রবিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৬

ভাবনার সমানাধিকার ও পর্নোগ্রাফী






ভাবনার সমানাধিকার ও পর্নোগ্রাফী
কৌশিক বাজারী


 ...সেটা নয়ের দশকের প্রথম দিক। তখন বোধহয় আমার একাদশ শ্রেণী। গ্রাম মফস্বলের পাড়া মহল্লাগুলি তখন ভরে উঠছে ভিডিও পার্লারে। কোথাও ত্রিপল খাঁচিয়ে, কোথাও বড় একটা হলঘরের ভেতরে চলছে রমরম করে ভিডিও শো। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো সিনেমা তখন চলে আসছে আমাদের এই ছোট্ট শহরে। মাত্র দুটাকার বিনিময়ে মিঠুন-শ্রীদেবীর ঝুমতারারারা । আর দুপুরবেলা ইংরেজী সিনেমা! হলিউডি ইংরেজী সিনেমার প্রতি একটা চোরাটান ছোটবেলা থেকেই। আলাদীন, বর্ন ফ্রি এসব তো দেখেছি চ্যারিটি শো-এ। একদিন দুপুরের শো-তে ঢুকে পড়েছিলাম সেইরকম একটা ভিডিও পার্লারে। একটা রদ্দি ইংরেজি সিনেমা প্রায় দেড় ঘণ্টা দেখে উঠে আসতে যাচ্ছি, একজন পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল। আরে এটা শেষ হলে তাপ্পর তো আসল সিনিমা। বসে যা । মিনিট খানেকের ভিতর শুরু হল সেই আসল সিনিমা! না, উঠে আসতে পারিনি। তখন আমার বয়স সতেরো বৎসর। সেইদিনের ঘটনা আজো হুবহু মনে আছে এতদিন পরেও। সেই বিবমিষা, সেই কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর, সেই উত্থিত ও মৃত সাপের মতো ঠাণ্ডা লিঙ্গ... তারপর সারাদিন বাড়ি ঢুকতে না পারা। গা বমি বমি ভাব। রাত্তিরে এক প্রকাণ্ড অপরাধ-বোধ ভেতরে নিয়ে মাথানিচু করে বড়ি ফেরা, রাতের খাবার খেতে না পারা আজো ভুলিনি। মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি তিনদিন। এসব হয়তো অতি-মধ্যবিত্ত প্রতিবেশে বেড়ে ওঠা আমার সেই বয়সের মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। এখন সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। সময় নিজেই অনেক সপ্রতিভ এখন!
   সেইসময় ভেসে যেতে যেতে একটা হাত যদি আমায় ধরে না ফেলত কি হত আমি জানি না। বাসুকীদার হাত। সদ্য কলাভবন থেকে ফিরে আসা বাসুকি দাশগুপ্ত। আমরা বলি বাস্কাদা। তার কাছে প্রথম দেখলাম বার্থ অফ ভেনাসের সেই চিরকালীন নগ্নতা। মদিগ্লইয়ানির সেই নগ্ন শায়িত নারী। দেখলাম প্রচুর প্রচুর প্রিন্ট, খাজুরাহো তার নির্মান আর হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলা এক ভারতবর্ষ! আমার ঠাণ্ডা ও মৃত লিঙ্গ পুনরুজ্জীবিত হল অতি ধীরে। বানিজ্যমূল্য থেকে বহুদূরের সেই নগ্নতার ঐশ্বর্য্য আমাকে পুনর্জীবন দিল বোধহয়।
   পর্নোগ্রাফী কী বস্তু? দেখেছিস কখনো? বাসুকিদার এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকলাম। তিনি বোধহয় প্রথম এত খোলামেলা আলোচনা করলেন বিষয়টা আমাদের সাথে।  আমার সাথে হয়তো আরো কেউ কেউ ছিল বন্ধুরা । তিনি দেখালেন যে পর্নোগ্রাফী কোনো শিল্প তো নয়ই বরং অতি-অশৈলী, শিল্প তথা জীবনের উল্টো একটা একটা ব্যাপার এর সাথে বার্থ অফ ভেনাসের নগ্নতার তুলনা হয় নাতুলনা হয় না খাজুরাহোর যৌবন উৎসবেরও
