণ। এ আমাদের পরম দুঃখ। সেই উচ্ছ্বাস, সেই ঝড়, সেই অপ্রতিরোধ্যতার ভেতর কোথায় যে ধ্বংসের বীজ লুকানো ছিল, আমরা চিনতে পারিনি তাকে। হয়তো চিনতে চাইনি। কারণ সেই সময় মূহূর্মুহু ঘোষিত হচ্ছে নতুন নতুন লিটিল ম্যাগাজিন, সেখানে ঘোষিত হচ্ছে বাংলা কবিতাকে হতে হবে গ্রাম্যতা বর্জিত, স্মার্ট ও শহুরে। এবং এই ডাকে সাড়া দিয়ে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপের সমস্ত কবিগন স্মার্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। গ্রাম্য শব্দ, লোকজ শব্দ কবিতার থেকে ঝেড়ে ফেলে সে এক নতুন ময়ুরপূচ্ছধারী হয়ে উঠছেন গ্রামীণ কবিরাও। ভেতরের প্রাণের কথা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছিল কেন যে, কে জানে! এবং এইসব বৈশিষ্ট্যগুলি না থাকলে বিখ্যাত শ্রেষ্ঠ পত্রিকা তো বটেই বিখ্যাত লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতেও স্থান পাওয়া দুষ্কর হয়ে  উঠছিল। একটি লিটিল ম্যাগাজিনের প্রখ্যাত সম্পাদক সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন—আমাদের পত্রিকা পরবর্তী বাংলা কবিতা পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, তা খানিকটা পাল্টেছে বৈকি! এই যে গায়ের জোরে বদল, এর পরিণাম ভাল হয় নি কখনো কোথাও । সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এই যে প্রকৃত-বিজ্ঞানহীন প্রযুক্তির শাসন। পৃথিবীর সমস্ত নদী স্রোতের উপরে বাঁধ, তার সাময়িক সুবিধাগুলি স্বীকার করেও ভবিষ্যতের অপূরণীয় ক্ষতি ও ধ্বংসের কথা প্রযুক্তি বলে যেতে পারেনি। যা বলা সম্ভব ছিল প্রকৃত বিজ্ঞানের পক্ষে। ঠিক সেইরকম, প্রাণহীন আঙ্গিকসর্বস্ব  বাংলা কবিতায় এই জোরপূর্বক বদল কতদূর সহনীয় জানি না।। কেউ কেউ বলবেন এতে কারো কিছু যায় আসে না, ভাষা-প্রবাহ তার আপন পথেই চলবে, তবু বিরুদ্ধ-শক্তি এই প্রবাহের পথ বহুদূর পর্যন্ত রোধ করতে সক্ষম, তার স্বাভাবিক প্রবাহের পথে বাধা আনতেও সক্ষম। সে হেতু সাম্প্রতিক প্রাণহীন বাংলা কবিতার বাড়-বাড়ন্তের জন্য আমি অনেকাংশেই এইসব পত্রিকা সম্পাদকদের অবিমৃশ্যকারিতাকেও দায়ী করি।
   তবু, যে কথায় পৌঁছানোর জন্য এইসব তিক্ততার অবতারণা সেইখানে ফিরে আসি, সেই নব্বই-এর দশকের চিৎকারের অন্তরালেও কেউ কেউ লুকিয়ে ছিলেন অন্য এক অন্বেষণের চেষ্টায়, যেমন সব কালেই থাকেন কেউ কেউ। তারা ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলেন সময়ের স্মিত ছায়া সরে যাবার পর। এক দশক, দুদশক পর, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একফর্মা দুফর্মার দুর্বল চটি বইগুলি, স্যাঁতস্যাঁতে খাটিয়ার তলা থেকে বিবর্ণ, অনুজ্জ্বল, আনস্মার্ট, গ্রাম্য খাতাগুলি কোথাও কোথাও পুনরায় ছাপা হতে দেখা গেল। তাদের কাব্যে ছিল সেই মায়া! সেই অনন্তঃ, সেই জাফরাণ রৌদ্রালোক—যা সমকালকে ছাড়িয়ে সামনে ও পিছনে আদিগন্ত মেঠোপথের মতো বহুদূর ছড়িয়ে রয়েছে—

জীবন উঠোন মাত্র সারাদিন পাতা ঝ’রে পড়ে
জগতের, জীবনের, সোনালী হলুদ সব পাতা
সারাদিন চুপ ব’সে পাতাদের ঝ’রে পড়া দেখি
সারারাত ধ’রে শুনি শুধু বাতাসের কথকতা
অপেক্ষা অপেক্ষা শুধু কোন এক শান্ত সকালের
ঝরা পাতা আর ফুলে ভরে আছে সামান্য উঠোন
কতদিন কত খেলা করা হল সকলের সাথে
আজ সেই কথা তাই অবিরাম ভেবে যায় মন
সকালবেলার কথা তবু চিরদিন থাকে জেগে
শিউলিতলায় বলো কতদিন ছুটে গেছি আমি
সাদা রঙ ক্রমে দেখি লাল আরো লাল হতে থাকে
দিগন্তও দেখি মাতে অপরূপ হোলির খেলায়
জীবন উঠোন মাত্র সারাদিন পাতা ঝরে পড়ে
জগতের জীবনের সোনালী হলুদ সব পাতা...

(পার্থপ্রতিম মজুমদার/ গ্রন্থ: শ্যাম অন্ধকারে/ ‘অনুরাগ’ পর্যায়)

 এক ধরনের কবিতা আছে, যা অংশমাত্র উদ্ধৃতি করলে তার ভেতরের সঙ্গীত-ধর্মীতা নষ্ট  হয় বলে আমার ধারণা। এবং যা বলতে চেয়েছি তাও পুরোটা বলা হয়ে ওঠে না। এবং সেই ভাষাহীন অনুভূতির আকুতি, যা সঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে কখনো কখনো মানুষের গহনে, তাও বোঝানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আর ভাষা যেখানে পথ পায় না সেখানে যে সঙ্গীত একমাত্র পথ! তবু কবিতা, কাব্য আগাগোড়া ভাষাজালে বদ্ধ। তাকে মুক্ত করবার প্রয়াসমাত্র এই সঙ্গীত-ধর্মীতা প্রদানে, সেটুকু নষ্ট করলে কবির আর কি অবশিষ্ট থাকে! তার আকুতি, তার জীবনের প্রতি অসীম মমতা ও খোঁজ, তাকে কি আমরা ধরতে পারলাম...। যাই হোক, এই কবিতাটির মধ্যে দিয়েই হয়তো আমরা হঠাৎ ঢুকে পড়লাম আমাদের বিষয়ের ভেতরে। -- আধ্যাত্মিকতা!

   মানুষ তার চেতনা, তার ভাব নিয়ে সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই এক অন্বেষণ জারি রেখেছে। বিজ্ঞান দর্শন কাব্যের ভিন্ন ভিন্ন পথে সে খুঁজে বেড়িয়েছে তার অতীত। তার উৎস। এই জীবন ও জগতের অর্থ ।  এই উৎসের খোঁজে সে ঘর ছেড়েছে, সমাজ সংসার ছেড়ে কেউ কেউ মহাসংসারের দিকে চলে গেছে। এবং চলেছে । স্টিফেন হকিং কথিত আদি মহাবিস্ফোরণের থেকে ছড়িয়ে পড়া ব্রহ্মাণ্ডপুঞ্জ ক্রমশ যেমন ছড়িয়ে পড়ছে তার কেন্দ্র থেকে আরো আরো দূরে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরস্পর থেকে প্রতিটি কণা, আর তাদের ভিতর থেকে হাহাকার উঠছে—‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর...’ আবার--আবার কখনো হয়তো ফিরে আসবে তারা পরস্পরের দিকে, মিলিত হবে নিজস্ব মণ্ডলে, এক পরম ভরের ভেতর সমগ্র শক্তিপুঞ্জ! এক অসীম কেন্দ্রাতিক অভিকর্ষ, যা তাকে ক্রমশ নিজের কেন্দ্রের দিকে, কুলকুণ্ডলিনীর দিকে টেনে নিয়ে যাবে ক্রমশ শূন্যের দিকে? কি আশ্চর্য আর কি মহাকায় সেই মিলন! অনন্তের অন্তে, সেই মিলনের আকুতিই কি তবে কবিতার ভাষাহীন সৌন্দর্য? ব্যাখ্যাতীত? আধ্যাত্মিকতা? এর থেকে বহুদূরে এই বিশ্ব-মানবের মেঠো পথ।  যেখানে পৃথিবীর আকাশে সূর্যোদয় হয়, ফুল ফোটে, আর ঐ মহাসংকেতের ঈঙ্গিতে  প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে যায়! অথবা, একাকী পথিক যেভাবে মিশে যায় পথে?

যেভাবে দিগন্তরেখা
মিশে যায় মাটি ও আকাশে
যেভাবে বসুন্ধরা
ছেয়ে যায় অনাবিল ঘাসে
আমিও তোমার মাঝে
একদিন মিশে যাব ঠিক
যেভাবে পথের বুকে
মিশে যায় একাকী পথিক...
(প্রেমের কবিতা / স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য /১৯৭১--)




   এই পৃথিবীর সামাজিক মানুষের কাছে, অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষে আধ্যাত্মিকতা বিষয়টির অর্থ হয়তো ভিন্ন। প্রথানুগ ভাবনা অনুযায়ী তাকে  ঈশ্বর বিষয়ক ভাবনা ও তাঁর দিকে যাত্রার এক পথ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। যদিও সেই পথ এক নয় সকলের কাছে। এবং নিরাকার ঈশ্বরের ধারণাও প্রত্যেকের কাছে ভিন্ন তথা বিমূর্ত। আমরা একে অন্যের ধারণার কথা জানি না। ভাবতে গেলে, যেন এই ধারণার ভিন্নতাই মূলত ঈশ্বর প্রতিম। অর্থাৎ ঈশ্বরের ধারণাই ঈশ্বর। এ এক জটিল আবর্ত! একজন সচ্ছল, আপাত সুখী মানুষের অবসরের ঈশ্বর আর একজন মেহনতি কৃষকের ঈশ্বর মূলত এক নয়। মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থান, তাদের মানসিক গঠন, শিক্ষা ,পরিবেশ প্রভৃতি ঈশ্বরকেও ভিন্ন করে দেয়। মার খেতে খেতে মার খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কাছে ঈশ্বর মূলত এই ধ্বস্ত জীবন থেকে মুক্তির পথ ছাড়া আর কিছু নয়। আবার একজন বড়বাজারের গদিতে বসা ব্যবসায়ীর কাছে ঈশ্বর মূলত গণেশের মূর্তি, ক্যাশ বাক্স আর শাঁসালো খদ্দেরের ভেতর ঘোরাফেরা করে। এইসব কিছু থেকে বহুদূরে, অথবা এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই একজন কবি অথবা একজন শিল্পীর ঈশ্বর আনমনে পথ হেঁটে যায়।  হয়তো সেও বহু দুঃখে অপমানে সিক্ত, তবু সুর সন্ধানী সে--


‘জল্লাদেরা জ্বাল দিচ্ছে মৃৎপাত্রে মারাত্মক বিষ—
ছায়াপাতে কেঁপে উঠছে নিভে আসা তোমার সময়!
তবু তুমি বাঁশি হাতে শেখো সুর! ওহে সক্রেটিস!
কী লাভ এ সুরে আর?—দণ্ড দুই বই তো আর নয়...’

‘দণ্ড দুই বই তো আর নয়—
তাই এই দণ্ড দুয়ে যদি
সুরের নতুন সিঁড়ি পারি ছুঁয়ে যেতে—
আরো এক পারানির কড়ি
জমা হবে এই দাহ্য মাটির ঝুলিতে—
আর কিছু নয়।
প্রকৃত পথিক জানে
প্রতিটি লগ্নই তার
গমনের শুদ্ধ সুসময়...’

(শুদ্ধ সুসময় / সপ্তর্ষি বিশ্বাস/গ্রন্থ: দাহ্য মাধুকরী)

   সুসময় বলে ভিন্ন কোনো কাল নেই। লগ্ন, নক্ষত্র, মাহেন্দ্রক্ষণ, তিথী, চন্দ্র, সূর্য নিরপেক্ষ সে। প্রতিটি লগ্নই তার গমনের শুদ্ধ সুসময়...সমস্ত কাল সুরে বাঁধা।
   বন্ধুবর কবি সপ্তর্ষি বিশ্বাসের সাথে এই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল একবার। তার মতে-- কাব্য বা শিল্পের আলোচনায় আধ্যাত্মিকতা থেকে প্রথমেই প্রথাগত ঈশ্বর চিন্তাকে বাদ দিতে হবে। এবং একেবারে সামনে রাখতে হবে কাব্য ও শিল্পের ভেতরের সৌন্দর্য্যানুভুতিকে। প্রকৃতি ও মানুষের ভেতরের সুর ও সুন্দরকে। যা প্রকৃত জীবন। সেই সুন্দরের ভিতর দিয়েই বরং  এগিয়ে যাওয়া যাবে অভীষ্টের দিকে।
এই মতবাদের ভিতর দিয়ে যখন তার কবিতাকে লক্ষ্য করি। দেখি, সেখানে এক এ্যান্টি-স্পিরিচ্যুয়ালিজম ঘাপটি মেরে আছে। এ্যান্টি-স্পিরিচ্যুয়ালিজম কথাটা রসিকতা করে বলা। মানিক চক্রবর্তীর এ্যান্টিপোয়েট্রি যেমন আদতে কবিতাই, শুধু গতানুগতিকতাকে সদর্থে ভাঙা এবং তার খোলোসকে ছুঁড়ে ফেলে এক অন্য রূপ দান করা, এও তেমন—স্পিরিচ্যুয়ালিজম থেকে প্রথমেই গতানুগতিক ঈশ্বরকে বাদ।
‘-- ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর
দেবতাও ব্যাথাতে কাতর...

হে দেবতা কবে তুমি ক্রোধে
তুলে নেবে নিজেও পাথর ?’

  কবীরের দোঁহা, বৈষ্ণব কবির কাব্য,  রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় আধ্যাত্মিকতার যে সুর,  তার থেকে যেনো বহুদূরের এই অবস্থান। (একমাত্র চর্যার সুর ছিল একেবারে মাটির কাছে) এখানে ভক্তি নয়, মূলত সখারূপ ঈশ্বর, বন্ধুর মতো তাকে ধমক দেওয়া যায়, এমন কি গালিগালাজ পর্যন্ত করা যায়। অন্তত এই কালখণ্ডে এসে কবির পরিবর্তিত মানসপট এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বাংলার সুপ্রাচীন ভক্তিগীতি বা প্রার্থনাসঙ্গীতের উল্টোদিকে আরো কাছাকাছি এক অবস্থান কবি তৈরি করতে পেরেছেন। অথবা সময় সেই অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে।   কবিগন নিমিত্ত মাত্র।

   প্রকৃত অনুভব শুধু গ্রাম শহরের বেড়া নয়, সময়ের বেড়া ভেঙে ফেলেও মানুষের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, এরপর সে কথা নতুন করে বলার কিছু নয়, তবু যখন কবিতাকে গ্রাম্য ও শহুরে ভাগে কেউ ভাগ করতে চায় তখন সেই পুরানো কথাগুলোই আবার—আবার বৃত্তাকারে সামনে চলে আসে। মানুষের জীবনের কথা, তার উৎসের দিকে যাওয়ার কথা। সব দেবতাকে ছেড়ে তার প্রাণের কাছে যেতে চাওয়া। ধরা যাক একজন শহুরে কবি, আদ্যন্ত যার শহরে বাস, শহরেই বেড়ে ওঠা, কর্মপোলক্ষে যদিও সে জগত দেখছে, মানুষ দেখছে, আর তার অন্তরচক্ষু খুলে গেছে। একদিন সকালে স্নান সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় পা দিয়ে অবাক হয়ে দেখে-- উল্টোদিকের ফুটপাতে বসে আছে গিরিকন্যা উমা! তার পায়ে রূপার নূপুর, উলোঝুলো চুল, কপালে ত্রিনয়নের মতো লেপ্টে আছে গেঁয়ো কুমকুম, বাপের সাথে শহরে এসেছে সে কোনো কাজের খোঁজে—

গিরিরাজকন্যা, কেন কলকাতার গলি-গুহামুখে
পিঁড়ি পেতে বসে আছো, কেন?

তুমি কোন পাহাড়ের খরস্রোতা হয়ে
জন্মেছিলে বনের ছায়ায়?

লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে উৎরাইয়ের পথ;
আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়তো কিছুটা;

লতায় জড়াতো চুল...
খ’সে পড়তো বুনো ফুল...
তবু এই পরিণাম সে সরল অধঃপতনের!

আমি লজ্জা লুকোবার ফাঁকে
দেখেছি তোমাকে
তুমি
দোষ নিও না পাহাড়ের মেয়ে।
সাকুল্যে খুব জোর, আর কিছু নয়, ওই
গ্লানির নূপুর-পায়ে হাত বুলোতাম, কাছে পেয়ে।

(বেনাম্নী/ শোভন ভট্টাচার্য/গ্রন্থ: ধ্বংসে লেখা ধ্রুপদ)
 
   ...আর মানুষের কাছাকাছি থাকা।  মানুষের দুঃখের, অপমানের পাশে এসে বসা—এর চেয়ে বড় আর কি? “কবিতা তুমি কেমন আছো?/যেমন থাকে ভালবাসার মানুষ, অপমানে...”—বামপন্থী এই কবির এই কবিতাটিকে যদি একটি পরম আধ্যাত্মিক কবিতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরি, কেউ কিছু মনে করবেন? অন্তঃত আধ্যাত্মিকতার প্রথাগত ট্যাবু ভেঙে ফেলে তার ব্যাপ্তি আরো খানিক বেড়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এবং এই আলোচনাতে সেই চিরাচরিত অবলোকন থেকে একটু ঘুরপথে যদি যেতে চাই, নিশ্চিত আপত্তি হবে না কারো। এতে কবিতার তথা শিল্পের ভেতরে যাবার পথ হয়তো সহজ হবে কিছুটা।
   যদি বলি নব্বই দশকের একজন খুব আউট-স্ট্যান্ডিং কবি ভূদেব কর, তাহলে খুব বাড়াবাড়ি হবে না বোধহয়। ভূদেবদার বয়স (জন্ম:১৯৫৮) নব্বই এর কবিদের চেয়ে কিঞ্চিত বেশী। হয়তো একটু দেরীতেই তিনি প্রকাশ্যে এসেছিলেন। নয়তো তিনি সত্তরের কবি হয়ে যেতে পারতেন অনায়াসে। দশক বিচারের এই এক অসুবিধা, আবার সুবিধাও। সুবিধা এই যে আমরা ভূদেবদাকে এই আলোচনাতে টেনে আনতে পারছি। এবং এই টেনে আনা অহেতুক নয়। আত্মব্যঙ্গসহ বহু তির্যক রঙ্গ রসিকতাগুলি পাশ কাটিয়ে তাঁর প্রাণের ভেতরের যে কথাগুলি তিনি গোপনে লিখে ফেলেছিলেন তার দু-এক ছত্র এখানে পাঠকের উদ্দেশ্যে দেওয়া খুব অন্যায় হবে না । উপরের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটির সাথে একটা বহুদূরের অথচ গভীর সাদৃশ্যও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে—

এর মধ্যে কতগুলি বৃষ্টির বিকেল ঢুকে আছে আমি জানি না।
অনেকদিনের কথা মনে রাখতে পারি না।
প্রত্যেকবার শীতে গুটিয়ে ছোটো হয়ে গেছি
শীত কেটে গেলে মনে থাকেনি।
হাত পা ভেঙেছি, মেঘের গম্ভীর গর্জনে
ভয়ে ছিটকে গেছি কাদায়
একটি কিশোরী দেখে’ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেছি
সে যে কতদিন অথবা কতবার আমার মনে নেই।
খেতে পাইনি একদম তাও নয়
তবু স্রেফ দুটো লুচি খাব বলে
অপরিচিতের দলে চ’লে গেছি কতদূর
পেট ভরে গেলে মনে হয়েছে অল্প অপমান ছিল।
লুচির সঙ্গে হালকা ঘিয়ের মতন জড়ানো সেই অপমান
বেশিদিন মনে রাখিনি।

মানুষ থাকে এক এক রকম, অনেকদিন ধ’রে রচিত হয়।
সব কিছু মনেও থাকে না।
হয়তো চল্লিশ বছর ধরে একটাই বাতাস ঘুরে ফিরে
বয়ে চলেছে
আমি টের পাচ্ছি না...
(‘১৯৫৮—২০০২’ নামক দীর্ঘকবিতার অংশ)
   --এই কবিতাটির ভেতর কোথায় কোন লাইনের ভেতর আধ্যাত্মিকতা লুকানো রয়েছে দয়া করে এই প্রশ্ন আমায় করবেন না। শুধু এই ঘনঘোর জীবনের ভেতর অল্প শীতবোধসহ, ভুলে যাওয়া ছেলেবেলার অপমানসহ, একটি কিশোরীর সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা এবং একটাই বাতাসের ঘুরে ফিরে যাওয়া তিনি আমাদের ভেতর বইয়ে দিলেন। কি বলব এই বহমান বাতাস কে, তার আবেদন কে? সারা জীবন ধরে একটাই বাতাস ঘুরে ফিরে একটাই বৃত্ত রচনা করে একজন মানুষের জীবনে। বৃত্ত এক পূর্ণতা। কবি আলোক সরকার বলেছিলেন-- “...‘ঈশ্বর’ হল এক ‘সম্পূর্ণতা’...“—আমরা এই প্রসঙ্গে পরে আবার ফিরে আসব এই নিবন্ধে।
এবং  আমরা দেখব কিভাবে নিবেদনের  ভাষা পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। বাংলা কবিতার ‘ফুল পাখি চাঁদ’ এই সকলের ‘মাখো মাখো’ আবহর প্রতি বিদ্রুপ মিশ্রিত গালাগালি নতুন কিছু নয়। কোন মনোগত অভিপ্রায় ও চাহিদা থেকে এই বিরূপতা , তাও একটু ভাবলেই বোঝা যাবে। কারন ফুল পাখি চাঁদ প্রেম –এই সকল আবহমানতা থেকে মানুষের ব্যাবহারিক ও আত্মজৈবনিক বিচ্যুতিই আমাদের বিরূপতার দিকে নিয়ে যায়। আর প্রকৃত যে কবি, তিনি এই সকলকেই সময়ের এক দারুণ প্রেক্ষাপটে আবিস্কার করতে সক্ষম হন। তখন সেই ‘মাখো মাখো’ ভাবালুতা আর থাকে না। বরং তার আবিস্কার পাঠককে তার সুবাস-মথিত এক উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে রাখে—

কী এক ফুলের গন্ধ
শ্বাসে শ্বাসে রক্তে গেল মিশে
ঘ্রাণের গভীর তলদেশে
ঘণীভূত হয়ে উঠল কুসুম শরীর

গন্ধের মাদকে বুঁদ
কখন যে ফুল হয়ে থেমে গেছে বুকের বাতাস
জ্যোতির্ময়, স্তব্ধহৃদাকাশ

এইকানে, আলোর শরীরে
লীন হতে এসেছে সৌরভ,
ন ইলে সে কী কারণে আসে?
ফুল আর উদ্ভিন্ন প্রকাশে
বাতাসে ভাসিয়ে দেয় এ দিওয়ানাপন?

কামিনী কাঞ্চন বেলি
গোলাপ করবী লিলি
আরো কত অনাম অজানা
ফুলেরা উঠেছে ফুটে
মধু ও বিষের কুটে
রূপে রূপে চক্ষু হল কানা

চোখ বুজে খুশবু নিই
আলোর শরীর সেই
খুশবু ঘন ফুল হয়ে ফোটে

আলোর পাপড়ি মেলে
আলোতে সে ঢেউ তোলে
আলোর মৌমাছি এসে জোটে ।
(লীলাকমল/অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় /১৯৭৪/গ্রন্থ: লীলাকমল)


  কবি বীতশোক ভট্টাচার্য, দেবাশিস তরফদার আদি কবির অনুবাদে আমরা জেন দর্শনের অদ্ভুত আধ্যাত্মিক কবিতাগুলি পড়েছি। এবং আশ্চর্য হয়েছি সারা জীবন মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে, ঈশ্বরের খোঁজে, সটোরি লাভের জন্য, কাব্য ও শিল্পের খোঁজে হেঁটে চলেছে কি ভাবে! প্রাচীন চৈনিক পেইন্টিং এ যেমন দেখি—সমগ্র পট জুড়ে অনন্ত মহাকাশ, সুবিশাল পর্বতমালা, ঘন-বনানীর নিচে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র মানুষ! এই যে মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বড় বিশ্ব-প্রকৃতি, তারচেয়েও আরো অনেক বড় এক মহাকাশ, হয়তো বা ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ তা, --যা আমাদের মনের ভেতর স্বাভাবিক রূপেই ছিল একদিন। যখন আমরা ছিলাম প্রকৃতির সন্তান। হয়তো মন ও চেতনার দুইতৃতিয়াংশ জুড়ে তখন ছিল প্রকৃতি। সভ্যতা যত বিজ্ঞানহীন প্রযুক্তির পথে এগিয়েছে, ভোগ ও লালসা যত গ্রাস করেছে চেতনাকে, ততোই আমরা প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গেছি। মনের স্বাভাবিক কবিতাগুলিকে এড়িয়ে আধুনিক হয়ে উঠতে চেয়েছি। অথচ এই বঙ্গেই কোথাও কোথাও কোনো গ্রামীণ কবির কলমে এখনো হয়তো বেজে ওঠে সেই হাওয়া, যা হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে যায় না কোনোদিন। প্রথাগত আধ্যাত্মিকতার প্রলেপ এখানে নেই, তবু মনে হয় জেন-বাদী পেইন্টিং এরই কাছাকাছি কিছু—
এ পথ কাউকে না কাউকে দেখাতেই হত
তবু তুমি প্রথমা হয়ে উঠলে
আমি প্রথম
আঃ চারিদিকে এত আলো
সব যেন ঝলমল করে উঠছে
খড়ের পাখিটিও প্রাণবন্ত, যেন
কথা কয়ে উঠলো--'ও লক্ষ্মী, দেখ, কে যেন এয়েচে'
আমি ফিস ফিস করে বলি
প্রায় নিঃশব্দে বলি,--ঐদিকে যাবো
ঐদিকে নিয়ে চলো পথের কাঙাল...
(পথ/ শীতল বিশ্বাস)


এবং আরো আছে। সেমন এই কবিতাটি, যা পড়লেই মনে হবে যেন কোনো জেন সন্ন্যাসীই হয়তোবা এর রচয়িতা।


বেলা প’ড়ে আসে
           ঘরে ঘরে প্রদীপ
উন্মুক্ত শঙ্খের ধ্বনি
           মুখর করে চলেছে জীবন।
আমার ঘরে প্রদীপ নেই, শাঁখ নেই
            আমি কি নিয়ে বাঁচি?
দুহাতের আঁজলাকে পিদিম ক’রে
     ঘরের কুলুঙ্গিতে রেখে যাব।
     শিখা যদি নিভে যায়,
আমার আঁজলা কেউ কি দেখতে পাবে?
অন্ধকারে ভেসে ওঠে
          স্বপ্নময় কুলুঙ্গী।

(স্বপ্নময় কুলুঙ্গী/মন্থন মোদক/১৯৮৩--)

    মন্থন পুরুলিয়া জেলার মানুষ, সাধারণের কাছে প্রায় অপরিচিত এই কবি আজ আর কবিতা লেখেন কিনা জানি না, আমার চোখে পড়ে না অন্তত বহুদিন। তবু তার কবিতার পথ চেয়ে থাকি।  এইসব জীবন ও প্রকৃতির  সমাবর্তন বিশেষ দেখি না তো ...।

   সাধারণ ভাবে প্রকৃতি এক শায়িত রূপ। সমুদ্র, অরণ্য, নদ, নদী, মরু ও মহাসাগর সমস্তই চরাচরে শায়িত-প্রকৃতি। এমন কি পাহাড় ও গম্ভীর পর্বত, সেও শায়িত। তবু সে সুমহান, সুউচ্চ। কিন্তু তার উচ্চতা গর্ব্বোদ্ধত নয়। ধীরে, অতি ধীরে সে আকাশের দিকে, শূন্যের দিকে চলে গেছে ঢেউ দিতে দিতে।
   মানুষ শুধু প্রকৃতি-বিরুদ্ধ আস্ফালনে মানুষকেই নত করতে গিয়ে প্রকৃতির উপরে চলে যেতে চেয়েছে! শেয়ার-সূচক থেকে আল-বুর্জ সেই গর্বোদ্ধত অতি আধুনিকতার আস্ফালন ছাড়া আর কি ? গগন কে চুম্বন করতে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে গগন বিদারক। নাকি চুম্বনের ছলনায় সে বিদীর্ণই করতে চেয়েছিল তাকে? তবু পারা গেল কি? কি অসীম করুণা আজ ঝরে পড়ছে গ্রাউন্ড জিরোর নিচে!
শুধু কবি জানে প্রকৃত সত্য –
.
যেখানে প্রাচীর ওঠে অসম্ভব অহংকারে,তার
উপরে আকাশ দেখা যায়
দেখ, নিষ্পলক চেয়ে আছে নদী আর ওই চাঁদ
জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে উহাদের এ কূল ও কূল...
(দূরত্ব/অভিষেক ঘোষ /১৯৮৪--)

কবিতার নাম ‘দূরত্ব’ । এই দূরত্ব রচনা করেছে মানুষ। পরমা-প্রকৃতি ও তার আত্মার ভেতরে। আবার অনন্ত দূরত্বকেও ‘একটু দূর’ অর্থাৎ ‘নিকট’ করে নিতে পারে কবিই। এমন একটি কবিতা শোনাবার দুরন্ত ইচ্ছে দমন করা যাচ্ছে না। কবি মণিশংকর হয়তো কোনো খ্যাতিমান কবি নন। অন্তঃত আজ থেকে একমাস আগেও তাঁর কবিতার সাথে আমার আলাপ ছিল না। তথাপি তিনি প্রকৃতই একজন উল্লেখযোগ্য কবি—

নির্জন শেফালী আর একটু দূরের
ঈষৎ সবুজ ওই তারাটি—
বস্তত একই তরঙ্গের অংশমাত্র।
প্রতিদিন তারাদেরকে যে এইখানে ডেকে পাঠায়
সেই গাছটির নাম রাত্রি।

তুমি ধীরে ধীরে তার প্রতিটি শাখাই ছুঁয়ে যাচ্ছ
বালকের মতো হেলা ভ’রে..

শিশিরে, নৈশব্দে...
(কবি / মণিশংকর বিশ্বাস/ /গ্রন্থ: চন্দনপিঁড়ি)

   এই রচনাটি শুরু করার আগে আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত ছিলাম যে নব্বই ও তার পরবর্তী দশকগুলি যে হারে যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত এক সুপারন্যাচারাল সার্কাসের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, অন্তত: আশিতেও এমনটা ছিল না বোধহয়, [কারণ নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে টেলিফোন, আর তারপর মহাদানব মোবাইল ফোন। এবং অতি নিঃশব্দে ‘পত্র’ নামক একটি শিল্প মাধ্যমের পৃথিবী ব্যাপী পতন ঘটে। এবং সাথে সাথে সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর খুব দ্রুত ও ব্যাপক এক বদল শুরু হয় ও ক্রমশ তা পরিণতির দিকে যায়। ১৯৯০/৯১-এ জন্ম এমন, যারা এখন ২৪/২৫ বছরের যুবক-যুবতী। তাদের পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন এই মোবাইল ও টেলিফোন বর্জিত এক পৃথিবীর কথা! যখন কোনো গ্রাম্য বধূর কাছের মানুষটি কাছে নেই, হয়তো বহুদূরের কোনো শহর থেকে সে চিঠি লিখছে—‘আগামী রবিবার আসিতেছি, আমার প্রীতি-চুম্বন লইও...’। সেই পত্র পৌঁছলনা, মানুষটি এসে গেল তার আগেই...সেই যে হঠাৎ দেখার ব্রীড়া, দরজার আড়াল থেকে তার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠা... অথবা ঠিক এর উল্টো, চিঠি এলো, মানুষটি এলো না।--এ বহুদিন যাবৎ বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত এক বিষয় হ’য়ে ছিল...
{লক্ষ্মী পূর্ণিমার ভোর। কাদের কুলের বৌ
অন্ধকারে জল নিতে আসে, তার

লাজুক নূপুর থেকে জল ঝরে, আর কোন
পাতার আড়ালে ডাকে অবাধ্য কোকিল,

বধূটির মন উচাটন। দূর শহরের থেকে
তার স্বামী কালও ফেরেনি...
(ঘাট সিরিজ/সুমন জানা/গ্রন্থ : সামান্য কথার কথা/রচনাকাল: নব্বই দশকের দ্বিতীয়ার্ধ)}
 ... এই যে বিষয়, এখন আর নেই, আর থাকবে না।– একদিন দুদিন নয়, এই যে বহুযুগের সমাজ সংস্কার দু’দিনেই ভেঙে যাওয়া, এর একটা প্রভাব তো থাকবে?] সেই ভয় ভেতরে নিয়ে কবিতাগুলির দিকে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভয় বা আশংকা অমূলক ছিল হয়তো। দেখছি, এখনো বহু কবি এই বাংলায় রয়েছেন, যাঁরা এই বাংলা কবিতার আবহমান ধারাটিতে  বিশ্বাস রেখে লিখছেন। লিখে চলেছেন। প্রেম ও প্রকৃতি এখনো মানবমনের প্রধান পরিমণ্ডল। যা থেকে বিচ্যুতি শুধু আপন থেকে দূরে চলে যাওয়া। শূন্যদশকের কবি সর্বজয়া যেমন তাঁর প্রায় সকল কবিতাতেই এক মহাজাগতিক প্রণাম ছড়িয়ে রাখেন। কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁর পূজা স্পষ্ট হয় যেন—

পড়ন্ত বাতাস কাঁপে
মুঠোভর আকুল পরাগ।
শাখাময় এই নীরবতা
জল নেই,শুধু বৃষ্টিদাগ।


পাতাগুলি, তারাগুলি বাজে
কাজে,আর কিছু ফুলসাজে
মর্মগতি,আর অভেদ ফাগ
জল নেই,আছে বৃষ্টিদাগ।
(শাখ / সর্বজয়া)

অথবা এই দ্বিপদীটি, যেখানে কবি তার উদ্দেশ্য, তথা মঞ্জিলের ঘরে পৌঁছতে পারছেন না, তার আকুতি, তার দীর্ঘশ্বাস—

আঙুল মাত্র দূর, ডালে এক পাখি বসে আছে,
বিশ্বাস মাত্র দূর, পৌঁছতে পারি না তার কাছে!
(যোগিয়া/সুকান্ত সিংহ /১৯৭৪/গ্রন্থ:যোগিয়া)

... প্রেম, পূজা, প্রকৃতির চিরাচরিত সঙ্গীতময় কাব্য তো বটেই, এর বাইরে, জীবন ও জগত সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা, মমত্ববোধ কাব্যের মূলাধার। আমার অন্ততঃ এমনটাই মনে হয়েছে। এবং সেই সূত্রে, ছন্দে লেখা পদ্য-মাত্রই যেমন সবসময় কবিতা হয়ে ওঠেনা, একই ভাবে অনুভবি গদ্যাংশও কবিতা হয়ে ওঠে তার অনুভব তথা জীবনের প্রতি গভীর মমতায়। যেভাবে  আরণ্যক, তিতাস একটি নদীর নাম, ঢোঁড়াই, মাল্যবান ইত্যাদি কিছু কিছু বাংলা সাহিত্যের সম্পদ আছে যা কাব্যগ্রন্থ বলেই মনে হয় আমার। হয়ত এই ভাব থেকেই , হয়তো কেন, নিশ্চয় এই ভাব থেকেই গদ্য কবিতার জন্ম হয়েছিল । যেমন এই কবিতাটি—

তিনি কথা দিয়েছেন, আমাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করবেন এমন সরল প্রকৃতির লোহা, যা থেকে শুধুই চাষী ভাইদের জন্য লাঙল অথবা কাস্তে বানানো যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নির্মিত হবে না ঘাতকের হাতিয়ার । যিনি নিয়েছেন ভার, তার নাম ঈশ্বর কামার। শ্রীমতী নদীর ধারে একটি চালাঘরকেই তিনি আপাতত মনে করেছেন কৈলাস পর্বত, অন্তত বছর তিরিশ সেখানেই কাজ সেখানেই বাস। সেই ঘরের আকাশে সর্বদায় জ্বলছে লাল আগুনের মতো সূর্য। চাঁদ উঠলে, তারা ফুটলে বন্ধ হয় ওই দোকানের ঝাঁপ। তিনি সর্বদায় পোড়ান আর পিটিয়ে চলেন, এতই কাজের চাপ যে, শরণাগতদের অধিকাংশকেই দু’একটা দিন বা সপ্তাহ পরে আসতে বলেন, ভিতর-বাড়ির থেকে ঈশ্বরী অথবা কন্যার এনে দেওয়া চা ও বিস্কুট বারবার খান, ছাই হয় বিড়ির বাণ্ডিল। মানুষ পিটিয়ে লোহা তৈরির অদম্য পরিশ্রমে বলিষ্ঠ শরীর বেয়ে ঝরতে থাকে ঘাম...
অবশেষে গিয়ে মেশে তাঁরই সৃষ্ট ওই নদীটির জলে।
(লোহা/ বিপ্লব চৌধুরী)
(এই কবিতাটির পর কয়েক মুহূর্ত নৈশ:ব্দের বিরতি...)

...


  ... ভিন্ন ভাবে ‘কবিতায় আধ্যাত্মিকতার খোঁজ’ আমাদের করতে হচ্ছে একটি নিবন্ধে, এও বাংলা কবিতার এক প্যারাডক্স বলা যায়। যা যুগের নিয়মে স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে আজ। অথচ এই নিবন্ধের প্রথমেই জীবনানন্দের যে উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে তা কিছুদূর অনুধাবন করলেই একথা পরিষ্কার হয় যে ব্যাপক অর্থে আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ না থাকলে কোনো রচনাই কবিতায় উত্তোরিত হতে পারে না কখনো। (এই প্রসঙ্গে একটু পিছিয়ে গিয়ে আলোচনা শুরু করলে এক অন্যরকম সূত্র পাওয়া যেতে পারে। যথা –জীবনানন্দ স্বয়ং। জীবনানন্দকে  ‘বিষাদের কবি’ হিসেবে দেগে দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণের রচনায় যে ‘আনন্দের গতি’ , জীবনানন্দের কবিতায় এসে তা পথ হারিয়ে ফেলেছে। এমন মনে করা হয়। এই হল আধুনিকতার ধাঁধা। জীবনানন্দ কখনো স্পষ্টঅক্ষরে তার ঈশ্বর সংক্রান্ত উপলব্ধি ব্যাখ্যা করেন নি। তথাপি তিনি লিখেছেন স্পষ্ট কিছু পঙক্তিমালা। যথা—‘শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়’ যা আমাদের ‘অপরূপ সূর্য চেতনার প্রভাতে নিয়ে যায়’ । এই প্রথম বন্ধনীর ভেতরে বলা কথাগুলির জন্য প্রয়াত কবি বিকাশ দাসের প্রতি ঋণ জানিয়ে রাখি।) – তো এই হল আধুনিকতার যুগ-যন্ত্রণা প্রসূত ‘আলো-অন্ধকার’। যা ক্রমশ নব্বই ও তার পরবর্তী কবিদের কাছে এসে  কখনো কখনো আরো কঠিন ও দুষ্পাচ্য হয়ে উঠেছে। এখানে আমাদের পরিচিত আধ্যাত্মিকতার রূপানুভূতি তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি গোচর হয় না, তারপর চোখ সয়ে এলে, ধাঁধা কেটে গেলে দৃষ্টিগোচর হয় সেই শিশুগ্রাম, যা আমরা ফেলে এসেছি বহু বহু যুগের ওপারে—


শোনো। রাতের বাতাস কি বলছে শোনো।
এ’গ্রাম শিশুগ্রাম। এগ্রামে কেউ বড় হয় না কখনো।

মাঠের ছায়া শুয়ে আছে মাঠের পাশে
আর মাঠে মাঠে চলছে যে খেলা, সে খেলা
থামেনি এখনো—
খেলছে যে শিশুরা—তারাও তো
খেলছে অনন্তকাল—
খেলবে অনন্তকাল
এখেলা থামেনা কখনো।

এ’গ্রামে দিন নেই, শুধুই রাত্রি
এ’গ্রামে বয়স থেমে মাঠের ঘাসে—
রাতের খেলা শুধু ভিজে যায় জলে
বর্ষায়, অশ্রুতে
বজ্রের আঘাতে—

শোনো। রাতের কান্না কি বলছে শোনো।
এ’গ্রাম শিশুগ্রাম। এ’গ্রামে কেউ বড় হয় না কখনো।
(বজ্রপাত/ আবীর সিংহ)

   শিশুরাই তো প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি মানব। এখনো আমাদের বানিয়ে তোলা ভুল শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিকতা যাদের স্পর্শ করেনি। কবি হয়তো বিশ্বজোড়া সেই শিশুগ্রাম-এর কথা বলতে চেয়েছেন। পৃথিবী ব্যাপী সেই অসংখ্য শিশু মনের  ঐকতান, যেখানে কেউ বড় হয় না, অর্থাৎ যেখানে বড়দের বানিয়ে তোলা ভুল-পৃথিবীর কোনো স্থান নেই। এই ভাবনাটিই শিহরণময়! যদিও কবিতাটির ভিতর অনেকগুলি পর্দা রয়েছে, যথা সময়ের স্থবিরতা (!) ইত্যাদি। সেগুলি আপাতত অনুন্মোচিত  থাক ।
   বিষয়ের চেয়ে উদ্ধৃতি এখানে স্থানে স্থানে দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে হয়তো। তবু আমি নাচার। কারণ উদ্ধৃতিই বিষয়। প্রবন্ধকার মধ্যে মধ্যে বটকেরা করছেন মাত্র। ‘বাংলা কবিতায় বিদেশী শব্দ’, বা ‘বাংলা কবিতায় প্রমিত শব্দ’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেমন পঙক্তিমাত্র উদ্ধৃত করে বিষয়টি বোঝানো যায়, এক্ষেত্রে সে পথ সম্পূর্ণ বন্ধ। কারণ কবিতার ভিতরের গভীর অনুভবটিকে (যা এখানে আধ্যাত্মিকতা) সম্পূর্ণতা ধরতে হলে সম্পূর্ণ কবিতাটি উদ্ধৃত করা ছাড়া উপাই নেই। সে কারনেই হয়তো এই নিবন্ধে আলোচ্য সময়-কালের বহু কবিই অনুপস্থিত থেকে যাবেন। তাছাড়া আলোচকের পাঠের অপ্রতুলতাও একটা বিশেষ কারণ। এই ভণিতা এখানে গেয়ে রাখলাম।
এখানে আপাতত কবি শংকর বসুর একটি মহাজাগতিক পথ হাঁটার ছোট্ট কবিতা পড়ে নিই—

সে কি টের পায়?
তার ছায়া
অনন্তের হাঁটা পথে সঙ্গদোষে মিশে থাকে
আমার-ই ছায়ায়...
(ছায়াসঙ্গী/ শংকর বসু)

  শংকরের কবিতাটি যেন শুধু বিশ্ব নয়, ব্রহ্মাণ্ড-প্রকৃতির দিকে চলে গেছে।   বর্তমান পৃথিবীতে এই প্রকৃতিকে শুধু ভুলে যাওয়া নয়। প্রকৃতির থেকে বিচ্যুত হতে হতে মানব সমাজ আজ প্রকৃতি-বিরুদ্ধতার দিকে চলে গেছে। প্রকৃতির কাছে নত হতে শুধু ভুলে যাওয়া নয় আজ মানুষ প্রকৃতিকেই তার সামনে নত হতে বলছে এক চরম স্পর্ধায়। যার মূল, ভোগ-ঈপ্সা। পরমা-প্রকৃতির কাছে পৌঁছানোর আকুতি তাই শুধুই ঠাকুমার গল্পকথার মতো শোনাচ্ছে...
    এখানে শংকরের কবিতাটি বলতে গিয়ে আরো একটি কবিতা মনে এলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই। কবি স্বর্ণেন্দুর এই তিন লাইনের ছোট্টো কাবিতাটির মধ্যে রয়ে গেয়ে সেই প্রস্তরীভূত অহল্যার চেয়ে থাকা, পৃথিবীর এই মাটি থেকে মহাজগতের দিকে নির্মিমেষ। শুধু একটি সম্মতির অপেক্ষায় আছি আমরা সকলে।  এই পূর্ণিমা, এই পৃথিবীর পাষান—সেও তো এক মহাজাগতিক খণ্ডতামাত্র! এই কথা মনে এলো—

তাকে সম্মতি দিতে বল, বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে
নক্ষত্রের দিকে মুখ, একটি পাথর, বৃষ্টিতে ভিজে গেলো আজ
আজ পূর্ণিমা, সম্মতির দিকে যেতে যেতে ভিজে গেছি আমরা সকলে...
(পূর্ণিমা/স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত)


...

   হয়তো আরো প্রচুর প্রচুর কবিতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে আমাদের। তারপর একটা তাৎক্ষণিক উত্তরের সামনে হয়তো দাঁড়াতে পারব। হয়তো তারপরেও প্রশ্ন রয়ে যাবে...। নিশ্চিত তারপরেও প্রশ্ন রয়ে যাবে...
   প্রশ্ন রয়ে যাবে কোথা থেকে এসেছিলাম, কোথায় বা যেতে চেয়েছি? –এই আদি ও অনন্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেছে মানুষ বরাবর। কবিতায় দর্শনে বিজ্ঞানে। সেইসব একাকী মানুষের পথ হাঁটা। আর কোথাও কোনো পথ না পেয়ে শেষ অবদি তার নিজের তৈরি মূর্তির সামনে এসে কেঁদে ভাসিয়েছে। যে অনন্তকে মানুষ কখনো কল্পনা করতে পারেনি, যে অসীম ধরা ছোঁয়ার অতীত, তাকে ছুঁতে গিয়ে মানুষ কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে। সে কখনো মাটি খড়ের মূর্তির ভেতরে তাকে দেখে ছুটে গেছে, কখনো অক্ষরের মধ্যে সাজানো কবিতার ভেতর। শ্যামলের একটা কবিতা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। যেখানে এই দুটো বিষয়কেই একসাথে আমরা পেয়ে যাব—
আমি মূর্তিকরকে দেখেছি
দেখেছি তার হাত ভরে উঠছে ভিজে মাটি...শুকনো খড়

তৈরি হচ্ছে মানুষেরই এক অবয়ব
আমি আঁকতে দেখেছি তার চোখ
যত্ন করে পরাতে দেখেছি শাড়ি

নির্মাণ শেষ হলে তারই সামনে নতজানু কান্নায়
গুমরে উঠতে শুনেছি মূর্তিকরকে—দেখা দে মা, দেখা দে

(শ্যামল ভট্টাচার্য/ গ্রন্থ: পঞ্চম আহুতি)

অথবা প্রায় একই বিষয় ভিন্ন অবলোকনে রয়ে গেছে সুকুমারের একটি কবিতায়—

সে এক অপটু চিত্রকর। কিছুদিন হলো আকাশে ছেড়েছে
                               এক অসম্পূর্ণ পাখি
সে পাখি এখনো হায় উড়াল শেখেনি তত ভালো
টলমল টলমল
          টলমল টলমল
এই মেঘ থেকে ওই মেঘ
          ওই মেঘ থেকে আরও দূর মেঘ
অভিমানে নিজেকে আড়াল করেছে

শিল্পী তাকাল আকাশের দিকে
পাখি নেই; অন্য পাখিরা সব উৎসবে ডানায় মেতেছে
(পাখিশিল্প/ সুকুমার মণ্ডল/গ্রন্থ:যে নদী গিয়াছে ডুবিয়া অস্তরাগ জলে)

এ হল সেই মানুষের আদি হাহাকার। এখানে মূর্তিকর ও শিল্পী যেন একই ব্যক্তি। তাদের হাহাকার আর অসহায়তা ছড়িয়ে দিচ্ছে কবিতার ভেতর দিয়ে।
এখানে এক অদ্ভুত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থাকব আমরা এই বাংলা কবিতার পাঠক। এখানে শ্যামলের কবিতাটি যেমন স্বরচিত মৃন্ময় মূর্তির ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সেই আবহমান রূপ। অরূপ বা অসীমকে তার স্বরূপে প্রত্যক্ষ করতে ব্যর্থ সামান্য মানুষের শেষ পর্যন্ত সেই মাটিকেই মাধ্যম করার কথা। মাটিকেই আঁকড়ে ধরা। উল্টোদিকে সুকুমারের কবিতাটি যেন স্বয়ং শিল্পীর পাখি-রূপ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির  এক অবসর। যে শিল্পীর চোখে তার সদ্যজাত উড়তে না শেখা সন্তানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কে সেই বিরাট ?
   কখনো কখনো ঈশ্বর এক গোপন কান্নার মতো! কান্না, কিন্তু বিষাদের নয় সর্বদা। এ এমন এক দুরূহ গোপনীয়তা যার অন্য কোনো দর্শক নেই। তাই শেষ পর্যন্ত শিল্পের, সঙ্গীতের আশ্রয়, কবিতার আশ্রয় নেয় ব্যথিত মানুষ—
অবশেষে আমি তাকে আবিষ্কার করলাম গোপনে
গুনগুন শব্দ সে
পাশাপাশি আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই

(চিরকুট /হিন্দোল ভট্টাচার্য /১৯৭৩--)

হ্যাঁ, সঙ্ঘ নয়। বরং সঙ্ঘাতীত এই অনুভব কবির একেবারে নিজস্ব। একাকীর। স্বপ্নের মতোই যার কোনো দ্বিতীয় দর্শক নেই।  তবু একমাত্র কবিই হয়তো পারেন তার অনুভবকে দ্বিতীয় কারো সামনে তুলে ধরতে।  সেইসব অনুভবগুলিই খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
 স্বপ্ন কী? প্রেম কী? যদি বলি স্বপ্ন ও প্রেম যথাক্রমে অসীম ও অরূপের ছদ্মবেশ। যা প্রতিটি মানুষের একাকীর।  এইখানে এসে এইবার আমরা কি জীবনের কাম-ঘামের দিকে মোড় নেওয়ার আগে প্রেমের কথা, প্রেমের গান শুনে নেব কি কিছু? কিন্তু সেই বৈষ্ণব কবিদের মতো করে কে শোনাবে প্রেমকথা এই সপ্রতিভ আধুনিকতায়? রবীন্দ্রনাথ যে কবিতা পাঠ করে আপ্লুত, বিস্মিত হয়েছিলেন?—সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি, কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমছবি, কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমগাম, বিরহ তাপিত হেরি রাধার নয়ান...—সেই প্রেমগান কি লেখা হয় আর! না। এখন এই অতিকালের সময়, যখন পৃথিবী তার প্রয়োজনের চেয়েও দ্রুত আবর্তিত হয়ে চলেছে, তখন এই প্রেমগানের তাল-লয় ভেঙে যেতে বাধ্য। তাই সেইসব না থাকারই কথা। ভেবেছিলাম নেই। তবু দেখি এই সমসময়কে অস্বীকার করে কেউ কেউ মহাকালের ইচ্ছার দিকে হাত বাড়ায়।

রাই ধনি কে লো ,আশেপাশে আমি সই না, গুঞ্জয়ে মধুকুঞ্জে সখী , আমি সে কাজল ভোমরা ।
আমি তোর সোহাগের দাসী- সোহাগে ওই মরি বাঁচি মরি … ভিতরে সোনার পাখি রেখে
খাঁচায় তালা দিলেন সাঁই। আর তার এত টলমল , নবোজ্জ্বলরস ! রসবতী, আমি রাই রাই
নামে ভরি কলসের সুখ। তোমার প্রেমের কী বা জানি

(রাই ধ্বনি ১/ দীপান্বিতা সরকার)
হ্যাঁ, আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, এই তো, সময়ের গতির সাথে সাথে তার তাল লয় আর জীবনের মাত্রা যথপোযুক্ত রেখে সেই বৈষ্ণব কবিতাই তো এসে পড়েছে এই কালে! না বোধহয়, বিস্ময়ের নয়। কারণ এ কোনো সমাপতন নয়। বরং স্বাভাবিকতা। জীবনের, ছন্দের স্বাভাবিকতা—স্বাভাবিকতা, কারণ দীপান্বিতা একা নন। সেই একই পুরাতন প্রেম, পুরাতন অথচ চির নতুন ভাষায় লেখা প্রেম আরো রয়েছে।  এবং লেখা হয়ে চলেছে--

আদিগন্ত রাজ্যপাট তোমাকে দেখেছি ছেড়ে যেতে
যখন কোপাচ্ছ মাটি এক চিলতে বেড়াঘেরা ক্ষেতে
তোমাকে দেখেছি আমি দূর থেকে, বাঁধের ওপরে
দাঁড়িয়েছি কতদিন নদীর রঙের শাড়ি প’রে
আমি জানি তুমি সেই রাজকুমার, আড়াল-বিলাসী
কোথায় তোমার বীজ, কী শস্য বুনেছ ক্ষেতে, চাষী?

