মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

দিলবালে, দুলহানিয়া ও গুটিকয় পার্শ্বচরিত্র




দিলবালে, দুলহানিয়া ও গুটিকয় পার্শ্বচরিত্র
----------------  
কৌশিক বাজারী

 


 ...বাহিরে কি বৃষ্টি নামিয়াছে?
   জানালার বাহিরে রাত্রির অন্ধকার ঘন হইয়া আসিয়াছে । মধ্যে মধ্যে বহুদূরবর্তী দিগন্তমেঘে মৃদু মেঘগর্জন আবহের ন্যায় বাজিয়া বাজিয়া শ্রুতিকে অভ্যস্ত করিয়া তুলিতেছে, ফলত তাহার ধ্বনি এখন আর কর্ণকুহরে বাজেনা তেমন ধারা, এমন ঘটনা চলিতেছে সেই সন্ধ্যা থাকিতেই, গুরু গুরু মৃদু বাদ্যের সহিত মধ্যে মধ্যে হাওয়ার আবহ। বৃক্ষদিগের, মনুষ্যদিগের ঘর-দুয়ার, পাতা, প্রশাখা, খড়খড়ি, জানালার পুরাতন পাল্লা আর উড়ন্ত পর্দা এবং প্রাচীন লৌহ সোপানের জটিল আবর্তের মধ্য দিয়া কখনো দ্রুত কখনো বা ধীর লয়ে বাতাসের বহিয়া যাওয়ার একটানা ধ্রুপদী আবহ ।  এই চলিতেছে। ধৃতিমান অন্ধকারের মধ্যে দেশলাই জ্বালাইয়া জ্বালাইয়া মোমবাতি খুঁজিয়া ফিরে, কিয়ৎ দূর অগ্রসর হয়, পুনরায় নিভিয়া যায়, পুনরায় জ্বালায়, অগ্রসর হয়, সহসা দু অঙ্গুলিস্থিত জ্বলন্ত শলাকার আলোয়, নিভিয়া যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে উড়ন্ত পর্দার পিছনে, খুলা ও অন্ধকার জানালার পার্শ্ববর্তী বিজিতার মুখমণ্ডল লালভ আভায় জ্বলিয়া উঠে, রহস্যের মতন অতঃপর নিভিয়া যায়..। মুহূর্তেক আলো ও পরক্ষণের ধূ-ধূ অন্ধকার দুজনার মধ্যে এক হাওয়ার প্রবাহ ঘটাইয়া দেয়। ধৃতিমান আর শলাকা জ্বালাইবার চেষ্টা করে না। বিজিতা সহসা অন্ধকার হইয়া বলিয়া উঠে
--থাক, এই ভাল...     
   তাহার মনের মধ্যে একটা গুরুগুরু চলিতেছিল। তাহা আলোর স্পর্শে যদি ফাটিয়া পড়ে ? এই আশঙ্কা হইতে সে মুক্তি পাইতে চাহিয়া আপাত অন্ধকারকেই বাছিয়া লইতে চায়। ধৃতির হাল ছাড়িয়া দেওয়া সে অন্ধকারে দেখিতে পায় না। ধৃতিও অন্ধকারের মধ্যে তাহাকে নিঃশব্দ সমর্থন দিয়া দেয়। সেও জানলার নিকটে গিয়া দাঁড়ায়, হ্যাঁ, বৃষ্টি নামিয়াছে...
   রাত্রির চরাচর জুড়িয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইলে অন্ধকারের দৃশ্যপটও পাল্টাইতে শুরু করে। এতক্ষণের নিকষ-শ্যাম-আঁধারের মধ্য হইতে এক রহস্যময় ধোঁয়াটে আলোকাভাস দেখা যায় জানলা দিয়া। পৃথিবীতে অলৌকিক এই আলোর উৎস সম্বন্ধে এখনো পর্যন্ত কিছুই জানা যায় নাই। ধৃতি সেই আলোর দিকে তাকাইয়া থাকে আর শব্দ গোনে। বৃক্ষ ও তাহার পত্র নিঃসরিত জলের পতন ধ্বনি, কার্নিশের উপর জলের পতন ধ্বনি, পাইপ বাহিয়া নিচে, পথপার্শ্বে জল বহিয়া যাবার শব্দ, কোথাও কোনো টিনের উপর টুং টুং ধ্বনি, সমস্ত সুর তাল মিলিয়া একটা মন খারাপ করা সুগন্ধি ও জটিল হাওয়ার পরিবেশ তৈরী হইতে থাকে।
   অন্ধকারের মধ্য হইতে বিজিতা হঠাৎ কথা কহিয়া ওঠেএখন আমি কোথায় যাবো ধৃতি ?
ধৃতিমান এই প্রশ্নটাকেই এতক্ষণ ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত, সেই অমোঘ প্রশ্ন, সেই নিশ্চিত প্রসারিত তলোয়ার উত্থাপিত হইল...

   ...

...বাইরে কি বৃষ্টি শুরু হল?  