   এখন এই বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কথাটা গণ-হিস্টিরিয়ার মধ্যেও জোর গলায় বলা দরকারনা হলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা মিথ্যে হয়ে যায়মায়ের সঙ্গে সন্তানকে , বাপের সঙ্গে মেয়েকে শুয়িয়ে দেওয়া কোনো শিল্প নয়চাইল্ড পর্নোগ্রাফী (দেখিনি কখনো, ভাবতেও পারিনা) তো নরকের অধম  আরো আছে, এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম নর-নারীর দেহ-ভোগের সম্ভব অসম্ভব সমস্ত বিকৃতির চুড়াগুলি পেরিয়ে মানুষ যখন ক্লান্ত, তখন তার সামনে নাকি এসে গেছে ‘ক্যানিবালিজম’। শেকলে বাঁধা জ্যান্ত নারীমাংস ভক্ষণের এ্যনিমেটেড পর্নোগ্রাফী! এবার তাহোলে কোথায় দাঁড়াব হে বন্ধুগন! তো এসবও কিন্তু আমেরিকার তৈরি ! অনেকেই বলছেনভাই, সবকিছুর মধ্যে বামপন্থীদের মতো আমেরিকান ভুত দেখার কোনো অর্থ হয় না। না,  আমি যদিও কোনো প্রথাগত বামপন্থী রাজনীতিতে শিক্ষিত নয় সেভাবে, তবু বলতে বাধা নেই, এ শুধু আমেরিকা-প্রসূত বানিজ্যনীতির ভুত নয়, বরং নিখাদ বর্তমান এবং সুদূর প্রসারিত ভবিষ্যতও। কারণ পর্নোগ্রাফী যদিও আমেরিকার সাথে সাথে ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি সহ এশিয়া এমনকি ভারত ও এই পোড়া বাংলাতেও নির্মিত  হয়ে চলেছে তবু বলব এই অ-শৈলী একান্ত ইতিহাসহীন তথা সংস্কৃতিহীন সেই আমেরিকা প্রসূতই। যাদের বানিজ্যনীতি সমগ্র বিশ্বজুড়ে এক পোষাক, এক খাদ্য, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, একরকম বানিজ্যিক-যৌনতার এক অদ্ভূত কিমাকার ঐক্যের প্রচারক।
   যদিও আদিকাল থেকেই সব দেশেই আদিরসের চাহিদা ছিল জনমানসে। সেই চাহিদা পূরণের জন্য যোগানও ছিল সকল স্থানেই, সেই সকল আদিরসের ভাণ্ডার ইতিহাস খুঁজলে পাওয়াও যায় এখনো। তবু তা এই আজকের লাস-ভেগাস অধ্যুষিত পর্নগ্রাফীর থেকে বহুলাংশে ভিন্ন। বটতলার সাহিত্য অভিধাটি আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। অপরিচিত নয় আমাদের দেশীয় সাহিত্যগুলি। তার ভেতরে নর-নারীর শরীর মিলন, কাম ও শরীরী বর্ণনা অপ্রতুল নয়। তৎকালীন পট শিল্পেও অপ্রতুল নয় শরীর-মিলনের চিত্র, তবু এইসবের ভেতরে রসবোধ মরে যায় নি কখনো। প্রেম মরে যায় নি কখনো। প্রেম ও প্রেম-প্রসূত কামই ছিল সেইসবের ধাত্রী। তা সে প্রেম যত প্রাকৃতই হোক। এখন যা আর কোথাও নেই। লাস-ভেগাস এসে সব প্রেম নিয়ে গেছে। নারীকেও...।
   এসব তাহলে আগ্রাসন নয়? তাহলে আফিমের বিরুদ্ধে চৈনিক বিল্পব সেও তো ভুল প্রমাণিত হবে? তার পরেও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার নিজের ঘরে বসে পর্নগ্রাফী দেখবেন নাকি আর্টফিলিম দেখবেন সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপারসেখানে কারো খবরদারী না থাকাই উচিৎকিন্তু তৎসহ আরো কিছু কথা মাথায় রাখা উচিৎ আমাদেরোযথা আমাদের রুচি কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়?  ভারত সরকার নাকি মার্কিন বানিজ্যবাদ নাকি অতিগেরুয়া শিক্ষা ? নাকি হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি ? আমরা জানিনাআমরা জানিনা ৬০% সরকারি ভাবে সাক্ষরের দেশে গন জাগরণ কিভাবে বা সম্ভব হবে? কতজনের হাতে আন্তর্জাল আছে জানিনাতার ব্যবহারকারী শিক্ষিতের হারে কত শতাংশের মধ্যে পড়েন জানিনাএই ৬০% এর মধ্যে কতজন নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতার মানে বোঝেন তাও জানিনা একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষিত প্রগতিশীল ফেসবুকার, যিনি পর্নো দেখার অধিকার সাংবিধানিক কিনা সে বিষয়ে তাঁর সুসংবদ্ধ চিন্তা ভাবনা লিপিবদ্ধ করতে পারেন তাঁর সমৃদ্ধ ভাবনা দিয়ে, সেই একই অধিকারে বলবর্তী হয়ে নির্ভয়া কাণ্ডের সেই বাস ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরেরাও কি একইরকম যুক্তি দেখানোর ক্ষমতায় আসীন, আজো? এই ভারতবর্ষে ? আমরা যে অধিকারের জন্য লড়াই করছি, সেই একই বস্তু আরেক জনকে লালসা, ধর্ষণ, হত্যা ও ফাঁসিকাঠের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো?এই হল আমাদের ভারতীয় গণতন্ত্রের কূটাভাস-জনিত ট্র্যাজেডি! ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন বাণিজ্যিক ছবি নির্মাতাদের আর সমান্তরাল ছবি নির্মাতাদের সমান সুযোগ দেওয়া হোক, আমি নিশ্চিত আমারা জিতে যাবসেই সমান সুযোগ আমরা পাইনিভারতীয় ছবিতে কি চুম্বন অনুমোদিত হওয়া উচিৎ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন চুম্বন এমন একটা বড় প্রশ্ন নয় যাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। ভারতীয় ঐতিহ্যের যে প্রকৃতি তাতে আমার মতে স্ক্রিনে চুম্বন দেখানো উচিৎ নয়। হ্যাঁ, এই কথা বলেছিলেন শ্রী ঋত্বিক ঘটক মহাশয়। চলচ্চিত্র ,মানুষ এবং আরো কিছু দ্রষ্টব্য। । তিনি সম্ভবত অজন্তা ইলোরা খাজুরাহো পরবর্তী হাজার বছরের পরে পরিবর্তিত সমাজবাস্তবতা মাথায় রেখেই কথাটি বলেছিলেন। কথা হল সেই ঐতিহ্য! যা সমাজ নিরপেক্ষ নয়। লাস-ভেগাস অনুমোদিত ঐতিহ্য আর ভারতীয় সমাজ-বাস্তবতা এক নয় কখনোই। কিন্তু তারপর আরো বহুদূর সময় পেরিয়ে গেছি। ভারতীয় সংস্কৃতির দ্রুত বদল ঘটেছে। চুম্বন এখন অচ্ছুৎ নয়। এবং বর্তমানে এই চুম্বন নর-নারীর প্রেমেরই প্রতীক। কিন্তু প্রেমহীনতা কোনো দেশেই কোনো কালেই বাঞ্ছনীয় হতে পারেনা। চুম্বন এসেছে কিন্তু বাণিজ্যিক ও সমান্তরাল ছবি নির্মাতাদের মূলধনগত সমানাধিকার আসেনি।   হাতে রইলো পর্নোগ্রাফী তখন কিন্তু বাণিজ্যিক সিনেমাও এত পর্নোগ্রাফীক হয়ে ওঠেনি যাই হোক সেই পর্নোগ্রাফী ব্যান করা হল, এটাও রাজনীতি, আবার শুনছি তুলে নেওয়া হবে, তাও রাজনীতি ভাবনার সমান অধিকার কবে পাবো? ভাবনার সমান অধিকারের কথা ভাবাও কি হয়েছে কখনো?