জলের খোঁজে কি তুমি তাকাবে এদিকে মুখ তুলে
নদীকে কাঁপাল ঢেউ, নদীও ত গিয়েছিল ভুলে
কবে সে এসেছে ফেলে প্রাসাদে সোনার জল-ঝারি
তুমি কি চিনেছ ঠিক? আমি সেই রাজার কুমারী...
(রূপকথা/মন্দ্রাক্রান্তা সেন)

 
এইখানে কিছু কথা বলা দরকার। যথা ভাষা ও জীবন। কবিতা তো আধ্যাত্মিক, সামাজিক এমন কিছু হয় না! বরং এই আধ্যাত্মিকতা জীবনের একটা চর্চা, বা একটা যাপন। কবিতা তার একটা উপাদান হয়তো। এখানে এই যে কবিতাগুলি উঠে আসছে তার অর্থ এই যে কবিগন সকলেই বিভিন্ন ভাবে, রূপে সেই চর্চার মধ্যে রয়েছেন। অন্য দিকে ভাষা ভেঙে যাচ্ছে। যে ভাষায় ডাক দিলে ভেতর পর্যন্ত হুহু করে উঠত একদা ,সেই ভাষা ভেঙে যাচ্ছে। টেলিভিশন, সিনেমা বানিজ্যিক সাহিত্যে ভাষাকে ভেঙে একমাত্রিক করা হচ্ছে। সুতরাং চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। একটা গোটা জাতী সম্পূর্ণ ভাবে যেখানে কবিত্বের অধিকারী ছিল সেখানে কবি বলা হচ্ছে কয়েকজন হাঁকডাক-ওয়ালা মানুষকে। সেই হাঁকডাকও তৈরি করা, বানানো, এখানেও চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।৷  প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে লিপিকুশলতাকে।   আমরা ভাষাকে হারাচ্ছি। বৈচিত্র্য হারাচ্ছি। একজন অক্ষর পরিচয়হীন বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের, অন্ত্যজ, বাউরি পাড়ার মহিলা শীতের রাতে কিভাবে মনে মনে লিখে ফেলে একটি তুষু গান, সকালে শীতে জুবুথুবু, দল বেঁধে কি ভাবে গীত হয় সেই গান, তাকেও আমরা হারাচ্ছি। সেই অন্ত্যজ প্রেম, সেই জীবন-কবিতার ঈশ্বরকে আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি। তিতাসের মালো পাড়ার মানুষদের কথায় কথায় কাব্যি! সেই কাব্য-ভাষা নষ্ট করে ফেলেছি । অন্যদিকে যে বর্তমান ভাষায় কথা বলি সে ভাষা পরস্পরে বুঝি না। কেউ কারো ডাক শুনতে পাই না তাই! মন্দাক্রান্তার  উদ্ধৃত কবিতায় সেই ভাষাটি ছিল, দীপান্বিতায় রয়েছে। ভাষাটি আমাদের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে...। ভাষার ঈশ্বর এখনো জীবিত এইসব কবিতায়। আমারা সেইরকম কবিতাগুলিই খুঁজে দেখব এখানে।
  মানুষ তার ব্যথিত জীবনের , অসহায় জীবনের কলরোল ঈশ্বরের হাতে তুলে দিতে চায়।হে ভগবান আমায় মুক্তি দাও—ব’লে, নিজে দায় মুক্ত হতে চায়। নিশ্চিত জীবন পাওয়া গেল না বলে বিষণ্ণ হয়। সেইসব কথাগুলিও বিষয়। কতরকমের যে ব্যাপ্তি, বোধ এই বাংলা কবিতায় ছড়ানো রয়েছে, পাঠক হতবাক হয়ে যায় এর সামনে দাঁড়িয়ে। দুমুঠো ভাত ঈশ্বর-স্বরূপ হয়ে ওঠে কখনো। থোকা থোকা সাদা ভাত ভাঙা থালায় স্বপ্নের মতো জেগে ওঠে—
গৃহস্থ
সোমেন মুখোপাধ্যায়

ফুলের বোঁটা ছিঁড়তে গিয়ে
স্তনবৃন্তের কথা মনে পড়ে,
মনে হয় অভুক্তের কথা।

শ্রীচরণে পূজিত ফুল
ভাতের থালা হয়ে, গৃহস্থে এস।
অথবা স্বয়ং ঈশ্বরকে ভাত বেড়ে দেয় কেউ কচুর লতি সেদ্ধ দিয়ে। এমন কি ছেঁড়া কাঁথার ঘৃণা, তাও ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়। সেই যে, বলছিলাম না—এখন ঈশ্বর সখারূপ! তাকে অল্প হেসে ধাক্কা পর্যন্ত দেওয়া যায়! আহ্ পৃথিবী—
ঈশ্বর ও আমরা
সন্তু দাস
ঈশ্বর আমাদের বাড়ি ভাড়া দেয়
বর্ষায় পিচ-চট দেয়
মাকে নতুন বাড়ির কাজ দেয়
শেষ রাতে আমাকে ঘুমহীন স্বপ্ন দেয়
আমরা ঈশ্বরকে নেশার জন্য পয়সা দিই
মায়ের হাতের কচুরলতি দিই
গরমে তালপাতার প্রেম আর
শীতে ছেঁড়া কাঁথার ঘৃণা দিই
এভাবে
ঈশ্বর আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসে
আমরা ভীত ঈশ্বরকে কাচের ফ্রেম দিই…
কেউ হয়তো শেষোক্ত কবিতাটিকে একটি এ্যান্টি স্পিরিচ্যুয়াল ইমেজ হিসেবে দেখতে চাইবেন। আমরা সেরকম ভাবে দেখছি না। এও সেই নেতি নেতির ভেতর দিয়ে, ঘৃণা-ভালবাসা। যেরকম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটি তার সকল সদস্যের মধ্যে প্রতি নিয়ত অনটন ঝগড়া বিবাদের ভেতর দিয়ে তাদের ভালবাসার সম্পর্কটিকে বয়ে নিয়ে যায় আজীবন। ভোগ, লালসা থেকে বহুদূরের সেই প্রাকৃত জীবনকে প্রণাম ছাড়া কি-ই বা জানাব।
...

 এইবার আমরা এসে পড়লাম জীবনের কাম-ঘামের ভিতর। এবং এরপর অবধারিত ‘মৃত্যু’-র দিকে যেতে হবে আমাদের। প্রেম,পূজা ও প্রকৃতির দেবতাকে আমরা ‘দেখেছি’। বাংলা কবিতার ভেতর তার ‘অরূপ’ ও ‘অসীম’ আমরা ‘দেখেছি’। এখনো যা আমরা দেখিনি তা ‘কাম’ ও ‘মৃত্যু’। মানুষের যৌনতা আর মৃ্ত্যুর রূপ আমরা ভেদ করতে পারিনি কখনো। সেই রহস্যানুভুতিও তো একপ্রকার অরূপ। তার ভেতরের আলো-অন্ধকার ভেদ করবার যে অবিরাম প্রচেষ্টা, যে আকুতি সেই আর্তির দিকে এইবার পা-বাড়াব। কাম, যৌনতা, মানব-মানবীর দেহমিলন –এক রহস্যঘন অনুভুতি। অপর দিকে মৃত্যু এক হিমশীতল আঁধার। এর মাঝে মানুষের ‘কাম-ঘাম’যুক্ত সংসার। মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতা আর একত্র হওয়ার প্রচেষ্টা।
দেখতে পাও, বলিশেষের খড়্গ গাঁথা নদীর কুলে
রক্ত অন্ধকার মাখা তার জড়িয়ে থাকা একটি চুলে
(প্রলয়/ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়/১৯৭০--)
আরো একটি নশ্বরতার কবিতা
কি বলে গেলে?
কিছুই স্থায়ী নয়
         আলো, অন্ধকার...
(জোনাকি/ অনির্বাণ দাস/১৯৭৭--)

এবং একেবারে এই সময়ে এসে, এই সাম্প্রতিকতায়, সেই অন্ধকার , যা মানুষকে ঘাড় ধরে জলের মধ্যে মুণ্ডু চুবিয়ে রাখে আর বলে—দ্যাখ, এই সেই অন্ধকার। আর মানুষ ও তার অন্তরাত্মা হাঁপিয়ে ওঠে। সামান্য শ্বাসের জন্য হাঁপিয়ে ওঠে, আর ছাড়া পেলে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াতে চায় খোলা আকাশের নিচে। পারেনা। কবিতা শেষ  হলে শুধু সেই বোধটুকু থাকে যা, মানুষকে আলোর প্রয়োজনের কথা বলে। এই কি তাহলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভেতর অনুভূত সেই ছায়াচ্ছন্ন ‘আধ্যাত্মিকতা’ ?

সিঁড়িটি অবাক হয়ে উঠে গেল দোতলার ছাদে।
গিয়ে দেখে, সব সত্যি—
‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍বাড়িঘর, প্রতিবেশী, এজমালি হাওয়া,
সুপুরিগাছের দাঁতে বিঁধে যাওয়া আকাশী পাথর,
কোথা দিয়ে ট্রেন যায়, কোথায় যে যায়
দ্রিম-দ্রিম শব্দ এসে ধাক্কা দেয় বাড়ির দেয়ালে।
এরপরে আর
কোথাও যাওয়ার নেই, এই কথা শুনে
সিঁড়িটি একাই নিচে নেমে এলো, ধীরে ধীরে
‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ অন্ধকার জমে উঠল সিঁড়ির তলায়।
(সিঁড়ি/ শৌভ চট্টোপাধ্যায় )
কি পেলাম এই কবিতায় আমরা? বিষণ্ণতা, অন্ধকার! অন্ধকার তো আমরা চাই নি। আমরা চেয়েছি আলো। তাহলে আধ্যাত্মিকতার আলোচনায় অন্ধকার কেন? –এই প্রশ্ন জীবনানন্দকেও ছেড়ে কথা বলে নি। তাকে মৌলিক বিষাদের কবি বলে পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন আধুনিকতার সময় তাকে নিয়ে পথ চলা ছাড়া গতি নেই। এ যেন ফটোগ্রাফির সেই ‘কনট্রাস্টনেস’। ‘আলো-অন্ধকার’। এই আলো-অন্ধকারের ভেতরেই ছবি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমরা তাকে দেখতে পাই। এখানেই কবিতাটির সার্থকতা হয়তো... হয়তো ঐ সিঁড়ি বেয়েই সিঁড়িটি শেষবার উঠে যাবে আলোর দিকে...


...

তাহলে এই ‘পরমা-প্রকৃতি’ থেকে ‘ঈশ্বর’ কতদূরের পথ? এর উত্তর খুঁজতে আমরা আশ্রয় নেব কিছু অন্যরকম উদ্ধৃতির। যেহেতু আধ্যাত্মিকতা কোনো বিশেষ দশকের মধ্যে আবদ্ধ রেখে আলোচনা খুব কঠিন ব্যাপার, তাই অনন্যোপায় হয়ে আমাদের যেতে হবে প্রবীণদের কাছেও। কারণ রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী কথিত সেই ‘ভারতীয় সুর্যাস্ত’। ‘ভারতীয় সূর্যাস্ত’ কথাটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন মানুষের ভেতর আধ্যাত্মিকতার উন্মেষের সময় হিসেবে, যা পড়ন্ত বেলার দিকে বয়স ঢলে পড়লে আপনা আপনি চলে আসে। অর্থাৎ জীবনের অহেতুক কলরোলগুলি স্তিমিত হয়ে এলে, যৌবনের উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে এলে যা সকল মানুষের ভেতর অতীব গোপনে প্রবেশ করে। --সেই ‘ভারতীয় সূর্যাস্ত’। সেই কারণেই, নব্বই ও তার পরবর্তী দশকের কবিরা এখনো মধ্য যৌবনে। অবশ্য সকলের জীবনেই যে এই ভারতীয় সূর্যাস্তের আলো এসে পড়বে এমন কথা নেই। আবার কেউ কেউ অনেক আগেই যে এই আলোর সন্ধানে বাহির হন সে তো আমরা উপরের উদ্ধৃত কবিতাগুলি থেকেই জানলাম। যাই হোক, প্রশ্ন এই-- ‘পরমা-প্রকৃতি’ থেকে ‘ঈশ্বর’ কতদূরের পথ?
     এক সাক্ষাৎকারে কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রবীণ কবি আলোক সরকারের কথোপকথন —
“—ঈশ্বর শব্দটা আপনার কাছে কেমনভাবে আসে, কী প্রতীক বা তাৎপর্য নিয়ে—যদিও আপনার লেখায় ঈশ্বরের উপস্থিতি বিষয়ে আলোচনা অনেক হয়েছে।
--‘ঈশ্বর’ মানে আমি বুঝি ‘সম্পূর্ণতা’।
-- এই ‘ঈশ্বর’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণতা’-র সঙ্গে সাক্ষাৎকার কি আপনার কবিতার মাধ্যমেই হয়? একটু আগে অনির্বাণের (ধরিত্রীপুত্র) আলোচনায় একটা কবিতা এসেছিল—“যে কোন পথের বাঁকে ঈশ্বর আসেন। আমরা কেবল দেরী ক’রে যাই”। পরে এরই সংযোজন—“এক মুহূর্তের/ভিন্নতায় সমস্ত জীবন রিক্ত মলিন তমসা”—এই উচ্চারণ, এই সাক্ষাৎ না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
--আমি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারিনি, এই যে ত্রুটি, এই যে দেরী, মাত্র এক মুহূর্তের। তার আগেই ঈশ্বর সেখানে ছিলেন—এখনো তাঁর গন্ধ চারদিকে ভাসছে”।
‘ঈশ্বর’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণতা’।–এই হল একজন পরিণত কবির মনগত আধ্যাত্মবাদ। এই কথাটি বলার জন্যই এত কথা বলা। আমরা বিভিন্ন ভাবে সকলেই ভিন্ন ভিন্ন পথে সেই সম্পূর্ণতার দিকেই চলেছি। যেতে চাই। এই কথা।







( প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশী শব্দ খরচ করার পরেও নিবন্ধটির মধ্যে দিয়ে আমরা বিশেষ কোথাও পৌঁছাতে পারলাম কি ? অথবা রচনাটি কি আদৌ শেষ হয়েছে? এই নিবন্ধটির পূর্ণতার দিকে যেতে গেলে আরো অনেকের কবিতার অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন ছিল। অরুন্ধতী চক্রবর্তী, অর্ণব পণ্ডা, তিলোত্তমা মজুমদার আদি কবিদের সুকবিতার উদ্ধৃতি। সুতীর্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপ ঘোষ সহ অনেকের লেখা এখন আর দেখি না বিশেষ, এক দশক আগেও এঁদের প্রচুর রচনা পড়া হত। ভবিষ্যতে কখনো বিস্তৃত লেখার ইচ্ছা রয়ে গেল। এই নিবন্ধে কবিদের কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকা থেকে রচনা সংগৃহীত হয়েছে। যথা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘অনুবর্তন’ পত্রিকার প্রায় ২০/২২ খানা খণ্ড, এখানে বলে রাখা উচিৎ যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একমাত্র এই অনুবর্তন পত্রিকাটিই, যাঁর সম্পাদকগন ধারাবাহিক ভাবে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কারের দুনিয়ায় এক আধ্যাত্মিক ভাবান্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই পত্রিকার বহু কবিতা ও গৌতম বসু, অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র, দেবাশিস তরফদারে প্রবন্ধাদি পাঠে উপকৃত হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। নিবন্ধটি লেখার সময় সেই পাঠপ্রভাব থাকবেই। কবি গৌতম চৌধুরীর বিভিন্ন প্রবন্ধ পাঠেও ছড়ানো রয়েছে ঋণ। নিবন্ধটির শেষে কবি আলোক সরকারের সাক্ষাৎকারের অংশটি অনুবর্তন পত্রিকার ফাল্গুন ২০১৪ সংখ্যা থেকে গৃহীত।   এছাড়া পাখিরা, মিরুজিন,গুহালিপিগুহালিপি ও আন্তর্জাল পত্রিকা থেকে কোনো কোনো কবিতা নেওয়া হয়েছে।)


























৪টি মন্তব্য:

  1. এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উথ্থান রহিত
    নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না ।
    নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়
    কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্যকোন শ্যামলতা নেই ।
    click here

    উত্তরমুছুন