বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১

কবিতার কাটাকুটি




কবিতার কাটাকুটি 



কবিতা লেখা নিয়ে কিছু বলবার অবাধ্যতা শেষ পর্যন্ত এই লেখা। কে কেন কীভাবে কবিতা লেখে আমি ভেবে পাইনা! একেক জন কবির কবিতা পড়ি,  হয়ত বই, বা কোনো পত্রিকায়, তখন ভাবি ইনি কি জানেন ইনি একজন কবি! মানে কবি সেজেই কি তিনি লিখতে বসেছিলেন? টেবিলে সেজবাতি, রেক্সিনে মোড়া নীল খাতা, পিছনে তাক ভরা বই, সামনে খোলা জানলার ওদিকে এক কিশোরী বেগুনি রঙের শাড়ি মেলছে ছাদে। আর মাথার উপর ঘড়ঘড়ে সিলিং ফ্যান। খোলা খাতা, কবির কলম ভর করে কবিতা নামছে! অনেকটা অধুনা সিপিয়া টোনের বায়োস্কোপিক সিন। কবির মুখ দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় দাড়ি আছে তার। কিন্তু ঘর সংসার বৌ বাচ্চা অশান্তি পড়শির খিস্তি জমির মামলা বাজারের দরদাম এসব এই দৃশ্যে অনুপস্থিত।  আমি ভাবতে চেষ্টা করছি ইনি কেন লেখেন! কীভাবে কোন মাকালীর দিব্যি কে এসে ভরে দিয়ে গেল এর মাথায়! মানে লিখতেই হবে কেন ভেবে পাইনা! 

   আমি নিজে কবিতা টবিতা লিখি বলেই (সেসব আদ্যন্ত টবিতাই) সম্ভবত এই গদ্য মস্কোর বরাত পেয়েছি, তথাপি  আমি কোনোদিন কবিতা কী বস্তু বুঝিনি সত্যিই, এবং সত্যি বলতে একজন মানুষের জীবনে তা বোঝা খুব অত্যাবশ্যকীয় বলে মনেও করিনা। হ্যাঁ লিখিত শব্দ-কবিতার কথা বলছি। এছাড়াও কবিতার আরো আরো পথ ও পয়গম্বর রয়েছে, সেসব তো পরের ঘটনা। এবং সেসবই আসল ঘটনা। আপাতত 'নকল' লিখিত কবিতার কথা--


   ঘটনা হল, ইস্কুলে যখন পড়তাম ডায়েরি লিখতাম। সেসব অতি সরল বালকের ডায়েরি। বন্ধুদের সঙ্গে গুলিডাণ্ডা সাইকেলে অচেনা রাস্তা আবিস্কারের অভিযান, আর লুকিয়ে ঠাকুরের পাটালি খাওয়ার গল্প সেসব। ধীরে যখন আট কেলাস পার হয়ে নয়ে উঠছি, আর শরীরের ভেতরে কি যে ঘটে যাচ্ছে ভগবান!  গাছপালা আকাশ চন্দ্র সূর্য, সমস্ত রঙ পালটে যাচ্ছে। বাতাসের বয়ে যাওয়া দেখতে পাচ্ছি। আর ছেড়া হাওয়াই চপ্পল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসবের ভিতর দিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছি। ইস্কুল থেকে ফিরছি। আর দেখছি প্রাচীন পরিখার জলে শালুক ফুটে ঝরে যাচ্ছে। বাউরিদের এক কিশোরি উবু হয়ে শামুক তুলছে, আর তার পিঠের শিরদাঁড়ায় পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরের নক্ষত্র, সূর্যের আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে।  আমি চোখ ফেরাতে পারি না। আমার লজ্জা হয়। দুবছর আগেও আমার শরীরে এই লজ্জা ছিল না। এ এক নতুন জাগতিক অনুভুতি। 

 বাড়ি ফিরে রাত্রে ডায়েরির সামনে বসে লজ্জা পাই। বড়দি বলেছিল এখানে সমস্ত সত্যি কথা লিখে রাখতে হয়। কিকরে লিখব এসব! কেউ পড়বে না, তবু নিজের কাছে নিজের মুখ লুকাবার এক আড়াল আবিস্কারের দিকে চলে যেতে থাকলাম আমি। লেখা যাবেনা, এসব লেখা যাবেনা কিছুতেই। অথচ এখানে সত্য লিখতে হয়। সত্যের আড়ালও কি সত্য! আমি আড়াল বাঁধলাম, বহু যত্নে, কষ্টে তখন ছলনার আশ্রয় নিলাম। গোয়েন্দা গল্পের রহস্য  চিরকুটের মতো সেসব লিখে রাখতে লাগলাম যাতে বড়দি বা ছোটকাকাকে ধোঁকা দেওয়া যায়। রূপক, চিহ্ন আর ছলনার মতো সেসব লেখা, সেই ভাষার আড়াল।

   বহু পরে, বোধয় কলেজের দিকে, একদিন এক বন্ধুর হাতে পড়ল আর সে অবাক হয়ে বদ্যি পুকুরে নায়াগ্রা আবিস্কারের ঢঙে বলল -- তুই কবিতা লিখিস! আমি ততোধিক অবাক বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়ে ভাবলাম এই তাহলে কবিতা! বন্ধুগণ,  তাহলে কবিতা শুধুই ধোঁকার টাঁটি আর ছলনা মাত্র! যা আদতে প্রকাশ করার জন্য নয়, বরং উল্টোটাই, নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য! অর্থাৎ এ হল একরকম আন্ডারগ্রাউন্ড কাজকর্ম।

     এখন এই ছলনাময় জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছর পার হয়ে যাচ্ছে।   



     এর পরেও এই যে কবি-বাসনা, এই যে নিজেকে সাজিয়ে তোলা,  অন্ধকারের আড়ালে একজন তৃতীয়লিঙ্গের মানুষের মতো, সমাজের লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, সংসার পরিত্যক্ত এই যে আড়াল, সেখানে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ার পর সে তার ওষ্ঠরঞ্জনী বার করে, ডান হাত বাঁকিয়ে ধরে আয়নার সামনে, মুখ বাড়ায়, নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আর স্নেহে, ভালবাসায়, কষ্টে,  এই ঘৃণিত জীবন পালটে ফেলতে না পারার ব্যাথ্যায়, সে এডিট করতে থাকে তার প্রতিচ্ছবি!    এইখানে গোলাপি পমেটম, এইখানে অল্প রুজ মুছে ফেলো, কাজল লেপ্টে যাচ্ছে অশ্রুতে, তাকে মোছো, আবেগ কমাও, আর লম্বা টিপ, ঝুটা মুক্তায় বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে ওঠার আগে শেষ মুহূর্তে  ছিঁড়ে ফেল কুচি কুচি করে! এই নষ্ট জীবনের উপর কোনো সাজ, কোনো এডিট,  কোনো নির্মাণ অপছন্দ হলে এই নিয়ম আমাদের সংসারের।  এবং পুনর্ণিমানের জন্য অপেক্ষা।

    


     এইবার সরাসরি নির্মাণে এসে পৌঁছানো গেল। একজন অর্ধনারীশ্বরএর মতিচ্ছন্নতার নির্মাণ। কোনো সাজানো নির্মাণ এ নয়। একদম দিনের প্রখর রোদে মনসাতলা বাজারে পোকায় কাটা সবজির দরদামের মতো   নির্মাণ। যা দিনভর ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার মতো। যা এক সমান্তরাল জীবন, নক্সার ভেতরে লুকোনো, যে নক্সা রয়েছে ভারি সিন্দুকের ভেতরে গোপন।   

   তো এসব সবার জীবনে ঘটেনা, কিছু কিছু ভুতে পাওয়া মানুষের কাণ্ড এসব। যেসব ঘটনার সঙ্গে বাকি ভৌত-পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহের  যোগাযোগ থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। কখনো কখনো সে আধিভৌতিক এক জগতের বাসিন্দা।   অন্তত আর পাঁচজনের যে জগত, তা থেকে আলাদা এক অপর ভুবনের বাসিন্দা হতে চায় । আসলে চায়ও না, তার নিয়তি তাড়িত মগজ তাকে নিয়ে যায়। এই জৈব শরীরের  খিদে পেলে খেতে চায়। ঘুম পেলে শুতে চায়। সেই চাওয়ার জন্য ভাষা আছে। লিপি আছে। তবু সেই ভাষাকে অতিক্রম করে এক অন্যতর ভুবনের দিকে চলে যেতে চায় যারা তাদের এক  অভিশপ্ত প্যারালাল জগত রয়েছে এখানে। এক অন্যতর ভাষার জগত। কী সেই ভাষা?

   আমাদের ভাবনার মূলত কোনো ভাষা নেই। ভাবনা মূলত এক অলৌকিক ভিস্যুয়াল।  তার ধ্বনি ও রঙ নিয়ে  সে এক বোবা জগত। বোবা, অথচ মুখরিত।  মূক মানুষের যেমন অগাধ কথা সারাজীবন চাপা থেকে যায়, সে সব কথা কোনোদিন আর তার বলা হয়ে ওঠে না, এও খানিক তেমন।  তবু ভাবনার ভাষাহীন যে ভ্যিসুয়াল তাকে লিপিতে রাখতে গিয়ে বারবার হতাশ হতে হতে তার সবচে কাছাকাছি পৌঁছনোর নামই হয়ত নির্মাণ বা কাটাকুটি।

   এই হতাশা মূলত ভাবনার অবাধ অসীমত্ব আর অন্যদিকে ভাষার অল্পপরিসরের সীমার চিরকালীন  দ্বন্দ। যেখানে ভাবনাকে কেটে ছেঁটে অনন্যোপায় আঁটিয়ে নিতে হবে।  


   এইখানে রয়েছে এক ছন্দের কাজ।  আমাদের চলনের ও কথনের ভেতর রয়েছে এক ছন্দ, রিদম। যা অর্জিত হয় দীর্ঘ একটা চলার মধ্যে দিয়ে। ছন্দ আমাদের চলাকে সহজ করে অবিরত।   মাথায় বিপুল ভার নিয়ে চলেছে মুটে, তার পদক্ষেপের ভেতরে ছন্দ। মাথায় বিশাল কাঠের বোঝা নিয়ে চলা সাঁওতাল রমনীর নিতম্ব এক ছন্দের ভেতরে দুলছে। ছাত পিটুনি গান এখন আর রাজমিস্ত্রিরা গায় না, মেশিন এসে গেছে । কোনো কোনো মানুষের সাধারণ কথার মধ্যেও থাকে একটা ছন্দ। কাজের মধ্যে ছন্দ ত রয়েইছে। আছে হাঁটার মধ্যে। যেমন জীবনের ভেতরেও। ছন্দহীন মানুষের জীবন মূলত অসুস্থ। কবিতার ছন্দও তাই আলাদা কিছু নয়। ভাবনার আধার থেকে ভাষার আধারে সে কখনো ছন্দের মধ্যে এসে পড়ে। ছন্দ ভাঙলে ভাবনার সূত্রও ছিঁড়ে যায়। তখন মাথার ভেতর অবিরাম কাটাছেঁড়।     

   এই কাটা-ছাঁটার কাজটা খাতায় হবে নাকি মাথায় সে একান্ত অভ্যেসের ব্যাপার। যিনি বলেন আমার রচনায় কোনো কাটাকুটি নেই, একেবারে সরাসরি, স্বয়মাগতার মতো কাব্য এসে ধরা দেয়, তারও মনোজগতে রয়েছে নির্মাণ ও কাটাকুটি।  দীর্ঘ  জীবনের চাপে পড়ে তিনি হয়ত ভুলে গেছেন প্রথম জীবনে সেই সাইকেল শেখার দিনগুলি। যখন প্যাডেলের দিকেই তাকিয়ে থাকতেন, আর যথা সময়ে ব্রেক খুঁজে না পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন গর্তের ভেতর। এখন খুব সহজেই তিনি সেই দ্বিচক্রযানটির সওয়ার হয়ে অচেতনেই বাড়ি ফিরে আসেন, পথই তাকে ফিরিয়ে আনে। আলাদা করে আর ভাবতে হয় না তখন কোথায় প্যাডেল আর কোথায় পথ।  এ হল দীর্ঘ অভ্যেসের ফল। নির্মানও এক অভ্যেস, যা ভুলে গেলে কাব্য তখন স্বয়মাগতা।


   এরপরেও কিছু কথা থেকে যায়। কবি লিখিত রচনা শুধু কবি দ্বারাই না, অন্যত্রও পালটে যায় তার শব্দ কথা ভাবনা সমূহ। বাদ যায় হয়ত একটা অংশ, হয়ত প্রক্ষিপ্ত হয় ঘটনাবলী।  ব্যাস রচিত মহাভারত জানিনা ঠিক কেমন ছিল। দেশে দেশে,  ভিন্ন ভাষায়,  ভিন্ন কালে, ভিন্ন কবি আর অনুকারকের মসীকালির ভেতর তার রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে গান্ধারী কবে হয়ে উঠলেন বাঙালী জেঠিমা আমরা জানিনা।  হাজার হাজার বছরের অতীত ঠেলে সেই প্রকৃত কাব্যের রূপ যাই হোক, এই আজ প্রকৃত সত্য। তাই কাব্যেরও শেষ সত্য কী আমরা জানিনা। যা আমার ভাবনার ভেতরে এসে শেষ পর্যন্ত মূল বিস্তার করে, তাই আপাত সত্য। যা হয়ত কিছু কাল পর পুনরায় পালটে যাবে অন্যতর সত্যের দিকে। 


(বোধশব্দ পত্রিকার পূর্ব প্রকাশিত)

    


৩টি মন্তব্য:

  1. এই লেখাটি পড়ে, আমি আপনার লেখার একজন পাঠক, এই বলে গর্ব করতে পারি। কি যে লিখেছেন এখানে তা হয়ত আপনি নিজেও জানেন না। খুব ভালো লাগল দাদা, খুব ভাল। অনেকদিন পর এমন সুন্দর একটি গদ্য পড়লাম।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন