লাল দোপাট্টা মলমল কা
ম্যাকোর বাড়ির মেয়েদের দু’পয়সায় সূর্য ঠিকরে যেতে যেতে বুকের ওপর নেমে আসে দু’দুটো চাঁদ। সুদ কষার অঙ্ক থেকে আতঙ্ক ছড়ালেও, অঙ্কবইতে মাসিক শব্দটি ঘিরে গোল দাগ পড়ে নটরাজ পেন্সিলের। টুং টুং শব্দে সাইকেল বেজে যায়। ঠাকুর ঘরের ঘণ্টাধ্বনি থেকে আলাদা সেই শব্দের ওপর ম্যাকোর গলা চড়ে। বজ্জাত, খচ্চর, বোকাচোদা।
ওরা চার বোন, চার সুন্দরী। সীমা, রিনা, শীলা আর নীলা।
রূপছায়া সিনেমা হলে একের পর এক রূপকথা খুলে যায় ব্যালকনির পাঁচসিকার টিকিটে। লাভ স্টোরির কুমার গৌরবের আদল যেন চোখে মুখে মেখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বেপাড়ার ছেলেরা। ম্যাকোদের বাড়ির দাওয়ায় সাইকেল নিয়ে আসে কুমার গৌরব। শীলা নীলা দুজনের মধ্যেই একঢাল চুলে বিজয়েতার ছায়া, বড়দি সীমা ওরফে রেখার মুখে ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন, তার প্রত্যেকটি বোরোলীনের ফোঁটার নিচে একেকটা ব্রণর আভাস লুকানো থাকে মুখ জুড়ে। শীলা কিম্বা নীলার চলাচলের পথে লাল রঙের নিচু সাইকেলে কানে ওয়াকম্যানের তার-গোঁজা কুমার গৌরবের ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে। সাইকেলটা দেখতে দেখতে হেলিকপ্টার হয়ে নেমে আসে মাঠ ঘাট পেরিয়ে শীলা নীলাদের দাওয়ায়। ম্যাকো চেঁচায়। লাভস্টোরি লাভস্টোরি। নদীর ধারের ভ্রমণে বিজয়েতার পিঠে গেঁথে যাওয়া কাঁটা মুখ দিয়ে তুলে নেয় কুমারগৌরব। শীলার মিষ্টি মুখের দিকে অপলক চাইতে চাইতে বলে –
এক হাতকড়ি মে বান্ধুঙ্গা তুঝে।
ঘাড় কাত ক’রে মিষ্টি হেসে বিজয়েতা বলে –
ফির?
- ফির হাম দোনো কো কোই আলগ নেই কর সাকতে।
- দুনিয়া বড়ে জালিম হ্যায়। চলো ভাগ চলে।
- চলো
দুহাত বাড়িয়ে বিজয়েতা দৌড়ে আসে
- ম্যায় আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি
- আ যা। কুমারগৌরব হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় শূন্যে।
রূপছায়া সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা মুখে তখন রূপকথা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ভোরের শিশিরের মতন। ন্যাপথলিনে মোড়া সোয়েটারগুলো রোদে বেরতে না বেরতেই শীলার রঙবেরঙের পঞ্চতে রোদ্দুরের ওম লেগে যায়। কুমার গৌরবের নিচু লাল সাইকেল হেলিকপ্টার হয়ে তখন বাতাসে। শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়া আর আটকাতে পারে না কেউ।
শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়ার খবরের পর, বড়দির ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন শুকিয়ে গেলেও একাধিক অমিতাভ বচ্চনরা ভিড় ক’রে থাকে। বড়দির কোঁকড়ানো ঘাড় অব্দি চুল, সাপের ফণার মতো রোদ মেখে নিলে। কমলালেবুর খোসা ছাড়ায় একেকজন অমিতাভ। দেখা এক খোয়াব কি হ্যায় সিলসিলে হুয়ে পার হয়ে খুন খারাপি রঙ ছুঁয়ে দেয় ভরাট গলার গান, রঙ বরসে ভিগে চুনারিবালি রঙ বরসে...
শীতকালীন একঘেয়ে বৃষ্টিতে আকাশ বাতাস জুড়ে অন্ধকার নেমে এলে নীলার মনখারাপে বেতাবী রঙ লেগে যায়। টুংটুংওয়ালার ছেলেটা অনেকটা সানি দেওলের মতো তাকায় আজকাল। বিজয়েতা থেকে অমৃতা সিং হতে হতে পার করতে হয় মাত্র দুটো বছর। পাহেলগাওঁয়ের খামারবাড়ি থেকে সাঁ ক’রে নেমে যাওয়া নদীটা নেমে আসে পলাশতলির মাটিতে। চিলেকোঠার ওপর থেকে, আ যা আ যা বলে চিৎকার করলে, তিন বার ফিরে আসে বাতাস, সেই সঙ্গে কানে আসে টুং টাং ধ্বনি।
টুংটুং টুংটুং শব্দ হলে নিজেকে আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখা যায় না।। টুংটুং করতে করতে শব্দটা এক সময় থেমে যায়। তখন যেন একটা স্বস্তি, কিছুটা সময় পেয়ে যাওয়ার। শব্দটা আবার সচল হতে হতেই দৌড় দৌড়। পৌঁছনো চাই শব্দের কাছে। ঠিক ঠাকুরঘরের বড় পিতলের ঘণ্টাটার মতো এর ঘণ্টাটা। দুপুরগুলো পলাশতলি রোডের মতো দীর্ঘ হয়ে যায় ছুটির দিনগুলোয়। ঠিক সেই সময় ঘণ্টার শব্দে পূজাপার্বণের কথা মনে পড়ে না। চারদিকে কিরিকিরি করা গোল সূর্যের মতো দু’পয়সা, ছ’কোণা তিন পয়সা, পেলেই দে ছুট। কদাচিৎ চারকোণা পাঁচ পয়সাও পেয়ে গেলে, হাতে স্বর্গরাজ্য এসে ধরা দিয়ে যায়। সেই পবিত্র ঘণ্টাধ্বনি থামিয়ে দিতে দু’পয়সার সূর্যালোকই যথেষ্ট।
ঘন্টাওয়ালা মাথা থেকে নামায় কাচের বাক্স। ঘাড়ের থেকে নামিয়ে আনে বাঁশের মোড়ানো স্ট্যান্ড। সেটা অদ্ভুত কায়দায় খুলে যায় মোড়ার মতো। তার ওপর সেই বাক্সটা। বাক্সটার মাথার ওপর বসানো লোহার শিকে গোঁজা সাদা কাগজের টুকরোগুলোই আসল। দু’পয়সায় দুটি কাগজ ছেঁড়ার অনুমতি পাওয়া যায়। দু’পিঠ- সাদা সেই কাগজগুলো ভেজানো হয় বাক্সের ওপরেই। বোতল থেকে সামান্য জল ছিটিয়ে তার ওপর চেপে ধরলেই ফুটে ওঠে সংখ্যা। ১ ২ ৩ ৪। যার যত সংখ্যা, তার হাতে ঘণ্টাওয়ালা ধরিয়ে দেবে ততগুলোই ঢ্যাপের মোয়া। হাল্কা, ফুরফুরে, মিষ্টি। ম্যাকো চেঁচায়। এমা দুই দুই দুই। এমা তিন তিন তিন। ম্যকো চেঁচায়। খচ্চর, তুই খচ্চর, বোকাচোদা। ঘরের পাশে ওদের কাঁচা নালায় পেচ্ছাবের গন্ধ বাতাস ভারি ক’রে রাখে। টুংটুংওয়ালার চোখে সানি দেওলের হাসি।
- জিনে কে লিয়ে দো বখত কে রোটিই কাফি। আগর পেয়ার হ্যায় তো সমঝ সব কুছ হ্যায়।
- ফির ভি তুম বড়ে বাপ কে বেটি। মেরে পাস কুছ ভি নেহি হ্যায়। সোচ লো।
- পেয়ার দৌলতসে নেহি বনতি। মেরি জান।
- চলো সাদি কর লে
- চলো।
নদীটায় সরাৎ করে নেমে যাওয়া কাঠের পাটাতনে খুলে রাখা থাকে জামা কাপড়, দোপাট্টা। সাঁতার-পোশাক পরে নদীতে নামে অমৃতা সিং আর সানি দেওল।
ভেঙ্গে পড়া জমিদারি থেকে অবশ্য কোনও হুংকার আসে না আমজাদ অথবা শাম্মি কাপুরের। সেখানে চুরুটের বদলে, পড়ন্ত জমিদারির ধিকি ধিকি আয় থেকে বেরিয়ে পড়তে থাকে নিষ্ফল ধোঁয়া। পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেওয়া দুই পুরুষের বদহজমের ঢেকুর তোলে একতলা বাড়িটি। সবটাই যেন গা-ছাড়া। স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া সংস্কার, রুচি, শালীনতা।
মেজদি রিনার চকচকে ফর্সা মুখ থেকে আলো পিছলে পড়ে। গালের কালো আঁচিল সে-আলো বাড়িয়ে দেয় হাজারগুণ। রিনার আঁচিল ঘিরে সারাদিন ভিড় করে লোকজন। সেখান থেকে কয়েকটি তির তুলে নেয় বড়দি সীমা। আরও দু’একটি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ে যায়। রিনার সুদূর নিমগ্ন গান বেয়ে উঠে আসতে গিয়ে পিছলে পড়ে কেউ কেউ। সুরের রেশ তার কালো চুলের মতো এলো করে দেয় রিনা। তার চোখে স্বপ্ন লেগে থাকে। মাটির অনেক ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে সে সুরের কাছে পৌছে যায়। এক এক সকালে ঘিরে ধরে আলো। নীল মেঘের ফাঁক দিয়ে বরফের পাহাড় দেখা গেলে মনে পড়ে, ওরা কোনও দিন শহরের গণ্ডি পেরয়নি। মেজদি রিনার ওই পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কোনও অমিতাভ মিঠুন নয়। সে অপেক্ষায় থাকে রাজপুত্তুরের। তার যাবতীয় প্রেম ঘনিয়ে ওঠে ম্যাকোকে ঘিরে। ম্যাকো ডাকে খেতে দে খেতে দে। রিনার আদরে আদরে বিপর্যস্ত ম্যাকো বলে খচ্চর। খচ্চর শব্দটা দু রকম করে বলতে পারে ম্যাকো। প্রেমে আর রাগে। কাউকে বলে দিতে হয় না কখন কোনটা।
এই সব সত্যি ঘটনাগুলো পরপর সাজালেও যে- ছবিটা স্পষ্ট নয়, সেটা হল পড়ন্ত এক জমিদার বাড়ির সিঁদ কেটে ঢুকে পড়া অসহায়তা। বিষদাঁত ভেঙ্গে নেওয়া সাপের মত এ-বাড়ির পুরুষেরা একের পর এক জমি বিক্রি করে যায়। একটু একটু করে নিঃশেষ হতে থাকে একটা প্রজন্ম। জমিদারবাড়ির ছেলেরা বাসের কন্ট্রাক্টরি করে। কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। কাঠের চুলায় ভাত চাপায় পড়ন্ত জমিদার গিন্নি। গিন্নির ফাঁদি নথ নাড়ানো তিরস্কার, ফসিল হয়ে যায়। সোনার সুতোয় কাজ করা পুরনো বেনারসি বিক্রি ক’রে কেনে লিপস্টিক, পাউডার। একেক খণ্ড জমি বিক্রির পর ওরা মাংস ভাত খায়, মাছ খায় পর পর সাত আট দিন। বাড়ন্ত চেহারাগুলোয় জৌলুস ওঠে। বড়দির পাতলা ঠোঁটে অন্য বাড়ির কনে সাজানোর আলো। বোরোলীনের ফোঁটায় দুপুরগুলো সাজিয়ে বসে মাঠে। উল বোনে। লম্বা ঝুলের সোয়েটার।
সাইকেল আরোহীরা সব শহরের বাইরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে। চার বছর পরপর বদল হয় মুখ। চার বছর পর পর নতুন আশ্বাস। বড়দি সীমার থেকে ক্রমশ বয়সে ছোট হয়ে আসে সাইকেল আরোহীরা। রিনারও বয়স ছাড়ায়। রাজপুত্তুরের জন্য অপেক্ষায় থাকে রিনা। তার কাঁধে চড়ে ঘোরে ম্যাকো।
সন্ধে থেকে আধো অন্ধকার হয়ে থাকে মফস্বলের পাড়াগুলো। নীলার বেতাবী মিটে যাওয়ারও পর একদিন। কয়ামত সে কয়ামত অব্দি দীর্ঘ হয়ে যায় কমলাপুর জঙ্গল। রিনার গানের রেশ আর দূরের আবছায়া পাহাড় মিশে যেতে যেতে কনকনে হিম পড়ে পলাশতলির মাঠে। একেকটা গানের সঙ্গে আছড়ে পড়ে একেকটা সময়। বায়স্কোপের চৌকো ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে পড়ে হারিয়ে যাওয়া একপাটি জুতো। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে পাহাড় স্পর্শ করিতে ইচ্ছে হয় রিনার। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সীমার প্রস্তাবে, কোনও এক সাইকেল-আরোহীর উৎসাহী অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলে– “যেতে পারি কিন্তু ও আমাকে টাচ করবে না!"
পাহাড়ে যাওয়ার আগে একটা একটা করে নদী পেরতে হয়। নদীর মনখারাপ থেকে শীতের সকালে উঠে আসে ধোঁয়া। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে চুল বাঁধে মেজদি রিনা। সকাল থেকে বিকেল একটাই রঙ হয়ে থাকে মেঘলাদিনে। যেন দীর্ঘ একটি বিকেল থেকে রাত নামে। অন্ধকার ঘনায়।
অন্ধকার ভালোমতো ঘনালেও ম্যাকোর চিৎকার চুপ করে থাকে। ওপাশের বাড়ির পুজোর ঘণ্টা থেমে যায়। এ-পাশের বাড়ির পরীক্ষার পড়া শোনা যায়। ম্যাকোর গালাগাল চুপ করে থাকে।
অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। সাইকেলের সমবেত ঘর্ষণ থেমে গেলে, মেয়েটি দৌড়াতে থাকে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে, নদীর চরটা যেন বড় বেশি দীর্ঘ। জলের কাছে পৌঁছাতে চায় মেয়েটা। জল সরেই যায় ক্রমাগত দূরে ...
নদীর ওই পারে আবছায়া পাহাড়ে তখন একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে আলো।
দেহ ঘষ্টে ঘষ্টে রাত্রি নামে শুকনো কাশবনে। চারদিকে ভয়াবহ সব আওয়াজ। শেয়ালের ডাক। মেয়েটি আকাশের দিকে তাকায়। কত তারা আকাশে, কিন্তু কত দূরে। কোনও আলোই এই গভীর বনে এসে পৌঁছায় না। এক ফোঁটা আলোর জন্য মেয়েটা ঘষ্টে যায় নিজেকে। জলের কাছাকাছি, জীবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চায়।
আলো, আলো, অন্ধকারে শুধু আলোর কথা ভাবে। মাথার ওপরে কোনও চাঁদ নেই। সিগারেটের টুকরোগুলো জ্ব’লে-নিভে দূরে সরে গেছে। অন্ধকারের রঙ বদলায়। বদলাতে থাকে। জলের কলকল ধ্বনি তীব্র হয়। অন্ধকার থেকে ফুঁড়ে ওঠা কাশে আটকানো লাল দোপাট্টা ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ে মেয়েটির ওপর। ঝরে পড়ে একটি আলোক বিন্দুও।
স্পষ্ট হতে থাকে সেই মেয়ে। তার পরনের সাদা গাউন সাদা পতাকার মতো ঝুলতে থাকে শুকনো কাশবনে। দ্যাখে অনেক দূরের পাহাড়ের আলোকবিন্দুকে। আলো একটার থেকে আরও বিন্দু হয়ে যায়। দূরের পাহাড় থেকে উপড়ে আসা আলো হাজার হাজার জোনাকি হয়ে ঘিরে ধরতে চায় মেয়েটিকে। গোটা পাহাড়টাই আলো সমেত এগোতে থাকে যেন। কুয়াশা সরিয়ে সকাল এলে চোখে পড়ে ওর ফর্সা চকচকে গালে তীব্র কালো তিল, জোনাকির আলোর মতো জ্বলে উঠছে।
অনেকটা দূরে মফস্বল শহরে তখন ম্যাকোর সবুজ পালকে ছিন্নভিন্ন রোদ। পাশের নারকেল গাছের গোড়ায় ঘাড় মটকানো টিয়াটাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ায় সবুজ পালক উড়ছে। আর কাশবনে...
হাওয়ামে উড়তা যায়ে লাল দোপাট্টা মলমল কা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন