(বইতরণী পত্রিকায় প্রকাশিত)
সমিধ :- প্রথমেই জানতে চাইব এই দীর্ঘ প্রায় ছয় মাসের লক ডাউন তোমার ব্যক্তিগতভাবে কীভাবে কাটছে?
কৌশিক :- লক-আনলক-লক-আনলক এই ফেরে জনজীবন অতিষ্ঠ সেটা তো নতুন করে বলার কিছু নাই। আমার ব্যক্তিগত জীবন তুই কিছুটা জানিস। সেখানে এই অবস্থার বিশেষ প্রভাব নাই। আমি বহুবছর বোধয় এরকম লকডাউন হয়েই রয়েছি, এতেই অভ্যস্থ। তিন চারদিন ছাড়া একবার সবজিবাজার বেরোই, এছাড়া বাইরে খুব কম যাওয়া হয়, মাঝেমাঝে বুবুর সঙ্গে বাইকে হাওয়া খেতে যাই অবশ্য, যেদিন খুব আবদার করে। এই লকডাউনে ওরও তো খেলাধুলা, সাইকেলিং বন্ধ, তাই আর কী।
আর কিছু পরোক্ষ অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখা হল। গল্পে, উপন্যাসে , ইতিহাসে পড়ে জেনেছিলাম, বহু আগে মানুষ পায়ে হেঁটে তীর্থ ভ্রমণে বেরোত, পথে লুটপাট, ঠগি, ঠ্যাঙাড়ের হাতে কত মানুষ মারা যেত, তাদের আর ঘরে ফেরা হতো না। সেসব বাস ট্রেন পূর্ব যুগের ঘটনা। শুধু তীর্থ না, নানা কাজেই, ভ্রমণে, সেই পাঠ্যপুস্তকে পড়া হিউয়েন সাং, অতীশ দীপঙ্কর ... তো, দেখলাম এখনো মানুষ হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে ফিরতে পারে! ঘরে ফেরা! শিউরে উঠছিলাম। তো এসব সারা ভারতের মানুষের অভিজ্ঞতা। এটা আমার নয়। আমি ঘরে শুয়ে ক্যাথারসিস করছিলাম মাত্র। তবে একটা ভয় ছিল, আছে, এই যে দিনের পর দিন বাজার বন্ধ, পথঘাট ফাঁকা, ব্যাবসা নেই, কোটি কোটি উপার্জনহীন মানুষ, অর্থের লেনদেন কমে যাচ্ছে, যদি ব্যাংক ব্যাবস্থা ধ্বসে পড়ে, যদি আমার সামান্য সঞ্চয় ভেসে যায়, যা থেকে খাই, পরি, বাপ ব্যাটা, তাহলে কী করব! সেই ভয়টা আছে।
সমিধ :- তাহলে বলো, লকডাউন কোথাও আমাদের অত্যন্ত নিজস্ব করে তুলেছে| হয়তো একটু খারাপভাবে বললে স্বার্থপরও। আমরা জনগণমন চিন্তা করতে করতেও কোথাও শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কায় ডুবে যাই।
কৌশিক :- অত্যন্ত নিজস্ব করে তুলেছে'টা ভদ্র করে বলা, আসলে ত স্বার্থপরই। আত্মকেন্দ্রিক। তবে সেটা যে লকডাউন করে তুললো, এই ছ'মাসে, তা নয়। আর সাধারণত মানুষ আদতে নিজে বেঁচে থাকতে চায় প্রথমে। এটা বোধয় বেসিক চাওয়া, সব প্রাণীরই। তবে সামাজিক মানুষ যখন একেবারে কোনঠাসা হয়, তখন জোটও বাঁধে। সুকৌশলে সেই জোটবদ্ধতা ভেঙেও ফেলে কিছু মানুষ, টোপ দিয়ে, বিশেষ কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিলে সে তখন নিজে একা বেঁচে যেতে চায়। তো এখন যদি মূল্যবোধ ইত্যাদির কথা বলিস, সেটা মানুষ হিসেবে আলাদা হয়। 'আমাদের স্বার্থপর করে তুললো' এই বহুবচনটা সত্যি হলেও কেউ কেউ তো আছেনই, যারা লড়ছেন। তো মানুষের এই আত্মকেন্দ্রিকতা মধ্যযুগে বেশি ছিল নাকি এখন, তা আমি জানিনা।
...
শুধু করোনার আবহ নয়, এই ২০২০ ভারতবর্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব ভয়াবহ, যেখানে সামাজিক স্থিতি ভেঙে এক অন্যতর সমাজ আর 'ইতিহাস' গড়ার কাজ চলছে। এটাও একরকম আত্মিক অস্তিত্বের সংকট বলে মনে হয়।
সমিধ :- 'অস্তিত্বের সংকট' ব্যাপারটাকে আমরা যদি অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, অর্থাৎ মধ্যযুগ, আদিমযুগ অথবা আধুনিক যুগ, যাই বল না কেন, সেই সংকট সর্বসময় অস্তিত্বের সঙ্গেই বিরাজমান| আর তার একমাত্র চালিকা শক্তি শুধুমাত্র মানুষের এক কমিউনিটির সঙ্গে অন্য কমিউনিটির সংঘাত তাও তো নয়| সেক্ষেত্রে প্রকৃতির অনেক রকম শক্তির ছোট ছোট উৎস ক্রিয়াশীল| সেক্ষেত্রে এই যে সংকট তা প্রকৃতির একটা নিজস্ব নিয়ম| এর মধ্যেই মানুষের যে টানাপোড়েন তাইই কি মানুষকে বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশিত করতে সাহায্য করে? তুমি কীভাবে ভাব এই সম্পর্ক?
কৌশিক :- বড় কঠিন প্রশ্ন করছিস।
আচ্ছা, তুই বোধয় বলতে চাইছিস অস্তিত্বের সংকট থেকেই সৃজনশীলতার উৎপত্তি কিনা? 'বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ', মানে তো তাই বলছিস। আচ্ছা।এখন, শিল্পবোধের উৎপত্তি শুধুই অস্তিত্ব সংকট থেকে তো বলা যাবে না। খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবে সেটা। মানুষ গুহাতে যখন শিকার দৃশ্য আঁকলো, সেটা শিল্প হয়ে উঠল বটে আমাদের আধুনিক মানুষের চোখে, কিন্তু তা আদতে শিকার পরিকল্পনা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ মুখের ভাষা তখনো পরিনত নয়, তাই ছবি এঁকে কীভাবে একটা বাইসন বা ম্যামথকে পেড়ে ফেলা হবে সমবেত ভাবে, এ হল তার ব্লু প্রিন্ট। বাঁচার প্রয়োজনের শিল্প, অস্তিত্বরক্ষার শিল্প বটে এটা। আসলে শিল্পই। সমস্তটাই জীবনের সঙ্গে যুক্ত। একটার থেকে আরেকটাকে খুলে দেখানো যায় না। কোনটা আর্ট আর কোনটা লড়াই, আলাদা করা যাবে না।
তোর প্রশ্নে 'সেই সংকট সর্বসময় অস্তিত্বের সঙ্গেই বিরাজমান'-- এরকম একটা কথা আছে, যেটা বেশ একটা অন্য জগতের কথা মনে পড়ায়, হয়ত যেখান থেকে আধ্যাত্মিকতার শুরু হল প্রথম। মানুষ যখন আরো কিছুটা মানুষ হল, তার মনে প্রথম আদি প্রশ্ন সম্ভবত -- 'আমি কে?!' এই আত্মজিজ্ঞাসা মানুষকে এখনো তাড়িয়ে ফিরছে! এ নিয়ে যাবতীয় কাব্য কবিতা রচনা হল।
আরেকটা দিক হল-- বাধা! আমরা চোখের সামনে বাধা পছন্দ করিনা, তাই দেয়ালের সামনে মুখ করে বসতে আমাদের কষ্ট হয়। বরং খোলা জানালার ধারটি পছন্দ করি। তো মানুষ যখন খোলা আকাশের থেকে চার-দেয়ালের মাঝে বাসা বাঁধলো, তখন সে বদ্ধ, বাস্তবে দেয়াল মেনে নিয়ে সে মনে মনে দেয়াল ভেঙে ফেলতে চাইল--দেয়ালে আঁকা হল ফুল লতা পাতা পাখি! দেয়াল আর দেয়াল মাত্র রইল না। ভেঙে গেল। তো এইভাবে এগোচ্ছি আর কী এখনো। আমাদের থালা বাটিতেও সেইভাবেই ফুল লতা পাখি রং ইত্যাদি রেখেছি। আর অস্তিত্ত্বের সংকট থেকেও কাব্য রচনা হয়েই থাকে। আসলে জীবনকে বাস্তবের সমস্ত বাধার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমরা এক অন্যতর জগত নির্মাণ করি এসবের মধ্যে। সেই আদিম খোলা মাঠের একটা ডাক এসবের মধ্যে রয়ে গেছে হয়ত। তুই কখনো কোনো দেয়ালে বা বাসন-কোসনে কলকারখানা, যন্ত্রের ডিজাইন দেখেছিস? এ হয় না বোধয়।
মানুষ সেই প্রথম ও একমাত্র প্রাণী, যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে ভার্টিকাল দেয়াল তুলল। আর তা তার নিজেরও সহ্য হল না। তখন সেই দেয়াল ভেঙে ফেলার প্রয়োজন হল। সম্ভবত সেই প্রয়োজনেই মানুষের প্রথম সৃজন প্রচেষ্টা।
সমিধ :- এই যে ভার্টিকাল দেয়ালে ফুলফল আঁকা বা অন্যভাবে বললে, ঘেরাটোপের মধ্যে একটি উন্মুক্ত জানালার খোঁজ এই ভাবটি তোমার নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু-তে খুব স্পষ্ট| এতদিন পরেও অনেকেই বইটির কথা বলেন হয়তো এই সামগ্রিক তৃষ্ণার্তির জন্যেই| বইটির প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই|
কৌশিক :- এতক্ষণ ঠিকই চলছিল। এই আমার লেখালিখি নিয়ে নিজের বিশেষ ভরসা নাই। বইটির প্রেক্ষাপট বলতে যদি তার লেখাগুলি নিয়ে বলিস, তো আমি সত্যিই কিছু বলতে পারব না। কারণ একটা বই প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর সেটা মাথা থেকে নেমে যায়। তবে পিছনের গল্পটা বলা যায়। যেমন এই বইয়ের অনেক লেখাই ১৯৯৫/৯৬ সালের লেখা। আর বইটা প্রকাশ হল ২০১৫ ডিসেম্বর। প্রায় কুড়ি বছরের লেখালিখি আরকি। মাঝে একগুচ্ছ লেখা নিয়ে একটা ছোট বই হয়েছিল, সে হিসেবে এটা দ্বিতীয় হলেও আসলে এটাই প্রথম বই। মানে আমার লিখতে আসার প্রথম দিকের কথাগুলিও এখানে রয়েছে। তো সেসব লেখায় যদি অবচেতনে অস্তিত্বের সংকট থেকে থাকে... তা আমি জানিনা, নিজের অবচেতন তো পড়তে পারিনা। আর কিছু বলব?
সমিধ :- যে ভার্টিকাল দেয়ালে ফুলফল আঁকার কথা বললে, যেন ঘেরাটোপের মধ্যে একটি উন্মুক্ত জানালার খোঁজ, সেটা এই বইটিতে খুব স্পষ্ট| তাহলে তোমার এই যে গৃহবাস, আরো বিস্তারে যা আমাদের বেড়ি পড়ানোর দিনযাপন তার বিপরীত একটা অবস্থান, অবচেতনে তোমার একদম গোড়ার দিকের লেখালেখি থেকেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে নাকি ?
কৌশিক :- এই দ্যাখ, আমার অবচেতন কি আমি জানি! তবে ওই দেয়াল ভাঙার ব্যাপারটা তো সত্যি। তবে সত্যি বলতে, আরো সোজা করে বল্লে, আমার লেখালেখি ব্যাপারটা আসলে বাস্তব থেকে পালানোর একটা পথ। যে অবস্থার মধ্যে অবস্থান করছি সেই নিরেট বাস্তব হয়ত আমি চাই না, অন্যদিকে যা নেই, যা পাইনি, যা ইচ্ছে করি, সেই অলীককে রচনা করা। একটা অন্য জগত তৈরি করে তার মধ্যে বাস করা। একজন পলায়নবাদী লোকের চালাকি বলতে পারিস।
সমিধ :- তোমার বইগুলির মধ্যে দুটি ধারা দেখা যাচ্ছে| একটিতে আছে নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু, লেখো অশ্রু লেখো, মাধুরীর সঙ্গে নাই কেউ এবং বকুল ডালের আঙুল| আর অন্য ধারার মধ্যে পড়বে বাকিগুলো যেমন, ম্যাটিনিতে রূপকথা টকিজে, বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে এরকম বইগুলি| এই স্ট্রাকচার কি তোমার সচেতনভাবেই তৈরী?
কৌশিক :- দুটা ধারা নাকি? জানিনা তো!
ভাবনার আর 'সচেতন প্রয়াস ' কী হবে? বিষয়গুলো হয়ত আলাদা, আবার কোথাও একই। একেকটা ফেজে একেক রকম ভাবনা আসে, আমি জানিনা ঠিক। ভাবিনি এটা কখনো। সচেতনতা বলতে কিছু লেখার পর টুকটাক শব্দ বদলানো। বা ফিরে লেখা। সে তো অন্যপ্রসঙ্গ।
সমিধ :- আচ্ছা বেশ| বিষয়টাকে অন্যভাবে বলি| তাতে হয়তো কিছু সূত্র উঠে আসবে| এই যে লেখালেখি তা আমাদের জীবন বোধের বাইরে তো নয়| একটা চাকা গড়াচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে দাগ পড়ছে মাটিতে| এই চাকা থেকে তার দাগকে কিন্তু আলাদা করা যায় না| কিছুটা কিছুটা দূরত্বে চাকা নিজেই কিছুটা পাল্টে পাল্টে যায়| দাগও পাল্টে পাল্টে যায়| তোমার কী মনে হয়, এই চাকা গড়ানোর ড্রাইভ ফোর্স তোমার ক্ষেত্রে কী?
কৌশিক :- চাকা নানা পথে ঘোরে। কখনো নরম মাটি কখনো শক্তমাটি, কখনো চড়াই কখনো উৎরাই। তো সেইমতো ছাপ পড়ে। সবার জীবনেই তা সত্যি। যে লেখে তার, যে লেখে না, তারও। কজনই বা এই লেখালিখির মধ্যে থাকে বল? কজনই বা পড়ে। মানুষ নানা কাজে আজীবন ব্যস্ত। মূলত বেঁচে থাকতেই, টিকে থাকতেই সমস্ত জীবন চলে যায়। সেখানে আজকের এই লেখালিখি একটা সৌখিন বিষয়। তবু কেউ কেউ লিখে রাখে। তাদের সেই লেখা থেকে ভবিষ্যৎ কখনো হয়ত দিশা পায়। সেই দিশা দেখানো কাজ যে পারে সে পারে। বাকিগুলো এই পথটাকে ধরে রাখা মাত্র। তবে ব্যর্থ কিছুই না। তো তুই হয়ত আমার লেখার চড়াই উৎরাইয়ের পথটা জানতে চাইছিস। সে তো বলার মতো তেমন কিছু না। খুব সামান্য, সাধারণ হাঁটাহাঁটি এইসব। আর পাঁচজনের হাটুরের মতো। তবু জীবনে নিশ্চিত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে নানা সময়ে, যেখানে আমার হাত ছিল না। হয়ত সেসব খুব সুখের নয়। সেইসব ঘটনার প্রভাব অথবা পলায়ন দুই-ই থাকতে পারে লেখাতে। এ নিয়ে আর কী বলব...
ড্রাইভ ফোর্স হয়ত একটা আছে। নইলে বেঁচে আছি কীভাবে! সেটা হয়ত স্বাভাবিক একটা গতি। তবে আমি এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। মূলত গড়ানো জীবনে আমি বিশ্বাসী। জীবনকে চালনা করার ক্ষমতা মানুষের নেই আসলে। তবু সে পরিকল্পনা করে ভবিষ্যতের। অতীতের হিসাব করে। আমি চলতে চলতে দেখায় বিশ্বাসী। রাস্তার দুপাশের যা রয়েছে, দেখে নেওয়া শুধু। কোথায় চলেছি, জানিনা। কে নিয়ে যাচ্ছে তাও জানিনা।
আর লেখার ব্যাপারে যদি বলিস, একটা ব্যাপার হয়, আমার সব লেখাই কখনো কাউকে মনে ভেবে লেখা। মানে বিশেষ কেউ, যে পড়বে। সে কখনো বৌ, কখনো প্রেমিকা, কখনো বন্ধু। বাস্তবে হয়ত সে পড়লই না। তবু আরকি...
সমিধ :- মায়াবনবিহারিণী? বিগত দশকগুলিতে আমাদের স্বনামে বিখ্যাত অগ্রজরাও এরকম কিছু বলেছেন বটে| সেখানে সুরা থেকে নারী, যৌনতা ড্রাইভ ফোর্স হিসেবে অনেক কিছুই এসেছে| তবে তুমি আবার একে বেঁচে থাকার 'সৌখিন দিক' হিসেবে অনেকবার বলেছ| এটা কি তবে নিছক একটা বিলাস? এবং যা অতিরিক্ত| তোমার মায়াবনবিহারিণীদের নিয়ে কিছু বলবে?
কৌশিক :- দ্যাখ, নিজের এই আবাল লেখালিখি নিয়ে কিছু বলা আমার কাছে হাস্যকর লাগে। তবু সবারই যেহেতু নিজের কথা বলার হক আছে তাই লিখি। এসব খুব কমন কথাবার্তা। বলতে চাই না তবু খোঁচা দিচ্ছিস।
হ্যাঁ, সেইসব অগ্রজেরা নমস্য, তাদের ক্ষেত্রে হয়ত এটা বেঁচে থাকার শৌখিন দিকই ছিল কারো কারো, আর পরবর্তী প্রজন্মের সব্বনাশটা এখানেই হয়েছে। যাকগে।
তবে এক্ষেত্রে বিষয়টা একটু অন্যরকম। যেমন 'নাচে জন্ম…'র পুরনো লেখাগুলো যখন লিখি তখন আত্মিক সংকটই চালিকা শক্তি, প্রথম যৌবন, অভাব, না পাওয়া, মানে সেখান থেকে পালানো,ওখানে নানারকম লেখা আছে, ওটা বিচিত্রানুষ্ঠান হয়ে গেছে। আবার 'বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে'র লেখাগুলো, তখন বুবু খুব ছোট, তার কৌতুহল, বিস্ময়, নিজের মনে বানানো গল্প, বাচ্চারা যেমন বলে আরকি, সেগুলো লিখে রাখতাম। সেইসঙ্গে ওর আঁকার খাতার ছবি। ইচ্ছেটা হল --এসব গুছিয়ে রেখে দিই, বড় হয়ে বুবু একদিন এসব আবিস্কার করে চমকে যাবে। আবার 'মাধুরীর সঙ্গে নাই কেউ' এর লেখাগুলো সবই একজন নারীর বয়ান। ব্যক্তি পুরুষ হিসেবে আমি সেখানে নেই।
'ম্যাটিনিতে রূপকথা টকীজে' নামে একটা ছোট বই আছে। সেটা আবার আমার সিনেমা দেখার গল্প। এক সময় প্রচুর সিনেমা দেখেছি। মিঠুন-শ্রীদেবী, প্রসেঞ্জিত সব। তখন নাইন টেনে পড়ি। সেই নেশাটাই পরে কনভার্ট হয়ে ঋত্ত্বিক,সত্যজিৎ বা বিদেশী সিনেমার দিকে চলে গেল। তো আমার ভাবনায় সিনেমার একটা ব্যাপক প্রভাব ছিল। শুধু আমার না, ভারতীয় শহর মফস্বলের জনজীবনেই এটা ছিল। বাবা কাকাদের সময় ছিল দিলীপ কুমার-দেবানন্দ ছাঁট চুল, আমাদের সময় সেটাই বচ্চন-মিঠুন ছাঁট। আবার আমাদের মা মাসীদের সময়ের অবশেসন উত্তম-সৌমিত্র-ছবি বিশ্বাস। সেইসব ধরে রাখতে এই কবিতাগুলো। রূপকথা টকীজ বিষ্ণুপুরের একটা সিনেমা হল।
হ্যাঁ, 'আধুনিক কবিতা' একরকম বিলাসই বটে। মানে এই জগতটার দিকে তাকালে তাই মনে হয়। পোশাক আশাক, মঞ্চ, পুরস্কার, জলসা, বিশাল লজ টজ ভাড়া নিয়ে হুল্লোড়, (এই হুল্লোড়টা আমারো ভাল লাগে, আড্ডা, মেলামেশা ইত্যাদি হয়) এই যে একটা ধারা চলছে এটা তরুণদের প্রভাবিত করেই। এখানে বিলাসিতা নেই এটা বলা যাবে না। এইটা বিলাসিতার একটা গোদা দিক। আবার যখন দেখি কপর্দক শূন্য মানুষ খালি পায়ে হাঁটছে হাজার হাজার মাইল, ফসল শূন্য মাঠের পাশে গাছে ঝুলছে চাষী পরিবার, তখন, যেহেতু আমার কবিতায় এদের সুরাহা নাই, তাই বিলাসিতা লাগে কখনো।
কিন্তু দেখ, কবিতা ব্যাপারটাকে এরকম একটা খোপে আটকে না রাখলে বিষয়টা অন্যরকম হত। যে লোকটি মাঠ থেকে ফিরে ঝুমুর লিখে রাখছে, যে ছেলেটা ভ্যান চালিয়ে ফিরে সন্ধেবেলা হাড়িয়া খেয়ে তুষু গান বানাচ্ছে, কিছুকাল আগেই রাজিমিস্ত্রিরা শ্রম লাঘবের জন্য ছাত পিটানোর গান গাইতো, সেসব জীবনেরই গান, এরা অনেক বেশি দায়বদ্ধ জীবনের প্রতি। এদের দেখলে অল্প লজ্জাবোধ হয় বৈকি। এদের ত আর কবি বলে স্বীকার করা হয় না, সময় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, এইসব কথাগুলিও গল্প হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
সমিধ :- অনেকেই শিল্পীর উচ্চকিত হওয়াটাকে পছন্দ করেন না| কিন্তু এইটাই একরকমের বদ্ধ মানসিকতা নয় কি? হৈ চৈ থেকে, অনুষ্ঠান, আদব-কায়দার হল্লায় না থাকাটা একটা মুখচোরা আত্মপলায়ন মনে হয় না? লেখাটা তো কেউ আর ওই জায়গায় বসে লেখে না! এই যে এখন প্রায় শোনা যায় 'আড়ালে থাকা কবি', কথাটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে না শুনতে !
আর ঝুমুর গান, টুসু বা ভাটিয়ালি অর্থাৎ যে সমস্ত শিল্পবোধ তথাকথিত প্রান্তিক মানুষদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত, তার আবেদন তো কেউ অস্বীকার করতে পারেন না| আধুনিক মিডিয়াতেও এঁরা অনেকেই প্রচারও পাচ্ছেন| কিন্তু এই যে আমাদের অহেতুক প্রান্তিকতার বিলাস ভাবনা, তার সত্যিই কোনো বাস্তবতা আছে ?
কৌশিক :- প্রথমতঃ উচ্চকিত না হওয়া আর বদ্ধ মানসিকতা সমার্থক কিনা?-- এই প্রশ্নটাই আসলে উত্তর।
উচ্চকিত মানুষের পাণ্ডিত্য দেখেছি, কিন্তু গভীর উপলব্ধির কথা বলছেন, এমনটা চোখে পড়েনি। যাইহোক, হৈচৈ হুল্লোড় আমি ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করি। অবশ্যই সেটা আঁতের লোকজনের সঙ্গে। কিন্তু আদব কায়দার হল্লায় না থাকাটা মুখচোরা চরিত্রের পরিচায়ক হলেও তা আত্মপলায়ন কেন হবে? আত্মপলায়ন তো আলাদা ব্যাপার। সে নিজেই নিজের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। যাইহোক, এগুলো সবই ব্যক্তিচরিত্র নির্ভর। আড়াল অনেকেই ভালবাসে। এমনকি জীবনানন্দও রূপসী বাংলার মতো পাণ্ডুলিপি, গোছা গোছা গল্প উপন্যাস ট্রাঙ্ক বন্দী রাখলেন, নিজের একটা সত্ত্বাকেই আড়ালে রাখলেন। সে তো অদ্ভুত বটেই। এই ' অদ্ভুত' শব্দটাও অদ্ভুত।
দ্বিতীয়তঃ ভাদু তুষু ঝুমুর ভাটিয়ালি ইত্যাদির মিডিয়া প্রচার। এইপ্রসঙ্গে বিকাশ জেঠু, কবি বিকাশ দাসের একটা সহাস্য মন্তব্য মনে পড়ছে। বাউল গান নিয়ে কথা হচ্ছিল, সে প্রসঙ্গে এক বিখ্যাত বাউল গায়কের কথা উঠল। যিনি আমেরিকা ইউরোপেও বাউল গাইতে গেছেন। পথে ঘাটে তার গান বাজে। তো বিকাশ জেঠু হা হা করে হেসে উঠে বল্লেন -- আরে ও তো ডিস্কো বাউল! তো এই 'ডিস্কো' শব্দটির ব্যঞ্জনা বিকাশ দাসের মুখে না শুনলে বোঝা মুশকিল। কথা হল চর্যা। সেই জীবনটা যাপন করা। এই যে বললি 'অহেতুক প্রান্তিকতার বিলাস ভাবনা'! এই যাপনের মধ্যে না থাকলে তা সত্যিই ভাবনার বিলাস মাত্র। যার কোনো বাস্তবতা যাপনের বাইরে নেই।
মোদ্দা কথা কাজটা যখন জীবনের প্রয়োজনে, তখন নিছক খ্যাতির শৌখিনতা থেকে আড়াল রচনা করে নেয় কেউ কেউ।
সমিধ :- মানুষের বেড়ে ওঠার ব্যাকগ্রাউন্ড তার চিন্তাভাবনার উপরে প্রভাব বিস্তার করে| আবার এই চিন্তা ভাবনাই পরবর্তীতে ক্রমে তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের নির্ণায়ক হয়| এই দুটো সমার্থক না হলেও নির্ভরশীল তো বটেই| তবে বদ্ধ ও মুক্ত চিন্তার ধারণাটা অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক কনসেপ্টে একটা টাল খাওয়া ব্যাপার বলে মনে হয় না কি তোমার? এখন তো বহু ক্ষেত্রেই সনাতন যা কিছু তাইই 'বদ্ধ' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়| আবার ব্যক্তিগত গণ্ডীর পরিসরও ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে| নিজস্ব শান্তির লক্ষণরেখায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে ঢুকে পড়াটাকে আমরা 'আধুনিক ও মুক্ত' নামে চালিয়ে দিচ্ছি| সমাজের বিভিন্ন দূরবর্তী স্রোত এই সময়ে সহজে মিশে যাওয়ার যে সুবিধা, তারই কি অন্য পিঠের অসুবিধা ভুগছি আমরা?
কৌশিক :- আগের প্রশ্নের সূত্র ধরে না নিয়ে এটাকে একটা ভিন্ন প্রশ্ন হিসেবেই ধরতে হবে বোধয়। হ্যাঁ, মানুষের বেড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট, পরিবেশ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা সব মিলিয়েই ত তার চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি শক্ত হয়। তাই মুক্ত চিন্তাও অনেক ক্ষেত্রে বদ্ধতা পায় দেখি। যখন সেটা তত্ত্বে পরিণত হয়। সেরকম ত ধর্ম থেকে রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই দেখলাম।
এখন 'সনাতন' মানে কী? যদি চিরন্তন, শাশ্বত অর্থে ধরি তাহলে তার কিবা মুক্ত কিবা বদ্ধ! তবে এই সমস্ত শব্দগুলির অর্থ যদি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে তখন সব গুলিয়ে দেওয়া হয়। আমি রাজনীতি বলতে দখলের রাজনীতিকেই বলছি। এখন সনাতন শব্দটিও রাজনৈতিক আর মুক্তচিন্তা শব্দটিও রাজনৈতিক। সম্ভবত সেইজন্যই এরকম একটা প্রশ্ন উঠে এলো। এখন একটা সমাজ কতখানি 'মুক্তচিন্তা'র হতে পারে? আদৌ কি সম্ভব? কারন এই এগুলি তো বিমূর্ত ধারণামাত্র! আর ইন্ডিভিজুয়ালি একেকজনের মুক্তচিন্তা একেকরকম হবে তার পরিবেশ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। তাহলে তোর মুক্তচিন্তা আর আমার মুক্তচিন্তা কীভাবে এক হবে! এটা একটা প্রশ্ন বটে। সমস্যাও এইখানে আর এইজন্যই তত্ত্ব। অর্থাৎ 'মুক্তচিন্তা'র একটা সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ণয় করে দিতে হয় সমাজের জন্য। যা আসলে কারোই চিন্তার মুক্তি হয়ে ওঠেনা শেষ অবধি।
অন্যদিকে তোর 'সনাতন'। যা চিরন্তন, শাস্বত। যেমন? উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে দেখি কিছুই চিরন্তন নয়। শাশ্বত নয়। বেদও নয় সূর্যও নয়। কোনো কনসেপ্ট, কোনো বিমূর্ততা, কোনো মূর্তিই শাশ্বত নয়। পৃথিবী, মানব, এই নীল আকাশ কিছুই না। প্রত্যেকেরই জন্ম হয়েছিল, মৃত্যু হবে। তাহলে এই সনাতনকেও ভেঙে নিতে হবে, আমাদের সভ্যতার মাপে। যেমন সময় একটি ধারণা মাত্র। যাকে আমরা দণ্ড, পল, মুহূর্ত, প্রহর, সেকেন্ড, মিনিট, বছর, যুগে ভেঙেছি নিজেদের প্রয়োজনে। তো ঝগড়াটা হল এই খণ্ডিত সনাতন নিয়ে। বা খণ্ডিত মুক্তচিন্তা।
বোধয় একমাত্র শাশ্বত সেই অন্ধকার! সৃষ্টির আগে বা পরে যা সত্য বলে ধরা হয়। যা আমাদের ক্ষুদ্র মানুষের অভিজ্ঞতায় আসার কথা না।
বলাবাহুল্য যে আমার এই কথাগুলোও খণ্ডিত চিন্তা মাত্র। এর এবসোলিউট কিছু নেই, ধরিস না।
সমিধ :- আলোচনাটাকে অন্য দিকে খুব বেশি বিস্তৃতির সুযোগ এখানে নেই, যাতে পাঠক খুব বেশি দর্শনের কচকচি মনে করেন|
আমি শিল্পের প্রসঙ্গ টেনে বলি, আমরা অনেকগুলো ডোমেইনের কথা বলি: আধুনিক- অনাধুনিক, সনাতন- অসনাতন, আরও কত কিছু| কবিতার ক্ষেত্রেও এই কনসেপ্টগুলো বর্তমান| আবার বিকাশবাবুর 'ডিস্কো বাউলের' কথাও শুনলাম| তাহলে দেখা যাচ্ছে যে শিল্প ব্যাপারটিও সর্বজনীন নয়| সমাজের বিভিন্ন ডোমেইনে তার গ্রহণযোগ্যতা বিভিন্ন| 'কমন আর্ট' বলেও কিছু হয় না| যদিও 'বিশুদ্ধ শিল্প' বলে একটা অজুহাত তৈরী আছে, তা সেও কিছু সর্বজন প্রামাণ্য বস্তু নয়|
এই যে শুধুমাত্র সামাজিক স্তর-বিভিন্নতার কারণেই শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা এবং ফর্ম পাল্টে যেতে বাধ্য হ'ল, সেটা কার অপারগতা? শিল্পীর নাকি গ্রহণকারীর? 'ডিস্কো বাউলে' মাতোয়ারা মানুষ 'মাটির বাউল' থেকে পরিত্যক্ত হয়ে রইল কার অযোগ্যতায়?
কৌশিক :- শুধুমাত্র সামাজিক স্তর-বিভিন্নতার কারনে গ্রহণযোগ্যতা বা ফর্ম পাল্টে গেছে এমনটা যদিও নয়। পাল্টে যাওয়ার মূল কারন আসলে-- ঘটমানতা। সে যাইহোক। মূল প্রশ্নটা সম্ভবত, ওই সমাজের বিভিন্নস্তরে শিল্পের গ্রহনযোত্যতার ভিন্নতা। হ্যাঁ, এখানে বেশ কিছু মজার ব্যাপার আছে। যেমন ধর 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' নামের সিনেমাটি। এটা তো উচ্চাঙ্গের দর্শকের কাছে খিল্লির ক্ল্যাসিক উদাহরণ। তো সিনেমাটাতে কী আছে? বহুকাল আগে দেখা, (আরে ভাই এটা জনা দশেক বন্ধু মিলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে দেখেছিলাম, হাসবি না।) যদ্দূর মনে পড়ছে যাত্রার স্টাইলে মেলোড্রামাটিক রূপকথার গল্প। যেটা সারা বাংলার সাধারণ দর্শক উপভোগ করেছিল। সুপারহিট যাকে বলে। আবার ঋত্বিক ঘটকের জনপ্রিয় ছবি মেঘে ঢাকা তারা ভাব। এটাও কিন্তু সবারই প্রিয় খুব। মানে বেদের মেয়ে যারা দেখেছে, তারাও এটা দেখে মোহিত। বা ঠিকঠাক বললে মেঘে ঢাকা তারা দেখা দর্শকই বেদের মেয়ে দেখেছিল। কীভাবে সম্ভব? সম্ভব, কারণ আমাদের ভারতীয় মন মেলোড্রমাতে ক্যাথারসিস করে বেশি। 'দাদা আমি বাঁচতে চাই' এই সংলাপ যখন ঘুরে ফিরে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, তখন যে মেলোড্রামা তৈরি হয় তা আমাদের কাঁদায়। ঋত্বিক এই আবহমান ভারতীয় মেলোড্রামাটা নিয়েছেন। তফাত হল, ঋত্বিক ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন, আর বেদের মেয়ে ব্যাবসা করতে চেয়েছে।
বাকি যেটা থাকে তা হল তথাকথিত শিক্ষিত, শহুরে দর্শকের নাকউঁচু হিপোক্রেসি। এই স্তরগুলো মেনে নিতে হবে। শিক্ষা ত অপরকে হেয় করতে শেখায় না। আমি গোদার বা তারাকোভস্কি শিক্ষিত-দর্শক, মানে এই নয় যারা বেদের মেয়ে দেখছে তাকে বাঁকা হাসব। এইখানেই ডোমেইন চলে আসে, খণ্ডিত ধারণা। পলনস্কি বা তারাকোভস্কির ব্যাকগ্রাউন্ডে যাত্রাপালা, কীর্তনগান, বা রামায়ণী গান, পাণ্ডবানী, ইত্যাদির ইতিহাস নেই, আছে তার দেশকালের অন্যতর ইতিহাস, সেটা মেনে নিয়ে সেগুলো দেখব। দুটোকে মেলানো যাবেনা।
এইবার একেবারে শেষের প্রশ্নটা। এক্ষেত্রে কিন্তু সাধারণ মানুষ 'ডিস্কো বাউল' আর 'মাটির বাউল'কে কনসাসলি আলাদা করছেই না। তারা ক্যাসেট বা সিডিতে ডিস্কো বাউল শুনছে, আবার তারাই অজয়ের তীরে বাউল মেলা যাচ্ছে। এখানে ডিস্কো বাউল আসলে দু'টাকার শ্যাম্পুর মতো। তাকে বানিজ্যিক ভাবে প্রোমোট করা হয়েছে। মানুষ খাচ্ছে। বাউলের সংজ্ঞা এভাবে সাধারণের কাছে পাল্টেও গেছে। আগে যেখানে বাউলদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। সোজা কথায়, মেরে তাড়ানো হয়েছিল, কারণ বাউল চর্চা সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির চোখে ছিল অশালীন, অসামাজিক চর্চা। এখন ডিস্কো বাউলের এসি গাড়ি বাড়ি মঞ্চ মানুষের সম্ভ্রম জাগাচ্ছে।
আবার বলি, আমি যা বলছি, তা আংশিক সত্য, বা ভুলও হতে পারে কোথাও, আসলে বিষয়গুলো খুবই জটিল। তোর এই প্রশ্নের ভেতর 'কমন আর্ট' 'বিশুদ্ধ শিল্প' এসব নিয়ে প্রচুর কথা হতে পারে। যেমন কমন আর্ট না থাকলেও 'পাবলিক আর্ট' বলে একটা বিষয় আছে। সেসব অন্য ব্যাপার, এই আরকী।
সমিধ :- দ্যাখো, বাণিজ্যকরণের পরিকল্পনার সঙ্গে শিল্পের মানোন্নয়নের মেলবন্ধন ঘটে কি! সেক্ষেত্রে বাণিজ্যকরণ শিল্প ও শিল্পীর অভিমুখ নির্ণয়ে ভূমিকা পালন করে, এই আক্ষেপে আটকে যাওয়া ছাড়া আমরা অন্য কি বিকল্পের কথা ভাবতে পারি?!
কৌশিক :- কাব্য শিল্পে বহুযুগ ধরেই এরকম দুটা ধারা রয়েছে তো। আগে ছিল রাজা মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতা, এখন বানিজ্যিকরণ। এর বাইরে কেউ কেউ স্বাধীনভাবে চলে। তবে এযুগে আমাদের সেই স্বাধীনতা কতটা স্বাধীন সেও একটা প্রশ্ন। কারণ আমাদের শিক্ষার নামে যে সকল ইনফরমেশন দেওয়া হয় সবই একটা ছাঁচ। জীবন শিক্ষা নাই। কাজেই আমাদের ভাবনার স্বাধীনতা নাই। যা কিছু আমার ভাবনা বলে আমরা মনে করি, তা অনেকাংশেই হয়ত আমাদের মাথায় পরিকল্পিত ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। --সিনেমা, টিভি, খবর, বিজ্ঞাপণ, বিলবোর্ড, গুজব, সমস্ত মিলিয়েই এই আমি। কল্পবিজ্ঞানের মাইক্রো ব্রেন চিপের মতো, আসলে আরো ভয়ংকর। এর থেকে পালানোর উপাই নাই। স্বাধীন কবিতা কীভাবে লিখবি রে! একাডেমিক ভাবে চুড়ান্ত অশিক্ষিত হওয়া একটা পথ হতে পারে। হাসছিস?
সমিধ :- জীবন শিক্ষার কথা বলছ! শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর অবস্থা দেখছ তো! আবার দ্যাখো, গান্ধীজি তৎকালীন দিনে আশ্রমে বই পড়তে দিতেন না বলে শুনেছি| তা রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি এই দুই গ্রাহ্য পথপ্রদর্শকের দুই ধারার 'জীবন শিক্ষাও' আমাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়|
কৌশিক :- গান্ধীজির এই ব্যাপারটা জানিনা। তবে রবীন্দ্রনাথ বা অরবিন্দের নির্দিষ্ট কিছু ভাবনা রয়েছে শিক্ষা সম্পর্কে। সেগুলো এখানে বলে ভার বাড়িয়ে লাভ নেই। তো রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আদর্শের ঘন্টা সম্ভবত সেদিনই বেজেছিল যেদিন বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হল। আরেকটা ব্যাপার হল, কেন্দ্রীয় যদি নাও হত, তবুও হয়ত সেই শিক্ষা আদর্শ চলতে পারত না খুব বেশি কাল। কারণ জগৎ একদিকে, আর তার মাঝে উল্টো পথের একটি দ্বীপ হয়ে কোনো আদর্শ কোনো প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকতে পারে কিনা জানিনা। হয় গোটা জগতকে নিজের মতো কর, নয় নিজে জগতের স্রোতে মিশে যাও, এই হল নিয়ম। সুতরাং যা হবার তাই হয়েছে।
সমিধ :- জগতের বেশিরভাগ সাধারণ জনগণই লোভী, ভোগবিলাসী, পরিশ্রমবিমুখ এবং কোয়ালিটি নেগেটিভ এই ধরণের একটা মতামত খুব চলছে| যেন গুটিকয় মাত্র মানুষ এসবের উপরে উৎকর্ষ চিন্তাভাবনা এবং জীবনচর্যায় ব্যাপৃত থেকে জগৎ কল্যাণে ব্যস্ত, আর বাকিরা নিতান্তই অবুঝ ও নালায়েক| অথচ আমরা যখন শিল্প সংস্কৃতির বিশুদ্ধতার কথা বলি, যখন গ্রহণযোগ্যতার কথা বলি তখন এই জনতাই জনার্দন, জনতাই একটা অনিবার্য শক্তি| স্পষ্ট করে বলো তো, এটা কেমন দ্বিচারিতা! আর সাধারণ জনগণ সত্যিই কি শিল্প সংস্কৃতির উৎকর্ষতার ট্রেন্ড তৈরী করতে সক্ষম?
কৌশিক :- জগতের বেশিরভাগ সাধারণ জনগণই লোভী, ভোগবিলাসী, পরিশ্রমবিমুখ এবং কোয়ালিটি নেগেটিভ আর গুটিকয় জগৎকল্যান করছে এরকম কোনো মতবাদ আমি শুনিনি এখনো। তাই বলতে পারব না। আর বিশুদ্ধতার সঙ্গে জনগনের সম্পর্ক কী তাও বুঝলাম না।
এখন তোর এই ক্ষোভটা নেব না প্রশ্নটা নেব? দুটো ত আলাদা? আচ্ছা এগুলো কারা বলছে, আমি ত খোঁজখবর রাখিনা বিশেষ। ব্যাপারটাই বুঝছি না তাই।
শেষ লাইনের প্রশ্নটা আলাদা ভাবে নেব?
সমিধ :- তোমার বক্তব্যের প্রথম অংশের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ক্লু দিচ্ছি:-
এক, বাণিজ্যিকভাবে প্রমোট করা জিনিসই সাধারণ মানুষ খাচ্ছে| দুই, জীবন শিক্ষাহীন শিক্ষিত হওয়ার সিস্টেমে ইঁদুর দৌড়ে সামিল হচ্ছে জনসাধারণ| তিন, খুব সহজেই রাজনৈতিক বোড়ে হয়ে ওঠা| চার, চূড়ান্ত ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, তোষণ এবং ধর্মান্ধ মানসিকতার ক্ষমতায়ণ|
আরও অনেক কিছুই তো প্রতিদিনের চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশনের বোদ্ধা আলোচনায় নিয়মিত ঝড় তুলছে| এড়িয়ে যাবে কী ভাবে!
যাই হোক, শেষ লাইনের প্রশ্নটা নিয়ে বলো|
কৌশিক :- আচ্ছা, শেষ ভাগের প্রশ্নটা ধরে বলি। প্রথমত, শিল্প আর সংস্কৃতির অর্থ বিপর্যয় ঘটে গেছে বহুকাল। এটা আমার মনে হয়। একদম প্রথমে শিল্প বিষয়টা কীভাবে এলো, আলোচনা হয়েছিল। সেটা ধরলে, তখন শিল্পের কোনো ক্লাস ছিল না। এখন আছে। এখন বিশেষ কিছু মানুষ শিল্পের চর্চা করে। একটা শ্রেণী। অথবা শিল্প ব্যাপারটা একটা ছোট খোপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সংস্কৃতিও তাই মনে হয়। রবীন্দ্র নৃত্য, গান, দুটা আধুনিক, তারপর শঙখ বাদন, মোমবাতি জ্বালানো এসবে এসে ঠেকেছে আরকী। এই হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অবশ্য নন্দন পাড়া আর আমাদের গয়লা পাড়ার সংস্কৃতি আলাদা। তো নন্দন পাড়া সবার জন্য নয়, সেটা একটা ক্লাস। আমাদের পাড়া আরেকটা ক্লাস। আরো আরো ক্লাস আছে।
এখন আধুনিক উচ্চমার্গীয় যে শিল্পধারাটি, সেটি একটি ছোট্টো ক্লাস। মধ্যবর্গীয়রা আমাদের পাড়ার যেটা বল্লাম। আর বাকি থাকে 'অপর'। তারা 'শিল্প' করে না। অথবা তাদের বেঁচে থাকার থেকে শিল্পকে আলাদা করে খুলে দেখানো যায় না।
লক্ষ্মী পূজার ধানের ঝাঁপি সাজানো হত একটা সময়, লাজদুয়ার থেকে লক্ষীর পায়ের ছাপ এঁকে চলে ঠাকুর ঘর উঠোন পেরিয়ে। গোবর নিকানো উঠোনে আঁকা শেয়াল, পেঁচা, মই, লাঙল, ধানের মরাই, এইসব। দুয়ারে পা দিলেই তুই সেই পদছাপ ধরে পৌঁঁছে যাবি সঠিক জায়গায়। শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠলে পুজা হয়। এটা রিচুয়াল। তো সেই একনম্বর ক্লাস এই রিচুয়াল থেকে পৌঁছে গেল ইনস্টলেশন আর্টে। এই পুজা আমাদের বাড়িতে হত বছরে চারবার, এখন আর হয় না, জমি নাই, ধান আসেনা, এখন আমি ক্লাস নির্দেশিত কবিতা লিখি। সেম জিনিস বাঁকুড়ার ঘোড়া। আর্ট করেনি কেউ, আসলে কালভৈরব এর থানে ঝোপে জঙ্গলে পড়ে থাকা অপদেবতা এরা। এখন ফার্স্টক্লাসের ড্রয়িং রুমে তিনি থাকেন। বিষয়টা কি কিছুটা বলতে পারলাম?
সমিধ :- এইটা খুব স্পষ্ট একটা দিশা পাওয়া গেল তোমার কথায়| খুব সুন্দর বললে। উঠোনে আঁকা শেয়াল, পেঁচা, মই, লাঙল, ধানের মরাই, এইসবে পা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিমুখটাই আমাদের সামান্য শিল্পচর্চার অভিমুখ| এই ছবিগুলিই আমাদের আত্মার আত্মীয়, আমাদের শিল্প ভাবনার প্রথম সোপান। তোমার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকবারই পেইন্টিং এর কথা উঠে আসে| মূলতঃ একাডেমিক পেইন্টিং এর কথাই| তোমার ভাবনা এবং লেখা এই একাডেমিক ও নন-একাডেমিক পেইন্টিং দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত জানতে ইচ্ছে করে।
কৌশিক :- এখানে সেই টিভির লোকটার মতো চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে -- না না না না না না! মানে একাডেমিক পেন্টিং সম্পর্কে আমার যে জ্ঞানগম্যি আছে বলে তোর ধারণা, সেটা সম্পূর্ণ ভুল। তবু বলেছি হয়ত কখনো, তার কারণ সঙ্গদোষ। আমার যারা বন্ধু, যারা একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছি এই বিষ্ণুপুরে, সেই দলটির প্রত্যেকেই, আমি বাদে, ফাইন আর্টসে গেছে। এখন তারা সবাই নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত, ভারতের নানা শহরে, তবু আমাদের সেই শেকড় বিষ্ণুপুর। সত্যি বলতে আমার বন্ধুরা কেউ কবি নয়, যদিও কবিবন্ধু অনেকেই আছেন। আর প্রভাব যদি বলিস তাহলে বলব, পেন্টিং নয়, আমাদের সবার মনোজগতে এই পরিবেশটা রয়ে গেছে, এই টেরাকোটা মন্দিরের চাতালে সারাদিন বসে থাকা, এগুলো আমাদের পাড়াই বলতে পারিস, এই অপূর্ব শৈলী, এই মাটি, এই এবড়োখেবড়ো ঢালু জমি, কাঁটা ঝোপ এইসব। ছোট থেকেই এর চারপাশে বেড়ে ওঠা, পরে, বড় হয়ে দেখব যামিনি রায় আদি শিল্পীদের ছবিতে এই বাংলার টেরাকোটার প্রভাব, ইত্যাদি। বাস্তবে এইসবই যদিও বদলে গেছে, কিচ্ছু নাই। তবু ভেতরে সেই মাটির রঙ কোথাও হয়ত রয়ে গেছে আমাদের।
সমিধ :- কবি মনীন্দ্র গুপ্তের তবু একটা অনির্বচনীয় অক্ষয় মালবেরি আছে| এই অনবরত হারিয়ে যাওয়া আর ছিন্নমূল হওয়া আমরা কী রেখে যাচ্ছি? কয়েকটা চটি কবিতার বই কি আর এতটা ভার বহন করতে পারব?
কৌশিক :- আহা! অক্ষয় মালবেরি! এইটা পড়ে আমি গদ্য লিখতে শিখেছিলাম। গদ্যে প্রাণ দেওয়াও দেখেছিলাম।
সমিধ :- গদ্যের কথা এল যখন, তখন তোমার সেই " চূড়া নাই, বাঁশি নাই, নাই রে কানাই/ কুন বনে হারাইলি বাঁশি খুঁজে পেলুম নাই..." -এর গল্পটা একটু শুনতে চাইব। কীভাবে প্রান্তিক মানুষের দিনযাপন এবং তাদের মুখের গান তোমার মধ্যে ঢুকে পড়ল?
কৌশিক :- এইটা বোধয় 'গতজীবনের গল্প'এ ছিল। বোষ্টম ঠাকুরের কাছে শোনা গান। মানে গ্রীষ্মের ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলে, কোনোদিন হয়ত অন্ধকার জানলা দিয়ে ভেসে আসা গান। খুব ভোরে ঝুঁঝকা অন্ধকারে বোষ্টম ঠাকুর গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে খঞ্জনী বাজিয়ে। ধীরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তার কণ্ঠ। বেলা হলে ছাতা মাথায় চাল নিতে আসবে পাড়ায়, ঘরে, তখন দেখা হবে, এক মুঠো চাল, কখনো বা একটা মেটে আলু । নানা রঙের চাল ভরা ঝুড়ি। মায়ের সঙ্গে কথা হবে তার, ঘরের, ছেলেমেয়েদের, অভাবের, সমাজের কত যে বিষয় থাকে...।
তো প্রান্তিক কে? প্রান্তে বসবাসকারী অর্থে প্রান্তিক যদি হয়, তবে তার মূল কোথায়? কেন্দ্র কোনটিই বা? ক্ষমতা যদি কেন্দ্র হয়, শাসক যদি কেন্দ্র হয় তবে প্রতিটি সাধারণ মানুষ প্রান্তিক। আর দীর্ঘ ইতিহাস, সমাজ, তার মানুষ, আমাদের এই চলমানতার কেন্দ্রে রয়েছি আমরা প্রত্যেকে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেটাই আমার কেন্দ্র। এর কোনো প্রান্ত নেই। আসলে এই 'প্রান্তিক' শব্দটি খুবই রাজনৈতিক বলে মনে হয়। ইতিহাসের প্রান্ত বলে কিছু হয় না। এটা ভুল শব্দ।
সমিধ :- আমি বলতে চাইছি, তোমার স্কুল, কলেজ কোথাও তো এই মানুষদের কথা নেই। যেটুকুও আছে সেটুকু ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দেখাটুকু। সিস্টেমের মধ্যে পড়ে এইই ত শিখি আমরা বছরের পর বছর। অথচ এই সিস্টেমের মধ্যে বাধ্যবাধকতায় ঢুকে পড়া সাধারণ কিশোর- যুবকটির মনে আঁকা থাকে অন্য একটা ছবি। এই তুমুল বিরোধিতার শিক্ষা ব্যবস্থা এই দেশে সফল হওয়া সম্ভব? আর অন্য পিঠে সেই কিশোর বা যুবাটি 'আধুনিক' গ্রহণযোগ্যতায় পিছিয়ে পড়বে না কি?
কৌশিক :- আগেই কোনো একটা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বলেছি বোধয়-- চুড়ান্ত ভাবে একাদেমিক শিক্ষায় অশিক্ষিত হওয়া একটা পথ হতে পারে। যেটা অসম্ভব। কারণ একাদেমিক শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য রাষ্ট্র চালনার যন্ত্র উৎপাদন। সেই যন্ত্র 'দেশে'র কথা ভাবে না। বরং ভুলিয়ে দেওয়া হয়। আর 'আধুনিক' গ্রহণযোগ্যতায় এগিয়ে থাকতে গিয়ে ত জগতটাই শেষ হয়ে গেল! এর থেকে আর উঠে আসা যাবে কিনা জানিনা। কিন্তু আমি ত শিক্ষাবিদ নই, বরং মূলত অশিক্ষিতই। এসব প্রশ্ন আমাকে কেন ভাই!
সমিধ :- হা হা হা... শিক্ষাবিদের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা করলে এমন আলোচনাগুলি তো মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
সে যাক, কবিতা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিশ্বাস কর? এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?
কৌশিক :- কবিতা বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোনো রাজনীতিকরণ নাই, কোনো ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ নাই। এটা তো তুইও জানিস।
তবে এসবের বাণিজ্যিকরণ করতে গেলে বিষয়টা এসে পড়ে। খ্যাতির ব্যাবসাও এসে পড়ে। পুরস্কার এসে পড়ে। তবে আবার বলছি-- কবিতা, সাহিত্যে এসব নাই। অন্ততঃ থাকার কথা না। কবিতা লিখে যদি পুরস্কার পাওয়া যায়, তবে ঈশ্বর চিন্তার জন্যও পুরস্কার থাকা উচিত তো? কে কতটা ঈশ্বরের কাছে যেতে পারলো, কার উপলব্ধি কত জোরালো... তেমন হয় নাকি?। ঈশ্বরের উদাহরণ দিচ্ছি বটে, যদিও ঈশ্বর ব্যাপারটা আমিও খুব একটা ভাবিনি কখনো। আমি নিরীশ্বর প্রাণী। পাপী লোক আরকি।
ওহ, হ্যাঁ, মোটা টাকার পুরুস্কারের খোঁজ পেলে জানাস। পাপীর ছুঁতমার্গ নাই।
…
এই সূত্রে আমার একটা অন্য কথা মনে আসে, আমি মনে করি পৃথিবীর গভীর কাব্য সাহিত্যগুলি বোধয় আড়ালেই রয়ে গেছে। যত গভীর, ততই গোপন! হয়ত তার খুব কাছের কিছু মানুষ, তার ভাষার কিছু পাঠক ছাড়া কেউ খোঁজ পায় না তার।
ধর, বাংলা ভাষার সেই লেখাগুলি তখনই অন্য ভাষার মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছবে, যখন সে পুরস্কৃত হবে, অনুদিত হবে, আর সেইজন্য তাকে আগে পৌঁছতে হবে সেই ক্ষমতার পায়ের কাছে। একজন শিল্পীর তো তা কাজ নয়, কাজেই সে তার আশপাশ নিয়ে পড়ে থাকে। অন্য ভাষা, অন্য দেশের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আর এসবের, এই ছড়িয়ে পড়ার, খুব প্রয়োজনও নাই বোধয়। ভুগোলে পড়েছিস ত, জলবায়ু অঞ্চল অনুযায়ী সেই সেই অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদের জন্ম। অন্য জায়গায় তার দরকার বিশেষ নাই।
তবে একটা কথা বলা দরকার।এখন দিনকাল পাল্টেছে। আন্তর্জালের মাধ্যমে সরাসরি এক দেশের মানুষ আরেক দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। বন্ধুত্ব হতে পারছে। সেই সূত্রে অনুবাদ বা অন্য আর্টফর্ম সরাসরি চলে যাচ্ছে অন্যত্র। তবে এখনো সেটা সামগ্রিকতা নয়। ভবিষ্যৎ হয়ত আরো পাল্টে যাবে।
সমিধ :- কাব্য-সাহিত্য-শিল্প কি শুধুমাত্র ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় মানুষের প্রয়োজনের শৃঙ্খলেই আবদ্ধ থাকা উচিত? একটা রিজিওনাল ভাষা বাংলাতে লিখেই তো একজন বাঙালি কবি নোবেল পেয়েছিলেন। তা নিশ্চয়ই তাঁর সৃষ্টিকে আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে| আরো ব্যাপ্ত, আরো অনেক সচেতনাস্পর্শী।
কৌশিক :- উচিত-অনুচিতের ব্যাপার নয় ত। আর এসব যে কী কাজে লাগে তাও সঠিক জানিনা আমি। হয়ত বহুদূরবর্তী কোনো কাজ তা, যা এক্ষুনি বোঝা যাবে না। আর আবদ্ধও নয় কিন্তু, ভাষার ক্ষেত্রটাই যা গণ্ডিবদ্ধ, সংগীত, সিনেমা চিত্রের ক্ষেত্রে তা নয় । ভাষা আর লিপির ক্ষেত্রটিতে তার সীমা আমাদের মেনে নিতেই হবে। আর নোবেল কিন্তু রিজিওনাল ভাষাটিতে আসেনি। ভাষাটি বদলে গেছল। যদি ঘুরিয়ে প্রশ্ন করি, নোবেল প্রাপ্তিই কেন আরো ব্যাপ্ত আরো সচেতনতাস্পর্শী করে তোলার মানদণ্ড হবে! আলফ্রেড নোবেলের জন্মের আগেই বা কী নিয়ম ছিল? আসলে মূল 'কাজ'টি আগেই ঘটে যায়, তারপর তো পুরস্কার প্রাপ্তি, তারপর পরিচিতি ইত্যাদি। যাকগে, বাদ্দে, এসব নিয়ে বড় বড় মানুষের অনেক কথা রয়েছে, অনেক আলোচনা। আমি অত জানিও না।
সমিধ :- তুমি ঈশ্বরবিশ্বাসী নও বল অথচ তোমার অনেক গদ্য বা কবিতাতেই অপূর্ব এক আস্তিক্য বোধের অস্তিত্ব আছে। এক্ষেত্রে তোমার আত্মজীবনীমূলক লেখা 'গতজীবনের গল্প' এবং 'ফেরিওয়ালার ডায়েরি' অসাধারণ। এই আস্তিক্যবোধটিকে তুমি বাস্তবে প্রগতিশীলদের মতো ঘোষিতভাবে অস্বীকার করো কেন?
কৌশিক :- 'কভি কভি লাগতা হ্যায় আপুন হি ভগবান হ্যায়...! ' --গনেশ গায়তোণ্ডে। একে তুই চিনিস না নিশ্চয়। দরকারও নাই। (এইখানে একটা হাসি হবে)
আসলে যা জানিনা, স্পষ্ট জানিনা, তা নিয়ে কিছুই বলার নেই। এই জন্য কবিতা নিয়েও কিছু বলতে পারিনা। সেও আমার কাছে ওই 'ঈশ্বর'তুল্য, অস্পষ্ট ধারণা মাত্র। কিন্তু অবিশ্বাসী বলিনা নিজেকে। যাকে চিনিনা, তাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করা যায় কি? যদি তিনি আছেন, তো আছেন। আমার আপত্তি বা সহমতি কিছুই নাই।
তবে একটা মজার কথা তোকে বলি, কেউ যখন খুব অন্তর দিয়ে ঈশ্বর উপলব্ধির কথা বলে, কোনো বিশেষ অতিজাগতিক অনুভুতির কথা, ধর যে বলছে সে আমার ভালবাসার মানুষ, তখন আবার তার সেই কথা আমি বিশ্বাস করে ফেলি। কখনো হয়ত গল্পের মাঝে শিউরে উঠি, অন্তত সেই মুহূর্তে সত্যিই তা বিশ্বাস করতে পারি। এ হল ভালোবাসা, বুজলি কিছু?
যেটা বলা হয়নি তা হল-- আমাদের উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা। আমাদের জীভের স্বাদ গ্রহণ যেমন, একই পদ কারো মুখে আলুনি লাগছে আবার কারো মুখে নুন বেশি লাগে। কেউ ঝালের চোটে খেতে পারছে না, কেউ আরো দুটা লংকা চেয়ে নিচ্ছে। এ হল ইন্দ্রিয় অনুভূতি। এখন আমার মনে হয় ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভবও সেইমতো। আমার উপলব্ধির ভেতরে যা নেই, তার অস্তিত্ত্ব জগতে কোথাও নেই, --এ বোধয় ঠিক ভাবনা নয়। ঈশ্বর বিশ্বাস প্রসঙ্গে এটুকু বলার, যে, তা আমার উপলব্ধির জগতে নেই। হয়ত অন্য কারোর উপলব্ধি জগত সেই কম্পাংক ছুঁতে পারে। তা আমার স্বীকার বা অস্বীকারের উপর নির্ভর করে না। এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। যে কারণে আমি নিটোল নাস্তিক বা আস্তিক কোনোটাই নই। এইটুকুই।
সমিধ :- এক সময় সত্যি সত্যি যে ফেরিওয়ালার জীবনে ঢুকে পড়েছিলে, সেই জীবনকে ভালোবেসেছিলে? বিশ্বাস করেছিলে? নাকি শুধুমাত্র ফেরিওয়ালা হয়ে ম্যাটাডোরের ভিতর থেকে শুধু ক্রেতাদের জীবনছবিটাই ছিল একমাত্র রোমান্টিসিজম ?
কৌশিক :- ওইভাবে ভাগাভাগি করে ভালোবাসার কথা ভেবে দেখা হয়নি। ফেরিওয়ালার চরিত্রে নিজেকে ভালোই লেগেছিল। তবে কিছু 'যদি' তো ছিলই। যদি মাথার উপরে কোনো সর্দার বা মালিকি সর্দারিহীন স্বাধীন ফেরিওয়ালা হতে পারতাম, তাহলে হয়ত ওই পেশাতেই রয়ে যেতাম আরো অনেকদিন। উত্তর ও মধ্য বিহারের ওই দেহাতি পথ, গ্রাম্য মানুষ এসব আসলে ভাল লেগেছিল। নিজেকে জাদুকর মনে হত। আমার ঝোলার ভেতরে সেই ফেরিওয়ালার মন্ত্রগুপ্তি। কিন্তু মালিকের মিষ্টি অত্যাচারে সেই রোমান্টিসিজম ভেঙে যেত।
সমিধ :- ফেরিওয়ালার জীবনের দুদিকে একদিকে মালিক পক্ষ অন্যদিকে গুণ্ডা ও ছিনতাইবাজদের নিপীড়ন। এই দুইয়ের মাঝে তোমার প্রাপ্তি ঠিক কী বলে মনে কর?
কৌশিক :- ভালো লাগার জায়গাটা তো আগেই বললাম। আর ছিল মানুষজন, দেহাত, নতুন নতুন জায়গা, মূলত পথের নেশা। একবার পথে নেমে গেলে দেখেছি আর ভয় থাকেনা। একেবারে রাস্তায় নেমে, নিচু হয়ে, ছোট হয়ে, মানুষের কাছে যাবার ভেতরে একটা মুক্তি ছিল। রাস্তায় নামলে তখন আর হারাবার কিছু নাই ত। শীত গ্রীষ্মে একটাই কম্বল, ঝোলাটাই বালিশ। কখনো ধর্মশালায়, কখনো বা গাছতলায়, বিশ্রামরত ট্রাকের তলায় শুয়ে থাকা। কিন্তু কষ্ট হয়নি সেসবে। রিস্ক এবং থ্রিল--দুটাই ছিল সেখানে।
সমিধ :- বইহার ফুলকিইয়া-সহ বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুর মালভূমি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে কাব্যিক হয়ে আছে বিভূতিভূষণের গদ্যের মধ্যে দিয়ে। ফেরিওয়ালা হয়ে তার কিছুটা আনাচে কানাচে তুমিও গিয়েছ। বিভভূতিভূষণকে পুনর্বার পাওয়া গেল?
কৌশিক :- বইহার ফুলকিয়া, কাহাল গাঁও, পীরপৈঁতি এসব তো খাস বিভূতিভূষণের এলাকা। এছাড়া শরৎচন্দ্র, সতীনাথ, বনফুলেরও এলাকা বটে। ভাগলপুর তখনো পৌছুইনি, তখনো মনের মধ্যে ভাগলপুর মানে সেই ঈন্দ্রনাথ-শ্রীকান্তের মাছ চুরি, জনার ক্ষেতের ভেতর নৌকা, আর সেই মেঘে ঢাকা চাঁদের অন্ধকার রাত্রির গঙ্গার বর্ণনা, এই নিয়েই পাড়ি দিয়েছিলাম। চটকা ভাঙলো সেখানে পৌঁছে, একদম বিপরীত একটা পরিবেশে। সেসব কিছুটা লিখেছি ওখানে। রাস্তাঘাট, মানুষজন, ভীড়, নোংরা, রংবাজি সব মিলিয়ে তখন ভাগলপুর এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ালো।
ভাগলপুর জেলাতেই কাহাল গাঁও বড় সুন্দর জায়গা। গঙ্গার এপার ওপার দেখা যায় না, এমন বিস্তার, মাঝে একটা চর, তাও আবছা ধোঁয়ার মতো। গঙ্গার গতি পথে ওটাই সবচে চওড়া অংশ। ওই পার বারৌণি শহর। এখন শুনেছি ব্রীজ হয়েছে। সেই ১৯৯৬ সালে, তখনো বেশ ফাঁকা আর নির্জনতা ছিল। বিভূতিভূষণ ফিলিং টা হতে পারত। কাঁধে ফেরির ঝোলা নিয়ে নদীর ধারে বসে থাকতাম কখনো, জঙ্গল নদী, তখনও কিছু ছিল, কিন্তু সামাজিক পরিবেশ নষ্ট। গুণ্ডা চোর ছিনতাইবাজের রাজত্ব চারদিকে। ফেরিওয়াকেও ছাড়ে না এরা। একাধিকবার পিস্তলের নলের মুখে দাঁড়াতে হয়েছে। তা তখন বিভূতিভূষণ কেন, বাপের নামও মনে পড়ত না ঠিকঠাক।
সে যাইহোক, আমি অক্ষরে দেখা জায়গাগুলো কাছাকাছি পেলে গিয়ে চর্মচোক্ষে দেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু অক্ষরের জগৎ আর এই মর-ভূমি কি আর মেলে? তাছাড়া দুটা একদম আলাদা টাইম-স্পেসে! তবু ওই আরকি...
সমিধ :- মাথায় বন্দুক ঠেকানোর অভিজ্ঞতা বোধ হয় বাঙালি লেখকদের জগতে অতটা সুলভ নয়। সেই মুহূর্তে কার কথা মনে পড়ে? কবিতার লাইন ভেসে ওঠে না? (হাসি)
কৌশিক :- শুধুমাত্র মাথায় বন্দুক কেন , কবিরা ত ফায়ারিং স্কোয়াডেও দাঁড়িয়েছে বলে শুনেছি। তা সেসব আনোখা পথেঘাটে নয় অবশ্য। তারা আদর্শের জন্যই দাঁড়িয়েছিল। এদিকে কিছু রাস্তার গুণ্ডার সামনে বীরত্বে কোনো আদর্শও নাই লাভও নাই। চোদ্দপুরুষের দেওয়া প্রাণটি যাবে খামোকা। তো, সেই মুহূর্তে কার কথা মনে পড়ে? কবিতার কথাটা তো ইয়ার্কি মেরে বলছিস বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া তখন কবিতা থেকে আমি অনেক দূরেই। সে যাইহোক, যেকোনো বিপদে আমি যা করি, তাই করতাম। ফার্স্ট-ফরোয়ার্ড! এটা জীবনের নানা বিপদে করেছি আমি। বিপদ অনুযায়ী টাইম এগিয়ে দিই সুবিধে মতো। কখনো একদিন, কখনো ছমাস, একবছর, দশবছর...। যখন সেই ছেলেটা পিস্তল বার করল, সবাই হতভম্ভ, আমি তখন ভাবছিলাম--আগামীকাল, ঠিক এই সময়, আমি কী করছি? কোথায়? দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে কি? অন্য কোনো গ্রামের পথে হাঁটছি? …. আমি একটাদিন টপকে চলে গেলাম।
সমিধ :- কৌশল যে কার্যকরী তা তো প্রমাণিত। ওই লেখা থেকেই জানা যায় যে তোমার ডাকনাম কানাই। একটা নদীর নাম বরাকর, যাকে তুমি লক্ষ্মণ গণ্ডী নাম দিয়েছ। এখন যদি জিজ্ঞেস করি, কানাই কি কখনোই এই গণ্ডী পেরোতে পারবে না? অন্ততঃ যে কানাইয়ের হাতের মুঠোয় আছে টাইম বদলের সুযোগ!
কৌশিক :- ওই নদীটা ছিল বরাকর। পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে। এবার কানাইয়ের কথা যা বলছিস, সেটা বোধয় জীবনের লক্ষণ গণ্ডী প্রসঙ্গে। আসলে গণ্ডী যেটুকু থাকে, তা আমাদের পারিপার্শ্বিক, সমাজ, নীতিশিক্ষা, এই সমস্ত কিছুর একটা নির্মম কঠিন গণ্ডী। যাকে সামাজিক মানুষ পেরোতে পারেনা। এবার যারা অল্প স্বল্প কবি কবি লোক, এই যেমন ধর আমিই (হাসি), তাদের এইসব নানান তুক-তাক জানা থাকে। সমাজে বাস করে অসামাজিক হওয়ার তুকতাক। সে তো তুই নিজেই কবি হিসেবে জানিস কিছুটা। এই গণ্ডী পেরোনোটাও তাই কিছুটা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করার মতোই ম্যাজিক। যাকিছু পারলাম না, যে অবরোধ, যে ঈপ্সা, যে অবদমন, যে ক্লান্তি গোপন রাখতে হয় আমাদের, তাকে মধ্যরাত্রে সাদা পৃষ্ঠায় উন্মুক্ত কর। তাকে রমণ কর। আদরে, যত্নে। নিজের টাইম-স্পেস ভেঙে বেরিয়ে যাও। কখনো কখনো ম্যাজিক ঘটে যায়, এ ছাড়া কিই বা পারি বল...
সমিধ :- তুমি এক্ষেত্রে খুবই বিনয়ী, তবু জানতে চাইব, এখন যে তরুণরা লিখছেন,! তাঁদের মধ্যে এই ম্যাজিকটা দেখতে পাও? কোনো কানাই, কোনো ফেরিওয়ালাকে তাঁদের মধ্যে খুঁজে পাও? তরুণদের প্রতি তোমার বক্তব্য কী?
কৌশিক :- ‘দুঃখ কর অবধান, দুঃখ কর অবধান ' –
একেবারে নতুন যারা, যারা কবি, যারা কবি নয়, তাদের সকলকেই এটুকুই শুধু বলার। একজন ভারতীয় পথযাত্রীর এটুকুই শুধু দেখার বলে মনে করি। এর বেশি কিছু না।
হ্যাঁ, প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে, আমি খুঁজে পাই বা না পাই, আমি বিশ্বাস করি প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে, যারা জাদুকর। তাদের ম্যাজিকের অপেক্ষায় থাকা আমাদের। তাদের সকলকে আমার প্রণাম।
হ্যাঁ রে এই দীর্ঘ বাচালপনা...লোকে গাল দেবে তো! এবার তো থামা দরকার কোথাও। প্রচুর বকবক করলাম। শান্তি শান্তি...
সমিধ :- কবি লেখকরা আর কবে গালাগালিকে পরোয়া করেছ! তবু একসময় থামতেই হয়। আরও অনেক কথা বাকি থেকে গেল। পরে অন্য কোথাও আবার জানব নিশ্চয়।
আপাততঃ শেষ প্রশ্নে এটা জানতে চাই যে যদিও তোমার ‘মাধবী বাগান’ নামে একটি গল্পের বই বেরিয়েছিল। মনে হয় প্রোডাকশনের কিছু সমস্যার কারণে বইটি পাঠকের হাতে সেভাবে পৌঁছায়নি। আমি তোমার গল্প এবং গদ্যের একান্ত ভক্ত। তার পিছনে অনেকগুলি কারণ আছে।
আপাততঃ প্রশ্ন এই যে, তোমার কবিতা সম্বন্ধে অনেকেই জানেন। কিন্তু তোমার মরমিয়া ও মায়াময় গদ্য ও গল্পগুলি পাঠকদের কাছে সেভাবে পৌঁছাল না কেন?
কৌশিক :- হ্যাঁ, 'মাধবী বাগান' নামে একটা গল্পের বই হয়েছিল ২০১৮ তে। প্রথম মুদ্রণে বেশ কিছু ভ্রান্তি থাকায় সেটা আটকে ছিল। পরে আমি আবার সংশোধিত প্রুফ পাঠাই। শুনেছি তা আবার ছাপা হয়েছে ২০২০ বইমেলায় । দেখিনি যদিও। মহামারী, লকডাউন ইত্যাদি কারণে সম্ভবত প্রকাশক পাঠিয়ে উঠতে পারেন নি। সে যাইহোক। এইটুকু সময়ে এবং অসময়েও বলতে পারিস, কোথায় বা পৌঁছবে লেখাগুলি। তাছাড়া বেশি তো লিখিনি আর। 'ফেরিওয়ালার ডায়েরি'ও বই হয়নি। গদ্য কতটুকুই বা লিখেছি যে তুই পড়লি! কাজেই পাঠক জানবে কীভাবে? আর সত্যি বলতে এখন অনেকের এত ভাল কিছু গদ্য পড়ি, এত ভাল লেখা, নিজের দিকে তাকালে সংকোচই হয়। মনে হয় এই অল্প মেধাহীনতায় যেটুকু দেওয়ার ছিল তাও কি দিলাম? তাও যেটুকু ভালোবাসা পাওয়া হল, তা যথেষ্টর চেয়ে বেশি মনে হয়। এর বেশি আশা করতে লজ্জা হয়।
সমিধ :- অনেক ধন্যবাদ কৌশিকদা। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের ভালোবাসা প্রাপ্তি তোমার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক, এই কামনা করি। সামান্য কয়েকটি ডাইমেনশনই এই কথপোকথনে ধরা রইল। বাকিটুকু কালের সম্ভাবনার উপর ন্যস্ত রইল। সমস্তরকম শান্তি প্রার্থনা করি।
ওম শান্তি! ওম শান্তি! ওম শান্তি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন