যা নেই, যা কখনো ছিল না...
ভোরবেলা আর র্সূযাস্তের সময় পৃথিবী সাদাকালো হয়ে যায়। কোনো রঙ থাকে না তখন। একটা আলো থাকে ভোরবেলা, যা ‘ক্রমে আসিতেছে’ মনে হয়। সাদাকালোর উপর রঙ ঢেলে দেবে বলে। আর সন্ধেবেলা একটা বিপন্ন আলো, সে চলে যাচ্ছে, সমস্ত রঙ চলে যাচ্ছে তার পিছু পিছু একটা মনখারাপ নিয়ে। এর মাঝে রঙিন পৃথিবী! ঝলমল করছে নারকেলগাছ, বিদিশাদের হলুদ চিলেকোঠা, নীল আদিগন্ত আকাশ! যা আদতে কিছুই না! যাকে নিয়ে এত কাব্য গান উচ্ছ্বাস তা আসলে এক বিশাল –না! সেই না-এর আলো এসে পড়েছে পথে-
আমি সাইকেল চালিয়ে বুড়াশিবতলা পার হয়ে যাই। কিছু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। পথ ভিজে। সাইকেলের চাকা বসে যাচ্ছে নরম মাটিতে। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। পশ্চিমের আকাশে একটা লালমেঘ থেকে যে আলো এসে পড়েছে, তা অন্য ভূবনের। এই ভূবন ক্ষণস্থায়ী, এই আলো ক্ষণস্থায়ী। আমি কালীমন্দিরের দাওয়ায় বসে পড়ি। র্পূবদিক ঘন হয়ে আসছে। বিদিশা আসবে কি? এই সন্ধেবেলা তার চিলেকোঠার হলুদ আলো নিভিয়ে যদি সে আসে? আমি কালীমন্দিরের বটের নিচে শেকড়ের ধীর ভেতরে চলে যাওয়া দেখি মন দিয়ে।
কালী মন্দিরের চাতালে এতক্ষণ যে আলো পড়ে ছিল, নিভে যায়। কালী মন্দিরের ভূবন অন্ধকার হয়ে যায়। কোনো দৃশ্য নেই, ভাবতে ভাবতেই একটা অন্য, পুরনো আলো জ্বলে ওঠে--
বিদিশা একদিন ঘুম থেকে ঠেলে তুলে বলেছিল—দেখ দেখ –আমি ঘুম ভেঙে দেখে ছিলাম জানলা খোলা, বাইরে আলো। কিছুটা কম বয়সের বিদিশা, একটা রাজস্থানী ঘাগরা পরে দাড়িয়ে জানলায়। তার বিপরীতে আলো যেহেতু, বিদিশাকে কালো দ্বিমাত্রিক ছবির মতো লাগে। বাইরে আকাশ লাল হয়ে নিভে যাচ্ছে। বিদিশা কি দেখাতে চেয়ে ডেকে উঠেছিল?
সেইরকম একটা আলো । আর আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে আছি। ফাঁকা ঘর। একটু আগের দৃশ্যে বিদিশা যেখানে ছিল, সেখানে একটা শূন্য চেয়ার , ধুলো জমে আছে বহু দিনের। এখন এই অবেলায় জেগে উঠে কি করব ভেবে পাই না। আমি শুয়ে শুয়ে মুখ বাড়িয়ে ফুঁ দিই, চেয়ারের ধুলো উড়ে যায়, ত্রসরেণু উড়তে থাকে ঘরের ভেতর,উলটো দিকের বন্ধ জানলার ফোকর দিয়ে আসা আলোর ভেতর খেলতে থাকে ত্রসরেণু। আমি শুয়ে শুয়ে তার বির্মূত তরঙ্গ নিয়ে খেলি। এককেকটা উজ্বল রেণু আলোর থেকে উড়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে...।
অন্ধকারের ভেতর একপ্রকার আলো থাকে। যা চোখে দেখা যায় না। তবু বহুদিনের অভ্যাসে আমরা বুঝতে পারি একে অন্যকে। ঘুমের মধ্যেও বোঝা যায় , অন্যজন জেগে আছে, তার চোখ অন্ধকারে খোলা। সে একাকী জাগ্রত কথা বলে যায়, আমি ঘুমের ভেতর থেকে তার উত্তর দিই কখনো কখনো।
--আমরা এবার কোথায় বেড়াতে যাব ? কতদূর...আচ্ছা তার আগে আমি সেরে উঠব ত...? ... শুনছো?
-- হ্যাঁ, এবার তো আমরা সুন্দরবনের নদীতে যাচ্ছি, একটা বিশাল নৌকার ভেতর রাত্রিবাস। সেখানেই রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, নৌকার ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে থাকা। শুক্লপক্ষ থাকবে ত? মেঘে মেঘে ঢাকা পড়বে চাঁদ। রাত্রে বাঘের ডাক শুনতে পাব আমরা।
--...আমরা ভাবি বাঘের ডাক মানেই ভয়ংকর কিছু! হয়ত সে বাঘিনীকেই ডাকছে, চাঁদের নিচে তারা শোবে...বহুদূর থেকে আমরা হয়ত সেই ডাক শুনছি...
--তুমি কখনো বাঘের ডাক শুনেছ বিদিশা?...
--একবার খুব কম বয়সে আমার এক পিসিরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, জানো? ইছামতীর তীরে, ওইপার বাংলাদেশ, এইরকম নদীর উপর নৌকাতে সারারাত ভেসে ছিলাম, মাঝরাতে মাঝীদের লণ্ঠন নিভে গেল, চাঁদ ছিল...
--তারপর?
সে চুপ করে থাকে, আমি ঘুমের ভেতর পাশ ফিরি, আর দেখতে পাই আয়নার ভেতর আমার একা শুয়ে থাকা! চমকে উঠি! ফের পাশ ফিরতে ভয় হয়...
একদিন বিদিশা এরকম ঘুম থেকে তুলে মধ্যরাতে আমার ভ্যাবাচাকা মুখের উপর হাত রেখে বলেছিল—আমি যেদিন থাকব না, তুমি কার কাছে থাকবে সুমেরু?
আমি দেখছিলাম পশ্চিমের সরু চাঁদ অস্ত যাচ্ছে জানলায়।
-–তুমি ঘুমোও নি বিদিশা?
--বলো, কে আসবে আবার? কেউ ত আসবে? তুমি একা থাকতে ভয় পাও জানি...
--মানুষের জীবন খুব রহস্যময় জানো! সে তার অতীত ছেড়ে চলে যায়, ভবিষ্যৎ অজানা তার...
-- তার কথা বল সুমেরু, সে কেমন? তাকে তুমি দেখতে পাও?
--যাকে আমি চিনিনি কখনো, তার ছবি কেমনে বা আঁকি!
--চেনো, তাকে চেনো, দেখো, তোমার ভবিষ্যৎ থেকে সে নেবে আসবে একদিন...
তৎক্ষণাৎ আমি চোখ বন্ধ করে যার মুখ দেখলাম, তার চক্ষু শাদা, মণিহীন! নারাণদার কবিতার সেই বৃদ্ধের সাথে রূপসী নারীর মতো! ভয় পেয়ে বিদিশাকেই জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাকি সে ঘুমিয়েই ছিল! আমি পুর্নবার জেগে উঠে দেখি জানলায় সরু চাঁদ তার মুখের উপর এক অলৌকিক আলো ফেলে চলে যাচ্ছে মেরুপ্রদেশের দিকে। যে মেরুপ্রদেশের গল্প আমরা করতাম প্রখর গ্রীষ্মের রাত্রে, আমরা গল্প করতে করতে অরোরাবোরিয়ালিস পার হয়ে যেতাম। মাথার উপর থেকে নেমে আসত হিম, ঠাণ্ডা, রঙের চাদর! আমাদের ভ্রমণ কাহিনীগুলি এইরকম ছিল। জানালায় সেই চাঁদ! হিম শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে সেই চাঁদের আকাশ থেকে আমাদের পৃথিবীতে। পূবাকাশ দেখে মনে হয় ভোর হবেনা বহুদিন!
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার, জানো! ভোররাতে। সত্যিই ভোর হয়েছিল জাগতিক! ঘুম ভেঙে দেখি বিদিশার মাথা বালিশের থেকে গড়িয়ে পড়েছে! আমি চিৎকার করে ডেকে উঠতেই দেখি তার চোখ মেরুপ্রদেশের মতো শাদা! মণিহীন!
ঘটনা হল এইসব কোনো ঘটনা নয়। দৃশ্যমাত্র। ঘটনা হল তুমি এইসব জানতে চাইছ। পুরনো ঘটনা সকল। যা আমার বিশ বছর আগের জীবনে ঘটে গিয়েছিল। অথবা ঘটতে চেয়েছিল মাত্র, ঘটা হয়ে ওঠে নাই এই ঘটনা সকলের। আজ তুমি চাইছো বলেই তা শূন্যের ভিতর এক আবশ্যিকতার মতো ঘটে যাচ্ছে। এবং শূন্য মানে যেহেতু আকাশ তাই আকাশের , এক বিরাট না-এর আলো এসে পড়ছে ফের ঘটনার মধ্যে। তুমি অলীক ভাবছ আমার চরিত্রটিকে। ভাবছ আসলে আমার চেয়ে থাকার মধ্যে সত্যতা নেই আদতে, বাস্তব নেই, তাই আসমানে ঘর বাঁধছ তুমি, ঝুরঝুর মাটি ঝরে পড়ে মিশে যাচ্ছে মহাশূন্যে। আমি মাটির দেয়ালের গায়ে গ্রামচিত্র এঁকে দিচ্ছি। বাঁশের বেড়া বাঁধছি, তুমি উঠোনে খড়ির আলপনা আঁকছো হাসিহাসি মুখে। আর মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনির উপর মাধবীকুঞ্জ এলিয়ে পড়ছে, তার ছায়া এসে দুলছে তোমার আলপনার উপর, আর তোমার কল্পবাস্তবের উপর আলো এসে পড়ছে বাঁকা। সেই বাঁকা আলোয় উত্তরের বারান্দার পাশে, সেই প্রিয় বকুলগাছের ছায়ায় এসে সে দাঁড়াচ্ছে। বিদিশা। সে জায়গা চাইছে এত এত বছর পর। তোমার হাসিহাসি মুখ আসমানি আলোর মত কেঁপে ওঠে। আমি ফিরে আসছি হয়ত তখন, গ্রামের রাস্তায়, কিছু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, নরমমাটিতে সাইকেলের চাকা বসে যায়। আমি ফিরতে ফিরতে ভাবছি, আজ তোমাদের কি কি কথা হল! কোথায় কোথায় বসলে তোমরা, আমার গোপনগুলি কি কি খুলে গেল আজ তোমাদের কাছে! আমি ভয়ে ভয়ে বেড়ার গায়ে সাইকেল রাখি।
আচ্ছা, এর আগে কখনো তোমায় সেই ম্যাজিক-কার্পেটের কথা বলেছি? যা আমাকে রক্ষা করত সমস্ত বিপদে। সমস্ত পালিয়ে যাওয়ার পথে। যদিও তার কোনো রূপ ছিল না, তবু কারু ছিল। ম্যাজিক-কার্পেট মানেই আলাদিন নয় কিন্তু! কোও দিগ্বিজয়ও নয়, শুধু উড়ে যাওয়া, উদ্দেশ্যহীন উড়ে যাওয়া। আমি তাকে স্মরণ করি। বেড়ার গায়ে সাইকেল রেখে ভেতরে এসে দেখি বকুলতলার বেদীতে তোমরা বসে আছ দুজন। বিদিশার তামার আংটি তোমার অনামিকায়, যা চোখে পড়ার কথাই না, সেটাই চোখে পড়ে কেন যে সবচেয়ে আগে! তুমি জানোনা , ওই আংটি বিদিশার চোদ্দ বছর বয়সের সত্যপীরের মেলায় কেনা। তখন আমি তার কিশোরী বুকের কাছে উপস্থিত ছিলাম কিনা মনে নেই আজ, তবু এত এত বার শুনে শুনে আজ মনে হয়, আমিই ছিলাম। সে বহুযুগ, তুমি তখন অন্য এক ভুবন, অন্য আলোর। সেই তোমার অনামিকা, এই অসহ্য ভার সহ্য করতে পারছে না দেখে আমার কষ্ট হয়।। আর এই এতদিন পর, বিদিশার মধ্যবয়সী অশরীর, কোনো অলংকার ধারণের থেকে দূরে, বকুলের ছায়ায় শুয়ে আছে। তুমিও গাছের গুড়িতে মাথে রেখে চেয়ে আছো শূন্যে, বহুদূর! তোমাদের দুজনের চোখের জমি সাদা! এই দৃশ্য ম্যাজিক কার্পেটের পিঠে বসে দেখে ফেলি আমি। দেখি, তোমাদের দুজনের অদূরে বাঁশের বেড়ার পাশ দিয়ে এক অকল্পনীয় সোনালী সাপ , ঘরের পিছনে, সৌদামিনির দিকে এগিয়ে চলেছে। সৌদামিনি ছোটো এক খাল, জল বয়ে যায়।
যাকে ‘তুমি’ ডাকছি , তাকে চিনি না। বিদিশা বলেও কেউ ছিল না কখনো। তবু ছিল। বিদিশা আমার এক গল্পের চরিত্র। যেখানে আমি বিদিশার বিপরীতে নিজেকে রেখে গল্প রচনা করেছি। সেই গল্পে বিদিশার মৃত্যু হয়েছিল। বিদিশা প্রেমের সন্ধানে বার হয়ে আর ফেরেনি। আমি এপথ ওপথ ফিরে এক নতুন গল্পের কাছে যাই। লেখা শুরু করি, আর দেখি, এই গল্পে ‘তুমি’ ক্রমশ এক চরিত্র হয়ে উঠেছ। যাকে আমি ভালবেসে ফেলছি। অথচ যা আমার র্নিমাণ, আমার হাতে তৈরি গল্পের জীবন, এক জটিল আর্বতের মধ্যে ঢুকে পড়ছি আমরা। সে প্রেয়সী হয়ে উঠেছে আমার গল্পের ভিতর। আদতে যা নেই, সেই আলোর ভিতর, আমরা নিজেদের পুরানো গল্পগুলিই খুঁজে বেড়াচ্ছি, পৌঁছে যেতে চাইছি পুনরায় সেইখানে। যদি কোনোদিন অতীত কাহিনীগুলি অন্য পথে বাঁক নেয়! আমরা অপেক্ষা করি একটা অলৌকিক র্ঝণার। সেই স্বপ্নের ট্রেন যাত্রার!
যখন, একদিন, দুপুরের কাঠগুদাম এক্সপ্রেসে চড়ে বসব আমরা। এই কাঠগুদাম এক্সপ্রেস কোথায় যায় জানি না। শুধু জানি, এই পথে সে চলে যায় বাঁশি বাজিয়ে। তার সুদূর এইদিকে গেছে । ফাঁকা ট্রেনের জানলায় পার হয়ে যাবে রুক্ষমাঠ। কৃষকের জলপানের বিশ্রাম দৃশ্য। দূর কোনো পাহাড়ের নীল রেখা দেখে তুমি জনহীন রেলস্টেশনে নেমে যেতে চাইবে। আমি হেসে তোমার হাত টেনে ধরে বসাব আবার। আমরা কি সন্ধের আগে কোনো জঙ্গলের হল্টে নেমে যাব? এখানে কি সেই হাতিমুখ ঝরণার পথ? চলো, যাওয়া যাক, মনে মনে এই ভেবে জঙ্গলের সুঁড়িপথে এ গল্পের দুই নায়ক নায়িকার চলে যাওয়া ঘটবে। যা নেই, যা কখনো ছিল না, সেই অলৌকিক রাত্রির ঝরণার দিকে...
ধন্যবাদ, একটি অনৈসর্গিক অনুভূতি বোধ হল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ স্বাগতা
উত্তরমুছুন