শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১

দেশ-রাষ্ট্র সংবাদ


ছবিঃ মিঠু সেন

দেশ-রাষ্ট্র সংবাদ 


.

১.

অসীম সীমানা

ছোটবেলায় শুনতাম বাবা তার দেশের বাড়ি যাবে। দেশের বাড়ি মানে কি? মানে, বাবা যেখানে জন্মেছে, তার ছোটোবেলা কেটেছে, সেই গ্রাম। গ্রামের নাম মেঠানা। সেই মেঠানা হল বাবার দেশের বাড়ি। সেখানে বাবার কাকাতো ভায়েরা আছে,কাকা আছে, খুড়িমা আছে। জমি জমা আমবাগান, বাঁশবন আছে। আমি বাবার সাইকেলে চেপে যেতাম বাবার দেশের বাড়ি। বাবা বলতো দেশগাঁ। মেঠানা হল বাবার দেশ। বাবার সাইকেলে চড়ে লালমাটির মেঠো পথ ধরে আমি বাবার দেশ গাঁয়ে যাই। বাবার দেশ তো আমারো দেশের বাড়ি! ঘন শালবন আর মহুয়ারবন পেরিয়ে যাই। বাবা চিনিয়ে দেয় দূরে দুরে কোনটা কোন গ্রাম। পথে হয়ত বাবার চেনাজানা কোনো লোকের সাথে দেখা হয়ে গেল। একটা বিশাল মোলগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারা কথা বলে, বিড়ি খায়, তারপর আবার চলতে থাকি কংসাবতীর অগভীর ক্যানেল পেরিয়ে ঘনবনের ভিতর দিয়ে।

আমার দেশ কোথায়? এই, যেখানে আমি জন্মেছি, এই বিষ্ণুপুর, তার মাটি, আশপাশ, গলিঘুঁজি, পথঘাট, লাল ছড়ানো মাটি আর তার ইতিহাস, গল্পকথা। কোথায় কখন আমাদের এই পাড়ার ভেতর বাঘ বেরিয়ে ছিল একদিন। পিন্টুদের পুকুরপাড়ে ঝোপের ভিতরে একদিন সকালে সেই বাঘ দেখে কে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তারপর সেই বাঘের সাথে আমাদের পাড়ার লোক সুরেশ গরাই এর সেকি মরণপণ লড়াই, হয়ত এইসব ষাট-সত্তর বছর আগের গল্পকথা, শুনতে শুনতে নিজের জীবনের অংশ বলে মনে হয় এখন। একটা দেশ মনের ভেতর রচিত হয়ে যায় অতি ধীরে। বাবা মায়ের মুখে মুখে শোনা এইরকম আরো কত গল্পের ভিতর দিয়ে, কত অভাব অনটন দুঃখ ও সুখস্মৃতির ভেতর আমাদের বড় হয়ে ওঠা—এই সমস্ত বিষয়টাই কি আমার দেশ নয়? এর বাইরে কোথায় কতদূর আমার রাষ্ট্রীয় মানচিত্র ছড়িয়ে রয়েছে আমি জানিনা। আমি তাজমহল দেখিনি, লালকিলা দেখিনি, দিল্লী যাইনি কখনো। সংসদ ভবন দেখিনি দূর থেকেও। তবু কাগজের মানচিত্র যদিও আমার পৌত্তলিক ঠাকুর বলে আমি মেনে নিই, তথাপি হৃদয়ের ঠাকুর কিন্তু এই আমার জন্মভিটের দিকে দিকে ছড়ানো বিস্তার আর এই মাটিতে জন্মানো মানুষগুলি আর দূর বহুদূর তাদের অগণিত দেশগাঁ। যেখানে জন্ম ও জীবন প্রবাহিত হয়। সেই আমার দেশ।

    

   একটি বিস্তীর্ণ ভূভাগের মানুষের কৃষ্টি। তাদের ভাষা, সংস্কার, জলবায়ু আর পরিবেশের উপর গড়ে ওঠা খাদ্যাভাস। গান, কথকতা, আর জীবনেতিহাস। শুধুমাত্র কোনো রাজকাহিনী নয়, যুদ্ধের ইতিবৃত্ত তাও নয়, বরং তার জীবনধারণের সামগ্রিক ইতিহাস একটা জাতীকে নির্মান করে দেয়। আমার বাংলাভাষার মাটি কতদূর অবদি ছড়ানো? বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, নদীয়া , কোচবিহার, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল,  শিলচর, কাছাড়, আগরতলা... কত কতদূর পর্যন্ত চলে যেতে পারি হাতে হাত রেখে? এ হল দেশ! বহুদূর পর্যন্ত কোনো বাধা নেই,বৃষ্টিপাত, মেঘ ও বাতাসে, কবিতায়, কাব্যে গানে ও মৎসাহারে। যদিও মধ্যিখানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় বাধার প্রাচীর। তার বয়স খুব বেশী নয় যদিও। সেই একই দেশ একই মানুষ, পরিবর্তনহীন। রাষ্ট্রসীমা শুধু পাল্টে যায়।  ভাল বা মন্দের চেয়েও—এ হল ঘটমানতা। 

   যে হাজার হাজার মানুষ সীমা পারাপার করেছিল এই বাংলায়, মাত্র কয়েক দশক আগে, তারা  জানে দেশ কী! আর রাষ্ট্র কী! আমরা জানি না। আমাদের কখনো রাষ্ট্রের জন্য দেশ ত্যাগ করতে হয়নি। পথে মা ভাই বোন হাত পা ও মুণ্ডু হারিয়ে ফেলতে হয়নি। অজানা অচেনা ‘দেশে’ পথে পথে ভিক্ষে করতে করতে মরে যেতেও হয়নি। যেমন এখন এই মূহুর্তে হাজার হাজার মানুষ দেশ ত্যাগ করে চলেছে সিরিয়া, লেবাননে...। সে অনেক দূর দেশ,  আর্ন্তজাতিক ঘটনা এসব, আমরা কেবল টিভিতে দেখি সমুদ্র তীরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে কাদের এক শিশু।

 সেই কারণেই দেশের দিকে মুখ ফেরানো যাক। বরং ঘরের দিকে মুখ ফেরাই--


কতদিন হয়ে গেল শীতল আসেনি। শীতল আমার বন্ধু। কবি। শীতল বিশ্বাস। শীতলের মামা বাড়ি বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে। শীতলের সারা জীবনে কখনো মামা বাড়ি যাওয়া হয়নি। শীতলের মা যখন আমাদের সাথে কথা বলে তার কথার মধ্যে ‘স-স’ উচ্চারণ বেশী শোনা যায়। যেন বাংলা দেশের কোনো নদীর পাড় ভাঙার শব্দ। তাঁর আর দেশে ফেরা হয়নি কখনো, এ জীবনে আর দেশে ফেরা হবে না একবারো। শীতলের একটা কবিতা দিয়ে লেখাটা শেষ করব, না, এ কবিতা কোনো রাজনৈতিক কবিতা নয়—


ফুলপুর

--------

কে যেন কবে বলেছিল ফুলপুর তার মামারবাড়ি

সেই থেকে মনে মনে তাকে খুঁজি

আর জিজ্ঞাসা করি--

ফুলপুরে তোমার, তোমার মামারবাড়ি ?

দু'একজন বলেছে নামটা শোনা বটে

রাঢ়দেশে নয়, বঙ্গদেশের কোথাও হবে

তবে কোথায় বলতে লারবে।

আজও আমি ফুলপুরের ভাবনা ভাবি

ফুলপুরের স্বপ্ন দেখি।

যদি সত্যি হ'য়ে যায়--

সত্যি

কোনোদিন কারুর সাথে আমি ফুলপুর বেড়াতে যাচ্ছি...



২.

চাষা ও ভুতের গপ্প


  বাবার জ্যাঠা একবার মরণের হাত থেকুন বেঁচে ফিরেছিল।

   ভিটাবাড়ির পিছনে ঘন বাঁশ আর আম কাঁঠালের বন ছিল আমাদের। সন্ধ্যা থেকেই শেয়ালের ডাকে ভুতুড়ে হয়ে থাকে অন্ধকার গ্রাম। ভুত প্রেত আরো ইতর আত্মা জীবিত ও মৃত সব মানুষের সঙ্গেই পাশাপাশি থাকতো সেইসব গ্রামে। ইংলণ্ডে মহারানী আর দিল্লীতে বড়লাটের চেহারা কেমন কোনো খোঁজ ছিল না তাদের। না ভুত, না মানুষের। খুব ভোরে, ঝুঁঝকা  অন্ধকার থাকতে কাম-কাজ শুরু হয়ে যাওয়া গ্রাম সব। সেচের কাজ খুব ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায়।  সদর দরজার পাশে মাটির পাঁচিলে ঝোলানো সেঁউতি খুলে দুজন মানুষ কাঁধে বয়ে নিয়ে যেত এক ক্রোশ পথ। হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন অল্প কালো শিস উড়িয়ে জ্বলতে থাকে বাঁ'হাতে। বাবার রামুকাকা রোজ ভোর রাতে ডেকে তুলত জ্যাঠাকে। তারপর নিঃশ্বব্দে কাজ শুরু হত। অত ভোরে অন্ধকারের চুপের ভেতর কারো কোনো কথা থাকে না স্বভাবতই। সেদিনও ছিল না। শীতের ভোরে উঠে পড়েছিল জ্যাঠা রামুকাকার ডাকে। লণ্ঠন কোনো অজানা বাতাসে নিভে গিয়ে থাকবে। জোনাকি আর একফালি কুয়াশা ঢাকা চাঁদ ছাড়া কোনো শব্দ ছিল না।  দূরে দূরে ক্ষেতের আলের উপর অন্য সব লণ্ঠনের আলোগুলিও ছিল না সেদিন। রামুকাকা সেঁউতির একপ্রান্ত পায়ে চেপে জলে ডোবায়, অন্যপ্রান্ত জ্যাঠা দড়ি ধরে নামায়, জল একটা সরু নালার ভেতর দিয়ে জমিতে বয়ে যায় এক নাগাড়ে। রামুকাকা ভুতে পাওয়ার মতো কাজ করে চলে।  অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না। ঘন্টা প্রহর গড়িয়ে যায় নালা বেয়ে, পূবের আকাশ ফর্সা হয় না। চাঁদ ডুবে গেলে আরো ঘন অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। হতক্লান্ত জ্যাঠা ক্ষেতের আলের উপর গড়িয়ে পড়িয়ে পড়েছিল।  অচৈতন্য,  শ্বাস পড়ছিল মৃদু। 

   মুখে জলের ঝাপটে তার যখন জ্ঞান ফেরে তখন মুখের উপরে ঝুকে পড়েছিল রামুকাকা আর সাবির আলীর মুখ। পূবাকাশ নীল হয়েছিল তখন। রামুকাকা বিস্মিত আর রাগত স্বরে বলেছিল -- আজ একা এলি কেনে! অত রাত থাকতে কুন নিশিতে পেইছিল তকে! বারআইলি একাই? 

বাবার জ্যাঠা সেবার মরণের হাত থেকুন বেঁচে ফিরিছিল। 

ভুত প্রেত মানুষ আর নিশির সঙ্গে বাস করা গ্রামগুলি নাই। ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন ইংল্যান্ডে মহারানী আর দিল্লীতে যারা আছে, তাদের চেহারা তারা জানে। ভুত প্রেত নিশি মানুষ আরো ইতর আত্মা মনুষ্যেতরদের সঙ্গে নিস্পৃহ বাস করা চাষাগুলি আছে। তাদের চেহারাগুলিও জানিয়ে রাখা দরকার বলে তারা আরো একবার নিশির ডাকে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েছে। অচৈতন্য হতে হতে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তাদের মরণ নাই। ধ্বংস নাই। তাদের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ছে একটা  আস্ত দেশ...।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন