বিকাশ জেঠুর কথা
*
অগ্রজ কবিদের দাদা বলার প্রথাটি ( তিনি বয়সে পিতার অগ্রজ হলেও) তখন যে জানা ছিল না, শুধু তাই না, তিনি ছিলেন নিতান্তই পাড়ার মানুষ। বাবা তাঁকে সাতুদা ডাকতো। আমরা সাতু জেঠু বলতাম কেউ কেউ, তবুও শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের সকলের বিকাশ জেঠু হয়ে উঠেছিলেন একেবারেই সেই আদি শহরের ঘরোয়া সম্পর্কের কারনেই। সকলের, অর্থাৎ শুধু বিষ্ণুপুর নয়, আমার তাবৎ বন্ধুকুল, যতদূর তাঁর কবিতা পৌঁছেছে, যতদূর তাঁর গল্পকথাগুলি মুখে মুখে পৌঁছেছে। এবং ততদূর, তিনি কবি বিকাশ দাশ।
বিকাশ জেঠু ঠিক কবির মতো দেখতে ছিলেন না। (এইখানে ধরে নিতে হবে কবি কেমন দেখতে হয় তা সকলেই জানেন)। বরং ভারতীয় সনাতন সাধুমুর্তিটি যেমন হয়, অনেকটা তার সঙ্গে মিলে যেতো জেঠুর তাকিয়ে থাকা। গেরুয়া কাটা লুঙ্গি, গেরুয়া হাফ পাঞ্জাবী, কাঁধে হলুদ ঝোলা, পায়ে চটি। সাদা দাড়ি হাওয়ায় ওড়া, এই ছিল আপামর বিষ্ণুপুরবাসীর কাছে সেই পরিচিত চেহারা। পরিচিত, কিন্তু রহস্যময় চরিত্র!
রহস্যময়, কারন, পাথরদরজা-দূর্গের উল্টোদিকে মুর্ছার পাড়ের উপর সন্ধেবেলা ঝোপের আড়ালে বসে থাকেন কেন একা? শ্মশানকালী মন্দিরের চাতালে আশ্রয় নেওয়া এক পাগল আর এক পাগলী, যারা ভাই বোন, তাদের অমন ধমক দিলেন কেন সেদিন রাস্তায়? শাঁখারিবাজারের সেই শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মহিলাটির বাড়ি মাসে একবার গিয়ে দেখা করবেন তিনি, এও জানা হয়ে গিয়েছিল আমার। এক শীতের সন্ধ্যায় চাফির কাপ হাতে ধরিয়ে মূহ্যমান বসে পড়লেন তিনি। আমি চাফিতে চুমুক দেওয়ার আগেই তিনি দীর্ঘশ্বাস সহযোগে (জনান্তিকে, অথবা আমাকেই) বললেন --' বোনটি চলে গেল, ভাইটি এখন একা পড়ে রইল।' আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতে তিনি যোগ করলেন--'সেই পাগল ভাইবোন দুটির একজন,গতকাল চলে গেল। ওহ! কি শূন্য দৃষ্টি ভাইটির, আজ সকালে দেখা হল, সেই বটগাছের নিচের চাতালে বসে আছে একই জায়গায়, একা'। জেঠুর চোখে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম পাগলের চোখের শূন্যতার উপর নেমে আসা শোক ও আরো শূন্যতা কতদূর হয়!
অকৃতদার বিকাশ জেঠুর এইসব আপজনদের কথা আমরা বন্ধুরা কেউ কেউ জানতাম। একজন পরিচিত মানুষের বাড়ির লোকের কথা, তার ঘনিষ্ঠজনদের কথা বিনা প্রচেষ্টায় যেমন আমরা জেনে ফেলি ধীরে ধীরে, সেই ভাবে।
একেকদিন খুব সকালবেলা তিনি চলে আসতেন। হয়ত সেইমাত্র মুখ ধুয়ে আমার টঙের ঘরে এসে বসেছি। নিচ থেকে সেই সুরেলা কণ্ঠ-- কৌশিইইক...। ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তেন সূর্যোদয় দেখতে একেকদিন একেক দিকে। একদিন এসে বল্লেন চলো, আজ দ্বারকেশ্বরের দিকে যাই। তোমার নতুন স্কুটিতে চড়া হয়নি এখনো, আজ ঘুরে আসি তবে।
দ্বারকেশ্বরের তীরে বসে আছি। সামনে আদিগন্ত চিকচিক করছে বালি। বহুদূরে নীল সরু সুতোর মতো নদীরেখা, বালিতে উলটানো ভাঙা নৌকা অর্ধেক গেঁথে আছে। হাওয়া বয়ছে। জেঠু সেই শূন্যের ধু-ধুর দিকে চেয়ে।
--কৌশিক, একাশি হল।
আমি চমকে ফিরে তাকাই।
--হ্যাঁ ভাই, এই ত, এবারের মতো হয়েই এলো দিনশেষ…
হাওয়ায় জেঠুর সাদা দাড়ি উড়ছে। দূরে আঁচবাড়ি গ্রামের থেকে একটা হালকা ধোঁয়ার কুন্ডলী আকাশে উড়ছে ওইপারে।
শাঁখারিবাজারের ঘিঞ্জি গলিপথ দিয়ে ফিরে আসার সময়, জেঠু হঠাৎ বললেন, ভাই তোমার গাড়ির চালটি বড় সুন্দর! আচ্ছা ভাই একটু দাঁড়াও এইখানে। মদনমোহন মন্দিরের কিছুদূরে, রাস্তার ধারেই একটা নিচু চালার ঘর। ভাঙা টিনের ছাউনি নেমে এসেছে বুক অব্দি। নিচু হয়ে দাওয়া পেরিয়ে অন্ধকার ঘরের ভেতর কাউকে ডাকলেন একবার। এক বৃদ্ধা, কোমর নুয়ে পড়া ভার নিয়ে একঝলক দেখা গেল। দুমিনিটও হয়নি, জেঠু ফিরে এলেন।
--চলো ভাই...এক্টু থেমে খুব কুন্ঠিত ভাবে… এখানে মাসে একবার আসতে হয়, জানোই তো, ভদ্রমহিলার কেউ আর বেঁচে নেই, ভিক্ষা করতেও পারেন না আর...তিনি চুপ করলেন। আমি স্কুটির ইঞ্জিন চালু করলাম।
রাস্তার উদাসীন পথিক, পাগল, ভিখারি হয়ে যাওয়া একদা নিম্নবিত্ত, মুমূর্ষু, যারা হারিয়ে যায় সমাজ সংসার থেকে, যারা আলাদা হয়ে যায় এই আত্মসুখের সাজানো সংসার থেকে, তারা কারো চোখের দিকেই চায় না আর। মানুষের সমাজ থেকেও তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা আর তাদের দেখতে পাই না। এইসব মানুষদের হৎাৎ দেখা যেত বিকাশ জেঠুর কাছাকাছি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে।
তথাপি, কবি বিকাশ দাশকে বিকাশ জেঠুর গল্পগুলি দিয়েই কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা এই মুখবন্ধ।
যখন কলেজে পড়ি, তার কিছু আগেপরে চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন তার পুরনো বিষ্ণুপুরের বাড়িতে। বিশাল ছড়ানো দেয়ানবাটির এক মাটির বাড়ির দোতলার একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছিলেন নিজের জন্য। সেখানে প্রথম কবে গেলাম? সুদেবদার(বকসী) সঙ্গেই কি? সেই ঘরেই ত শুনেছিলাম সুদেবদার সেই কবিতাটি--'বিকাশ জেঠু, ফিরে আসব, আবার তোমার গল্পে দেব চঞ্চুসঞ্চালন'।
যেখানে কোনো কোনো সন্ধ্যায় আমরা কয়েজন বন্ধু জেঠুর হাতে চাফি খেতে যেতাম। আসবাব বলতে একটা বড় বুকসেল্ফ, একটা ছোট বই ভর্তি টেবিল। একটা লুঙ্গি, জামা রাখার আলনা। ব্যস। শয়ন মাটিতে কম্বল পেতে। একবার বর্ষায় কম্বলের ভেতর কাঁকড়া বিছে ঢুকে পড়েছিল বলে একটা তিন বাই ছয়ের প্লাইউড কিনে আনলেন, তার উপর কম্বল পেতে মশারির ধার গুঁজে দিতেন প্লাইউডের নিচে। আর ছিল একটি দড়ি বাঁধা রেকর্ড প্লেয়ার, বিভিন্ন ভারতীয় ঘরানার রাগ সংগীতের সংগ্রহ, আর বহু পুরনো দিনের, সাদাকালো জমানার একটি ক্যামেরা। ছবি তুলতে ভালবাসতেন শুধু নয়, রীতিমতো ভাল ফটোগ্রাফার ছিলেন একজন।
এহেন বিকাশ জেঠুর খাদ্যাভাস ছিল আশ্চর্য রকম! দুপুরে একমুঠো সাদা ভাত আর একবাটি টকদই, অল্প সবুজ তরকারি হয়ত, আজীবন এই।
একজন কবির কথা লিখতে গিয়ে এসব কি খুব জরুরি তথ্য? না, হয়ত নয়, আবার মনে হয় এসব না লিখলে তার ছবিটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আজীবন রবীন্দ্রনাথ আর বিভূতিভূষণএ নিবেদিত একজন মানুষ শুধু বইএর পাতায় নয়, লেখায় নয়, জীবনেও কতখানি নিবেদিত তা ধরা যাবে না হয়ত।
মাইথনের ডি ভি সি ব্রাঞ্চে কর্মজীবনের কথা তার মুখেই শুনেছি বহুবার। ডায়েরি খুলে সেইদিনগুলিতে পৌঁছে যেতে ভালবাসতেন। পড়ে শোনাতেন প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলিতে হিমালয় চলে যাবার কথা। সারাজীবনে মাত্র চৌঁত্রিশবার হিমালয়ে গেছেন, অল্প হেসে বলতেন সে কথা। সেই বাটারফ্লাই ভ্যালির নিদারুন স্তব্ধতার ভেতর একা বসে থাকার কথা, অন্য এক অভিযাত্রী দলের নেত্রীর সঙ্গে হঠাত আলাপের কথা, যুবা বয়সে তার সঙ্গে পত্র আদান প্রদানের কথা বলতে গিয়ে মুখ অল্প লালাভ হয়ে উঠত কি জেঠুর? অল্প চুপ থেকে অন্য এক হলুদ হয়ে যাওয়া ডায়েরির পাতা খুলে ততধিক হলুদ এক চিঠি বার করে পড়তে শুরু করলেন। আর হয়ত বছর পঞ্চাশ আগের বাটারফ্লাই ভ্যালির অর্কিডের ফুল,তার রঙ, হিমেল বাতাসে পলল পাথরের গন্ধ, হিমালয়ের পথের সব্ধ্যার অস্তরাগ এসে পড়ল তাঁর ছোট্ট কোঠাঘরের মধ্যে! আমি, হয়ত একা, সামনে বসে আছি পুত্র তুল্য, তবু তিনি বন্ধুর মতোই সলজ্জ হয়ে উঠছেন কখনো কখনো! তারপর পাঠ করছেন পুরনো কবিতা। কবিতা বলতেন না কখনো, বলতেন দিনলিপি। ' আমি ত ভাই দিনলিপি লিখি'! আর শিরোনামও দিতেন না, কারন কবিতা বা সেই দিনলিপি লেখার পরেই যেহেতু আসে শিরোনামের ভাবনা, তাই নিচে লিখতেন নাম। পাদনাম।
জেঠুর সেই দিনলিপি-পূর্ণ খাতার সংখ্যা কতগুলি তা সঠিক আমিও জানিনা।
একজন কবির কবিতা অথবা দিনলিপিই যদি ধরে নিই তবে সেগুলিই তার যথেষ্ট পরিচয় ধরে নিয়ে কবিতা বিষয়ে কিছুই বলা হবে না এই লেখায়। এখানে সেই কবি মানুষটিকে কেমন দেখেছি, অথবা আমার নিজেরো জীবন কীভাবে স্পর্শ পেলো এইসব মানুষ, প্রকৃতি, মাটির, তথা বিকাশজেঠু আর আমার একই অথচ ভিন্ন এক বিষ্ণুপুর কীভাবে গড়ে উঠল সারাজীবন ধরে, সেকথা বলেলে কিছুটা পরিস্কার হবে কি?
ছিয়াশি বছরের জীবনে তিনি যত লেখা লিখেছেন তার অল্পই প্রকাশিত, এই বইএও সেই অল্প প্রকাশিত অপ্রকাশিত মিলিয়ে কবিকে ধরার চেষ্টা, যতটুকু হলে কবিকে চেনা যায়, ততটুকুই দেওয়া হল। যেটুকু ছাপার অক্ষরে রাখলে পাঠক এই প্রায় অজ্ঞাত বাংলা ভাষার কবিকে চিনে নিতে পারেন, ঠিক ততটুকুই চেষ্টা রাখা হল বিকাশ জেঠুর জীবন-চরিত্র মনে রেখে।
জীবন-চরিত্র বলছি কেন? কারন, নব্বইএর দশকে 'টেরাকোটা শহরের কবিতা' নামে এক সংকলনে স্থানীয় ১২ জন কবির সাথে তার ১৬ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা একদা ছাপা হয়েছিল। প্রকাশক 'সমাকৃতি'। এই ব্যতিক্রম ছাড়া ছিয়াশি বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি কবিতাগুলি দুই মলাটে সংরক্ষণের কোনো চেষ্টাই করেননি কখনো। কী বলব একে? লুকিয়ে থাকা স্বভাব? নাকি বাংলা বাজারের প্রচলিত শব্দ 'প্রচার-বিমুখ'? অথবা অন্তরমুখিনতার মতো ভারি শব্দ দিয়েও ঠিক বোঝা যাবে না বিষয়টি। প্রথম জীবনে বুদ্ধবেদ বসুর কবিতা পত্রিকা অথাবা পরবর্তীতে 'কৃত্তিবাস' এবং তৎকালীন 'দেশ ' পত্রিকা তে যেমন লিখেছেন, তেমনি 'অনুবর্তন', তিরপূর্নি'র মতো নব্বইএর গুরুত্বপূর্ন অভিজাত ছোটপত্রিকাগুলিতেও, এরপরেও গাঁয়ে গঞ্জে এমন কি পাড়ার কালীপুজার স্যুভেনির, কাউকে তিনি ফেরাননি কখনো। অথচ থরে থরে 'দিনলিপি' ভরা খাতাগুলি সযত্নে তাকের উপরে সজ্জিত রইল চিরকাল। মলাট বন্দীর কথা ভাবা হল না কখনো।
না, কোনো প্রচলিত শব্দ ব্যবহার দিয়ে এই ঘটনাকে ব্যখ্যা বা গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করলে বিষয়টি লঘু হয়ে উঠবে। প্রচলিত মহত্বের ধারণাটি এখানে অচল।
বিষ্ণুপুর, জেলা বাঁকুড়া, লাল মাটির প্রান্তর, ডিহি, এক রুখু কাঁটাঝোপ ক্যাক্টাস অধ্যুষিত প্রাচীন শহর। একদিকে বহু প্রাচীন মল্ল্রাজাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আর অন্যদিকে প্রকৃতিগত ভাবেই উদাসীন এক যাপন এখানের মানুষের স্বাভাবিক শ্রেণী চরিত্রের মতো। পাগল, নিষ্কর্মা, প্রায় কর্মহীন বেকার মানুষের মোড়ের আড্ডা, গুলজার হয়ে থাকা চায়ের দোকান, দারিদ্র, আর সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে এক উদাসীস জীবনের বয়ে যাওয়া ছিল এই শহরে। সেই আড্ডায় অকৃতদার মধু জেঠু, বিষ্ণুপুর ঘরানার সেতার বাদক যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্তবাবু, ছেলেবেলায় সমস্ত পরিবার হারানো গম্ভীর গোবু বাবু, দরজি কাসেম, কমিউনিস্ট করা ছোকরার দল, আর এই ইটের দাঁত বেরোনো ছাদ খুলে যাওয়া দোকান ঘরে ছিল একদা ডাকাত পটু বদ্যির আস্তানা। পুরনো আর বর্তমান মিশে যাওয়া এক আবহমানতা।
অন্যদিকে যেকোনো অঞ্চলের অর্থনীতি সেখানের মানুষের যাপন চরিত্র নির্দিষ্ট করে দেয় হয়ত। বিলাসিতার সজ্ঞা কতদূর নেমে আসতে পারে তা তিরিশ বছর আগের বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামেও দেখা যেত, জামার বোতাম অতিব্যবহারে ছিড়ে যাওয়ার পর তা বুকের দুপাশে ঝুলতে থাকাই ছিল নিয়ম। হাতে বোতাম টুকু লাগিয়ে নেওয়াও বিলাসিতা মাত্র।
যেখানে নিজ খরচে কাব্য পুস্তিকা ছাপার মতো অকিঞ্চিৎকর ও হাস্যকর কর্ম বোধকরি কেউ ভাবতেই পারেনা! তাই সাতু জেঠু, বিকাশ দাশ, পাড়ার বনেদী পরিবার দেওয়ানবাটীর ছোট ভাই। তিনি কবি। পাড়ার লোক দু একজন ছাড়া সে কথা কেউ জানে না, কাঁধে ঝোলা নিয়ে যেকোনো দিকের বাসে উঠে পড়তেন কোনো কোনোদিন। কন্ডাক্টর খালাসি সকলেই মুখচেনা। শহর ছাড়িয়ে শাল মহুয়ার জঙ্গলের মাঝে হঠাত ড্রাইভারকে বলতেন - একটু আস্তে ভাই, এইখানেই নামিয়ে দাও'। ধুধু জঙ্গলের মাঝে তাকে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে গেল বাঁক পেরিয়ে। 'এখন কোথায় যাব আমরা জেঠু?' 'এই ত, এখানেই'। বলে অল্প থেমে, তিনি হাঁটেন। নতুন মুকুল এসেছে শালের, রঙ পালটে যাচ্ছে দেখো জঙ্গলের, প্রতি ঋতুতে তার রঙ রূপ গন্ধ পালটে পালটে যায়, কেউ দেখবে না! এখন এর মাঝ দিয়ে হেঁটে ফিরে যাব আমরা উলটো দিকের পথটুকু...। হ্যাঁ পিছনের পথ হেঁটে ফিরে যাওয়ার জন্য এখানে বাসে চড়ে আসা হল।
এখানে, এই এতদূর এসে এরপরেও কি মনে হবে? কেন কোনো বই নেই আমৃত্যু! উদাসীনতা নয়, অন্তরমুখিনতাও নয়, এ হল মাটি-চরিত্র। একেক মাটি একেক রকম হয়।
এইসব ঘটনা শুধু দিনলিপির আকারে লিখে রাখা আছে তার খাতার ভেতর।
একজন কবি তার জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের সময়টুকু কীভাবে হেঁটে চলে বেড়ালেন, কীভাবে তার দেশ গ্রাম আর এই জগতকে দেখলেন, মানুষ কীভাবে তার কাছে এলো, তিনি কীভাবে তার কাছে পৌঁছালেন এই হল তার কবিজন্মের রহস্যরূপ! তার রেখাচিত্র তিনি রহস্যময় উপায়ে লিপিবদ্ধ করে রাখেন বলেই তিনি কবি, তিনি রহস্যময় হয়ে ওঠেন সকলের কাছেই, হয়ত নিজের কাছেও। আর ক্রমশ এই সমস্ত জগতকে নিজের ভেতর নিয়ে তিনি উদাসীন হয়ে ওঠেন ক্রমে। সংসারে স্ত্রী পুত্র কন্যা থাকলে সেই উদাসীনতা প্রায়শই ভেঙে ভেঙে যায়, যার সে বালাই নেই তিনি ক্রমেই আরো নিজের ভেতর তলিয়ে গিয়ে চুপ হয়ে যেতে থাকেন। হয়ত সংসারে এই একা থাকার অভ্যাস বিকাশ জেঠুকে ক্রম-উদাসীন করে তুলেছিল নিজের প্রতি।
শেষ দশ বারোটি বছর আমি প্রায় প্রতিদিনের সান্ধ্য-সাক্ষাতে আর যেতে পারিনি জেঠুর ঘরে। আড্ডা বলতে একা অথবা অনুজ কবি বন্ধু শীতল, অংশুমানের সঙ্গে। বিষ্ণুপুর থেকে কিছুদূরে এক গ্রামে তখন থাকি সংসার নিয়ে। মাঝেমাঝে বাড়ি গিয়ে দেখা করি। দেখি কবি ক্রমশ দিগন্তের দিকে চলেছেন। একদিন শীতল ফোনে বলল জেঠু ভাল নেই, একবার এসো। পরেরদিন বিকেলে গেলাম। সেই মাটির বারান্দা। ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে দোতলার কোঠায়। একটা লোহার ফোল্ডিং খাটিয়ায় তিনি শুয়ে আছেন। তার মাটির শয়ন ভেঙে তাকে খাটিয়েয় দেওয়া হয়েছে। চির-অস্থিসার কবি শুয়ে আছেন, সম্পূর্ণ নগ্ন। ধুপের গন্ধ। জেঠু, আমি কৌশিক। তিনি দুহাত তুলে জোড় করলেন। জেঠু, চাদরটা গায়ে দিয়ে দিই? তিনি দুহাত তুলে ধরলেন, যার অর্থ-- আর থাক ভাই। এই ভাল আছি। শূন্য দৃষ্টি উপরের দিকে। কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জেঠু কিছু বলবেন? তিনি মৃদু হাসলেন। পুনরায় হাত জোড় করলেন, অর্থাৎ-- বিদায়!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে প্রতিবারের মতোই দেখলাম শেষ ধাপে সেই খুলে রাখা দুটি প্লাস্টিকের চটি-- বিদায়!
*
--কৌশিক বাজারী
১আগস্ট, ২০১৯
শুধু পড়লাম বললে ভুল হবে , শিখলাম । কিন্তু আজ এত বয়েস বেড়ে গেছে যে বিকাশ জেঠুর মতো লোক আমাকে ছাত্র হিসেবেও নেবেন না । হয়তো কবি জীবনের প্রথম দিনগুলোতে এই সমস্ত চিরপ্রণম্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছ বলেই মা সরস্বতী তোমার মাথায় তাঁর হাতটি রেখেছেন । চোখে জল এল লেখাটা পড়ে । এইটুকুই আমার না দেখা কবির প্রতি তর্পণ । মৃতেরা জীবিতর কিছুই গ্রহণ করেননা , এমন কি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও হয়তো নেন না ।
উত্তরমুছুন