অনিমেষ বুকের উপর বইটা মুড়ে রেখে একবার পর্দা-টানা বন্ধ নিশ্ছিদ্র জানলাটার দিকে চায় । ঘরের মধ্যে একটা টিউব জ্বলছে। সিলিং পাখা ঘুরছে সর্বোচ্চ গতিতে। বাইরে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের ঝাঁ-ঝাঁ শেষ দুপুর চলছে। না, বৃষ্টি নয় তাহলে। বহু পুরনো সিলিং পাখাটা মাঝে মাঝে এমন ঝিরঝির বৃষ্টির মতো শব্দ দেয় । অন্যমনস্ক অনিমেষকে ধন্দে ফেলে দেয় । তাহলে বৃষ্টি নয়! গল্পেরবই-এর বৃষ্টি-ছাঁট ? হাঃ হাঃ হাঃ বিজিতা-ধৃতিমান...।
   হঠাৎ তার ঘেমে ওঠা শরীরে পাখার বাতাস লেগে শীত শীত করে। এই ঝাঁ ঝাঁ গরমে শীত শীত ভাব তাকে একবার ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। শরীর খারাপ হবে নাকি? একটা অজানা ভয় তাকে একবার পাক মেরে চলে যায়। অনিমেষ হাত ওয়ালা গেঞ্জিটা টান মেরে খুলে ঘরের কোনে জমা করা স্তূপীকৃত জামাকাপড়ের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেটা খানিক দূরে অঞ্জুর ঠাকুর আসনের কাঠের চুড়ায় গিয়ে ঝুলে পড়ে। অনিমেষের হাসি পেয়ে যায় অযথায়। সে উঠে গিয়ে সেটা যথাস্থানে রাখে। অঞ্জুর পরিপাটি ঠাকুরের আসন এখন বাসিফুলে ম্যাড়ম্যাড় করছে। প্লাস্টিকের কিছু উজ্জ্বল ফুল সাজানো, সেখানে হালকা ধুলোর আস্তরণ। আসনের কাঠের চুড়োয় ঝিকমিক আলো জ্বলা টুনি লাইট। টুনি বলে কি ওগুলোকে? এখন আর টুনি বলে না বোধহয়। অনিমেষ ভাবে; আজ বিকেলে বাজার যাবে কিনা ?  রান্নাঘরে উঁকি মেরে একবার সবজির ঝুড়িটা দেখে নেয়। সেখানে একটা টিকটিকি চুপ করে আছে, দুটো শুকনো আলু আর পেঁয়াজের খোসা  উড়ছে। অথচ তার বাজারে যেতে ইচ্ছে করেনা। ...খুব যে আকস্মিক বজ্র পাতের মতো ঘটনা তাও নয়। অঞ্জু যে চলে যাবে, যেতেই পারে যে কোনো দিন, এমন একটা হাওয়া ছিলোই। কিন্তু সত্যিই চলে যাওয়াটা যে কেমন, সেটা জানা ছিলো না , এমন কি এখনো ঠিক মতো উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি অনিমেষ। বরং বেশ একটা হালকা ভাব লাগছে। --যা: শালা, যাবোনা বাজার, শুয়ে থাকবো, হাওয়া খাবো। অনিমেষ নীল পাঞ্জাবীর পকেটে মানি ব্যাগ হাতড়ায়, মানিব্যাগের সাথে একগুচ্ছ কাগজ, ছেঁড়াখোঁড়া উঠে আসে, বাসেরট্রেনের টিকিট, ছিলিমপুর টু মহিমগঞ্জ, দোকানের ফর্দ, একটা ছাপানো কার্ড, দেবেশ চন্দ্র ঘোষাল, ইন্টিরিয়ার ডেকোরেটার, ফোন-৯৪৭৫.... মহিমগঞ্জ অঞ্জুর দাদার বাড়ি, গত সপ্তাহে গিয়েছিল দুজনেই, ট্রেনে আলাপ দেবেশ চন্দ্র ঘোষালের সঙ্গে। মানিব্যাগে টাকা আছে এখনো কিছু...। ধৃতি আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে দেবেশ চন্দ্রকে ছুঁড়ে ফেলে। ফেলে দেওয়ার আগে পুরনো  ফর্দটাতে চোখ বুলায়ধারা সরষে তেল ১লি, অলিভ ওয়েল, সিমুই চার প্যাকেট, শ্যাম্পু পাতা বারোটা, রবিন ব্লু, হুইসপার রেগুলার...। এগুলো কি আনা হয়েছিল?ভাবে অনিমেষ। ভাবতে ভাবতে বিছানায় লম্বা হয়। পাশ ফেরে। বিছানায় পিঠের নিচে শক্ত বোর্ডের খোঁচা লাগে। ...বইটা, যার মধ্যে বিজিতা-আর ধৃতিমান...
  
   মাথার অনেক  উপরে ভারী একটা প্রাচীন লৌহসেতুর  উপর দিয়া একটা মালবাহিকা লৌহশকট ধীর ও গুরুগম্ভীর চালে চলিয়া যাইতে থাকে বহুক্ষণ ধরিয়া। সেতু হইতে বহু নিচে নদীর বালুকা মিশ্রিত বিক্ষিপ্ত শ্যামলিমা, যার উপর দিয়া হাঁটিয়া যায় তাহারা দুইজন। রেলগাড়ির গুমগুম আবহের মধ্য হইতে তাহারা কথা কহে। দুই জনেই পরস্পরের কথা অর্ধেক শুনিতে পায়, অর্ধেক পায়না...
ধৃতি :  শুভময়ের সমস্ত কাহিনী তুমি মুছে ফেলতে পার কি বিজিতা...?
বিজিতা : সমস্ত কাহিনীই যেখানে অপমানের আর অপরিচয়ের তাকে মুছে ফেলতে পারলে বেঁচে যেতাম ধৃতি...
ধৃতি : কিন্তু, বিজিতা, কাহিনী মাত্রই বহুমাত্রিক, সেখানে শুধু অপমান আর অপরিচয় তো নয়... এতগুলো বছর, সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয়, হাওয়ার রাত, বর্ষণমুখরতা... আর ...তাছাড়া... যেখানে চলেছ সেখানেও তো অপরিচয় ?
বিজিতা : তবু সেই যে অনিশ্চিত, সে এক খেলা, কি বলো ধৃতি ?
ধৃতি :  তবু ভালো, তোমার ঠোঁটে কৌতুক এসেছে...
বিজিতা: জীবনের পাঁচ-পাঁচটা বছর তো অনেকটা সময়, তাই না ?
   ধৃতি মনে মনে ভাবিতে থাকে , এই পাঁচ বৎসরেও তোমাদের কোনো সন্তান নাই কেন বিজিতা। তাহা হইলে হয়তো তোমায় এভাবে একাকী অনন্যপায় হইতে হইত না...
বিজিতা যেন বা ধৃতির মনে মনে বলা কথার জবাব দিয়া উঠেআসলে এমন একটা সময়, একটা জীবন, পেরিয়ে এলাম, সেখানে কোনো সৃষ্টি নেই, সম্ভাবনা নেই, সন্তান যা শ্রেষ্ঠ সৃজন, সেখানে এলো না ধৃতি...
  রেলসেতুর উপর মালগাড়িটার শেষ কামরাটিও ওপারে মিলাইয়া গেলে  চরাচরের মধ্যে একটা দৈনন্দিন নীরবতা নামিয়া আসে । দুজনেই খানিক নীরব থাকিবার পর ধৃতি কহে :   চলো ঐ গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, রোদে রক্ত পর্যন্ত ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে...।
   কিছুদূরে শিলাবতী নামের একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। একটা কদম্ব বৃক্ষের ঝিরিঝিরি ছায়ায় আসিয়া দাঁড়ায় দুইজনা। প্রতীকী কদম্ববৃক্ষের মধ্যদিয়া তির্যক শ্লেষের মতো রৌদ্র আসিয়া পড়িয়াছে তাহাদের গায়ে। এরূপ মনে হইতেই বিজিতা এইবার সামান্য শব্দ করিয়াই হাস্য সম্বরণ করে । ধৃতি কৌতূহলে তাহার মুখের পানে চায় । বিজিতা উপর পানে চায়। বর্ষার প্রথম কদম্বপুষ্পের ঘ্রাণ। তথাপি এখন ত প্রবল রৌদ্র, বর্ষা কোথা ... তবু হায়, প্রকৃতি অসময় বুঝে নাই... বিজিতা ধৃতির কাঁধে বিচরণরত একটা কাঠপিঁপড়া  তাহার আঁচল দিয়া আলগোছে ঝাড়িয়া ফেলে...
--জানো, ধৃতি, শুভময়দের বাড়িতে শুধু কাচের পুতুল, ঠাকুর ঘরেও কাচের পুতুল...আমার শাশুড়ি সারাদিন পুতুল খেলেন...
--শুভময়দের বাড়ি ! সে কোথায় বিজিতা ...?


 ...বইটা বন্ধ করতেই বহুদূর থেকে একটা অচেনা গলায় ডাক শুনতে পায় অনিমেষ। --অনিঅনিঅনি । কেউ তাকে ডেকে ডেকে চলে যাচ্ছে।   উঠে গিয়ে জানলা খুলে বাইরে তাকায় সে, দেখে, শেষ দুপুরের রোদ রাস্তায়, গ্রীস্মবিকেলের শুনশান পথে একটা অবাঙালী ফেরিওয়ালা, কাঁধে ঝোলা, অদ্ভুত দেহাতি-হিন্দী টানে হেঁকে যাচ্ছেঅনিঅনি-- । অনেক ভেবেও অনিমেষ বুঝতে পারেনা কি বস্তু ফেরী করছে সে ! অনিই বা কি বস্তু !

     অনিমেষ পাজামার উপর একটা হাফ-পাঞ্জাবী চড়িয়ে রাস্তায় নামে। বিকেলের আলো রাস্তায় তার ছায়া কে দীর্ঘতর করে নিয়ে গেছে বহুদূর। দীর্ঘ ধড়ের উপর কোথায় তার মাথা অনি নিজেই খুঁজে পায়না। সে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে সে ছিলিমপুর স্টেশনের মোরাম বিছানো প্লাটফর্মের একেবারে শেষের দিকের ফাঁকা বেঞ্চিটায় এসে বসে। পাশেই একটা বিশাল রাধাচূড়া। তামাটে হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে, যদিও তার হলুদ রং এখন আর হলুদ নয়। হলুদ নয় কেননা সূর্য অস্ত গেছে । সন্ধ্যা পূর্ব দিগন্তের উপর মাটি থেকে কিছুটা ওপরে আঁধার ঘনিয়ে থমকে আছে। দেখছে, পশ্চিম এখনো প্রস্তুত নয়। সেখানে সূর্য বিদায়ের পর শেষ ছটাদের স্তিমিত কলরব ।  এখন বিকেলও নয়, সন্ধ্যাও নয় ! এক অন্যতর সন্ধিকাল! তাই রাধাচূড়া ছাইবর্ণ, তবু অভ্যস্ত মানুষের চোখ তাকে হলুদই দেখে।
   রাধাচূড়া গাছটার তলায় একটা পাখমারা পরিবার এই অবেলায় উনুনে জ্বাল দিচ্ছে। লোকটা চিত হয়ে সন্ধ্যা আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে মাটিতে । পাশে ছেঁড়া নোংরা কানিতে জড়ানো একটা চারমাসের বাচ্চার কঙ্কাল। তার বুকের পাঁজরে লোকটার অজানিত হাত। যে মেয়েটা জ্বাল দিচ্ছে সে এর মা, কত বয়স হবে ? ১৭-১৮ । দেখে মনে হয় ৪০-৪৫ । রুগ্ন, চোয়ালের হাড় বার করা। মেয়েটার সঙ্গে অনিমেষের একবার চোখাচোখি হয়। অনিমেষ লক্ষ্য করে তার চোখ ধ্বক করে জ্বলে ওঠে একবার। এদের জীবন সম্পর্কে আমাদের মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজে নানান গল্প রয়েছে। কেউ বলে পাখমারা, কেউ বলে ইরানি। ইরানি যে কেন বলে এদের অনিমেষ ভেবে পায় না। আর এদের দলের পুরুষরা নানা জীব জন্তু পাখি শিকার করে বেড়ায় বটে, তবে তাদের মূল উপার্জন সম্ভবত চুরি, হাতসাফাই। মেয়েরা দিনেরবেলা পথে ঘাটে ট্রেনে নানান পশরা ফেরি করে বেড়ায় আর রাত্রে শরীর। এদের দলে নাকি নারী পুরুষের অবাধ সম্পর্ক। যা কিছু অবাধ, ভদ্রসমাজে তাই তো অবৈধ। অথবা  সবই হয়তো আমাদের দূরত্ব জনিত অজ্ঞান কল্পনাঅনতি দূরে, রেল লাইনের ওপারে তাদের খুলে নেওয়া তাঁবু গুলির দিকে চেয়ে ভাবে অনিমেষ। এরা হঠাৎ হঠাৎ কখনো এসে জোটে রেল লাইনের ধারে, তারপর একদিন আবার হঠাৎ উধাও হয়ে যায়।
   রাধাচুড়া গাছের নিচে ফিরে চেয়ে দেখে লোকটা আকাশের দিকে সেই এক ভাবে চেয়ে আছে স্থির। লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমেষ আকাশের দিকে চায় । ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে ।  পূবদিকে যেখানটা বেশী ঘনিয়েছে, সেখানে একটা তারা। রাতের প্রথম তারা ! ট্রেনের ভোঁ শুনে তাকিয়ে দেখে হলদিয়া-আসানসোল ঢুকছে। ফাঁকা ফাঁকা ট্রেন । এ লাইনে এতদূর অবদি ভিড় আসে না। এবার তো পশ্চিম রাঢ়, রুক্ষ, মানুষজন কম। ট্রেনের জানলায় ঘর ফিরতি মানুষের পরিশ্রান্ত মুখ। এপাশের জানলায় দুটি মানুষের মাঝখান দিয়ে ওপাশের জানলার হলুদ আকাশ। অনি দেখে; মানে, হঠাৎ তাদের দেখে ফেলে একটা জানলায়, মুখোমুখি ধৃতিমান-বিজিতা। বিজিতার মুখ থমথমে। ধৃতিমান উদাস । হাওয়ায় উড়ছে বিজিতার চুল, তার অলক এসে পড়ছে চোখের উপর । বিজিতা বাঁ হাতে চোখের উপর থেকে আনমনে চুল সরায় আর সেই মুহূর্তে অনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় তার । বিজিতা চোখ কি অচেনা নারীর মতো চায়? অনি আত্ম সঙ্কোচে ইতস্তত চোখ ফেরায়, ভাবেগল্পের নারী কি একাকী পাঠককে একবার দেখে নিয়ে তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত চিনে নিতে পারে? সে বিপন্ন বোধ করে। এক মুহূর্ত। ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়। অনি অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় । দেখে, পাখমারা পরিবারটা ট্রেনের পাশে পাশে ছুটছে  আর ট্রেনের ইঞ্জিন দ্রুত গতি তুলে একটার পর একটা কামরা তাদের পেরিয়ে যাচ্ছে।  লোকটার কোলে নোংরা কাপড়ে জড়ানো সংসার । তার মেয়েটা অনেক পিছনে আছাড় খেতে খেতে দৌড়চ্ছে, কোলে সেই জীর্ণ কঙ্কালসার বাচ্চা। তার মাথা দৌড়ের তালে তালে ঝাঁকাচ্ছে, অনি শিউরে ওঠে, ওর ঘাড় সোজা হয়েছে তো?  লোকটা ভারী পুঁটলি নিয়ে পিছনে তাকায়, ভাবেপৌঁছতে পারবে কিনা, হিসেব কষে, তারপর ক্রমশ গতি বাড়তে থাকা ট্রেনের একটা দরজার ভিতরে তার পুঁটলি ছুড়ে দেয়, হাতল ধরে লাফ মেরে উঠে পড়ে। শেষ কামরার শেষ দরজা। মেয়েটা হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসছে, তার আঁচল খসে গেছে, বুক খোলা ছেঁড়া নোংরা ব্লাউজ, শুকনো দড়ির মতো অষ্টাদশী স্তন ডাঁয়ে বাঁয়ে পেন্ডুলামের মতো দুলছে।  অনি পিছনে ফিরে তাকায় । রাধাচূড়া গাছের তলার একটু আগের সেই সংসার শূন্য পড়ে আছে । তিনটে ইটের উনুন থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছে কেবল। লোকটা এক হাতে দরজার হাতল ধরে অন্য হাত বাড়িয়ে ধরে । মেয়েটা বাঁ হাতে বাচ্চা সামলে ডান হাত বাড়ায়। মধ্যে খানের দূরত্ব কমতে থাকে, আর একটা হকার চেঁচিয়ে জোকার দেয়আ-বে দিলবালে দুলহানিয়া বে...। মেয়েটার হাত ধরে ফেলে লোকটা।  যাত্রীরা হেসে ওঠে, পাখমারা পরিবারটিও হাসে, রেলের কামরায় বাচ্চাটা কোল বদল হয়। বিজিতা একবার চমকে উঠে দিলবালে ও দুলহানিয়াকে দেখে নেয় আর ট্রেন প্লাটফর্ম থেকে ধক-ধক শব্দে বার হয়ে যায় পশ্চিমের দিকে। যেখানে প্রায়ান্ধকার দিগন্তে কিছুক্ষণ পূর্বের সূর্যাস্ত এখনো বর্ণময় হয়ে  আছে।
  

শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

“অভ্র ও আবির” : একটি কবিতা জীবন






অভ্র ও আবির : একটি কবিতা জীবন

কিছুই দেবে না


           শুধু উচাটন করে
                          চলে যাবে বসন্ত বাতাস...



 কবি সুদেব বকসীর পরিচয় কখনোই সেভাবে উচ্চকিত নয়, তিনি-মানুষটির মতোই তাঁর কবিতার বইগুলিও খানিক মুখ-লুকোনো স্বভাবের। তাঁকে আভিধানিক অর্থে না হলেও প্রচলিত বাংলা অর্থে বলা যায় স্বভাব রোমান্টিক এক কবি মানুষ । যিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে এক অর্থে জীবনকেই সাজিয়ে তোলেন। জীবনের, প্রতিদিনের যাপনের ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ সব ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা, সেখানে কোথাও কোনো চমৎকার, কোনো উচ্চরোল, কোনো ঝঙ্কার ছাড়াই তাঁর কথাগুলি অতি সহজভাবে দেখি বসে থাকে। কখনো উদাসীন, কখনো বিষন্ন, অভাবিত কখনো । হয়তো জবাগাছের মতো অতি সাধারন এক গাছের পাতায় রোদ এসে পড়েছে। জবা পাতা খসে পড়ছে পাশের পুকুরে, সেখানেও রোদএই এক দৃশ্য। হয়তো পাশের বাড়ির আইবুড়ো মেয়ে একদৃষ্টে সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, এ সবই তাঁর কবিতার বিষয়হীনতা হয়ে ওঠে কখনো বা। তিনি তাঁর অতি সাধারন কথাগুলিই স্বীকার করে ফেলেন তাঁর লেখায়
প্রত্যেকটা ঘটনাই সাধারণ
                          শীত ও হেমন্তের মধ্যবর্তী অস্বস্তি

 আর এভাবেই কোনো একটি লেখা ধীরে ধীরে কবিতার দিকে অগ্রসর হয়...।
  সমস্যা হল যিনি খুব কাছের মানুষ, তাঁর নামের পাশে পদবী ব্যবহার অস্বস্তিকর। বার বার কবি বলাটাও। কারন সুদেবদা কে সুদেবদা বলতেই অভ্যস্ত প্রায় কুড়ি বছরেরো বেশী সময় যাবত। তাই এই লেখাতেও তাঁকে সুদেবদাই বলতে হবে। নাহলে লেখা এগোবে না...।
  তো যে কথা বলছিলাম। সুদেবদার এই কবিতাগ্রন্থটির ভেতর সুস্পষ্ট একজন ঈশ্বরী আছেন। এই যে বইটির কথা বলছি, অভ্র ও আবির , অন্তত এই বইটির ছত্রে ছত্রে সেই ঈশ্বরীকেই  আমরা প্রত্যক্ষ করি বারবার । দেখি, তাঁকে ছোঁয়ার চেষ্টা, বোঝার চেষ্টা, কখনোবা তাঁকে লুকোনোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন কবি। অথচ যে প্রথাগত প্রেমের কবিতা আমরা এতদিন ধরে চিনি, এ হয়তো সেই প্রেমের কবিতা নয় ! বরং কোনো বৃহত্তর জীবন প্রেমের দিকেই  আমাদের নিয়ে যেতে চান তিনি। আর সেই সম্পর্ক উন্মুক্ত করতে গিয়ে, তাঁকে, সেই ঈশ্বরী অথবা দেবী, তাঁকে এক অপার রহস্যে আড়াল করেন । অথচ মানুষের ছদ্মবেশে  সেই দেবীই কবিতার মধ্যে ফিরে ফিরে আসেন, এক রহস্য-আঁধার রচনা করেন।

যতবার কাছে যায়, থেমে যায়
                      দূরে গেলে গান বেজে ওঠে
এ কোন্ ঘুমন্ত স্বপ্ন, কুহেলিকা, মানুষের ছদ্মবেশে
                                               খেলে
লুকোচুরিযে যাকে পাবে না তার সঙ্গে গিয়ে ফিরিয়ে আনবেই
যতবার কাছে যাই নিথর গলার স্বর, মৃদু শ্লেষ্মা, ভিজে নি:শ্বাস
যতবার সরে আসি সুবাতাসবাগেশ্রী সাধে কণ্ঠধ্বনি
                যে যাকে পাবেই তাকে দূরে ঠেলে দেয়

   আর সেই আঁধার-রহস্যের ভেতর আমাদের ছোটো ছোটো ব্যাথা-কাতরতা, বিষন্নতা অথবা শুধুই নীরবতা কোথাও বা ঘনিয়ে ওঠে আমাদের মনের ভেতর। তাকে ফেলে দেওয়া যায় না, আবার বয়ে বেড়ানোও যায় না। ভারী লাগে। বোঝা দুর্বহ হয়ে ওঠে কখনো। তখন সেই বোঝা কোথাও নামানো প্রয়োজন। কোথায় নামাবো সেই বোঝা? একলা পথে নামা মানুষ, কার হাতে সেই বোঝা দুদন্ড রেখে জিরিয়ে নেব? তখন সেই বোঝা আজীবনের সঙ্গী হয়ে যায়। মানুষ ধীরে ধীরে তাকে ভালবেসে ফেলে। আমাদের বিষন্নতাগুলি, ব্যাথাগুলি নুপুরের নিক্কনের মতো, কখনো বা স্তব্ধতার মাঝে বেজে বেজে ওঠে।

তাকে নয় তার মন চাওয়াসেই
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গরব,
                  মনোবলে মনোবলে ভেঙে যাওয়া
হয়তো এমন হিমশৈলে পরশের সাধে নিজেকে ভাসিয়ে
                           শোভা দেখা
দুই কূল, ফেনা, লবনাক্ত জলের রহস্য

স্বপ্নে দেখা জনপদ, ধু ধু হাওয়া, পরিত্যক্ত জেটি
    সেখানে দাঁড়িয়ে ছায়ামূর্তির মতো তুমি ডাকো
                                      আমার ক্রন্দন
  সেই নিক্কনের সুর ভেতরে নিয়ে একজন একলা মানুষ,  এক অজানা মনখারাপের ভেতর হেঁটে যাচ্ছেন। কোথাও জিরিয়ে নিচ্ছেন অল্প। তার অর্থ এই নয় যে তিনি পরাজিত কোনো প্রাণ। বরং জয়ী হবার কোনো বাসনাই তার ছিলো না কখনো। তার অর্থ আবার এ-ও নয় যে তার জীবনে কোনো যুদ্ধ ছিলো না। বরং সেই যুদ্ধে বারবার পরাজয়ই এক রহস্যময় জয় এনে দিচ্ছে তাঁকে। এই এক অসামান্য বোধ নিয়ে সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা হেঁটে চলেছে।

অনেক হেরেছি
                গ্লানি এসে বসে আছে মনের বেদীতে
এই যদি জীবনচণ্ডিকা
                 পূজা দিই বিক্ষোভের ছলে,
                                   অসাড় জয়ের ব্রত মেনে
একথা জানে না কেউ জয় আমার প্রাণের দেবতা...

   যদিও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা হেঁটে যাওয়া’—কথাটা বড় বানানো মনে হয়। বড় বেশী কাব্য-সাহিত্য আলোচনার মতো । আসলে তাও না। সুদেবদা থাকেন সেই বেহালার দিকে। শুনেছি সেখান থেকে রোজ তার কর্মস্থল পাড়ি দিতে হয় অটো-বাস-ট্রেন নানা রকম যানে চড়ে কলকাতা শহরটাকে মাঝামাঝি দুভাগ করে অন্য প্রান্তে আরো দূর চলে যেতে হয় । সারাটা পথ তো কবিতার খাতার সফেদ পৃষ্ঠা নয়! আমি ভাবি, ঐ দুরন্ত ভীড় ঠেলে পথ ঠেলে একজন মানুষ চলেছেন। তাঁর মাথার মধ্যে কিন্তু কোনো ভীড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই , চিৎকার হুল্লোড় নেই, হয়তো ট্রেনের চাকা আর রেলের ঘর্ষণ জনিত ধ্বনি, জানলা দিয়ে বাওড়ের বাতাস, তাঁকে এক অন্য আবহ, এক শান্ত কোলাহল, অন্য এক ঘোর এনে দিচ্ছে

 এই ঘোর, তুমি সেই ঘোরের প্রস্তুতি
তোমার দৃষ্টি দিয়ে সাজিয়েছি তন্ময়তা
                  শ্রুতি দিয়ে স্তব্ধতার সাজ
সংকোচ ভেঙে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চুমকি গুলি
          একে একে তুলে নিয়ে লজ্জা-ও সাজায়

গভীর গহন দিনে ঢাকা-পড়া সজ্জিতকরণের কাজ
              প্রতিপদে সন্ধ্যায় সব খুলে যায়

   একটা যাত্রা, একটা গমন, টের পাওয়া যায়, শেষ পর্যন্ত। কোনো বিশেষ একটা কবিতায় হয়তো নয়। সমগ্র গ্রন্থ, অথবা একজন কবির জীবনী জুড়ে তবু ধীরে ধীরে সেই যাত্রাপথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্রমশ। যেখানে যাত্রাটাই মূল হয়ে ওঠে, পথই যেখানে মঞ্জিল, উদ্দেশ্যের চেয়ে তার পথ, পথের পারিপার্শ্ব, গল্প পার হয়ে একটা প্রস্তুতি


 এরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে তোমার বাড়ি
                     --এটাই তো দারুণ

রাস্তাই পাড়, পাশ দিয়ে নদী
নদীর জলের ঢেউতোমার স্মৃতি
                চিক চিক করছে, কখনো তোমার অশ্রু মনে হয়

ঢেউ দিয়েঢেউ দিয়ে তুমিও থামিয়ে দিচ্ছ ছলাৎছল
                রাস্তার গতি, আমি যাচ্ছি

অপরিকল্পিত এই পাড়-ভাঙাতুমি প্রস্তুত হয়েছো?

  ২০১০সালে সুদেবদা যখন এই কবিতাগুলি লিখছেন, তখন তিনি পঞ্চাশ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর সেই প্রথম কবিতা পুস্তিকাটি বাদামী কুঁজোর কথা তিনি ফেলে এসেছেন বহুদূরে। সেখানে যে কবিতাগুলি ছিলো, সেগুলি যখন লিখছিলেন তখন আমাদের পরিচয় ঘটে, সেটা আমার শহর বিষ্ণুপুরে। সেই সমস্ত বইটি জুড়ে বিষ্ণুপুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এই অভ্র ও আবিরে এসে কবির যাত্রাপথ একটা কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, তাঁর পরের গ্রন্থ পঞ্চানন্দ খ্যাপার থানে তে  হয়তো একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে। পরে সেই কথা কোথাও বিস্তারিত বলার ইচ্ছে থাকলো।

অভ্র ও আবির ।। সুদেব বকসী ।। ২০১০ ।। সপ্তর্ষি প্রকাশন ।। কলকাতা ।।

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

উজানি কবিতা : ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা (কবি গৌতম চৌধুরীর কবিতার পাঠ)




উজানি কবিতা : ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা  (একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া)

(কিছু দিন পূর্বে এক কর্মপোলক্ষে কলকাতা সহরে গিয়ে টেলিফোনে অগ্রজ কবি গৌতম চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি টেলিফোনে তাঁর বাড়ির সহজ পথ, বাস, রুট পথের নাম ইত্যাদি বলে বলে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন উত্তর-কলকাতা থেকে হাওড়ায় তাঁর বাড়ি যাওয়া কতটা জলবরাবর। আর আমার মাথা ততই গুলিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ঠিক হল রবীন্দ্রসদন, ঐ জায়গাটি আমার পূর্ব পরিচিত। এবং সেদিন বিকেলে তাঁর ক্ষীণ কন্ঠ এবং আমার প্রায় বধির বাঁমকর্ণের  ও কলকাতার ভীড়ের অপূর্ব কলকাকলির মেলবন্ধন সহ সেদিনের চা-চক্র প্রায় চক্রান্তে রূপান্তরিত হলেও এক সুন্দর বিকেল অতিবাহিত হয়েছিল । পরে বাড়িতে ফিরে দেখা গেল তিনি আমায় যে সব উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সদ্য প্রকাশিত এই বইটিও রয়েছে।–“উজানি কবিতা)




কালান্তক, কেন মেল গ্রাস
      এ-জীবন বড় ক্ষুদ্র                আদি অন্তে নাহি সূত্র
বহে কাল মহা রুদ্র
নিরখিয়া মনে লাগে ত্রাস
...
   ... আমি  আশ্চর্য হয়ে পাঠ করি আর দেখিপ্রতিটি উজানি কবিতার ভেতর এক তৃতীয় সম্ভাবনা রুদ্ধ রয়েছে ।  যে সম্ভাবনা প্রকৃতার্থে অসম্ভাব্যের শিল্প । যেমন প্রতিটি জগত-অণুর মধ্যে রয়ে গেছে ব্রহ্মাণ্ডের আশ্চর্য রেপ্লিকা। সেই খবর জগত অথবা অণুর গোচর নয় কখনো। আর এই সমগ্র বিশ্ব-জগতও তো সেই অসম্ভাব্যের শিল্প মাত্র। যা হওয়ার ছিলো না, যা হওয়ার কথা কোথাও লুকানো ছিলো না, অথবা যা হয়ে ওঠাই ছিল একমাত্র নিয়তি, তাই অসম্ভাব্যের শিল্প! কে আমার পিতা-মাতা, কে আমার সন্তান? কেন তারা আমারই পিতা-মাতা-সন্তান, আমায় কে বলে দেবে ? জগত মূলত তাই...    
   একদিন একটা ধূমকেতু সূর্যের শরীর ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ব্রহ্মা তাঁর বাঁমহাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নেওয়া সূর্যের খানিকটা ছিনিয়ে আনলেন। সে-ই আমাদের সৌর জগত! সেখানে একটা অতি সাধারণ টুকরো তিন নম্বর স্থানে তার জায়গা করে নিল। সূর্যের আলো উত্তাপ রোদ শৈত্য সমস্ত মিলে সেখানে একটা অশ্চর্য রামধনু তৈরী করল। আর সে নিজে সাড়ে ছেশট্টি ডীগ্রি হেলে রইল, জল বাতাস মেঘ মাটি আর মহা সমুদ্র তৈরী করল। সেই অতি সাধারণ খণ্ডটি আর সাধারণ রইলোনা! কেন? এই হল সেই অসম্ভাব্যতার শিল্প। এসব না হলেও চলত, তবু হল...।
  উজানি কবিতাগুলিতেও রয়েছে সেই তৃতীয় মাত্রার ইঙ্গিত। কবি ও কবিতা নিরপেক্ষ এক অসম্ভাব্যতা, যা সূক্ষ্ম ও দৃঢ় প্রতিষ্ঠ।

    উজানি কবিতা একটি কাব্যগ্রন্থের নাম। সেখানে একাধিক অধ্যায় রয়েছে। যেমন একটি অধ্যায়--ও মাঝি, সুন্দর মাঝি। কোনো এক মাঝি কে উদ্দেশ্য করে রচিত এই কবিতাগুলি যখন আমরা পাঠ করি, তখন মনে প্রশ্ন জাগেকে এই মাঝি? দুর্গম গিরী কান্তার মরুর সেই কান্ডারীই কি এই ছদ্মবেশী আপাত শান্ত সুন্দর মাঝি? নাকি সে অন্য কেউ অন্য কোনো আকাশগঙ্গার দেশের চির রহস্যাবৃত কোনো নাও-এর আঁধার নাইয়া ? পাঠমাত্র দ্বন্দ তৈরী হয় । দ্বন্দ সঙ্গত কারনেই, কারন উজানি কবিতার কবি আমাদের পূ্র্ব পরিচিত গৌতম চৌধুরী। যেহেতু জানি সেই অমায়িক, শান্ত, ক্ষীণকণ্ঠী সত্তর দশকীয় ঋজু শালবৃক্ষের ন্যায় কবিটিকে। যিনি একদা বাংলা সংস্কৃতির জগতে বিপ্লব ঘোষণা করেছিলেন। এবং তাঁর সতীর্থরা অনেকেই কালের স্রোতে নানান চরভূমিতে ঠেকে গেলেও যিনি আজো সমভাবে সঞ্চরণশীল এবং গতিময়। তাই তার উজানি কবিতা পাঠ কালে তাঁর পূর্ব পরিচয়ও মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে মানসপটে।  এবং কবিতাগুলি আমাদের এক চরম ও এক অন্যতর পরম প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় কখনো কখনো।

...
সপ্তঋষি ফেলে ছায়া      ভাসে নৌকা মহা মায়া
সুন্দরিয়া মাঝিরে বোলাই
ওগো মাঝি, ও অপার     লুক্কায়িত কেন আর
দেখা দাও, জ্বালো দিয়াশলাই
জ্বলাই গোপন টেমি    কেঁপে ওঠে চক্রনেমী
সেই ঘোর আবর্তে ঝাঁপাই
এই হল সেই পরম দ্বন্দ! একদিকে ঐ-- সপ্তঋষি ফেলে ছায়া / ভাসে নৌকা মহা মায়া / সুন্দরিয়া মাঝিরে বোলাই / ওগো মাঝি, ও অপার...  এই অপারের হাতছানি ।
      অন্যদিকে আবার মাঝি যেন এই পৃথিবীর মাটির ঘরের কোনো মুশকিল আসান মানুষ। যে আমাদের পথ দেখাবে অন্ধকারে --    লুক্কায়িত কেন আর / দেখা দাও, জ্বালো দিয়াশলাই / জ্বলাই গোপন টেমি  /  কেঁপে ওঠে চক্রনেমী...   এই যে গোপন টেমি, এই যে দিয়াশলাই, এই যে চক্রনেমীর কেঁপে ওঠা, আর সেই ঘোর আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়া, আমাদের আরো কিছু প্রতীক ও অন্যতর কথা অবচেতনে মনে পড়িয়ে দেয় ।  মনে পড়িয়ে দেয়ইনি গৌতম চৌধুরী। সামাজিক সাম্যের দর্শনে বিশ্বাসী কবি ! তাই কি সর্প্তষির জিজ্ঞাসা ছাড়িয়ে, মহা তরঙ্গের দিকে নৌকা ভাসাতে গিয়েও তাকে ছেড়ে যায় না এই মহা মায়ার মতো প্রতীকগুলি ?

ভুলিনি কিছুই, ভুলে গেছি শুধু ইচ্ছে  
পেরিয়ে এসেছি দোজখের আভা মহাথির অণুবিশ্বে
চিনেছো আমায়?’—প্রশ্নের ছায়াগুচ্ছ
ঝরে গেছে ভাঙা মিনারে-দেউলে, তবু মৃদঙ্গ উচ্ছল
তবু সুড়ঙ্গ ছুঁতে চায় মহাপ্রান্তর...
  
    এই রচনা একান্তই পাঠপ্রতিক্রিয়া, কোনো আলোচনা নিবন্ধ নয়। একটি গ্রন্থ পাঠকালে মনান্তরালে যে আলো-ছায়া খেলে যাচ্ছিল, তার লিপিরূপ মাত্র।
    মনে হচ্ছে বহু দিক থেকে ঘুরে ফিরে এই গ্রন্থের কবিতাগুলির অবলোকন প্রয়োজন। যেমন কোনো প্রাচীন স্থাপত্যের, তার শরীরের কারুকাজ গুলির ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। কোথাও মাথা ভাঙা কোনো যক্ষীর মূর্তী আমাদের এক যুদ্ধ-ইতিহাসের কথা বলে, আবার কোথাও মানব মানবীর রমণ দৃশ্যে বিহ্বল হয়ে পড়িসেই রকম এক স্থাপত্য। যা বিমূর্ত, অক্ষরে মাত্র রচিত। এইভাবে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে আমরা মূল স্থাপত্যের কিছু দূরে এক বিমূর্ত প্রশ্নের নির্জন ভগ্ন চাতালে এসে দাঁড়াই। যার সাথে এই কাব্য-স্থাপত্যের হয়তো কোনো আপাত সম্পর্ক নেই। অথবা হয়তো কখনো ছিল...। শ্রেণী-সংগ্রাম যদি মানব প্রেমের একটি রূপভেদ মাত্র হয়, তাহলে ভারতীয় তথা প্রাচ্য আধ্যাত্মবাদ থেকে তা কতখানি দূরের পথ? নাকি একই লক্ষ্যের ভিন্ন পথ মাত্র? সেই প্রশ্ন
   জানি এটি একটি জতিলতম বিষয়। প্রশ্ন সেখানেই। কে এই সুন্দর মাঝি? তিনি কি কান্ডারী হুসিয়ারের কান্ডারীমাত্র, নাকি এই মহাশূন্য, মহাকাল, মহাকালসমুদ্রের ওপারে বসে থাকা আকাশগঙ্গার কোনো ভৌতিক (ভুতুড়ে নয়) কান্ডারী ?
   কেন এইরূপ প্রশ্ন? প্রশ্নের উপর প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মার্ক্সীয় মানব মুক্তি আর আধ্যাত্মবাদকে আমরা বরাবর দুটি ভিন্ন মেরুতে রেখেই অবলোকন করেছি। আর এদুটিকে মিলিয়ে ফেললে, গুলিয়ে ফেলা হয় বলেই জেনেছি। অথচ একটা বিষয় আমরা খেয়াল করিনি একদিকে লড়াকু মানব মুক্তি ও অন্যদিকে রমেন্দ্র সুন্দর কথিত ভারতীয় সূর্যাস্ত থেকে আত্মা বা স্পিরিট টুকু সরিয়ে নিলে যা পড়ে থাকে তা একই বস্তু, যা মূলত স্বার্থান্বেষী অনুশাসন মাত্র।
   অজাতশত্রু রাজা হল যবে পিতার আসনে আসি সেদিন কিভাবে পিতার ধর্ম শোনিতের স্রোতে মুছিয়া ফেলিল রাজপুরি হতে সেই কাহিনী আমরা জানি। বৌদ্ধ শ্রমণেরা মার খাচ্ছে, তাদের জীবিত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশি আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। স্তূপ ভেঙে জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে মন্দির। আর শ্রমণেরা টুঁ-শব্দটি করছেন না। এই স্তব্ধতাই প্রতিবাদ, --আত্মা, জেন, স্পিরিট...।
  কিশোর ক্ষুদিরামকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে স্নান করানো হচ্ছে। খাবার দেওয়া হচ্ছে। ওজন নেওয়া হচ্ছে। আর আশ্চর্য ভাবে লক্ষ করা হচ্ছে তার ওজন বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। তার মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, আর সে বলছে মনে মনে—‘মা আবার ফিরে আসবো তোর কোলে...।---আত্মশক্তি, স্পিরিট...
   আবার দেখা যাচ্ছে বলিভিয়ার জঙ্গলে একদল বিপ্লবী আত্মগোপন করে আছে। গ্রামাফোন শোভিত সুখীগৃ্হকোন ছেড়ে, রবিবারের মদ ও নিরুপদ্রব মাংসের জলসা ছেড়ে, পিতা মাতা স্ত্রী কন্যা এবং সংসারের যাবতীয় সুখের বালিশ ছেড়ে তারা কাঁটার উপর শুয়ে  আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে...কেউ তাদের জোর করেনি যদিওকি বলবো একে? স্পিরিট ছাড়া?

গিলে ফেলি দিন রাত্রিও করি পান
কামড়ে কামড়ে, চুমুকে চুমুকে, তাবৎ
ভাঙা হাড় গোড় ফেরি করি, সেরিবান
রক্তের মেঘে তবু জেগে ওঠে শ্রাবণ

অথবা

এই কি তবে সফর নামার নিরেট প্রাপ্তি
নীল আঁধারের ঝরনাধারায় রুদ্ধ
তবুও শূন্য খোঁজার ছলে শূন্যে লাফ দিই
হয়তো উড়াল মহাপাতাল অবধি

  এ শুধুই ভোগ অথবা দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ থেকে উৎসারিত যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না । যা অপরের জন্য, সত্যের জন্য মৃত্যুকে পর্যন্ত উপেক্ষা করতে শেখায়। জীবন উজ্জ্বল, উজাগর হয়ে ওঠে।
   উপরোক্ত কথা গুলি বার বার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে এলো উজানি কবিতার স্থাপত্য শৈলীর সামনে বসে থেকে। যা শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র এই জীবন থেকে এক মহাজীবনের দিকে, এক অনু থেকে এক মহাবিশ্বের (আক্ষরিক অর্থেই, মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের মাঝের যে কোনো শূন্য কালো বিন্দুটিও যে লক্ষতারার সমাবেশ, তা এই ক্ষুদ্র যতি চিহ্নের মতো মানব জীবনে বার বার ভুলে যাই) দিকে কেবলি যেতে চায়, আমাদের নিয়ে যেতে চায়।
      এ-জীবন বড় ক্ষুদ্র                আদি অন্তে নাহি সূত্র
বহে কাল মহা রুদ্র
...

   উদাহরণত, যে কোনো পাতা উল্টে যে কোনো রচনা পাঠককে পড়ানো যেতে পারে, আর কিছু নয়--

দুখানি বলদ ছুটে চলে যতিহীন
একটি আমার অমোঘ রাত্রি, অন্যটি ভাঙা দিন
সাথ কেঁদে মরে দুটি ঘুরন্ত চাকা
অমাবস্যার গহন আমার, আমারই পূর্ণ রাকা
অনন্ত ঘুমে নিচে শুয়ে আছে পথ
সে বুঝি আমারই শয়ন মুদ্রাসন ধেকে সংবৎ
গ্রাম অরণ্য প্রান্তর নদীতীর
চলেছে শকট স্বপ্নে আমার উন্মাদ গম্ভীর
সঙ্গে চাবুক, লণ্ঠন, চিড়েগুড়
যা-কিছু আমার শৃঙ্খল আর মুক্তির অঙ্কুর
সবই আছে, তবে আরোহীটি কিনি বটে ?
কেউ নেই শুধু ছইয়ের আড়াল, কিংবদন্তি রটে...


(গ্রন্থ: উজানি কবিতা / কবি: গৌতম চৌধুরী / মনফকিরা / ২০১৪)