.
(রচনাটি বাংলা সংবাদপত্র এই সময়এর কোনো এক রবিবারে প্রকাশিত)

*
কৌশিক বাজারী
মাড়ুই বাজার/বিষ্ণুপুর/বাঁকুড়া/৭২২১২২
ফোন৯৪৭৫৬৮৩৫৫৬
Email—koushik.bazari@rediffmail.com

বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৬

প্রথাগত এবং প্রথা ভাঙার ভাষা:






প্রথাগত এবং প্রথা ভাঙার ভাষা:


    কোনটা প্রথা, কোনটাইবা প্রথার ভাঙন ? 'অপরূপ ভাবে ভাঙা, গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো কখনো...' হ্যাঁ,ভাঙতে জানা চাই... তেমন করে ভাঙা বাংলা সাহিত্যে কজনই বা ভেঙেছেন যারা ভেঙেছেন, তারা থেকে গেছেন, বাকি সবই তো ঝাঁটার প্রলেপ... আবহমানের প্রচলিত ছন্দ ভেঙে দুর্ধর্ষ উঠে দাঁড়ালেন মাইকেল, সেই যে দাঁড়ানো, দেখলে এখনো মাথা নত হয়ে আসেনা ? তারপর ধরুন বঙ্কিম না, এখনো বাংলা সাহিত্যে তার সঠিক উত্তরাধিকারী অপ্রতুল দু'একজন সতীনাথ, বিভূতিভূষণ কে বাদ দিলে আর কেউ নেই বললেই চলে
যদি থাকত, যদি বঙ্কিমের কাব্যঝংকারময় উত্তরাধিকার সঠিক পথে পরিচালিত হত, তাহলে বাংলাসাহিত্য মানে শুধু ভুতুড়ে-সাহিত্য বোঝাতো না নিশ্চয়  মাঝে মধ্যে দু'একজন কমল কুমার,সুভাষ ঘোষাল...বিস্মরণ-সমৃদ্ধ, এছাড়া কোথায় সেই ভাষার ঝংকার কেউ আবার ভেবে বসবেন না যেন, যে বঙ্কিমের স্টাইলের সাথে আমি সতীনাথ বিভূতিভূষণের তুলনা টানলাম। তুলনাটা ভাষা কাব্য-চেতনার।
    কোথায় বাংলাভাষায় রচিত অখণ্ড ভারতভূমির বিস্তার, কোথায় সেই ব্যাপক ইতিহাস চেতনার ছবি, কোথায় বা আন্তর্জাতিকতা...এখন বহুল-খ্যাত প্রধান বাংলা সাহিত্য গুলিতে ভূমি মানে -- কলকাতা, মাঝে মধ্যে মুখ বদলে শান্তিনিকেতন! আর ইতিহাস চেতনা মানে, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের ইতিহাস, আন্তর্জাতিকতা মানে বেনাপোল বর্ডার... তবু আমাদের আত্ম শ্লাঘার শেষ নেই অথচ বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার বিস্তারের আরম্ভেই আমরা পেয়েছি মাইকেল, বঙ্কিমদের তারপর যিনি রয়েছেন, সম্ভবত বাঙালীর অন্বেষণ বিমুখতার প্রধান কারণ তিনিই, হাজার বছরের বোঝা তিনি একাই বহন করছেন, সুতরাং আমাদের অপ্রয়োজনের মস্তিষ্ক শূন্যতিনি রবীন্দ্রনাথ
   
এরা প্রত্যেকেই কিন্তু চলিত' প্রথাকে ভেঙেছেন নিজস্ব নিয়মেই, নিজস্ব প্রয়োজনেই প্রয়োজনেই , কারণ চলিত' প্রথার সংকীর্ণ প্রসারের ভিতর এরা নিজেদের স্থাপন করতে ছিলেন অপারগ, প্রত্যেকেই দমবন্ধ অপ্রশস্ত গলিপথ থেকে নিজস্ব রাজপথ খুঁজে নিয়েছেন আপন গরজেই, সেটাই দস্তুর...পরে,কালে কালে, ইতিহাসের বিষম ঠাট্টার মতো যে পথের উপরে গজিয়ে উঠবে অশ্লীল বাজার, অবৈধ নির্মাণ সেই পথকে করবে অবরুদ্ধ, পথ ক্রমশ তমসাবৃত হাভিয়া-দোজখের দিকে চলে যাবে...তারপর তো আমাদেরও জন্ম হবে সে অনেক পরের কথা
   
তার আগে আছেন গলিত ধ্বস্ত সময়-কাল-পথের এক মায়াময় পথিকজীবনানন্দ কে যেন বলে ছিলেন; ভাষার ওপর 'তাণ্ডবনৃত্য' ভাষাকে ভেঙে দেয় ,তছনছ করে তারপর যারা আসে নাচ দেখানোর বাসনায়, তারা সে ভাঙা মঞ্চের ওপরে বড় অসহায় বোধ করে লক্ষণীয়, রবীন্দ্র পরবর্তী,জীবনানন্দ পরবর্তী কবিদের সে অবস্থাই হয়েছে;--- এই ভাঙা ভাষা, ধ্বস্ত ভাষা লইয়া আমরা কী করিব!
   
সম্ভবত এই পথেই প্রথমে চোরাগোপ্তা এবং পরে প্রকাশ্য প্রবেশ উত্তরাধুনিকতার যার জন্মভূমি পাশ্চাত্য দেশ  
   সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন অবধারিত উঠে আসবে : তাহলে সাহিত্য মানে কি শুধুই ভাষাকে ভাঙার ইতিহাস ? এবং তৎপরবর্তী নব্যভাষা গঠনের কারুকাজ মাত্র ?না , তা তো কখনোই নয় এগুলো আবহমান পথ মাত্র, গন্তব্য অন্যত্র গন্তব্যে পৌঁছনর উদ্দেশ্যেই পথের নির্মাণ  এবং প্রতিটি মানবের যেহেতু একটা নিজস্ব গন্তব্য রয়েছে, আপন মঞ্জিল, তাই তার পথও আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। দুটি মানুষের দুটি পথ পাশাপাশি চললেও কখনোই একটিই পথ দুজনের নয়, কারণ ব্যক্তি আলাদা তাদের ভাবনা গতি ভিন্ন, তাই পথও ভিন্ন তাহলে ইউরোপে পাশ্চাত্য দেশে জন্ম নেওয়া পথ, আমাদের পথ কি ভাবে হয়ে উঠলো? এক পরম বিস্ময় !
   ইউরোপীয় সমাজ রাষ্ট্র যে পথে এগিয়েছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীতে,...শিল্প-বিপ্লব, মহাযুদ্ধ যে ভাবে বদলে দিয়েছিল সেখানকার সমাজ ব্যক্তিজীবন, তার আন্দাজ তখন আমরা পাইনি ইউরোপের প্রবল গৃহযুদ্ধ, মন্দা, মহাযুদ্ধ মূল্যবোধের ধ্বংসসাধন আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়নি
   
অনেক পরে 'ইতিহাসের' পৃষ্ঠায় আমরা দেখলাম ভ্যানগঘের 'আলু-ভোজী', গুন্টার গ্রাসের টিনড্রামের চলচ্চিত্র রূপান্তর দেখছিলাম একদিন, সে এক বিধ্বস্ত মানবতার দলিল, সেখানেও দেখলাম আলু-ভোজী,অর্থাৎ দারিদ্রের অনন্যপায়তা...আর মানব জীবনের অবমূল্যায়নের ভুরিভুরি উদাহরণ জার্মানিতে,পোল্যান্ডে,রাশিয়ায়,তার পরে পরে অনেক জায়গায়... ভেঙ্গে গেলো ইউরোপীয় সমাজের রক্ষণশীলতা ক্রুসেডের শেষ ভাগে যুদ্ধের প্রয়োজনে পুরুষ-শূন্য পরিবার গুলিতে নারীরাই এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সামাজিক কর্মকাণ্ডে মহাযুদ্ধের প্রভাবে সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল পুনর্বার...
   
এইভাবে ভেতরে ভেতরে মার খেতে খেতে তৈরি হয়েছে একটা সমাজ উঠে এসেছে একের পর এক সাংস্কৃতিক,সামাজিক আন্দোলন,তার প্রভাব পড়েছে সাহিত্যে শিল্পে...আমরা দুর থেকে শুধু দেখেছি,বাহাবা দিয়েছি, নিজেদের ইতিহাস, ভূমি, দুর্গতি, মন্বন্তর, মৃত্যু-মিছিল, দেশভাগ ভুলেছি আর বিজাতীয় আন্দোলন নকল করেছি...(আশ্চর্য! 'বাঙালী কেড়ে খায়নি কেন' সেও তো আজ গবেষণার বিষয়!...হয়ত এই কারণেই কোনো নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলনও(?) নেই আমাদের)
   
যথারীতি বাংলা সাহিত্যের মধ্যে ঢুকে পড়ল মার্ক্স ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব, যা আজো আমাদের আরোপিত মনে হয়না! (মানিক থেকে মহা-চীন, কোথায় বা মার্ক্স সাহেব সঠিক ভাবে প্রযুক্ত হলেন) বুদ্ধদেব বসু, যিনি জীবৎকালে ছিলেন কিংবদন্তী,প্রয়াণের কয়েক দশকের মধ্যেই বিস্মৃত প্রায়, কেন,কে বলে দেবে?  সত্তরের দশক বাংলা জগৎকে অনেক দিয়েছে, তবে সে যত-না সাহিত্যের প্রয়োজনে, তারচেয়ে ঢের বেশী সমাজ বদলের দায়ে সেই বদলের অভিঘাতও ইতিহাস,যার কোনো পূর্ণ প্রামাণ্য সাহিত্য দলিল আজো নেই,যেটুকু পাই তাও আলংকারিক মাত্র
   তবে নির্লজ্জতার চরম উল্লসিত প্রকাশ সুপ্রসিদ্ধ 'বঙ্গীয় নব্বইয়ের দশক' যেখানে প্রকাশ্যে ঘোষিত হল.'কবিতা'কে হতে হবে স্মার্ট,শহুরে এবং গ্রাম্যতা বর্জিত
'
গ্রাম্য' শব্দটি বহুতলীয়, তাই ওটিকে সযত্নে এড়িয়ে গেলাম কিন্তু স্মার্ট! শহুরে !!
অর্থাৎ চমকদার, জেল্লাদার, যৌন-গর্ভ, অগভীরতার এক সার্বিক উদযাপন!! ছন্দময় যৌনতা জীবনের অঙ্গ, কিন্তু ছল-চাতুরী পূর্ণ যৌনতা,  জীবন ছন্দ-হীন যৌনতার এক চাপা উল্লাসে পূর্ণ  অনেক কবিতা রচিত হল, (আর যা হলএক অগ্রজ, প্রখ্যাত প্রধান কবির বাহ্যিক অক্ষম অনুকরণে ভরে গেল নব্বইয়ের দশক)
   পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা কবিতা মানে হয়ে দাঁড়াল একটিই ভাষা ভঙ্গী, এক জনের কবিতার ভাষা অন্য জনের থেকে আলাদা করা যায় না। কবিগন কারখানার প্রোডাকশনে পরিণত হলেন। সকলই বাংলা কবিতা প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক প্রযোজিত প্রচারিত গ্রাম বাংলা মফস্বলের কবিদেরও উৎসাহিত করা হল স্মার্ট, শহুরেকবিতার প্রতি। সবই শূন্য-গর্ভ গমন-উদ্দেশ্যহীন এক অন্ধ-যাত্রা, যেখানে বিপথগুলি এসে পড়েছে একে অন্যের ঘাড়ে। উদ্দেশ্য চেনা যায় না ! নাকি সাহিত্য কাব্যের বাইরে রয়েছে অন্য কোনো কাঞ্চন উদ্দেশ্য ?

    একদিকে আমেরিকা-ইউরোপের বাণিজ্যিক-সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে ধিক্কার,অপর দিকে তাদেরি প্রযোজিত একরৈখিক, বৈচিত্র্য ধ্বংসকারী বাণিজ্যিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে লালিত করে চললাম 'স্মার্ট'' হওয়ার জন্য,'শহুরে' হওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি চটজলদি খ্যাতিলাভের জন্য,এইবার, আবার ভাষাকে ভাঙার 'প্রয়োজন' দেখা দিল বলা বাহুল্য এই প্রয়োজন আরোপিত মাত্র এই অবৈধতার প্রয়োজনেই আমরা ভাষা-রাজপথ ছেড়ে,সংকীর্ণ অন্ধ-গলির আশ্রয় নিলাম খানিকটা সচেতনেইভাষার 'দ্যুতি'' 'মায়া' গ্রামীণ লোকজ শব্দ ব্রাত্য গণ্য হল
কয়েকজন ব্যতিক্রমী ছাড়া নব্বইয়ের অধিকাংশই কানাগলির পথিকআজ মাত্র এক দশকের ব্যবধানে তরা প্রত্যেকেই অন্তর্হিত অন্তর্হিত,কারণ তাদের নিজস্ব কোনো ভাষা ছিলনা,তাদের বলার মতো কোনো বেদনা ছিলনা ধার করা ভাষা কল্প-বেদনা কবিতার উপজীব্য হতে পারেনা কখনো
  
অর্থাৎ ইউরোপীয় সভ্যতার যে বেদনা, আমাদের কাছে তাই ধার করা ছদ্ম-অশ্রু যা শীতের ধুসর বিকেলে নিস্তরঙ্গ পুকুরের ভাসমান সরের মতো ম্লান যার কোনো সুদূর গভীরতা নেই সত্যিকারের আধুনিক আমরা কবে হব...