মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

লাল দোপাট্টা মলমল কা : এণাক্ষী রায় (একটি ছোটগল্প)

লাল দোপাট্টা মলমল কা

ম্যাকোর বাড়ির মেয়েদের দু’পয়সায় সূর্য ঠিকরে যেতে যেতে বুকের ওপর নেমে আসে দু’দুটো চাঁদ। সুদ কষার অঙ্ক থেকে আতঙ্ক ছড়ালেও, অঙ্কবইতে মাসিক শব্দটি ঘিরে গোল দাগ পড়ে নটরাজ পেন্সিলের। টুং টুং শব্দে সাইকেল বেজে যায়। ঠাকুর ঘরের ঘণ্টাধ্বনি থেকে আলাদা সেই শব্দের ওপর ম্যাকোর গলা চড়ে। বজ্জাত, খচ্চর, বোকাচোদা।
ওরা চার বোন, চার সুন্দরী। সীমা, রিনা, শীলা আর নীলা।

রূপছায়া সিনেমা হলে একের পর এক রূপকথা খুলে যায় ব্যালকনির পাঁচসিকার টিকিটে। লাভ স্টোরির কুমার গৌরবের আদল যেন চোখে মুখে মেখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বেপাড়ার ছেলেরা। ম্যাকোদের বাড়ির দাওয়ায় সাইকেল নিয়ে আসে কুমার গৌরব। শীলা নীলা দুজনের মধ্যেই একঢাল চুলে বিজয়েতার ছায়া, বড়দি সীমা ওরফে রেখার মুখে ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন, তার প্রত্যেকটি বোরোলীনের ফোঁটার নিচে একেকটা ব্রণর আভাস লুকানো থাকে মুখ জুড়ে। শীলা কিম্বা নীলার চলাচলের পথে লাল রঙের নিচু সাইকেলে কানে ওয়াকম্যানের তার-গোঁজা কুমার গৌরবের ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে। সাইকেলটা দেখতে দেখতে হেলিকপ্টার হয়ে নেমে আসে মাঠ ঘাট পেরিয়ে শীলা নীলাদের দাওয়ায়। ম্যাকো চেঁচায়। লাভস্টোরি লাভস্টোরি। নদীর ধারের ভ্রমণে বিজয়েতার পিঠে গেঁথে যাওয়া কাঁটা মুখ দিয়ে তুলে নেয় কুমারগৌরব। শীলার মিষ্টি মুখের দিকে অপলক চাইতে চাইতে বলে –
এক হাতকড়ি মে বান্ধুঙ্গা তুঝে।
ঘাড় কাত ক’রে মিষ্টি হেসে বিজয়েতা বলে –
ফির?
- ফির হাম দোনো কো কোই আলগ নেই কর সাকতে।
- দুনিয়া বড়ে জালিম হ্যায়। চলো ভাগ চলে।
- চলো
দুহাত বাড়িয়ে বিজয়েতা দৌড়ে আসে
- ম্যায় আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি
- আ যা। কুমারগৌরব হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় শূন্যে।

রূপছায়া সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা মুখে তখন রূপকথা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ভোরের শিশিরের মতন। ন্যাপথলিনে মোড়া সোয়েটারগুলো রোদে বেরতে না বেরতেই শীলার রঙবেরঙের পঞ্চতে রোদ্দুরের ওম লেগে যায়। কুমার গৌরবের নিচু লাল সাইকেল হেলিকপ্টার হয়ে তখন বাতাসে। শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়া আর আটকাতে পারে না কেউ।

শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়ার খবরের পর, বড়দির ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন শুকিয়ে গেলেও একাধিক অমিতাভ বচ্চনরা ভিড় ক’রে থাকে। বড়দির কোঁকড়ানো ঘাড় অব্দি চুল, সাপের ফণার মতো রোদ মেখে নিলে। কমলালেবুর খোসা ছাড়ায় একেকজন অমিতাভ। দেখা এক খোয়াব কি হ্যায় সিলসিলে হুয়ে পার হয়ে খুন খারাপি রঙ ছুঁয়ে দেয় ভরাট গলার গান, রঙ বরসে ভিগে চুনারিবালি রঙ বরসে...

শীতকালীন একঘেয়ে বৃষ্টিতে আকাশ বাতাস জুড়ে অন্ধকার নেমে এলে নীলার মনখারাপে বেতাবী রঙ লেগে যায়। টুংটুংওয়ালার ছেলেটা অনেকটা সানি দেওলের মতো তাকায় আজকাল। বিজয়েতা থেকে অমৃতা সিং হতে হতে পার করতে হয় মাত্র দুটো বছর। পাহেলগাওঁয়ের খামারবাড়ি থেকে সাঁ ক’রে নেমে যাওয়া নদীটা নেমে আসে পলাশতলির মাটিতে। চিলেকোঠার ওপর থেকে, আ যা আ যা বলে চিৎকার করলে, তিন বার ফিরে আসে বাতাস, সেই সঙ্গে কানে আসে টুং টাং ধ্বনি।
টুংটুং টুংটুং শব্দ হলে নিজেকে আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখা যায় না।। টুংটুং করতে করতে শব্দটা এক সময় থেমে যায়। তখন যেন একটা স্বস্তি, কিছুটা সময় পেয়ে যাওয়ার। শব্দটা আবার সচল হতে হতেই দৌড় দৌড়। পৌঁছনো চাই শব্দের কাছে। ঠিক ঠাকুরঘরের বড় পিতলের ঘণ্টাটার মতো এর ঘণ্টাটা। দুপুরগুলো পলাশতলি রোডের মতো দীর্ঘ হয়ে যায় ছুটির দিনগুলোয়। ঠিক সেই সময় ঘণ্টার শব্দে পূজাপার্বণের কথা মনে পড়ে না। চারদিকে কিরিকিরি করা গোল সূর্যের মতো দু’পয়সা, ছ’কোণা তিন পয়সা, পেলেই দে ছুট। কদাচিৎ চারকোণা পাঁচ পয়সাও পেয়ে গেলে, হাতে স্বর্গরাজ্য এসে ধরা দিয়ে যায়। সেই পবিত্র ঘণ্টাধ্বনি থামিয়ে দিতে দু’পয়সার সূর্যালোকই যথেষ্ট।
ঘন্টাওয়ালা মাথা থেকে নামায় কাচের বাক্স। ঘাড়ের থেকে নামিয়ে আনে বাঁশের মোড়ানো স্ট্যান্ড। সেটা অদ্ভুত কায়দায় খুলে যায় মোড়ার মতো। তার ওপর সেই বাক্সটা। বাক্সটার মাথার ওপর বসানো লোহার শিকে গোঁজা সাদা কাগজের টুকরোগুলোই আসল। দু’পয়সায় দুটি কাগজ ছেঁড়ার অনুমতি পাওয়া যায়। দু’পিঠ- সাদা সেই কাগজগুলো ভেজানো হয় বাক্সের ওপরেই। বোতল থেকে সামান্য জল ছিটিয়ে তার ওপর চেপে ধরলেই ফুটে ওঠে সংখ্যা। ১ ২ ৩ ৪। যার যত সংখ্যা, তার হাতে ঘণ্টাওয়ালা ধরিয়ে দেবে ততগুলোই ঢ্যাপের মোয়া। হাল্কা, ফুরফুরে, মিষ্টি। ম্যাকো চেঁচায়। এমা দুই দুই দুই। এমা তিন তিন তিন। ম্যকো চেঁচায়। খচ্চর, তুই খচ্চর, বোকাচোদা। ঘরের পাশে ওদের কাঁচা নালায় পেচ্ছাবের গন্ধ বাতাস ভারি ক’রে রাখে। টুংটুংওয়ালার চোখে সানি দেওলের হাসি।
- জিনে কে লিয়ে দো বখত কে রোটিই কাফি। আগর পেয়ার হ্যায় তো সমঝ সব কুছ হ্যায়।
- ফির ভি তুম বড়ে বাপ কে বেটি। মেরে পাস কুছ ভি নেহি হ্যায়। সোচ লো।
- পেয়ার দৌলতসে নেহি বনতি। মেরি জান।
- চলো সাদি কর লে
- চলো।
নদীটায় সরাৎ করে নেমে যাওয়া কাঠের পাটাতনে খুলে রাখা থাকে জামা কাপড়, দোপাট্টা। সাঁতার-পোশাক পরে নদীতে নামে অমৃতা সিং আর সানি দেওল।

ভেঙ্গে পড়া জমিদারি থেকে অবশ্য কোনও হুংকার আসে না আমজাদ অথবা শাম্মি কাপুরের। সেখানে চুরুটের বদলে, পড়ন্ত জমিদারির ধিকি ধিকি আয় থেকে বেরিয়ে পড়তে থাকে নিষ্ফল ধোঁয়া। পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেওয়া দুই পুরুষের বদহজমের ঢেকুর তোলে একতলা বাড়িটি। সবটাই যেন গা-ছাড়া। স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া সংস্কার, রুচি, শালীনতা।
মেজদি রিনার চকচকে ফর্সা মুখ থেকে আলো পিছলে পড়ে। গালের কালো আঁচিল সে-আলো বাড়িয়ে দেয় হাজারগুণ। রিনার আঁচিল ঘিরে সারাদিন ভিড় করে লোকজন। সেখান থেকে কয়েকটি তির তুলে নেয় বড়দি সীমা। আরও দু’একটি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ে যায়। রিনার সুদূর নিমগ্ন গান বেয়ে উঠে আসতে গিয়ে পিছলে পড়ে কেউ কেউ। সুরের রেশ তার কালো চুলের মতো এলো করে দেয় রিনা। তার চোখে স্বপ্ন লেগে থাকে। মাটির অনেক ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে সে সুরের কাছে পৌছে যায়। এক এক সকালে ঘিরে ধরে আলো। নীল মেঘের ফাঁক দিয়ে বরফের পাহাড় দেখা গেলে মনে পড়ে, ওরা কোনও দিন শহরের গণ্ডি পেরয়নি। মেজদি রিনার ওই পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কোনও অমিতাভ মিঠুন নয়। সে অপেক্ষায় থাকে রাজপুত্তুরের। তার যাবতীয় প্রেম ঘনিয়ে ওঠে ম্যাকোকে ঘিরে। ম্যাকো ডাকে খেতে দে খেতে দে। রিনার আদরে আদরে বিপর্যস্ত ম্যাকো বলে খচ্চর। খচ্চর শব্দটা দু রকম করে বলতে পারে ম্যাকো। প্রেমে আর রাগে। কাউকে বলে দিতে হয় না কখন কোনটা।

এই সব সত্যি ঘটনাগুলো পরপর সাজালেও যে- ছবিটা স্পষ্ট নয়, সেটা হল পড়ন্ত এক জমিদার বাড়ির সিঁদ কেটে ঢুকে পড়া অসহায়তা। বিষদাঁত ভেঙ্গে নেওয়া সাপের মত এ-বাড়ির পুরুষেরা একের পর এক জমি বিক্রি করে যায়। একটু একটু করে নিঃশেষ হতে থাকে একটা প্রজন্ম। জমিদারবাড়ির ছেলেরা বাসের কন্ট্রাক্টরি করে। কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। কাঠের চুলায় ভাত চাপায় পড়ন্ত জমিদার গিন্নি। গিন্নির ফাঁদি নথ নাড়ানো তিরস্কার, ফসিল হয়ে যায়। সোনার সুতোয় কাজ করা পুরনো বেনারসি বিক্রি ক’রে কেনে লিপস্টিক, পাউডার। একেক খণ্ড জমি বিক্রির পর ওরা মাংস ভাত খায়, মাছ খায় পর পর সাত আট দিন। বাড়ন্ত চেহারাগুলোয় জৌলুস ওঠে। বড়দির পাতলা ঠোঁটে অন্য বাড়ির কনে সাজানোর আলো। বোরোলীনের ফোঁটায় দুপুরগুলো সাজিয়ে বসে মাঠে। উল বোনে। লম্বা ঝুলের সোয়েটার।
সাইকেল আরোহীরা সব শহরের বাইরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে। চার বছর পরপর বদল হয় মুখ। চার বছর পর পর নতুন আশ্বাস। বড়দি সীমার থেকে ক্রমশ বয়সে ছোট হয়ে আসে সাইকেল আরোহীরা। রিনারও বয়স ছাড়ায়। রাজপুত্তুরের জন্য অপেক্ষায় থাকে রিনা। তার কাঁধে চড়ে ঘোরে ম্যাকো।
সন্ধে থেকে আধো অন্ধকার হয়ে থাকে মফস্বলের পাড়াগুলো। নীলার বেতাবী মিটে যাওয়ারও পর একদিন। কয়ামত সে কয়ামত অব্দি দীর্ঘ হয়ে যায় কমলাপুর জঙ্গল। রিনার গানের রেশ আর দূরের আবছায়া পাহাড় মিশে যেতে যেতে কনকনে হিম পড়ে পলাশতলির মাঠে। একেকটা গানের সঙ্গে আছড়ে পড়ে একেকটা সময়। বায়স্কোপের চৌকো ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে পড়ে হারিয়ে যাওয়া একপাটি জুতো। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে পাহাড় স্পর্শ করিতে ইচ্ছে হয় রিনার। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সীমার প্রস্তাবে, কোনও এক সাইকেল-আরোহীর উৎসাহী অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলে– “যেতে পারি কিন্তু ও আমাকে টাচ করবে না!"

পাহাড়ে যাওয়ার আগে একটা একটা করে নদী পেরতে হয়। নদীর মনখারাপ থেকে শীতের সকালে উঠে আসে ধোঁয়া। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে চুল বাঁধে মেজদি রিনা। সকাল থেকে বিকেল একটাই রঙ হয়ে থাকে মেঘলাদিনে। যেন দীর্ঘ একটি বিকেল থেকে রাত নামে। অন্ধকার ঘনায়।
অন্ধকার ভালোমতো ঘনালেও ম্যাকোর চিৎকার চুপ করে থাকে। ওপাশের বাড়ির পুজোর ঘণ্টা থেমে যায়। এ-পাশের বাড়ির পরীক্ষার পড়া শোনা যায়। ম্যাকোর গালাগাল চুপ করে থাকে।
অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। সাইকেলের সমবেত ঘর্ষণ থেমে গেলে, মেয়েটি দৌড়াতে থাকে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে, নদীর চরটা যেন বড় বেশি দীর্ঘ। জলের কাছে পৌঁছাতে চায় মেয়েটা। জল সরেই যায় ক্রমাগত দূরে ...
নদীর ওই পারে আবছায়া পাহাড়ে তখন একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে আলো।

দেহ ঘষ্টে ঘষ্টে রাত্রি নামে শুকনো কাশবনে। চারদিকে ভয়াবহ সব আওয়াজ। শেয়ালের ডাক। মেয়েটি আকাশের দিকে তাকায়। কত তারা আকাশে, কিন্তু কত দূরে। কোনও আলোই এই গভীর বনে এসে পৌঁছায় না। এক ফোঁটা আলোর জন্য মেয়েটা ঘষ্টে যায় নিজেকে। জলের কাছাকাছি, জীবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চায়।
আলো, আলো, অন্ধকারে শুধু আলোর কথা ভাবে। মাথার ওপরে কোনও চাঁদ নেই। সিগারেটের টুকরোগুলো জ্ব’লে-নিভে দূরে সরে গেছে। অন্ধকারের রঙ বদলায়। বদলাতে থাকে। জলের কলকল ধ্বনি তীব্র হয়। অন্ধকার থেকে ফুঁড়ে ওঠা কাশে আটকানো লাল দোপাট্টা ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ে মেয়েটির ওপর। ঝরে পড়ে একটি আলোক বিন্দুও।
স্পষ্ট হতে থাকে সেই মেয়ে। তার পরনের সাদা গাউন সাদা পতাকার মতো ঝুলতে থাকে শুকনো কাশবনে। দ্যাখে অনেক দূরের পাহাড়ের আলোকবিন্দুকে। আলো একটার থেকে আরও বিন্দু হয়ে যায়। দূরের পাহাড় থেকে উপড়ে আসা আলো হাজার হাজার জোনাকি হয়ে ঘিরে ধরতে চায় মেয়েটিকে। গোটা পাহাড়টাই আলো সমেত এগোতে থাকে যেন। কুয়াশা সরিয়ে সকাল এলে চোখে পড়ে ওর ফর্সা চকচকে গালে তীব্র কালো তিল, জোনাকির আলোর মতো জ্বলে উঠছে।
অনেকটা দূরে মফস্বল শহরে তখন ম্যাকোর সবুজ পালকে ছিন্নভিন্ন রোদ। পাশের নারকেল গাছের গোড়ায় ঘাড় মটকানো টিয়াটাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ায় সবুজ পালক উড়ছে। আর কাশবনে...
হাওয়ামে উড়তা যায়ে লাল দোপাট্টা মলমল কা। 

বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬

মাতৃমুখী (বাঁকড়ি ভাষায় লেখা একটি ছোটগল্প। কলেজস্ট্রীট পত্রিকায় প্রকাশিত)

মাতৃমুখী

কৌশিক বাজারী



আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ ।
সাইকেলে যেতে যেতে সারা পথ সে অং বং নানান কথা ভেবে ভেবে প্যাডেল ঘুরায়, শুকনা শীতের পথে লাল মিহি ধুলা উড়ে উড়ে যায় । তার হইলদা পাজামা আরঅ লাল হয়ে যায় বাঁকুড়ার মাটির আল-পথে , হাওয়াই চপ্পল মিহি ধুলায় ঢেকে যায় । পথ-জুড়ে আধ-মাইল লম্বা গরুর পালের মধ্যে পড়ে দিশাহারা হয়ে তার চুল পয্যন্ত ধুলায় মাখামাখি হয়ে যায় । সাইকেল ঠেলে লিয়ে কিছুদূর যায়, আবার চাপে,--এই হল তার পথ। ফাঁকা ধূ-ধূ দ্বারকেশ্বরের বালি ঠেলে ঐ পারে আরো পাঁচ মাইলটাক লাল-ধুলার পথ পেরিয়ে তবে পাকারাস্তা । সেই বড় রাস্তা ধরে আরঅ দু কিমি পথ পেরালে বিষ্টুপুর বাজার । ফাঁকা রাস্তায় হঠাৎ চেনা কেউ ডেকে তার সাড়া পায় নাই। লোকে তাকে আড়ালে বলে ক্ষ্যাপা। বলে; আটিস মানুষ । পঞ্চানন তখন আতাল পাতাল ভাবে , কি যে ভাবে, সে নিজেই জানে নাই। ভাবে; তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা, হারিয়ে যাওয়া বাপের কথা । ভাবে ; তারা কি আজঅ বেঁচে আছে! সেই তার দু-বছর বয়সে পালিয়ে যাওয়া মায়ের সামনে এই পঞ্চাশ বছর পর যদি দাঁড়ায় ? মা কি চিনবেক ? একটা বহুদিনের হইলদা হয়ে যাওয়া ছবি ছিল পালিয়ে যাওয়া মায়ের ফেলে যাওয়া টিনের তোরঙের ভিতর । বাপ আর মা। তারকেশ্বরে বেড়াতে গিয়ে ফটোঅলার কাছে তুলা ছবি । কাকি জেঠির সংসারে, তাদের মাটির বাড়ির উপরের কোঠার জঞ্জালের ভিতর হঠাৎ আবিস্কার করা সেই ফটো, লুকানো অতীতের অন্ধকার ছায়ায় সে লুকিয়ে দেখেচে অনেকদিন। কল্পনায় সেই হলুদ হয়ে যাওয়া ঝাপসা মায়ের মুখটায় দেখে সে ।

পঞ্চানন কর্মকার, তার বাপের দিয়া নাম । এখন তার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে যায় । পঞ্চাননের বাবারা তিন ভাই , তাদের কামারশালে লোহার কাজ ছিল নাই । ছিল কাঁসার কাজ। কাঁসার চাকতি আসত বিষ্টুপুরের গোলাদারের ঘর থেকুন । তারা অর্ডার দিত কাঁসার বাসনের । বাসন বলতে শুধু থালা । কাঁসার চাকতি পিটিয়ে থালা বানানো ছিল তাদের ঘরোয়া ব্যাবসা । পঞ্চাননের বাবা কাঙাল কামার ভাইদের মধ্যে মেজ । থালা তৈরি হয়ে গেলে থালার চারপাশে ফুল, লতা, পাতা আঁকা ছিল তার কাজ, এই কাজটা গাঁয়ে তার মতন আর কেউই পাত্তো নাই, উসব হাতুড়ির ভোঁতা কাজ তার পোষাত নাই, বিষ্টুপুরের বাজারেও কাঙাল কর্মকারের মিনা করা লাল-কালো ফুলকাটা থালার আলাদা কদর ছিল সেকালে। কামার পাড়ার অন্যরাও থালা বাটি বাসন-কুসনের আঁকা-জুকার কাজটা কাঙালকে দিয়েই করাতো। সবাই জানত কাঙাল একজন আটিস –সে থালায় ফুল কাটে, আর সইন্ধা হলেই তার দল বল লিয়ে চলে যায় দ্বারকেশ্বরের চড়ায়, শ্মশানকালীর মন্দিরে। সিখেনে তাদের মজলিশ বসে । কেত্তন গায় কাঙাল, তখন সে রাধা। কীষ্ট-ভাবে ভিভোর । তার সংসারে মন নাই । বৌ-টা দু বছরের ছেলাটারে রেখে সেই যে চলে গেল্যাক, তারপর থেকে কাঙাল উদাস হয়ে গেল আরঅ, ফুল-লতা-পাতার আড়ালে কাঙাল বৌ-এর মুখ আঁকত, ল্যাংটা ছেলাটা পাশে বসে বসে দেখত বাপের হাতের অস্তাদি। মাতৃমুখি ছা-টা কে দেখলে ভিতরটা হু-হু করে উঠত কাঙালের...। সেই ছেলা-- পঞ্চানন কর্মকার ।

উসব বহুদিনকার ঘটনা, পঞ্চাননের আবছা মনেও পড়েনাই আর । কাঁসার বাসনের দিন-কাল আর নাই । পঞ্চানন যখন ইস্কুলে, তখনি বাপটা বিবাগী হয়ে গেল । জেঠি খুড়িদের হাতে মানুষ। কাকা কিছুদিন পয্যন্ত ব্যাবসাটা চালিয়ে ছিল, এখন কাকার এক ছেলা টুকটাক কাজ করে, তবে শুধু কাঁসার কাজে আর ঘর চলে নাই , সাথে একটা পানের গুমটি চালায় । ইস্টিলের বাসন বাজারে আসার পরে পরেই কাঁসার বাজার নামতে নামতে শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু বিয়া, মুখেভাতের কাজঘর ছাড়া আর কাঁসার বাসনের কাটতি নাই । পঞ্চানন বাপের হাত পেয়েছিল, সেও আটিস। বিষ্টুপুর বাজারের মডান-আট-এ কাজ করে সে । সাইনবোড় আঁকা, ঘর সাজানো, বিয়াঘরের গাড়ি সাজানো ইসবের কাজ। সাইনবোড়ে মেয়া মানুষের ছবি গুলান পঞ্চাননের হাতে খোলতায় হয় ভাল, মালিক ছকরা তাকে দিয়ে ইসব কাজ গুলানই করায় । তা এইসবে তার চলেও যায় । ঘর-উঠান ভাগ হয়ে গেছে বহুদিন, তার বাপ যিখ্যানে কাঁসার থালায় ফুল কাটত বসে, সেটা এখন কাকার ছেলার ভাগে । একফালি ভাগের ঘরের লাগোয়া পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনি দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে লিয়েচে পঞ্চানন। একটায় ছেলা দুটা লেকাপড়া করে, লোকজন এলে বসতে দেয়, সে আর তার বৌ অন্যটায়, রাত্তে ঘুমায় । পঞ্চানন সকালে বেরিয়ে যায় সাইকেল লিয়ে বিষ্টুপুর ।

আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ । লালমেঘ বিকালের মতন ক্যানে !! ভাবতে ভাবতে পঞ্চাননের মন খারাপ হয়ে যায় । তার এই স্বভাবের জন্যি বৌ তাকে খোঁটা দেয়, বলে; মেয়ালি পারা লোক । অথচ তার এই মন খারাপটা সত্যি। হয়ত অকারণ, তবু পঞ্চানন সাতসকালে একটা ভর-ভত্তি বিকালের মনখারাপ লিয়ে নদীর নাবাল থেকে উঠে আসে...


***


উত্তরের দ্বারকেশ্বর থেকে সোজা উঠে এসে যে রাস্তাটা বিষ্টুপুরের ভিতর ঢুকেচে, ছোটো নদীর পুল পার হয়েই সেই রাস্তায় একটা চৌ-মাথা। এটা সোনামুখী মোড় । চা-দোকান, সাইকেল সারাই , ট্রাকের গ্যারাজ আর ট্রাক-ড্রাইভারদের লাইন-হোটেলে জায়গাটা সকাল থেকেই ভীড় হয়ে থাকে আজকাল । পূবে কইলকাতা ১৫০ কিমি, পশ্চিমে বাঁকুড়া সদর, উত্তরে সোনামুখী,দূর্গাপুর আর দক্ষিণে সোজা বিষ্টুপুর বাজার মাত্র ২কিমি । দ্বারকেশ্বরের দিক থেকে যে লোকটা সাইকেলে আনমনে রাস্তা পার হচ্ছিল, সে দেখে নাই কিছুই, কইলকাতার দিক থেকে একটা ট্রাক রাস্তার মাঝ বরাবর তার সাইকেল ঘেঁষে পার হয়ে পশ্চিমে বাঁকুড়ার দিকে চলে যায় ধুলা উড়িয়ে। চা-দোকানের , লাইন-হোটেলের, সাইকেল-সারাই-এর লোকজন হৈ-হৈ করে ওঠে । মোড়ের শিরিশ গাছের মাথায় বসে থাকা একটা ধূসর কাক তার রোজকার অভ্যস্ত উপর-তলা থেকে দেখে; লোকটা ঘাবড়ে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার মাঝ-বরাবর, আর লাল ধুলা-মাখা পিচের উপর নিপাট পড়ে যায়। কাকের দল কা-কা- হাহাকারে উড়ে যায় মিনিসিপালটির ভাগাড়ের দিকে। লোকজন দৌড়ে এসে তাকে ধরা ধরি করে হোটেলের দড়ির খাটিয়ায় শুয়িয়ে দেয়, জলের ঝাপটা দেয় মুখে, লাল ধুলা মাখা পা ধুয়িয়ে দেয় একজন, মাথায় কপালে জল দেয় , তার ভিজা মাথার চুল থেকে লাল ধুলা মাখা জল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা । লোকটা নড়ে না । তার বুকের হাপর নড়ে না । এমন সময়, সকাল আটটায়, তার মাথার উপর একটা লাল সাঁজ-বিকালের মেঘ নদীর দিক থেকে এসে থামে। তার মুখ গম্ভীর । থমথমা... ।

......


বিষ্টুপুর মহকুমা হাসপাতালে আনা হলে গম্ভীর ডাক্তার বাবু বুকে নল ঠেকিয়ে সামনের ভীড়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়; বাড়ির কেউ আছেন ? -- কেউ নাই । পকেটে কাগজ-পত্ত কিছু পাওয়া গেছে ?—উত্তর নাই... ।
এরপর একটা অজ্ঞাতপরিচয়-লাশ হতে হতে শেষবার ঘুরে দাঁড়ায় লোকটা...
শিবপদর ভাইরাভায়ের পেটে পাথর । হাসপাতালে ভত্তি আজ তিনদিন। হাসপাতালের সামনে বটতলে বসে সে বিড়ি টানছিল। কৌতুহলে ভীড়ের দিকে উঘু মেরে চমকে উঠে শিবপদ । ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে, চেঁচিয়ে উঠে ; পঞ্চানন ! ইত আমাদের গাঁয়ের পঞ্চানন-আটিস !
ডাক্তারবাবু চশমার ভিতর থেকে বলেন; ফোন আছে? বাড়িতে খবর দিন একটা, আর আমার সাথে আসুন...
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ বুক-পকেটের দড়ি বাঁধা মোবাইল ফোন বার করে পঞ্চাননের কাকাতো ভাই নিতাই কর্মকারকে ফোনে ধরে ।
আটিস-পঞ্চাননের খবরটা আধ-ঘন্টার ভিতর গাঁয়ে চাউর হয়ে যায় । একটা প্রায় অজ্ঞাতপরিচয় হতে যাওয়া লাশ তার বৌ, ছেলা আর গাঁয়ের-লোকদের ফিরে পায় আরবার।

.......

--ভালকরে দেখ , চিনতে পার ?

বিষ্টুপুর হাসপাতালের বারান্দায় কুকুর আর রুগীর লোকজনের ভীড় যাতায়াতের পাশে টিনের স্টেচারে শোয়ানো ময়লা সাদা কাপড়ে ঢাকা মুখটা খুলে দেয় লোকটা । ঘাড় হেলে আছে একপাশে । মাথায় চুলে লাল ধুলা মাখামাখি । কপালের পাশে জল শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে । সমীর দেখে তার বাবার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিলটা ঠিক সেরকম, যেমন বাবা ঘরে ঘুমিয়ে থাকার সময় । তার ভিতরটা আবার হু-হু করে ওঠে । চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসে ... কোনো কথা না বলে সে তার বাবাকে সনাক্ত করে ।

--নাম কি ?
--সমীর কর্মকার।
--বাবার নাম ?
--পঞ্চানন কর্মকার ।
--বয়স ?
--??
-- বাবার বয়স কত হইছিল ?
-- ৫৩-৫৪ ।
-- আর কে কে আছে ঘরে ?
সমীর পাশে দাঁড়ানো ইস্কুলে পড়া ছোটো ভাই ছোটনকে দেখায় । বলে; ঘরে মা আছে ।
হাসপাতালের ক্লার্ক চশমা তুলে একবার সামনের ভীড়টার দিকে দেখে লেয়।
--এদের সঙ্গে বড় মানুষ কে আছে ?
-- এই যে স্যার..
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ এগিয়ে আসে ।
--শুনুন, লাশ ফাড়াই হবেক, তারপর ডাক্তার বাবু সাট্টিফিকেট সই করবেক। অপঘাতের মড়া, বুঝতেই ত পাচ্ছেন, থানার সাট্টিফিকেট লিয়ে আসবেন। তবে বডি পাবেন । এখন ঘরে চলে যাওয়ায় ভাল, সবাইকার থাকার দরকার নাই । আর সব ঠিকঠাক হলে কাল সকালেই বডি পেয়ে যাবেন । এই যে দাদা, আপনি ইখেনে একটা সই করুন ত...


সমীর কলেজে পড়ে । ভাত খেয়ে সকাল সকাল রেডি হচ্ছিল। বেলার দিকে খবরটা পেয়ে তার অসাড় পা-দুটা কাঁপছিল বাবুই পাখির মতন, দাঁড়াতে পারছিল নাই । ঘর-ভিত্রে মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল । কাকিমা সারাক্ষণ মায়ের পাশেই ছিল। শিবপদকাকা আর নিতাইকাকা বাইরেটা সামলেছে । সে আর ছোটন সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে । এখন নিজেকে অনেকটা সামলে লিয়েছে সমীর, যেন্ এক বেলাতেই সে অনেকখানি বড় হইয়ে গেছে...। ছোটনের সবে আট কেলাস । তার শুকনা চোখ দুটা ফুলে আছে অবেলায়। ভায়ের দিকে তাকাতেই সমীরের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে আবার...



***


...সে নদীর নামোতে এসে আজো একবার উপ্রের দিকে চায় । ভাবে, এই পথেই কি তার ঘর ? রাতের কালো আকাশে ইধার থেকে উধার অবদি সাদা ধুঁয়ার মতন ছায়াপথ । প্রথম শীতের পরিস্কার আকাশটা তারায় ছেয়ে আছে । নদীর সরু জলের ধারা পা ডুবিয়ে পার হয় । উপারে গাঁয়ের আলো দেখা যায় বিন্দু বিন্দু । আজ কি একটু দেরী হয়ে গেল ? ঠান্ডা জলে পায়ের চেটা ডুবতেই শরীরটা কেমন হালকা হইয়ে যায় তার । সে ভাবে, মরণের পর শরীরের আর কুনু ভার থাকে নাই... নিজের ভাবনায় সে নিজেই ভয় পায় ।

রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে । গ্রামদেশে শীতের সাড়ে আটটা অনেক রাত । গাঁয়ের রাস্তার উপরে নিমতলার চাতাল, সিমেন্টে বাঁধানো । বহু পুরনো বিশাল নিম গাছটার ডাল-পালা মেলা ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকার হয়ে আছে । নিমায়ের সদরের ডুমবাতির আলো এসে পড়েছে পথ পেরিয়ে নিমতলা চাতালে । সেই আধো-অন্ধকারে কামার পাড়ার লোকজন, শিবপদ, গাঁয়ের আর কয়েকজনের একটা দল বসে ছিল, তারা কেউ পঞ্চাননের কথা ভাবছিল, কেউ মানুষের অন্তিম নিয়তির কথা ভেবে নিঝুম বসেছিল, কেউ শুধুই বিড়ি টানছিল। সমীর একবার ওদের চা দিয়ে গেছে কিছু আগে । শিবপদ প্রথম লক্ষ করে লোকটাকে , সাইকেল থেকে নামছে , সেই ধুলা মাখা গা, লালচে হয়ে যাওয়া পাজামা, ধুলি ধুসর পা। ঘরে ঢুকার আগে একবার নিমতলার জটলার দিকে অবাক হয়ে চায় লোকটা, রাস্তার আলোয় তার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিল দেখা যায়! পঞ্চানন ! শিবপদ থমকায়, যারা বসেছিল সহসা উঠে দাঁড়ায়, যে লোকটা বিড়ি টানছিল তার হাত পুড়ে যায় –পঞ্চানন ! নিতায়ের সদরের ডুমবাতি হাওয়ায় দপদপ করে উঠে কেরাসিন লম্ফর মতন নিমে যায়, আবার জ্বলে উঠে । শিবপদর গলার রা বন্ধ হয়ে গেছল, কুনু রকমে বলতে পারে-পঞ্চাদা ! এইসময় সমীর দুয়ারের বার হতে যেয়ে সামনে পঞ্চননকে দেখে প্রথমত কাঠ হয়ে যায়, তারপর বাবা বলে মাটিতে বসে পড়ে ।ঘরে ভিতরে ততক্ষণে খবর গেছে, সমীরের মা, পঞ্চাননের বৌ পাগলের মতন আধখুলা কাপড়ে সদরদুয়ারের চৌকাঠে এসে বসে পড়ে –আর এসব দেখে রীতিমত বিরক্ত ও ক্লান্ত পঞ্চানন ক্রমশ আরো ক্লান্ত হয়ে ওঠে।

আজ সকালে বিষ্টুপুর বাসস্ট্যান্ডে সাইকেল রেখে সে গেছল বাঁকুড়া সদর । কেরাণীবাঁধ বাইপাশে একটা ওয়ালিং এর কাজ ছিল । দুতলা ঘরের দেয়ালে শাড়ির দুকানের বিজ্ঞাপণ। মিনুশাড়ি পরা মেয়া-মানুষের দুতলা সাইজের ছবি । তিনদিনের কাজ । আটিস পঞ্চানন ভেবেছিল আজ আউট-লাইনটা সেরে রাইখবেক । দেরী হল একটু, দুটা বাস মিস্। এর মধ্যে কি এমন হল সে ভেবে তল পাই নাই...।

দিনভর উপাসী, চোখ-মুখ কালো হয়ে যাওয়া পঞ্চাননের বৌ খুব মিহি সুরে জিগ্গাসে
—‘হ্যাঁ গা, তুমি ফিরে আসতে পাল্লে থালে? ফিরে আসা যায় সিখ্যান থাকতে!’
পঞ্চানন রাগে, দুখে: বৌ-এর দিকে চায় ।


......


পঞ্চানন সমস্ত শোনে আর অবিশ্বাসে, ভয়ে, শিহরণে কেঁপে কেঁপে ওঠে । সমীরের দিকে ফিরে অস্ফুট ধমকের মতন বলে ; নিজের বাপ কে চিনতে লারলি আজ পয্যন্ত... !
শিবপদ আর গাঁয়ের আরো যারা সঙ্গী ছিল তারা পঞ্চানন কে বোঝায়; উয়ার দুষ কিছু নাই, উ ত ছেলা-মানুষ, আমরাও ভুল কল্লম ক্যামনে, বুঝতে লারচি রে ভাই...।

***

.... এদিকে পঞ্চাননের ঘর থেকে অনেক দুরে, মহকুমা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের সেই লোকটা পুনরায় অজ্ঞাতপরিচিতির দিকে চলে যায় । সে তার ভুল সন্তান, বৌ, পরিজন আর গাঁয়ের লোকদের সঙ্গ হারায় । পরিত্যক্ত, দাবিহীন, নি:সহায় লাশ হয়ে শাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে আবার শুয়ে পড়ে , লাশকাটা ঘরের অন্য বাসিন্দারা পাথরের মতন চোখে চায়, তাদের চোখে অশ্রু নাই , শুকনা, বরফ...
...সার রাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে ভোর-রাতে এই রকম একটা স্বপ্ন দেখে পঞ্চানন বিছানায় উঠে বসে । টিনের বালতি থেকে গেলাসে জল ডুবিয়ে খায় । সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও আজ তার ঘুম নাই চোখে । ভাবে; থাইলে কে সেই জন ? হুবহু আমারি মতন ? কুথা থেকে তার আগমন ছিল ? কুথায় বা গমন ? পঞ্চাশ বছরের জীবনে তার সাথে একবার মুখামুখি দেখা হল কৈ ? একবার কি দেখা হওয়া নিয়তি ছিল নাই ? তবে, সে কি আমিই ? সে আমি এখন কুথায় ? কুন সাদা কাপড়ের নিচে শুয়ে আছি কার অপেক্ষায় ?

আমার হারিয়ে যাওয়া মা কি তারও মা ? আমার বিবাগী বাপের খবর ছিল তার কাছে ?
সে কি আমার মাতৃমুখী দোসর কুন ?
মা কি জানে ? খবর পেয়েছে ?

পঞ্চানন উতলা হয়ে ভাবে; একবার যাওয়া দরকার । সেই মৃত অজ্ঞাতপরিচয়ের কপট অপরিচয় খুলে ফেলা দরকার । সে দরজা খুলে একটা অতিজাগতিক ভোরবেলার ভিতর বেরিয়ে আসে । দেখে ভোরের আকাশে সুয্যদেব উদিত হয়েছেন । এখন কুথায় তবে তিনি অস্তমিত ? সিখেনে কি সাঁজ-বিকালের পারা লাল মেঘ ছড়ানো রয়েছে ? সিখানে তার হইলদা, ঝাপসা, কীটে-খাওয়া কিশোরী মাতৃমুখের কাছে ফিরে আসছে তার মাতৃমুখী সন্তান । একটু উদাসীন, ক্ষ্যাপাটে, তার মাথার চুলে লাল ধুলা জলে মাখামাখি, কানের পাশ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে। মায়ের আঁচল মুছে দিবেক বলে তার ধুলা মাখা মাথা নিচু হয়ে আসে...
পঞ্চানন ঘুমন্ত বৌ আর ছেলাদের রেখে সাইকেল লিয়ে নদীর নাবালে নেমে আসে, তখন পুবদিক জাগ্রত হচ্চে , লাল হচ্চে আকাশ …

শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৬

কবি, একা মেঘরাস্তা ধরে (কবি ফল্গু বসুর কবিতা নিয়ে কিছু কথা)

কবি, একা মেঘরাস্তা ধরে...

কৌশিক বাজারী



কোনো কোনো মানুষ পথ চলতে চলতে হাওয়া দিলে গায়ের জামা খুলে ফেলেন । শরীরে, দেহত্বকে সেই বহতা হাওয়া ধারণ করে বুঝে নেন তা কত বছরের পুরনো। হাওয়া বয়ছে সুন্দরবন থেকে নাকি জাভাদ্বীপ থেকে। বুঝে নেন হাওয়া বেহুলার মান্দাস কতদূর পৌঁছে দিয়ে এলো। তারপর মনে মনে গুঞ্জরিত হন । এর নাম পথ চলা। সাধারণ মানুষ, সাধারণত পথ চলেন কোথাও পৌঁছনোর জন্য। তাদের থাকে একটা ভাল-মন্দ-কাজ-অকাজের গন্তব্য । আর এরকম, যারা ঠিক সাধারণ নন, অল্প ভুতে পাওয়া, তাদের সাধারণত কোনো গন্তব্য থাকে না। পথের শেষ নয়, পথের দুপাশেই মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছড়িয়ে রয়েছে। ভূগোল ও ইতিহাস-অনির্দিষ্ট সেই বহুতলীয় পথ, যা কখনো ফুরিয়ে যায় না। মূলত সেই কারণেই তাদের পথের কোনো শেষ থাকে না। আজীবন অবিরাম পথ। তাই একটা অবিরাম চলা তাদের ভেতর থেকে উঠে আসে। তাঁকে আমরা বলি কবি। কবি পথকে নিজের জীবনের মধ্যে ধারণ করে বাঁচেন।

বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক থেকে একবিংশের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত সময়কাল, খুব বেশী না হলেও, চলার হিসেবে, মানব জীবনে খুব কমও নয়। কবি ফল্গু বসু এমন একজন নিভৃতচারী মানুষ। আমি তাঁকে টেলিফোনে চিনি। কণ্ঠস্বরে তাঁর আন্তরিকতা বুঝেছি বহুদূর। তাঁর ছড়ানো ছিটানো লেখা-পত্তর ও সাক্ষাৎকার থেকে যেটুকু বুঝেছি, তিনি

সত্তরের সেই অশান্ত ঐতিহাসিক দিন গুলোতে জড়িয়ে পড়েছিলেন নক্সালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখা অনেক কবিতায় সেই সময়ের প্রতিধ্বনি, ব্যর্থতা ও আশা-হতাশার কথা শোনা গেছে সেখানে। ১৯৮৭—৮৮তে লেখা ‘শামুক’ নামক কবিতায় দেখি তিনি বলছেন—

গোপনে বিপ্লব করে ঘুষির সিনেমা দেখে দেখে
দু-দুটো প্রজন্ম হেজে গেল। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরি
থানার দেয়ালটাকে একবার পাক মেরে দেখি
ফাটলের চারাগাছ কেউ উপড়ে ফেলেছে কি না
চারাগাছ ভাল আছে দেখে থানার দেয়াল থেকে
ইচ্ছে করে পড়ে গিয়ে আরো বেশি শক্ত হতে চাই।
অত্যন্ত স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা। আরো পরিষ্কার করে বললে—রাজনৈতিক আশার কথা দিয়ে তিনি আরম্ভ করলেন, এবং এই কবিতাটিরই শেষে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক ‘রাজনৈতিক হতাশা।– ‘দু-দুটো প্রজন্ম গেল, তবু নেতৃত্ব অংশত শেষ’ থেকে
‘সব ঘাট চষে ফেলি
শেওলা ডিঙিয়ে যাই, শুঁড় বার করে দেখি, তবু

প্রাক্তন নক্সাল বলে কেউ আর সমীহ করে না।‘

একটি ন্যায় ও সৎ-আবেগজাত প্রকৃত তারুণ্যের আন্দোলন, কিছুকালের মধ্যেই কিছু উজবুক নেতার ভ্রান্তি এবং প্রতিপক্ষের অন্যায় ষড়যন্ত্রের মাঝে পড়ে ধুরমুশ হয়ে যাওয়ার অবব্যহিত পরেই একটি স্বাভাবিক সমাজ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ সম্ভবত ফল্গুদার এই কবিতাটি ।
কবি নিজে ‘প্রহর’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এই কবিতাটি সম্পর্কে বলেছেন—
--“দেখো, আমি মনে করি কবির দায় বহন করার আইনত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে প্রকাশ করার স্বাধীনতা আছে। এখান থেকেই ব্যাপারটা এসেছে। কবিতায় যেটা দেখছো সেটা তো মিথ্যে নয়। ওই মতাদর্শের (নকশালবাড়ির আন্দোলন) প্রতি একটা চাপা টান তো ছিলই। পরবর্তীতে তাদের জায়গা থেকে বিচ্যুত হতে দেখে ভিতরে ভিতরে একটা কষ্ট দানা বাঁধে। ‘অবাধ্যের পুঁথি’তে ‘শামুক’ কবিতাটা দেবদাসদা সংকলন থেকে বাদ দিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি দিতে পারিনি।“
অর্থাৎ কোনো আকস্মিকতাতো নয়ই, বরং কবিমনের এক দৃঢ়তাই এখানে প্রতিষ্ঠিত। যাকে কবি কখনোই বর্জন করতে পারেন না। হয়তো এখনো তিনি অপেক্ষা করেন।–‘এখনও অপেক্ষা করি দাঁড়াই নদীর শুকিয়ে যাওয়া পাশে....যেখান থেকে জলের একটি রেখা আসে....’
যদিও এইসকল বিষয় এই আলোচনার কেন্দ্রমূল নয়। তবু মূলে যাবার আগে এই ভূমিকার প্রয়োজন আছে। কবির প্রকৃত পথের হদিশ পেতে হলে পিছনের ফেলে আসা পথগুলিও ফিরে দেখা দরকার একটু...। কারণ—

সবার মনের মধ্যে চলে বিচিত্র ঘড়িটি
যে খুব যত্নের সঙ্গে ধারাপাত মুখস্থ করেছে

দহনের আগে স্বপ্নের সময় বিবেচনা
করেই ফেরত দিচ্ছে প্রত্যেকের ডুবে যাওয়া গ্রাম।
----

২০১১ এর কলিকাতা বইমেলায় সংগ্রহ করি একটি কাব্যগ্রন্থ –‘করতলে ভাগ্যরেখা নেই’। কাব্যগ্রন্থের নাম তাৎক্ষণিক হিসেবে খুব পছন্দ হয়নি তখন আমার। তারপর পড়তে পড়তে পরে একটা অন্য আবেদন পরে তৈরি হয় । তথাপি নিজের মুদ্রাদোষেই এই গ্রন্থটির অন্য অন্য নামকরণ করেছি আমি বিভিন্ন সময়ে। যেমন—‘আনন্দ ব্যাকুল রোদ’, ‘পাখি শূন্য মনের গহন’, ‘একা মেঘ রাস্তা ধরে’—এটা আমার প্রিয় কবিতা পাঠের একটা ব্যক্তিগত খেলা ছাড়া আর কিছু না। কোনো বই পড়তে গিয়ে, এক-একটা কবিতা, অথবা কোনো চরণ, কোনো দৃশ্যকল্পনা, কখনো কখনো মাথার ভেতরে রয়ে যায় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে । কাজের মধ্যে, পথ চলার মধ্যে, স্নানের মধ্যে তারা আসা যাওয়া করে।
এই বই এর কবিতাগুলি তো আসলে ভ্রমণকাহিনী। কবির আত্মজৈবনিক ভ্রমণ। এর যে কোনো একটা কবিতা ধরেই পাঠক শুরু করতে পারেন তাঁর ভ্রমণ। ধরা যাক অতিসাধারণ এক পাঠক। এই আমার মতো ছা-পোষা লোক, যদি এই কবিতাগুলির কোনো বাস্তব গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই কখনো, হয়ত দেখব এসব কিছুই কিছু নয়। হয়ত কবিতায় কথিত ‘মাটিয়ারি’ গ্রামে গিয়ে দেখা যাবে পেতলের বাসন-কোসন, চাষবাস—আর কিছুই নেই। তবু আছে কোথাও হয়ত, হুবহু এইসব। সেখানে পৌঁছুতে হলে আপাতত অন্যভাবে পৌঁছতে হয়। কারণ কবিতাগুলি সময়-যানের মধ্য দিয়ে, অতীত ও বর্তমানের ভেতর দিয়ে অতিবাস্তব ও কল্পলোকের ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে অনবরত। কারণ মাটিয়ারি গ্রামে ‘রামনবমী মেলায় আগে পুতুল নাচ হত, আজকাল উঠে গেছে’।
আঠাশ পৃষ্ঠার এই বইটির সব কবিতাগুলির নামই গ্রাম-নাম। আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও, এহল কবির গমনপথ। এও আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক এক কাব্যিক রূপরেখা। শুধু কি তাই ? তাহলে তো প্রবন্ধ হয়ে উঠত লেখাগুলি। আরো যা আছে—মৃত্তিকা ও মৃত্তিকার প্রাণ।

নদীটির জন্য ভেবে ভেবে গানপাগলা পরিতোষ
গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ঘুরে, ফিরে আসে বিরহীতে।
প্রাচীনের মুখে নবীন শুনেছে—কোনো এক কালে
এখানেও জমিদার ঘোড়া চড়ে ঘুরতেন রোজ
ক্ষমতা বা জেদের কারণে এখানেও বহুবার
যুদ্ধ হয়েছিল।...
...মজা খালটির পাশে জেগে ওঠে বাদল আকাশ
শোনা যায়, করুণানিধান কিছুকাল কাছাকাছি
খুব একাকী ছিলেন, জাতীয় সড়ক চলে যাচ্ছে
স্টেট বাসে। বিরহীর উন্নতিতে মদনগোপাল
নিজে অপার আনন্দ পান।
এই যে এখানে কবি এক গ্রামের কথা বলতে গিয়ে অতীত-বর্তমান গেঁথে দিয়ে একজন প্রায় মুছে যাওয়া ‘গ্রামীণ’ কবিকে খুঁজে দিলেন। করুণানিধান। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামটি এবং সাথে সাথে কবিতাটিতেও অন্যরকম এক মেদুর আলো এসে পড়ল। করুণানিধান এখানে থাকতেন। এ সকল পার হয়ে কবিতার শেষে তিনি পৌঁছে গেলেন মদনগোপালের অপার আনন্দে।
পৌঁছে গেলেন--‘বিরহীর উন্নতিতে মদনগোপাল নিজে অপার আনন্দ পান’—এই সহজ পঙক্তিটিতে। খুব কী সহজ? ‘উন্নতি’ মানে কি? উন্নয়ন ? আর মদনগোপাল কে ? মদনগোপাল আমাদের সহনাগরিক, এক সামাজিক নায়ক । তিনি মানুষের দু:খে দু:খী আর মানুষের সুখে সুখী হন। ঠাকুর মশাই রান্না চাপালে তার একবেলা আহার জোটে। আর তার অন্ন নিজ হাতে সাজান বলেই ঠাকুর মশাই ঐ হাতে কোনো পাপ করতে পারেন না কখনো। তার চাল ফুটো হয়ে জল পড়ে । জ্যোৎস্নালোক পড়ে। --এইসব গল্প আমাদের জানা। এখন বিরহীর উন্নতি মানে কী? তাও আন্দাজ করা যায়। কারণ উন্নয়ন আর মঙ্গল-কল্যাণ সমার্থক নয়, যদিও বর্তমানে পৃথিবীর সব গ্রাম মূলত বিরহী। উন্নয়নের সড়ক ধরে স্টেট বাস চলে যায় ধুলো উড়িয়ে। আর ‘অপার’ শব্দটির দ্যোতনা সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষণীয়। ‘অপার’ আনন্দ লাভের পথ যে জাগতিক ভোগের প্রয়োজনে নির্মিত ‘উন্নয়ন’ নয় তা বলাই বাহুল্য। তাই এই ‘অপার আনন্দ’ মদনগোপালের আত্ম-শ্লেষই হয়তো বা।
সমগ্র বইটিতে এমন অসংখ্য ‘সহজ’ পঙক্তি ও কবিতা ছড়ানো রয়েছে ফল্গু-দার গ্রাম ‘দর্শনে’র পথে পথে । এখানে আধটি কবিতা ভেঙে দেখতে গিয়ে এই হাল হল আমার।
কত যে গ্রাম এই বাংলায় । তাই তো গ্রামবাংলা শব্দটি রয়েছে এই বাংলা ভাষায়। সবুজ সুন্দর বলিষ্ঠ ছায়াসুনিবিড় বনেদি শস্যময় আর রুক্ষ রাঢ় ধূ-ধূ ধুলো ঢাকা খাঁ-খাঁ গ্রাম সকল। মাটিয়ারি, ঝামটপুর, বলাগড়, নিশিগঞ্জ, উষাগ্রাম, হাভেলি শহর আরো কত গ্রাম-নাম।
নানা গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে একটা গ্রামের মুখে এসে থমকে দাঁড়াই। যেখানে আমি গিয়েছি আগে। গ্রাম অর্থাৎ কবিতা। গ্রামের নাম ‘সাব্রাকোণ’। কবিতার নাম ‘সাব্রাকোণ’। আসলে আমরা বাঁকুড়া বিষ্টুপুরের লোক যাকে বলি সাবড়াকোণ। বিষ্টুপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছাড়ে— ‘বিষ্ণুপুর—সাবড়াকোন—পাঁচমুড়া’ লেখা থাকে। এই বাসে চড়ে আগে গিয়েছি । এই সাবব্রাকোণের পাশেই আমার বাপ-ঠাকুদ্দার দেশগ্রাম। হাঁটাপথ। রুখা,শুখা, টাঁড়, ডিহিতে ভরা বাঁকুড়ার ল্যাটেরাইট অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানে ‘দিঘি উল্টে জল চাটে পিপাসা কুকুর’ । মানে—গ্রীষ্মের ধূ-ধূ রোদে মাটি ফেটে গেছে। এমন কি দিঘি উল্টে দিয়েও এক ফোঁটা জল পায় না বাঁকুড়ার কুকুর।
“...
রামকৃষ্ণ মন্দির লাগোয়া দোলমঞ্চে
ঋঞ্ঝা অতীত শুধরে ফের উথলে ওঠে।
নদীকে অনিয়মিত দাবি করে বাঁকা প্রবাহিত
পুরন্দর, দুইপাশে বিকেল লুটোয়
কে তাকে সুদেষ্ণা ডাকে ?
পাখি জানে, আর জানে বলেই সে
দেবালয় দূরবর্তী আকাশে ভাসার কথা ভাবে ।
নচেৎ অজ্ঞান, রজনী আছাড় খায়
চৌচির ভূমিতে। এই মানবজন্ম সন্ধ্যাপ্রদীপ
উষ্ণ হাওয়া টের পায় ফুলবনে লেগেছে আগুন।
...”
হায়! এ কোথায় এসে পড়লাম ফল্গুদার হাত ধরে ! এ যে আমার ই গ্রামে আমাকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। পুরন্দর! আহা পুরন্দর! খুব ছোটোবেলা সেজপিসিমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই পুরন্দরেই তো স্নান করতাম আমি। লাল মোটাদানার বালি। সেই খালপাড়, দেবালয় দূরবর্তী আকাশে ভাসমান পাখির পিছনে সূর্যাস্ত। তাহলে পাল্টে যায় নি সমস্ত ? কিছু থেকে যায় আমাদের প্রবাহিত জীবনের ভিতর ? সুদেষ্ণা অথবা তন্দ্রা নামের কিশোরীটির সাথে ফের দেখা হয়ে যায় পথে...যখন, ফুলবনে লেগেছে আগুন।
এই লেখার শুরুতে একটা পথ চলার কথা বলা হয়ে ছিল। আর ‘শামুক’ নামে একটা কবিতার উল্লেখ ছিল। সেখানে কবির ব্যক্তিগত অপেক্ষা, আশা, হতাশা কথা ছিল। এখন আমরা যেখানে এসে পৌঁছলাম সেখানে হতাশার লেশ মাত্র নেই। বরং সেই অপেক্ষা-আকাঙ্খার পথে চলতে গিয়ে ফল্গুদার হাত ধরে আমরা এসে পড়েছি নিজস্ব গ্রামে।





মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬

বাংলা কবিতার মেঘে তনুভূত জল

বাংলা কবিতার মেঘে তনুভূত জল ;
নব্বই ও তারপরের কবিতায় আধ্যাত্মিকতা...


“আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি...”
--জীবনানন্দ।



ত্রিকাল মায়ার ঘেরে পড়ে গেছে এ পৌণ্ড্রবর্ধন
অতীত সুবর্ণময়, বঙ্কিম স্বভাবে যাকে ছেনে
ভবিষ্য হীরকখণ্ড নির্মাণ করেছে চাঁদবেনে,
অধুনা সেও নাকি ভিখারিনী, পড়ে পাওয়া ধন
হঠাৎ হাওয়ার সাথে, কলমের তাই উজ্জীবন।

জাগরণে বিভাবরী থমকি থামিল কোথা এসে?
কালের গভীরে কেউ বাদ্য করে মৃদঙ্গ ত্রিতাল,
কালের অজস্র মুখে অসংখ্য কালের মুখ মেশে,
অনেক কালের বুকে শুয়ে পড়ে কাল ভালোবেসে--

এ কোন প্রবল ধাঁধা, রহস্যের পাথারে বাঙালী
ভাসায় কাব্যের স্রোত, কাল বুঝে অথবা না বুঝে?
ব্যাকরণ ডুবে যায় কালের অতল আনখুঁজে,
কেবল ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে ইচ্ছাময়ী কালী”।।
(অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়/ গ্রন্থ: শাক্ত চতুর্দশপদী)

আধ্যাত্মিকতা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার কোনো যোগ্যতা আমার মতো অজ্ঞেয়বাদীর আছে কিনা জানি না। এই অজ্ঞানতা প্রথমেই স্বীকার করে রাখা ভালো। সাম্প্রতিক কালের কিছু কবিতা পাঠ করতে করতে আমারা বরং সেই দিকে, সেই পথের সন্ধানে যাবো, যেখানে—“কেবল ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে ইচ্ছাময়ী কালী” ।     এই তো! এখন পংক্তিটি একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়ে গেল এই মুহূর্তে। ইচ্ছাময়ী আমাদের ইচ্ছার স্রোতে ভেসে থাকে, অর্থাৎ যে যেরকম ভাবে তাকে ভেবে নেব, আপন করব—এই আর কি।
   তবু বাংলা কবিতার একটা আবহমান রূপ যেন এই পংক্তি ক’টির ভিতর  সংহতি খুঁজে পাচ্ছে। বাংলা কবিতার আবহমান রূপ মানে কি? কাব্য-রূপের আবার আবহমানতাই বা কি? এই সব কূট প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবু কাব্য-ভাষা বদলাতে বদলাতে যেদিকেই যাক তার অন্তঃস্থলে রয়ে গেছে সেই আদি ইচ্ছাময়ী, তার উপস্থিতি ব্যতীত কাব্যদেহ প্রাণহীন। এই প্রাণ, এই প্রতিষ্ঠাই কাব্যের আধ্যাত্মিকতা কিনা তা ভাবনার বিষয়। জীবনানন্দ যেমন বলেছেন--–“সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়--- কিম্বা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়,যে মনে হয়, --এই সমস্ত জিনিষই অনেকদিন ধরে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল; এবং ভঙ্গুর হয়ে নয়, সংহত হয়ে,আরো অনেক দিন পর্যন্ত, হয়ত মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরাণ রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে; এই সবের অপরূপ উদ্গীরণের ভিতর এসে হৃদয়ে অনুভূতির সৃষ্টি হয় ।"—তো এই অনুভূতি আধ্যাত্মিক অনুভূতি কিনা তিনি পরিষ্কার করে বলেন নি কোনোদিন। তবু , এই যে তিনি বললেন ‘...কোথাও যেন রয়ে যাবে’—এই যে প্রায় প্রশ্ন বোধক অনন্ত, এই অনন্তই হয়তো বা সেই , যাকে আমরা কোনোদিন সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। এবং পারি না বলেই তা অশেষ! আবহমান! বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক কবিতার বিষয়ভিত্তিহীনতা ও ভাষার জাগলিং-এর গড্ডালিকার দিকটি বাদ দিলে কাব্যমাত্রই অনুভূতি প্রসূত। যা মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে বলে মনে হয়। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় যেমন বলেছেন—‘কালের অজস্র মুখে অসংখ্য কালের মুখ মেশে,/অনেক কালের বুকে শুয়ে পড়ে কাল ভালোবেসে’ ।


    তেমনি বাংলা কবিতার নব্বইএর দশক একটি বিশেষ কালখণ্ড, যার বিশেষত্ব এই যে, সে আশির দশকের পরবর্তী দশক এবং শূন্য দশকের পূর্ববর্তী। এছাড়া সমস্তটাই আবহমানতা। তবু আমাদের কারো কারো কাছে এই কালখণ্ডের কি অপরিসীম ব্যঞ্জনা! অর্থাৎ আমরা যারা কেউ কেউ এই দশকটিতে পৃথিবীকে চিনতে শিখেছিলাম এক নতুন চোখে। নবীন বয়সের উচ্ছ্বাসে। সে হল আমাদের কবিতাবেলার কৈশোর --তাই তাকে পারিনা এড়াতে। তো এইসময় যে সকল কবি বাংলা কবিতার জগতে পা রেখেছিলেন, এবং জয় করেছিলেন, সত্যি বলতে তাদের বেশীর ভাগই এক-দশকের ব্যবধানে অন্তর্হিত প্রায়, প্রথম বাল্য-প্রেমের মতো কবিতা তাদের ছেড়ে গেছে বহুদিন। আরো কেউ কেউ যারা অভ্যাসের বশে রয়ে গেছেন তারাও ম্রিয়মাণ। এ আমাদের পরম দুঃখ। সেই উচ্ছ্বাস, সেই ঝড়, সেই অপ্রতিরোধ্যতার ভেতর কোথায় যে ধ্বংসের বীজ লুকানো ছিল, আমরা চিনতে পারিনি তাকে। হয়তো চিনতে চাইনি। কারণ সেই সময় মূহূর্মুহু ঘোষিত হচ্ছে নতুন নতুন লিটিল ম্যাগাজিন, সেখানে ঘোষিত হচ্ছে বাংলা কবিতাকে হতে হবে গ্রাম্যতা বর্জিত, স্মার্ট ও শহুরে। এবং এই ডাকে সাড়া দিয়ে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপের সমস্ত কবিগন স্মার্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। গ্রাম্য শব্দ, লোকজ শব্দ কবিতার থেকে ঝেড়ে ফেলে সে এক নতুন ময়ুরপূচ্ছধারী হয়ে উঠছেন গ্রামীণ কবিরাও। ভেতরের প্রাণের কথা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছিল কেন যে, কে জানে! এবং এইসব বৈশিষ্ট্যগুলি না থাকলে বিখ্যাত শ্রেষ্ঠ পত্রিকা তো বটেই বিখ্যাত লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতেও স্থান পাওয়া দুষ্কর হয়ে  উঠছিল। একটি লিটিল ম্যাগাজিনের প্রখ্যাত সম্পাদক সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন—আমাদের পত্রিকা পরবর্তী বাংলা কবিতা পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, তা খানিকটা পাল্টেছে বৈকি! এই যে গায়ের জোরে বদল, এর পরিণাম ভাল হয় নি কখনো কোথাও । সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এই যে প্রকৃত-বিজ্ঞানহীন প্রযুক্তির শাসন। পৃথিবীর সমস্ত নদী স্রোতের উপরে বাঁধ, তার সাময়িক সুবিধাগুলি স্বীকার করেও ভবিষ্যতের অপূরণীয় ক্ষতি ও ধ্বংসের কথা প্রযুক্তি বলে যেতে পারেনি। যা বলা সম্ভব ছিল প্রকৃত বিজ্ঞানের পক্ষে। ঠিক সেইরকম, প্রাণহীন আঙ্গিকসর্বস্ব  বাংলা কবিতায় এই জোরপূর্বক বদল কতদূর সহনীয় জানি না।। কেউ কেউ বলবেন এতে কারো কিছু যায় আসে না, ভাষা-প্রবাহ তার আপন পথেই চলবে, তবু বিরুদ্ধ-শক্তি এই প্রবাহের পথ বহুদূর পর্যন্ত রোধ করতে সক্ষম, তার স্বাভাবিক প্রবাহের পথে বাধা আনতেও সক্ষম। সে হেতু সাম্প্রতিক প্রাণহীন বাংলা কবিতার বাড়-বাড়ন্তের জন্য আমি অনেকাংশেই এইসব পত্রিকা সম্পাদকদের অবিমৃশ্যকারিতাকেও দায়ী করি।
   তবু, যে কথায় পৌঁছানোর জন্য এইসব তিক্ততার অবতারণা সেইখানে ফিরে আসি, সেই নব্বই-এর দশকের চিৎকারের অন্তরালেও কেউ কেউ লুকিয়ে ছিলেন অন্য এক অন্বেষণের চেষ্টায়, যেমন সব কালেই থাকেন কেউ কেউ। তারা ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলেন সময়ের স্মিত ছায়া সরে যাবার পর। এক দশক, দুদশক পর, অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একফর্মা দুফর্মার দুর্বল চটি বইগুলি, স্যাঁতস্যাঁতে খাটিয়ার তলা থেকে বিবর্ণ, অনুজ্জ্বল, আনস্মার্ট, গ্রাম্য খাতাগুলি কোথাও কোথাও পুনরায় ছাপা হতে দেখা গেল। তাদের কাব্যে ছিল সেই মায়া! সেই অনন্তঃ, সেই জাফরাণ রৌদ্রালোক—যা সমকালকে ছাড়িয়ে সামনে ও পিছনে আদিগন্ত মেঠোপথের মতো বহুদূর ছড়িয়ে রয়েছে—

জীবন উঠোন মাত্র সারাদিন পাতা ঝ’রে পড়ে
জগতের, জীবনের, সোনালী হলুদ সব পাতা
সারাদিন চুপ ব’সে পাতাদের ঝ’রে পড়া দেখি
সারারাত ধ’রে শুনি শুধু বাতাসের কথকতা
অপেক্ষা অপেক্ষা শুধু কোন এক শান্ত সকালের
ঝরা পাতা আর ফুলে ভরে আছে সামান্য উঠোন
কতদিন কত খেলা করা হল সকলের সাথে
আজ সেই কথা তাই অবিরাম ভেবে যায় মন
সকালবেলার কথা তবু চিরদিন থাকে জেগে
শিউলিতলায় বলো কতদিন ছুটে গেছি আমি
সাদা রঙ ক্রমে দেখি লাল আরো লাল হতে থাকে
দিগন্তও দেখি মাতে অপরূপ হোলির খেলায়
জীবন উঠোন মাত্র সারাদিন পাতা ঝরে পড়ে
জগতের জীবনের সোনালী হলুদ সব পাতা...

(পার্থপ্রতিম মজুমদার/ গ্রন্থ: শ্যাম অন্ধকারে/ ‘অনুরাগ’ পর্যায়)

 এক ধরনের কবিতা আছে, যা অংশমাত্র উদ্ধৃতি করলে তার ভেতরের সঙ্গীত-ধর্মীতা নষ্ট  হয় বলে আমার ধারণা। এবং যা বলতে চেয়েছি তাও পুরোটা বলা হয়ে ওঠে না। এবং সেই ভাষাহীন অনুভূতির আকুতি, যা সঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে কখনো কখনো মানুষের গহনে, তাও বোঝানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আর ভাষা যেখানে পথ পায় না সেখানে যে সঙ্গীত একমাত্র পথ! তবু কবিতা, কাব্য আগাগোড়া ভাষাজালে বদ্ধ। তাকে মুক্ত করবার প্রয়াসমাত্র এই সঙ্গীত-ধর্মীতা প্রদানে, সেটুকু নষ্ট করলে কবির আর কি অবশিষ্ট থাকে! তার আকুতি, তার জীবনের প্রতি অসীম মমতা ও খোঁজ, তাকে কি আমরা ধরতে পারলাম...। যাই হোক, এই কবিতাটির মধ্যে দিয়েই হয়তো আমরা হঠাৎ ঢুকে পড়লাম আমাদের বিষয়ের ভেতরে। -- আধ্যাত্মিকতা!

   মানুষ তার চেতনা, তার ভাব নিয়ে সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই এক অন্বেষণ জারি রেখেছে। বিজ্ঞান দর্শন কাব্যের ভিন্ন ভিন্ন পথে সে খুঁজে বেড়িয়েছে তার অতীত। তার উৎস। এই জীবন ও জগতের অর্থ ।  এই উৎসের খোঁজে সে ঘর ছেড়েছে, সমাজ সংসার ছেড়ে কেউ কেউ মহাসংসারের দিকে চলে গেছে। এবং চলেছে । স্টিফেন হকিং কথিত আদি মহাবিস্ফোরণের থেকে ছড়িয়ে পড়া ব্রহ্মাণ্ডপুঞ্জ ক্রমশ যেমন ছড়িয়ে পড়ছে তার কেন্দ্র থেকে আরো আরো দূরে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরস্পর থেকে প্রতিটি কণা, আর তাদের ভিতর থেকে হাহাকার উঠছে—‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর...’ আবার--আবার কখনো হয়তো ফিরে আসবে তারা পরস্পরের দিকে, মিলিত হবে নিজস্ব মণ্ডলে, এক পরম ভরের ভেতর সমগ্র শক্তিপুঞ্জ! এক অসীম কেন্দ্রাতিক অভিকর্ষ, যা তাকে ক্রমশ নিজের কেন্দ্রের দিকে, কুলকুণ্ডলিনীর দিকে টেনে নিয়ে যাবে ক্রমশ শূন্যের দিকে? কি আশ্চর্য আর কি মহাকায় সেই মিলন! অনন্তের অন্তে, সেই মিলনের আকুতিই কি তবে কবিতার ভাষাহীন সৌন্দর্য? ব্যাখ্যাতীত? আধ্যাত্মিকতা? এর থেকে বহুদূরে এই বিশ্ব-মানবের মেঠো পথ।  যেখানে পৃথিবীর আকাশে সূর্যোদয় হয়, ফুল ফোটে, আর ঐ মহাসংকেতের ঈঙ্গিতে  প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে যায়! অথবা, একাকী পথিক যেভাবে মিশে যায় পথে?

যেভাবে দিগন্তরেখা
মিশে যায় মাটি ও আকাশে
যেভাবে বসুন্ধরা
ছেয়ে যায় অনাবিল ঘাসে
আমিও তোমার মাঝে
একদিন মিশে যাব ঠিক
যেভাবে পথের বুকে
মিশে যায় একাকী পথিক...
(প্রেমের কবিতা / স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য /১৯৭১--)




   এই পৃথিবীর সামাজিক মানুষের কাছে, অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষে আধ্যাত্মিকতা বিষয়টির অর্থ হয়তো ভিন্ন। প্রথানুগ ভাবনা অনুযায়ী তাকে  ঈশ্বর বিষয়ক ভাবনা ও তাঁর দিকে যাত্রার এক পথ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। যদিও সেই পথ এক নয় সকলের কাছে। এবং নিরাকার ঈশ্বরের ধারণাও প্রত্যেকের কাছে ভিন্ন তথা বিমূর্ত। আমরা একে অন্যের ধারণার কথা জানি না। ভাবতে গেলে, যেন এই ধারণার ভিন্নতাই মূলত ঈশ্বর প্রতিম। অর্থাৎ ঈশ্বরের ধারণাই ঈশ্বর। এ এক জটিল আবর্ত! একজন সচ্ছল, আপাত সুখী মানুষের অবসরের ঈশ্বর আর একজন মেহনতি কৃষকের ঈশ্বর মূলত এক নয়। মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থান, তাদের মানসিক গঠন, শিক্ষা ,পরিবেশ প্রভৃতি ঈশ্বরকেও ভিন্ন করে দেয়। মার খেতে খেতে মার খেতে খেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কাছে ঈশ্বর মূলত এই ধ্বস্ত জীবন থেকে মুক্তির পথ ছাড়া আর কিছু নয়। আবার একজন বড়বাজারের গদিতে বসা ব্যবসায়ীর কাছে ঈশ্বর মূলত গণেশের মূর্তি, ক্যাশ বাক্স আর শাঁসালো খদ্দেরের ভেতর ঘোরাফেরা করে। এইসব কিছু থেকে বহুদূরে, অথবা এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই একজন কবি অথবা একজন শিল্পীর ঈশ্বর আনমনে পথ হেঁটে যায়।  হয়তো সেও বহু দুঃখে অপমানে সিক্ত, তবু সুর সন্ধানী সে--


‘জল্লাদেরা জ্বাল দিচ্ছে মৃৎপাত্রে মারাত্মক বিষ—
ছায়াপাতে কেঁপে উঠছে নিভে আসা তোমার সময়!
তবু তুমি বাঁশি হাতে শেখো সুর! ওহে সক্রেটিস!
কী লাভ এ সুরে আর?—দণ্ড দুই বই তো আর নয়...’

‘দণ্ড দুই বই তো আর নয়—
তাই এই দণ্ড দুয়ে যদি
সুরের নতুন সিঁড়ি পারি ছুঁয়ে যেতে—
আরো এক পারানির কড়ি
জমা হবে এই দাহ্য মাটির ঝুলিতে—
আর কিছু নয়।
প্রকৃত পথিক জানে
প্রতিটি লগ্নই তার
গমনের শুদ্ধ সুসময়...’

(শুদ্ধ সুসময় / সপ্তর্ষি বিশ্বাস/গ্রন্থ: দাহ্য মাধুকরী)

   সুসময় বলে ভিন্ন কোনো কাল নেই। লগ্ন, নক্ষত্র, মাহেন্দ্রক্ষণ, তিথী, চন্দ্র, সূর্য নিরপেক্ষ সে। প্রতিটি লগ্নই তার গমনের শুদ্ধ সুসময়...সমস্ত কাল সুরে বাঁধা।
   বন্ধুবর কবি সপ্তর্ষি বিশ্বাসের সাথে এই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল একবার। তার মতে-- কাব্য বা শিল্পের আলোচনায় আধ্যাত্মিকতা থেকে প্রথমেই প্রথাগত ঈশ্বর চিন্তাকে বাদ দিতে হবে। এবং একেবারে সামনে রাখতে হবে কাব্য ও শিল্পের ভেতরের সৌন্দর্য্যানুভুতিকে। প্রকৃতি ও মানুষের ভেতরের সুর ও সুন্দরকে। যা প্রকৃত জীবন। সেই সুন্দরের ভিতর দিয়েই বরং  এগিয়ে যাওয়া যাবে অভীষ্টের দিকে।
এই মতবাদের ভিতর দিয়ে যখন তার কবিতাকে লক্ষ্য করি। দেখি, সেখানে এক এ্যান্টি-স্পিরিচ্যুয়ালিজম ঘাপটি মেরে আছে। এ্যান্টি-স্পিরিচ্যুয়ালিজম কথাটা রসিকতা করে বলা। মানিক চক্রবর্তীর এ্যান্টিপোয়েট্রি যেমন আদতে কবিতাই, শুধু গতানুগতিকতাকে সদর্থে ভাঙা এবং তার খোলোসকে ছুঁড়ে ফেলে এক অন্য রূপ দান করা, এও তেমন—স্পিরিচ্যুয়ালিজম থেকে প্রথমেই গতানুগতিক ঈশ্বরকে বাদ।
‘-- ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর
দেবতাও ব্যাথাতে কাতর...

হে দেবতা কবে তুমি ক্রোধে
তুলে নেবে নিজেও পাথর ?’

  কবীরের দোঁহা, বৈষ্ণব কবির কাব্য,  রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় আধ্যাত্মিকতার যে সুর,  তার থেকে যেনো বহুদূরের এই অবস্থান। (একমাত্র চর্যার সুর ছিল একেবারে মাটির কাছে) এখানে ভক্তি নয়, মূলত সখারূপ ঈশ্বর, বন্ধুর মতো তাকে ধমক দেওয়া যায়, এমন কি গালিগালাজ পর্যন্ত করা যায়। অন্তত এই কালখণ্ডে এসে কবির পরিবর্তিত মানসপট এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বাংলার সুপ্রাচীন ভক্তিগীতি বা প্রার্থনাসঙ্গীতের উল্টোদিকে আরো কাছাকাছি এক অবস্থান কবি তৈরি করতে পেরেছেন। অথবা সময় সেই অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে।   কবিগন নিমিত্ত মাত্র।

   প্রকৃত অনুভব শুধু গ্রাম শহরের বেড়া নয়, সময়ের বেড়া ভেঙে ফেলেও মানুষের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, এরপর সে কথা নতুন করে বলার কিছু নয়, তবু যখন কবিতাকে গ্রাম্য ও শহুরে ভাগে কেউ ভাগ করতে চায় তখন সেই পুরানো কথাগুলোই আবার—আবার বৃত্তাকারে সামনে চলে আসে। মানুষের জীবনের কথা, তার উৎসের দিকে যাওয়ার কথা। সব দেবতাকে ছেড়ে তার প্রাণের কাছে যেতে চাওয়া। ধরা যাক একজন শহুরে কবি, আদ্যন্ত যার শহরে বাস, শহরেই বেড়ে ওঠা, কর্মপোলক্ষে যদিও সে জগত দেখছে, মানুষ দেখছে, আর তার অন্তরচক্ষু খুলে গেছে। একদিন সকালে স্নান সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজায় পা দিয়ে অবাক হয়ে দেখে-- উল্টোদিকের ফুটপাতে বসে আছে গিরিকন্যা উমা! তার পায়ে রূপার নূপুর, উলোঝুলো চুল, কপালে ত্রিনয়নের মতো লেপ্টে আছে গেঁয়ো কুমকুম, বাপের সাথে শহরে এসেছে সে কোনো কাজের খোঁজে—

গিরিরাজকন্যা, কেন কলকাতার গলি-গুহামুখে
পিঁড়ি পেতে বসে আছো, কেন?

তুমি কোন পাহাড়ের খরস্রোতা হয়ে
জন্মেছিলে বনের ছায়ায়?

লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে উৎরাইয়ের পথ;
আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়তো কিছুটা;

লতায় জড়াতো চুল...
খ’সে পড়তো বুনো ফুল...
তবু এই পরিণাম সে সরল অধঃপতনের!

আমি লজ্জা লুকোবার ফাঁকে
দেখেছি তোমাকে
তুমি
দোষ নিও না পাহাড়ের মেয়ে।
সাকুল্যে খুব জোর, আর কিছু নয়, ওই
গ্লানির নূপুর-পায়ে হাত বুলোতাম, কাছে পেয়ে।

(বেনাম্নী/ শোভন ভট্টাচার্য/গ্রন্থ: ধ্বংসে লেখা ধ্রুপদ)
 
   ...আর মানুষের কাছাকাছি থাকা।  মানুষের দুঃখের, অপমানের পাশে এসে বসা—এর চেয়ে বড় আর কি? “কবিতা তুমি কেমন আছো?/যেমন থাকে ভালবাসার মানুষ, অপমানে...”—বামপন্থী এই কবির এই কবিতাটিকে যদি একটি পরম আধ্যাত্মিক কবিতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরি, কেউ কিছু মনে করবেন? অন্তঃত আধ্যাত্মিকতার প্রথাগত ট্যাবু ভেঙে ফেলে তার ব্যাপ্তি আরো খানিক বেড়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এবং এই আলোচনাতে সেই চিরাচরিত অবলোকন থেকে একটু ঘুরপথে যদি যেতে চাই, নিশ্চিত আপত্তি হবে না কারো। এতে কবিতার তথা শিল্পের ভেতরে যাবার পথ হয়তো সহজ হবে কিছুটা।
   যদি বলি নব্বই দশকের একজন খুব আউট-স্ট্যান্ডিং কবি ভূদেব কর, তাহলে খুব বাড়াবাড়ি হবে না বোধহয়। ভূদেবদার বয়স (জন্ম:১৯৫৮) নব্বই এর কবিদের চেয়ে কিঞ্চিত বেশী। হয়তো একটু দেরীতেই তিনি প্রকাশ্যে এসেছিলেন। নয়তো তিনি সত্তরের কবি হয়ে যেতে পারতেন অনায়াসে। দশক বিচারের এই এক অসুবিধা, আবার সুবিধাও। সুবিধা এই যে আমরা ভূদেবদাকে এই আলোচনাতে টেনে আনতে পারছি। এবং এই টেনে আনা অহেতুক নয়। আত্মব্যঙ্গসহ বহু তির্যক রঙ্গ রসিকতাগুলি পাশ কাটিয়ে তাঁর প্রাণের ভেতরের যে কথাগুলি তিনি গোপনে লিখে ফেলেছিলেন তার দু-এক ছত্র এখানে পাঠকের উদ্দেশ্যে দেওয়া খুব অন্যায় হবে না । উপরের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটির সাথে একটা বহুদূরের অথচ গভীর সাদৃশ্যও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে—

এর মধ্যে কতগুলি বৃষ্টির বিকেল ঢুকে আছে আমি জানি না।
অনেকদিনের কথা মনে রাখতে পারি না।
প্রত্যেকবার শীতে গুটিয়ে ছোটো হয়ে গেছি
শীত কেটে গেলে মনে থাকেনি।
হাত পা ভেঙেছি, মেঘের গম্ভীর গর্জনে
ভয়ে ছিটকে গেছি কাদায়
একটি কিশোরী দেখে’ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে গেছি
সে যে কতদিন অথবা কতবার আমার মনে নেই।
খেতে পাইনি একদম তাও নয়
তবু স্রেফ দুটো লুচি খাব বলে
অপরিচিতের দলে চ’লে গেছি কতদূর
পেট ভরে গেলে মনে হয়েছে অল্প অপমান ছিল।
লুচির সঙ্গে হালকা ঘিয়ের মতন জড়ানো সেই অপমান
বেশিদিন মনে রাখিনি।

মানুষ থাকে এক এক রকম, অনেকদিন ধ’রে রচিত হয়।
সব কিছু মনেও থাকে না।
হয়তো চল্লিশ বছর ধরে একটাই বাতাস ঘুরে ফিরে
বয়ে চলেছে
আমি টের পাচ্ছি না...
(‘১৯৫৮—২০০২’ নামক দীর্ঘকবিতার অংশ)
   --এই কবিতাটির ভেতর কোথায় কোন লাইনের ভেতর আধ্যাত্মিকতা লুকানো রয়েছে দয়া করে এই প্রশ্ন আমায় করবেন না। শুধু এই ঘনঘোর জীবনের ভেতর অল্প শীতবোধসহ, ভুলে যাওয়া ছেলেবেলার অপমানসহ, একটি কিশোরীর সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা এবং একটাই বাতাসের ঘুরে ফিরে যাওয়া তিনি আমাদের ভেতর বইয়ে দিলেন। কি বলব এই বহমান বাতাস কে, তার আবেদন কে? সারা জীবন ধরে একটাই বাতাস ঘুরে ফিরে একটাই বৃত্ত রচনা করে একজন মানুষের জীবনে। বৃত্ত এক পূর্ণতা। কবি আলোক সরকার বলেছিলেন-- “...‘ঈশ্বর’ হল এক ‘সম্পূর্ণতা’...“—আমরা এই প্রসঙ্গে পরে আবার ফিরে আসব এই নিবন্ধে।
এবং  আমরা দেখব কিভাবে নিবেদনের  ভাষা পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। বাংলা কবিতার ‘ফুল পাখি চাঁদ’ এই সকলের ‘মাখো মাখো’ আবহর প্রতি বিদ্রুপ মিশ্রিত গালাগালি নতুন কিছু নয়। কোন মনোগত অভিপ্রায় ও চাহিদা থেকে এই বিরূপতা , তাও একটু ভাবলেই বোঝা যাবে। কারন ফুল পাখি চাঁদ প্রেম –এই সকল আবহমানতা থেকে মানুষের ব্যাবহারিক ও আত্মজৈবনিক বিচ্যুতিই আমাদের বিরূপতার দিকে নিয়ে যায়। আর প্রকৃত যে কবি, তিনি এই সকলকেই সময়ের এক দারুণ প্রেক্ষাপটে আবিস্কার করতে সক্ষম হন। তখন সেই ‘মাখো মাখো’ ভাবালুতা আর থাকে না। বরং তার আবিস্কার পাঠককে তার সুবাস-মথিত এক উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে রাখে—

কী এক ফুলের গন্ধ
শ্বাসে শ্বাসে রক্তে গেল মিশে
ঘ্রাণের গভীর তলদেশে
ঘণীভূত হয়ে উঠল কুসুম শরীর

গন্ধের মাদকে বুঁদ
কখন যে ফুল হয়ে থেমে গেছে বুকের বাতাস
জ্যোতির্ময়, স্তব্ধহৃদাকাশ

এইকানে, আলোর শরীরে
লীন হতে এসেছে সৌরভ,
ন ইলে সে কী কারণে আসে?
ফুল আর উদ্ভিন্ন প্রকাশে
বাতাসে ভাসিয়ে দেয় এ দিওয়ানাপন?

কামিনী কাঞ্চন বেলি
গোলাপ করবী লিলি
আরো কত অনাম অজানা
ফুলেরা উঠেছে ফুটে
মধু ও বিষের কুটে
রূপে রূপে চক্ষু হল কানা

চোখ বুজে খুশবু নিই
আলোর শরীর সেই
খুশবু ঘন ফুল হয়ে ফোটে

আলোর পাপড়ি মেলে
আলোতে সে ঢেউ তোলে
আলোর মৌমাছি এসে জোটে ।
(লীলাকমল/অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় /১৯৭৪/গ্রন্থ: লীলাকমল)


  কবি বীতশোক ভট্টাচার্য, দেবাশিস তরফদার আদি কবির অনুবাদে আমরা জেন দর্শনের অদ্ভুত আধ্যাত্মিক কবিতাগুলি পড়েছি। এবং আশ্চর্য হয়েছি সারা জীবন মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে, ঈশ্বরের খোঁজে, সটোরি লাভের জন্য, কাব্য ও শিল্পের খোঁজে হেঁটে চলেছে কি ভাবে! প্রাচীন চৈনিক পেইন্টিং এ যেমন দেখি—সমগ্র পট জুড়ে অনন্ত মহাকাশ, সুবিশাল পর্বতমালা, ঘন-বনানীর নিচে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র মানুষ! এই যে মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বড় বিশ্ব-প্রকৃতি, তারচেয়েও আরো অনেক বড় এক মহাকাশ, হয়তো বা ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ তা, --যা আমাদের মনের ভেতর স্বাভাবিক রূপেই ছিল একদিন। যখন আমরা ছিলাম প্রকৃতির সন্তান। হয়তো মন ও চেতনার দুইতৃতিয়াংশ জুড়ে তখন ছিল প্রকৃতি। সভ্যতা যত বিজ্ঞানহীন প্রযুক্তির পথে এগিয়েছে, ভোগ ও লালসা যত গ্রাস করেছে চেতনাকে, ততোই আমরা প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গেছি। মনের স্বাভাবিক কবিতাগুলিকে এড়িয়ে আধুনিক হয়ে উঠতে চেয়েছি। অথচ এই বঙ্গেই কোথাও কোথাও কোনো গ্রামীণ কবির কলমে এখনো হয়তো বেজে ওঠে সেই হাওয়া, যা হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে যায় না কোনোদিন। প্রথাগত আধ্যাত্মিকতার প্রলেপ এখানে নেই, তবু মনে হয় জেন-বাদী পেইন্টিং এরই কাছাকাছি কিছু—
এ পথ কাউকে না কাউকে দেখাতেই হত
তবু তুমি প্রথমা হয়ে উঠলে
আমি প্রথম
আঃ চারিদিকে এত আলো
সব যেন ঝলমল করে উঠছে
খড়ের পাখিটিও প্রাণবন্ত, যেন
কথা কয়ে উঠলো--'ও লক্ষ্মী, দেখ, কে যেন এয়েচে'
আমি ফিস ফিস করে বলি
প্রায় নিঃশব্দে বলি,--ঐদিকে যাবো
ঐদিকে নিয়ে চলো পথের কাঙাল...
(পথ/ শীতল বিশ্বাস)


এবং আরো আছে। সেমন এই কবিতাটি, যা পড়লেই মনে হবে যেন কোনো জেন সন্ন্যাসীই হয়তোবা এর রচয়িতা।


বেলা প’ড়ে আসে
           ঘরে ঘরে প্রদীপ
উন্মুক্ত শঙ্খের ধ্বনি
           মুখর করে চলেছে জীবন।
আমার ঘরে প্রদীপ নেই, শাঁখ নেই
            আমি কি নিয়ে বাঁচি?
দুহাতের আঁজলাকে পিদিম ক’রে
     ঘরের কুলুঙ্গিতে রেখে যাব।
     শিখা যদি নিভে যায়,
আমার আঁজলা কেউ কি দেখতে পাবে?
অন্ধকারে ভেসে ওঠে
          স্বপ্নময় কুলুঙ্গী।

(স্বপ্নময় কুলুঙ্গী/মন্থন মোদক/১৯৮৩--)

    মন্থন পুরুলিয়া জেলার মানুষ, সাধারণের কাছে প্রায় অপরিচিত এই কবি আজ আর কবিতা লেখেন কিনা জানি না, আমার চোখে পড়ে না অন্তত বহুদিন। তবু তার কবিতার পথ চেয়ে থাকি।  এইসব জীবন ও প্রকৃতির  সমাবর্তন বিশেষ দেখি না তো ...।

   সাধারণ ভাবে প্রকৃতি এক শায়িত রূপ। সমুদ্র, অরণ্য, নদ, নদী, মরু ও মহাসাগর সমস্তই চরাচরে শায়িত-প্রকৃতি। এমন কি পাহাড় ও গম্ভীর পর্বত, সেও শায়িত। তবু সে সুমহান, সুউচ্চ। কিন্তু তার উচ্চতা গর্ব্বোদ্ধত নয়। ধীরে, অতি ধীরে সে আকাশের দিকে, শূন্যের দিকে চলে গেছে ঢেউ দিতে দিতে।
   মানুষ শুধু প্রকৃতি-বিরুদ্ধ আস্ফালনে মানুষকেই নত করতে গিয়ে প্রকৃতির উপরে চলে যেতে চেয়েছে! শেয়ার-সূচক থেকে আল-বুর্জ সেই গর্বোদ্ধত অতি আধুনিকতার আস্ফালন ছাড়া আর কি ? গগন কে চুম্বন করতে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে গগন বিদারক। নাকি চুম্বনের ছলনায় সে বিদীর্ণই করতে চেয়েছিল তাকে? তবু পারা গেল কি? কি অসীম করুণা আজ ঝরে পড়ছে গ্রাউন্ড জিরোর নিচে!
শুধু কবি জানে প্রকৃত সত্য –
.
যেখানে প্রাচীর ওঠে অসম্ভব অহংকারে,তার
উপরে আকাশ দেখা যায়
দেখ, নিষ্পলক চেয়ে আছে নদী আর ওই চাঁদ
জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে উহাদের এ কূল ও কূল...
(দূরত্ব/অভিষেক ঘোষ /১৯৮৪--)

কবিতার নাম ‘দূরত্ব’ । এই দূরত্ব রচনা করেছে মানুষ। পরমা-প্রকৃতি ও তার আত্মার ভেতরে। আবার অনন্ত দূরত্বকেও ‘একটু দূর’ অর্থাৎ ‘নিকট’ করে নিতে পারে কবিই। এমন একটি কবিতা শোনাবার দুরন্ত ইচ্ছে দমন করা যাচ্ছে না। কবি মণিশংকর হয়তো কোনো খ্যাতিমান কবি নন। অন্তঃত আজ থেকে একমাস আগেও তাঁর কবিতার সাথে আমার আলাপ ছিল না। তথাপি তিনি প্রকৃতই একজন উল্লেখযোগ্য কবি—

নির্জন শেফালী আর একটু দূরের
ঈষৎ সবুজ ওই তারাটি—
বস্তত একই তরঙ্গের অংশমাত্র।
প্রতিদিন তারাদেরকে যে এইখানে ডেকে পাঠায়
সেই গাছটির নাম রাত্রি।

তুমি ধীরে ধীরে তার প্রতিটি শাখাই ছুঁয়ে যাচ্ছ
বালকের মতো হেলা ভ’রে..

শিশিরে, নৈশব্দে...
(কবি / মণিশংকর বিশ্বাস/ /গ্রন্থ: চন্দনপিঁড়ি)

   এই রচনাটি শুরু করার আগে আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত ছিলাম যে নব্বই ও তার পরবর্তী দশকগুলি যে হারে যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত এক সুপারন্যাচারাল সার্কাসের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, অন্তত: আশিতেও এমনটা ছিল না বোধহয়, [কারণ নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে টেলিফোন, আর তারপর মহাদানব মোবাইল ফোন। এবং অতি নিঃশব্দে ‘পত্র’ নামক একটি শিল্প মাধ্যমের পৃথিবী ব্যাপী পতন ঘটে। এবং সাথে সাথে সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর খুব দ্রুত ও ব্যাপক এক বদল শুরু হয় ও ক্রমশ তা পরিণতির দিকে যায়। ১৯৯০/৯১-এ জন্ম এমন, যারা এখন ২৪/২৫ বছরের যুবক-যুবতী। তাদের পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন এই মোবাইল ও টেলিফোন বর্জিত এক পৃথিবীর কথা! যখন কোনো গ্রাম্য বধূর কাছের মানুষটি কাছে নেই, হয়তো বহুদূরের কোনো শহর থেকে সে চিঠি লিখছে—‘আগামী রবিবার আসিতেছি, আমার প্রীতি-চুম্বন লইও...’। সেই পত্র পৌঁছলনা, মানুষটি এসে গেল তার আগেই...সেই যে হঠাৎ দেখার ব্রীড়া, দরজার আড়াল থেকে তার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠা... অথবা ঠিক এর উল্টো, চিঠি এলো, মানুষটি এলো না।--এ বহুদিন যাবৎ বাংলা সাহিত্যের অন্তর্গত এক বিষয় হ’য়ে ছিল...
{লক্ষ্মী পূর্ণিমার ভোর। কাদের কুলের বৌ
অন্ধকারে জল নিতে আসে, তার

লাজুক নূপুর থেকে জল ঝরে, আর কোন
পাতার আড়ালে ডাকে অবাধ্য কোকিল,

বধূটির মন উচাটন। দূর শহরের থেকে
তার স্বামী কালও ফেরেনি...
(ঘাট সিরিজ/সুমন জানা/গ্রন্থ : সামান্য কথার কথা/রচনাকাল: নব্বই দশকের দ্বিতীয়ার্ধ)}
 ... এই যে বিষয়, এখন আর নেই, আর থাকবে না।– একদিন দুদিন নয়, এই যে বহুযুগের সমাজ সংস্কার দু’দিনেই ভেঙে যাওয়া, এর একটা প্রভাব তো থাকবে?] সেই ভয় ভেতরে নিয়ে কবিতাগুলির দিকে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভয় বা আশংকা অমূলক ছিল হয়তো। দেখছি, এখনো বহু কবি এই বাংলায় রয়েছেন, যাঁরা এই বাংলা কবিতার আবহমান ধারাটিতে  বিশ্বাস রেখে লিখছেন। লিখে চলেছেন। প্রেম ও প্রকৃতি এখনো মানবমনের প্রধান পরিমণ্ডল। যা থেকে বিচ্যুতি শুধু আপন থেকে দূরে চলে যাওয়া। শূন্যদশকের কবি সর্বজয়া যেমন তাঁর প্রায় সকল কবিতাতেই এক মহাজাগতিক প্রণাম ছড়িয়ে রাখেন। কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁর পূজা স্পষ্ট হয় যেন—

পড়ন্ত বাতাস কাঁপে
মুঠোভর আকুল পরাগ।
শাখাময় এই নীরবতা
জল নেই,শুধু বৃষ্টিদাগ।


পাতাগুলি, তারাগুলি বাজে
কাজে,আর কিছু ফুলসাজে
মর্মগতি,আর অভেদ ফাগ
জল নেই,আছে বৃষ্টিদাগ।
(শাখ / সর্বজয়া)

অথবা এই দ্বিপদীটি, যেখানে কবি তার উদ্দেশ্য, তথা মঞ্জিলের ঘরে পৌঁছতে পারছেন না, তার আকুতি, তার দীর্ঘশ্বাস—

আঙুল মাত্র দূর, ডালে এক পাখি বসে আছে,
বিশ্বাস মাত্র দূর, পৌঁছতে পারি না তার কাছে!
(যোগিয়া/সুকান্ত সিংহ /১৯৭৪/গ্রন্থ:যোগিয়া)

... প্রেম, পূজা, প্রকৃতির চিরাচরিত সঙ্গীতময় কাব্য তো বটেই, এর বাইরে, জীবন ও জগত সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা, মমত্ববোধ কাব্যের মূলাধার। আমার অন্ততঃ এমনটাই মনে হয়েছে। এবং সেই সূত্রে, ছন্দে লেখা পদ্য-মাত্রই যেমন সবসময় কবিতা হয়ে ওঠেনা, একই ভাবে অনুভবি গদ্যাংশও কবিতা হয়ে ওঠে তার অনুভব তথা জীবনের প্রতি গভীর মমতায়। যেভাবে  আরণ্যক, তিতাস একটি নদীর নাম, ঢোঁড়াই, মাল্যবান ইত্যাদি কিছু কিছু বাংলা সাহিত্যের সম্পদ আছে যা কাব্যগ্রন্থ বলেই মনে হয় আমার। হয়ত এই ভাব থেকেই , হয়তো কেন, নিশ্চয় এই ভাব থেকেই গদ্য কবিতার জন্ম হয়েছিল । যেমন এই কবিতাটি—

তিনি কথা দিয়েছেন, আমাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করবেন এমন সরল প্রকৃতির লোহা, যা থেকে শুধুই চাষী ভাইদের জন্য লাঙল অথবা কাস্তে বানানো যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই নির্মিত হবে না ঘাতকের হাতিয়ার । যিনি নিয়েছেন ভার, তার নাম ঈশ্বর কামার। শ্রীমতী নদীর ধারে একটি চালাঘরকেই তিনি আপাতত মনে করেছেন কৈলাস পর্বত, অন্তত বছর তিরিশ সেখানেই কাজ সেখানেই বাস। সেই ঘরের আকাশে সর্বদায় জ্বলছে লাল আগুনের মতো সূর্য। চাঁদ উঠলে, তারা ফুটলে বন্ধ হয় ওই দোকানের ঝাঁপ। তিনি সর্বদায় পোড়ান আর পিটিয়ে চলেন, এতই কাজের চাপ যে, শরণাগতদের অধিকাংশকেই দু’একটা দিন বা সপ্তাহ পরে আসতে বলেন, ভিতর-বাড়ির থেকে ঈশ্বরী অথবা কন্যার এনে দেওয়া চা ও বিস্কুট বারবার খান, ছাই হয় বিড়ির বাণ্ডিল। মানুষ পিটিয়ে লোহা তৈরির অদম্য পরিশ্রমে বলিষ্ঠ শরীর বেয়ে ঝরতে থাকে ঘাম...
অবশেষে গিয়ে মেশে তাঁরই সৃষ্ট ওই নদীটির জলে।
(লোহা/ বিপ্লব চৌধুরী)
(এই কবিতাটির পর কয়েক মুহূর্ত নৈশ:ব্দের বিরতি...)

...


  ... ভিন্ন ভাবে ‘কবিতায় আধ্যাত্মিকতার খোঁজ’ আমাদের করতে হচ্ছে একটি নিবন্ধে, এও বাংলা কবিতার এক প্যারাডক্স বলা যায়। যা যুগের নিয়মে স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে আজ। অথচ এই নিবন্ধের প্রথমেই জীবনানন্দের যে উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে তা কিছুদূর অনুধাবন করলেই একথা পরিষ্কার হয় যে ব্যাপক অর্থে আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ না থাকলে কোনো রচনাই কবিতায় উত্তোরিত হতে পারে না কখনো। (এই প্রসঙ্গে একটু পিছিয়ে গিয়ে আলোচনা শুরু করলে এক অন্যরকম সূত্র পাওয়া যেতে পারে। যথা –জীবনানন্দ স্বয়ং। জীবনানন্দকে  ‘বিষাদের কবি’ হিসেবে দেগে দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণের রচনায় যে ‘আনন্দের গতি’ , জীবনানন্দের কবিতায় এসে তা পথ হারিয়ে ফেলেছে। এমন মনে করা হয়। এই হল আধুনিকতার ধাঁধা। জীবনানন্দ কখনো স্পষ্টঅক্ষরে তার ঈশ্বর সংক্রান্ত উপলব্ধি ব্যাখ্যা করেন নি। তথাপি তিনি লিখেছেন স্পষ্ট কিছু পঙক্তিমালা। যথা—‘শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়’ যা আমাদের ‘অপরূপ সূর্য চেতনার প্রভাতে নিয়ে যায়’ । এই প্রথম বন্ধনীর ভেতরে বলা কথাগুলির জন্য প্রয়াত কবি বিকাশ দাসের প্রতি ঋণ জানিয়ে রাখি।) – তো এই হল আধুনিকতার যুগ-যন্ত্রণা প্রসূত ‘আলো-অন্ধকার’। যা ক্রমশ নব্বই ও তার পরবর্তী কবিদের কাছে এসে  কখনো কখনো আরো কঠিন ও দুষ্পাচ্য হয়ে উঠেছে। এখানে আমাদের পরিচিত আধ্যাত্মিকতার রূপানুভূতি তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি গোচর হয় না, তারপর চোখ সয়ে এলে, ধাঁধা কেটে গেলে দৃষ্টিগোচর হয় সেই শিশুগ্রাম, যা আমরা ফেলে এসেছি বহু বহু যুগের ওপারে—


শোনো। রাতের বাতাস কি বলছে শোনো।
এ’গ্রাম শিশুগ্রাম। এগ্রামে কেউ বড় হয় না কখনো।

মাঠের ছায়া শুয়ে আছে মাঠের পাশে
আর মাঠে মাঠে চলছে যে খেলা, সে খেলা
থামেনি এখনো—
খেলছে যে শিশুরা—তারাও তো
খেলছে অনন্তকাল—
খেলবে অনন্তকাল
এখেলা থামেনা কখনো।

এ’গ্রামে দিন নেই, শুধুই রাত্রি
এ’গ্রামে বয়স থেমে মাঠের ঘাসে—
রাতের খেলা শুধু ভিজে যায় জলে
বর্ষায়, অশ্রুতে
বজ্রের আঘাতে—

শোনো। রাতের কান্না কি বলছে শোনো।
এ’গ্রাম শিশুগ্রাম। এ’গ্রামে কেউ বড় হয় না কখনো।
(বজ্রপাত/ আবীর সিংহ)

   শিশুরাই তো প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি মানব। এখনো আমাদের বানিয়ে তোলা ভুল শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিকতা যাদের স্পর্শ করেনি। কবি হয়তো বিশ্বজোড়া সেই শিশুগ্রাম-এর কথা বলতে চেয়েছেন। পৃথিবী ব্যাপী সেই অসংখ্য শিশু মনের  ঐকতান, যেখানে কেউ বড় হয় না, অর্থাৎ যেখানে বড়দের বানিয়ে তোলা ভুল-পৃথিবীর কোনো স্থান নেই। এই ভাবনাটিই শিহরণময়! যদিও কবিতাটির ভিতর অনেকগুলি পর্দা রয়েছে, যথা সময়ের স্থবিরতা (!) ইত্যাদি। সেগুলি আপাতত অনুন্মোচিত  থাক ।
   বিষয়ের চেয়ে উদ্ধৃতি এখানে স্থানে স্থানে দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে হয়তো। তবু আমি নাচার। কারণ উদ্ধৃতিই বিষয়। প্রবন্ধকার মধ্যে মধ্যে বটকেরা করছেন মাত্র। ‘বাংলা কবিতায় বিদেশী শব্দ’, বা ‘বাংলা কবিতায় প্রমিত শব্দ’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেমন পঙক্তিমাত্র উদ্ধৃত করে বিষয়টি বোঝানো যায়, এক্ষেত্রে সে পথ সম্পূর্ণ বন্ধ। কারণ কবিতার ভিতরের গভীর অনুভবটিকে (যা এখানে আধ্যাত্মিকতা) সম্পূর্ণতা ধরতে হলে সম্পূর্ণ কবিতাটি উদ্ধৃত করা ছাড়া উপাই নেই। সে কারনেই হয়তো এই নিবন্ধে আলোচ্য সময়-কালের বহু কবিই অনুপস্থিত থেকে যাবেন। তাছাড়া আলোচকের পাঠের অপ্রতুলতাও একটা বিশেষ কারণ। এই ভণিতা এখানে গেয়ে রাখলাম।
এখানে আপাতত কবি শংকর বসুর একটি মহাজাগতিক পথ হাঁটার ছোট্ট কবিতা পড়ে নিই—

সে কি টের পায়?
তার ছায়া
অনন্তের হাঁটা পথে সঙ্গদোষে মিশে থাকে
আমার-ই ছায়ায়...
(ছায়াসঙ্গী/ শংকর বসু)

  শংকরের কবিতাটি যেন শুধু বিশ্ব নয়, ব্রহ্মাণ্ড-প্রকৃতির দিকে চলে গেছে।   বর্তমান পৃথিবীতে এই প্রকৃতিকে শুধু ভুলে যাওয়া নয়। প্রকৃতির থেকে বিচ্যুত হতে হতে মানব সমাজ আজ প্রকৃতি-বিরুদ্ধতার দিকে চলে গেছে। প্রকৃতির কাছে নত হতে শুধু ভুলে যাওয়া নয় আজ মানুষ প্রকৃতিকেই তার সামনে নত হতে বলছে এক চরম স্পর্ধায়। যার মূল, ভোগ-ঈপ্সা। পরমা-প্রকৃতির কাছে পৌঁছানোর আকুতি তাই শুধুই ঠাকুমার গল্পকথার মতো শোনাচ্ছে...
    এখানে শংকরের কবিতাটি বলতে গিয়ে আরো একটি কবিতা মনে এলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই। কবি স্বর্ণেন্দুর এই তিন লাইনের ছোট্টো কাবিতাটির মধ্যে রয়ে গেয়ে সেই প্রস্তরীভূত অহল্যার চেয়ে থাকা, পৃথিবীর এই মাটি থেকে মহাজগতের দিকে নির্মিমেষ। শুধু একটি সম্মতির অপেক্ষায় আছি আমরা সকলে।  এই পূর্ণিমা, এই পৃথিবীর পাষান—সেও তো এক মহাজাগতিক খণ্ডতামাত্র! এই কথা মনে এলো—

তাকে সম্মতি দিতে বল, বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে
নক্ষত্রের দিকে মুখ, একটি পাথর, বৃষ্টিতে ভিজে গেলো আজ
আজ পূর্ণিমা, সম্মতির দিকে যেতে যেতে ভিজে গেছি আমরা সকলে...
(পূর্ণিমা/স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত)


...

   হয়তো আরো প্রচুর প্রচুর কবিতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে আমাদের। তারপর একটা তাৎক্ষণিক উত্তরের সামনে হয়তো দাঁড়াতে পারব। হয়তো তারপরেও প্রশ্ন রয়ে যাবে...। নিশ্চিত তারপরেও প্রশ্ন রয়ে যাবে...
   প্রশ্ন রয়ে যাবে কোথা থেকে এসেছিলাম, কোথায় বা যেতে চেয়েছি? –এই আদি ও অনন্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেছে মানুষ বরাবর। কবিতায় দর্শনে বিজ্ঞানে। সেইসব একাকী মানুষের পথ হাঁটা। আর কোথাও কোনো পথ না পেয়ে শেষ অবদি তার নিজের তৈরি মূর্তির সামনে এসে কেঁদে ভাসিয়েছে। যে অনন্তকে মানুষ কখনো কল্পনা করতে পারেনি, যে অসীম ধরা ছোঁয়ার অতীত, তাকে ছুঁতে গিয়ে মানুষ কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে। সে কখনো মাটি খড়ের মূর্তির ভেতরে তাকে দেখে ছুটে গেছে, কখনো অক্ষরের মধ্যে সাজানো কবিতার ভেতর। শ্যামলের একটা কবিতা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। যেখানে এই দুটো বিষয়কেই একসাথে আমরা পেয়ে যাব—
আমি মূর্তিকরকে দেখেছি
দেখেছি তার হাত ভরে উঠছে ভিজে মাটি...শুকনো খড়

তৈরি হচ্ছে মানুষেরই এক অবয়ব
আমি আঁকতে দেখেছি তার চোখ
যত্ন করে পরাতে দেখেছি শাড়ি

নির্মাণ শেষ হলে তারই সামনে নতজানু কান্নায়
গুমরে উঠতে শুনেছি মূর্তিকরকে—দেখা দে মা, দেখা দে

(শ্যামল ভট্টাচার্য/ গ্রন্থ: পঞ্চম আহুতি)

অথবা প্রায় একই বিষয় ভিন্ন অবলোকনে রয়ে গেছে সুকুমারের একটি কবিতায়—

সে এক অপটু চিত্রকর। কিছুদিন হলো আকাশে ছেড়েছে
                               এক অসম্পূর্ণ পাখি
সে পাখি এখনো হায় উড়াল শেখেনি তত ভালো
টলমল টলমল
          টলমল টলমল
এই মেঘ থেকে ওই মেঘ
          ওই মেঘ থেকে আরও দূর মেঘ
অভিমানে নিজেকে আড়াল করেছে

শিল্পী তাকাল আকাশের দিকে
পাখি নেই; অন্য পাখিরা সব উৎসবে ডানায় মেতেছে
(পাখিশিল্প/ সুকুমার মণ্ডল/গ্রন্থ:যে নদী গিয়াছে ডুবিয়া অস্তরাগ জলে)

এ হল সেই মানুষের আদি হাহাকার। এখানে মূর্তিকর ও শিল্পী যেন একই ব্যক্তি। তাদের হাহাকার আর অসহায়তা ছড়িয়ে দিচ্ছে কবিতার ভেতর দিয়ে।
এখানে এক অদ্ভুত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থাকব আমরা এই বাংলা কবিতার পাঠক। এখানে শ্যামলের কবিতাটি যেমন স্বরচিত মৃন্ময় মূর্তির ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সেই আবহমান রূপ। অরূপ বা অসীমকে তার স্বরূপে প্রত্যক্ষ করতে ব্যর্থ সামান্য মানুষের শেষ পর্যন্ত সেই মাটিকেই মাধ্যম করার কথা। মাটিকেই আঁকড়ে ধরা। উল্টোদিকে সুকুমারের কবিতাটি যেন স্বয়ং শিল্পীর পাখি-রূপ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির  এক অবসর। যে শিল্পীর চোখে তার সদ্যজাত উড়তে না শেখা সন্তানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কে সেই বিরাট ?
   কখনো কখনো ঈশ্বর এক গোপন কান্নার মতো! কান্না, কিন্তু বিষাদের নয় সর্বদা। এ এমন এক দুরূহ গোপনীয়তা যার অন্য কোনো দর্শক নেই। তাই শেষ পর্যন্ত শিল্পের, সঙ্গীতের আশ্রয়, কবিতার আশ্রয় নেয় ব্যথিত মানুষ—
অবশেষে আমি তাকে আবিষ্কার করলাম গোপনে
গুনগুন শব্দ সে
পাশাপাশি আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই

(চিরকুট /হিন্দোল ভট্টাচার্য /১৯৭৩--)

হ্যাঁ, সঙ্ঘ নয়। বরং সঙ্ঘাতীত এই অনুভব কবির একেবারে নিজস্ব। একাকীর। স্বপ্নের মতোই যার কোনো দ্বিতীয় দর্শক নেই।  তবু একমাত্র কবিই হয়তো পারেন তার অনুভবকে দ্বিতীয় কারো সামনে তুলে ধরতে।  সেইসব অনুভবগুলিই খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
 স্বপ্ন কী? প্রেম কী? যদি বলি স্বপ্ন ও প্রেম যথাক্রমে অসীম ও অরূপের ছদ্মবেশ। যা প্রতিটি মানুষের একাকীর।  এইখানে এসে এইবার আমরা কি জীবনের কাম-ঘামের দিকে মোড় নেওয়ার আগে প্রেমের কথা, প্রেমের গান শুনে নেব কি কিছু? কিন্তু সেই বৈষ্ণব কবিদের মতো করে কে শোনাবে প্রেমকথা এই সপ্রতিভ আধুনিকতায়? রবীন্দ্রনাথ যে কবিতা পাঠ করে আপ্লুত, বিস্মিত হয়েছিলেন?—সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি, কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমছবি, কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমগাম, বিরহ তাপিত হেরি রাধার নয়ান...—সেই প্রেমগান কি লেখা হয় আর! না। এখন এই অতিকালের সময়, যখন পৃথিবী তার প্রয়োজনের চেয়েও দ্রুত আবর্তিত হয়ে চলেছে, তখন এই প্রেমগানের তাল-লয় ভেঙে যেতে বাধ্য। তাই সেইসব না থাকারই কথা। ভেবেছিলাম নেই। তবু দেখি এই সমসময়কে অস্বীকার করে কেউ কেউ মহাকালের ইচ্ছার দিকে হাত বাড়ায়।

রাই ধনি কে লো ,আশেপাশে আমি সই না, গুঞ্জয়ে মধুকুঞ্জে সখী , আমি সে কাজল ভোমরা ।
আমি তোর সোহাগের দাসী- সোহাগে ওই মরি বাঁচি মরি … ভিতরে সোনার পাখি রেখে
খাঁচায় তালা দিলেন সাঁই। আর তার এত টলমল , নবোজ্জ্বলরস ! রসবতী, আমি রাই রাই
নামে ভরি কলসের সুখ। তোমার প্রেমের কী বা জানি

(রাই ধ্বনি ১/ দীপান্বিতা সরকার)
হ্যাঁ, আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, এই তো, সময়ের গতির সাথে সাথে তার তাল লয় আর জীবনের মাত্রা যথপোযুক্ত রেখে সেই বৈষ্ণব কবিতাই তো এসে পড়েছে এই কালে! না বোধহয়, বিস্ময়ের নয়। কারণ এ কোনো সমাপতন নয়। বরং স্বাভাবিকতা। জীবনের, ছন্দের স্বাভাবিকতা—স্বাভাবিকতা, কারণ দীপান্বিতা একা নন। সেই একই পুরাতন প্রেম, পুরাতন অথচ চির নতুন ভাষায় লেখা প্রেম আরো রয়েছে।  এবং লেখা হয়ে চলেছে--

আদিগন্ত রাজ্যপাট তোমাকে দেখেছি ছেড়ে যেতে
যখন কোপাচ্ছ মাটি এক চিলতে বেড়াঘেরা ক্ষেতে
তোমাকে দেখেছি আমি দূর থেকে, বাঁধের ওপরে
দাঁড়িয়েছি কতদিন নদীর রঙের শাড়ি প’রে
আমি জানি তুমি সেই রাজকুমার, আড়াল-বিলাসী
কোথায় তোমার বীজ, কী শস্য বুনেছ ক্ষেতে, চাষী?

জলের খোঁজে কি তুমি তাকাবে এদিকে মুখ তুলে
নদীকে কাঁপাল ঢেউ, নদীও ত গিয়েছিল ভুলে
কবে সে এসেছে ফেলে প্রাসাদে সোনার জল-ঝারি
তুমি কি চিনেছ ঠিক? আমি সেই রাজার কুমারী...
(রূপকথা/মন্দ্রাক্রান্তা সেন)

 
এইখানে কিছু কথা বলা দরকার। যথা ভাষা ও জীবন। কবিতা তো আধ্যাত্মিক, সামাজিক এমন কিছু হয় না! বরং এই আধ্যাত্মিকতা জীবনের একটা চর্চা, বা একটা যাপন। কবিতা তার একটা উপাদান হয়তো। এখানে এই যে কবিতাগুলি উঠে আসছে তার অর্থ এই যে কবিগন সকলেই বিভিন্ন ভাবে, রূপে সেই চর্চার মধ্যে রয়েছেন। অন্য দিকে ভাষা ভেঙে যাচ্ছে। যে ভাষায় ডাক দিলে ভেতর পর্যন্ত হুহু করে উঠত একদা ,সেই ভাষা ভেঙে যাচ্ছে। টেলিভিশন, সিনেমা বানিজ্যিক সাহিত্যে ভাষাকে ভেঙে একমাত্রিক করা হচ্ছে। সুতরাং চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। একটা গোটা জাতী সম্পূর্ণ ভাবে যেখানে কবিত্বের অধিকারী ছিল সেখানে কবি বলা হচ্ছে কয়েকজন হাঁকডাক-ওয়ালা মানুষকে। সেই হাঁকডাকও তৈরি করা, বানানো, এখানেও চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।৷  প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে লিপিকুশলতাকে।   আমরা ভাষাকে হারাচ্ছি। বৈচিত্র্য হারাচ্ছি। একজন অক্ষর পরিচয়হীন বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের, অন্ত্যজ, বাউরি পাড়ার মহিলা শীতের রাতে কিভাবে মনে মনে লিখে ফেলে একটি তুষু গান, সকালে শীতে জুবুথুবু, দল বেঁধে কি ভাবে গীত হয় সেই গান, তাকেও আমরা হারাচ্ছি। সেই অন্ত্যজ প্রেম, সেই জীবন-কবিতার ঈশ্বরকে আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি। তিতাসের মালো পাড়ার মানুষদের কথায় কথায় কাব্যি! সেই কাব্য-ভাষা নষ্ট করে ফেলেছি । অন্যদিকে যে বর্তমান ভাষায় কথা বলি সে ভাষা পরস্পরে বুঝি না। কেউ কারো ডাক শুনতে পাই না তাই! মন্দাক্রান্তার  উদ্ধৃত কবিতায় সেই ভাষাটি ছিল, দীপান্বিতায় রয়েছে। ভাষাটি আমাদের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে...। ভাষার ঈশ্বর এখনো জীবিত এইসব কবিতায়। আমারা সেইরকম কবিতাগুলিই খুঁজে দেখব এখানে।
  মানুষ তার ব্যথিত জীবনের , অসহায় জীবনের কলরোল ঈশ্বরের হাতে তুলে দিতে চায়।হে ভগবান আমায় মুক্তি দাও—ব’লে, নিজে দায় মুক্ত হতে চায়। নিশ্চিত জীবন পাওয়া গেল না বলে বিষণ্ণ হয়। সেইসব কথাগুলিও বিষয়। কতরকমের যে ব্যাপ্তি, বোধ এই বাংলা কবিতায় ছড়ানো রয়েছে, পাঠক হতবাক হয়ে যায় এর সামনে দাঁড়িয়ে। দুমুঠো ভাত ঈশ্বর-স্বরূপ হয়ে ওঠে কখনো। থোকা থোকা সাদা ভাত ভাঙা থালায় স্বপ্নের মতো জেগে ওঠে—
গৃহস্থ
সোমেন মুখোপাধ্যায়

ফুলের বোঁটা ছিঁড়তে গিয়ে
স্তনবৃন্তের কথা মনে পড়ে,
মনে হয় অভুক্তের কথা।

শ্রীচরণে পূজিত ফুল
ভাতের থালা হয়ে, গৃহস্থে এস।
অথবা স্বয়ং ঈশ্বরকে ভাত বেড়ে দেয় কেউ কচুর লতি সেদ্ধ দিয়ে। এমন কি ছেঁড়া কাঁথার ঘৃণা, তাও ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়। সেই যে, বলছিলাম না—এখন ঈশ্বর সখারূপ! তাকে অল্প হেসে ধাক্কা পর্যন্ত দেওয়া যায়! আহ্ পৃথিবী—
ঈশ্বর ও আমরা
সন্তু দাস
ঈশ্বর আমাদের বাড়ি ভাড়া দেয়
বর্ষায় পিচ-চট দেয়
মাকে নতুন বাড়ির কাজ দেয়
শেষ রাতে আমাকে ঘুমহীন স্বপ্ন দেয়
আমরা ঈশ্বরকে নেশার জন্য পয়সা দিই
মায়ের হাতের কচুরলতি দিই
গরমে তালপাতার প্রেম আর
শীতে ছেঁড়া কাঁথার ঘৃণা দিই
এভাবে
ঈশ্বর আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসে
আমরা ভীত ঈশ্বরকে কাচের ফ্রেম দিই…
কেউ হয়তো শেষোক্ত কবিতাটিকে একটি এ্যান্টি স্পিরিচ্যুয়াল ইমেজ হিসেবে দেখতে চাইবেন। আমরা সেরকম ভাবে দেখছি না। এও সেই নেতি নেতির ভেতর দিয়ে, ঘৃণা-ভালবাসা। যেরকম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটি তার সকল সদস্যের মধ্যে প্রতি নিয়ত অনটন ঝগড়া বিবাদের ভেতর দিয়ে তাদের ভালবাসার সম্পর্কটিকে বয়ে নিয়ে যায় আজীবন। ভোগ, লালসা থেকে বহুদূরের সেই প্রাকৃত জীবনকে প্রণাম ছাড়া কি-ই বা জানাব।
...

 এইবার আমরা এসে পড়লাম জীবনের কাম-ঘামের ভিতর। এবং এরপর অবধারিত ‘মৃত্যু’-র দিকে যেতে হবে আমাদের। প্রেম,পূজা ও প্রকৃতির দেবতাকে আমরা ‘দেখেছি’। বাংলা কবিতার ভেতর তার ‘অরূপ’ ও ‘অসীম’ আমরা ‘দেখেছি’। এখনো যা আমরা দেখিনি তা ‘কাম’ ও ‘মৃত্যু’। মানুষের যৌনতা আর মৃ্ত্যুর রূপ আমরা ভেদ করতে পারিনি কখনো। সেই রহস্যানুভুতিও তো একপ্রকার অরূপ। তার ভেতরের আলো-অন্ধকার ভেদ করবার যে অবিরাম প্রচেষ্টা, যে আকুতি সেই আর্তির দিকে এইবার পা-বাড়াব। কাম, যৌনতা, মানব-মানবীর দেহমিলন –এক রহস্যঘন অনুভুতি। অপর দিকে মৃত্যু এক হিমশীতল আঁধার। এর মাঝে মানুষের ‘কাম-ঘাম’যুক্ত সংসার। মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্নতা আর একত্র হওয়ার প্রচেষ্টা।
দেখতে পাও, বলিশেষের খড়্গ গাঁথা নদীর কুলে
রক্ত অন্ধকার মাখা তার জড়িয়ে থাকা একটি চুলে
(প্রলয়/ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়/১৯৭০--)
আরো একটি নশ্বরতার কবিতা
কি বলে গেলে?
কিছুই স্থায়ী নয়
         আলো, অন্ধকার...
(জোনাকি/ অনির্বাণ দাস/১৯৭৭--)

এবং একেবারে এই সময়ে এসে, এই সাম্প্রতিকতায়, সেই অন্ধকার , যা মানুষকে ঘাড় ধরে জলের মধ্যে মুণ্ডু চুবিয়ে রাখে আর বলে—দ্যাখ, এই সেই অন্ধকার। আর মানুষ ও তার অন্তরাত্মা হাঁপিয়ে ওঠে। সামান্য শ্বাসের জন্য হাঁপিয়ে ওঠে, আর ছাড়া পেলে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াতে চায় খোলা আকাশের নিচে। পারেনা। কবিতা শেষ  হলে শুধু সেই বোধটুকু থাকে যা, মানুষকে আলোর প্রয়োজনের কথা বলে। এই কি তাহলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভেতর অনুভূত সেই ছায়াচ্ছন্ন ‘আধ্যাত্মিকতা’ ?

সিঁড়িটি অবাক হয়ে উঠে গেল দোতলার ছাদে।
গিয়ে দেখে, সব সত্যি—
‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍বাড়িঘর, প্রতিবেশী, এজমালি হাওয়া,
সুপুরিগাছের দাঁতে বিঁধে যাওয়া আকাশী পাথর,
কোথা দিয়ে ট্রেন যায়, কোথায় যে যায়
দ্রিম-দ্রিম শব্দ এসে ধাক্কা দেয় বাড়ির দেয়ালে।
এরপরে আর
কোথাও যাওয়ার নেই, এই কথা শুনে
সিঁড়িটি একাই নিচে নেমে এলো, ধীরে ধীরে
‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ ‍‍‍‍‍‍ অন্ধকার জমে উঠল সিঁড়ির তলায়।
(সিঁড়ি/ শৌভ চট্টোপাধ্যায় )
কি পেলাম এই কবিতায় আমরা? বিষণ্ণতা, অন্ধকার! অন্ধকার তো আমরা চাই নি। আমরা চেয়েছি আলো। তাহলে আধ্যাত্মিকতার আলোচনায় অন্ধকার কেন? –এই প্রশ্ন জীবনানন্দকেও ছেড়ে কথা বলে নি। তাকে মৌলিক বিষাদের কবি বলে পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন আধুনিকতার সময় তাকে নিয়ে পথ চলা ছাড়া গতি নেই। এ যেন ফটোগ্রাফির সেই ‘কনট্রাস্টনেস’। ‘আলো-অন্ধকার’। এই আলো-অন্ধকারের ভেতরেই ছবি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমরা তাকে দেখতে পাই। এখানেই কবিতাটির সার্থকতা হয়তো... হয়তো ঐ সিঁড়ি বেয়েই সিঁড়িটি শেষবার উঠে যাবে আলোর দিকে...


...

তাহলে এই ‘পরমা-প্রকৃতি’ থেকে ‘ঈশ্বর’ কতদূরের পথ? এর উত্তর খুঁজতে আমরা আশ্রয় নেব কিছু অন্যরকম উদ্ধৃতির। যেহেতু আধ্যাত্মিকতা কোনো বিশেষ দশকের মধ্যে আবদ্ধ রেখে আলোচনা খুব কঠিন ব্যাপার, তাই অনন্যোপায় হয়ে আমাদের যেতে হবে প্রবীণদের কাছেও। কারণ রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী কথিত সেই ‘ভারতীয় সুর্যাস্ত’। ‘ভারতীয় সূর্যাস্ত’ কথাটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন মানুষের ভেতর আধ্যাত্মিকতার উন্মেষের সময় হিসেবে, যা পড়ন্ত বেলার দিকে বয়স ঢলে পড়লে আপনা আপনি চলে আসে। অর্থাৎ জীবনের অহেতুক কলরোলগুলি স্তিমিত হয়ে এলে, যৌবনের উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে এলে যা সকল মানুষের ভেতর অতীব গোপনে প্রবেশ করে। --সেই ‘ভারতীয় সূর্যাস্ত’। সেই কারণেই, নব্বই ও তার পরবর্তী দশকের কবিরা এখনো মধ্য যৌবনে। অবশ্য সকলের জীবনেই যে এই ভারতীয় সূর্যাস্তের আলো এসে পড়বে এমন কথা নেই। আবার কেউ কেউ অনেক আগেই যে এই আলোর সন্ধানে বাহির হন সে তো আমরা উপরের উদ্ধৃত কবিতাগুলি থেকেই জানলাম। যাই হোক, প্রশ্ন এই-- ‘পরমা-প্রকৃতি’ থেকে ‘ঈশ্বর’ কতদূরের পথ?
     এক সাক্ষাৎকারে কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রবীণ কবি আলোক সরকারের কথোপকথন —
“—ঈশ্বর শব্দটা আপনার কাছে কেমনভাবে আসে, কী প্রতীক বা তাৎপর্য নিয়ে—যদিও আপনার লেখায় ঈশ্বরের উপস্থিতি বিষয়ে আলোচনা অনেক হয়েছে।
--‘ঈশ্বর’ মানে আমি বুঝি ‘সম্পূর্ণতা’।
-- এই ‘ঈশ্বর’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণতা’-র সঙ্গে সাক্ষাৎকার কি আপনার কবিতার মাধ্যমেই হয়? একটু আগে অনির্বাণের (ধরিত্রীপুত্র) আলোচনায় একটা কবিতা এসেছিল—“যে কোন পথের বাঁকে ঈশ্বর আসেন। আমরা কেবল দেরী ক’রে যাই”। পরে এরই সংযোজন—“এক মুহূর্তের/ভিন্নতায় সমস্ত জীবন রিক্ত মলিন তমসা”—এই উচ্চারণ, এই সাক্ষাৎ না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
--আমি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারিনি, এই যে ত্রুটি, এই যে দেরী, মাত্র এক মুহূর্তের। তার আগেই ঈশ্বর সেখানে ছিলেন—এখনো তাঁর গন্ধ চারদিকে ভাসছে”।
‘ঈশ্বর’ অর্থাৎ ‘সম্পূর্ণতা’।–এই হল একজন পরিণত কবির মনগত আধ্যাত্মবাদ। এই কথাটি বলার জন্যই এত কথা বলা। আমরা বিভিন্ন ভাবে সকলেই ভিন্ন ভিন্ন পথে সেই সম্পূর্ণতার দিকেই চলেছি। যেতে চাই। এই কথা।







( প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশী শব্দ খরচ করার পরেও নিবন্ধটির মধ্যে দিয়ে আমরা বিশেষ কোথাও পৌঁছাতে পারলাম কি ? অথবা রচনাটি কি আদৌ শেষ হয়েছে? এই নিবন্ধটির পূর্ণতার দিকে যেতে গেলে আরো অনেকের কবিতার অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন ছিল। অরুন্ধতী চক্রবর্তী, অর্ণব পণ্ডা, তিলোত্তমা মজুমদার আদি কবিদের সুকবিতার উদ্ধৃতি। সুতীর্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপ ঘোষ সহ অনেকের লেখা এখন আর দেখি না বিশেষ, এক দশক আগেও এঁদের প্রচুর রচনা পড়া হত। ভবিষ্যতে কখনো বিস্তৃত লেখার ইচ্ছা রয়ে গেল। এই নিবন্ধে কবিদের কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকা থেকে রচনা সংগৃহীত হয়েছে। যথা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘অনুবর্তন’ পত্রিকার প্রায় ২০/২২ খানা খণ্ড, এখানে বলে রাখা উচিৎ যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একমাত্র এই অনুবর্তন পত্রিকাটিই, যাঁর সম্পাদকগন ধারাবাহিক ভাবে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কারের দুনিয়ায় এক আধ্যাত্মিক ভাবান্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই পত্রিকার বহু কবিতা ও গৌতম বসু, অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র, দেবাশিস তরফদারে প্রবন্ধাদি পাঠে উপকৃত হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। নিবন্ধটি লেখার সময় সেই পাঠপ্রভাব থাকবেই। কবি গৌতম চৌধুরীর বিভিন্ন প্রবন্ধ পাঠেও ছড়ানো রয়েছে ঋণ। নিবন্ধটির শেষে কবি আলোক সরকারের সাক্ষাৎকারের অংশটি অনুবর্তন পত্রিকার ফাল্গুন ২০১৪ সংখ্যা থেকে গৃহীত।   এছাড়া পাখিরা, মিরুজিন,গুহালিপিগুহালিপি ও আন্তর্জাল পত্রিকা থেকে কোনো কোনো কবিতা নেওয়া হয়েছে।)


























সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৬

নীল পানকৌড়ি


নীল পানকৌড়ি


 কৌশিক বাজারী


অনেক দিন পর আজ বিদিশাকে দেখলাম স্বপ্নেদূর থেকে দেখলাম, সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে একটা রঙিন ছাতায় রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেমেয়েদের অপেক্ষার একটা একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে দেখলেই বোঝা যায় তার অপেক্ষারত চোখ ও দেহভঙ্গি সেই বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিদিশাএমনি তে সে বরাবর একটু চাপা ও গভীর স্বভাবের ,গম্ভীর নয় যদিও ক্লাসের অনান্য মেয়েরা ওর চাপা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এেঁটে উঠতে পারতো না অনার্সের ক্লাস চলত একটু বেশীক্ষণ ধরেই ওর ক্লাস শেষ হওয়া অব্দি আমি আপেক্ষা করতাম কলেজের দোতলার করিডোরেএখান থেকে লীলাসায়রের একটা অংশ দেখা যায়ঐ দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কেটে যেত, লীলাসায়রের জলে ঝাঁকে ঝাঁকে বালীহাঁস উড়ে আসত শীতকালেবিদিশা বলত; ওরা নাকি সমুদ্রসারস, সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসছে এই খানে প্রেমের সন্তানের জন্মদিতে রঞ্জনবাবুর ক্লাস থাকলে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে একটা স্নেহের হাসি উপহার দিয়ে যেতেনকোনোদিন হয়ত অল্প দাঁড়িয়ে বলে যেতেন; ‘তোমাদের পত্রিকা দেখলাম, আমার লেখাটায় বেশ কিছু প্রিন্টিংমিস্টেক রয়েগেছে, পরেরবার আমায় প্রুফটা একটু দেখিয়ে নিও...অবশেষে ওদের ক্লাস থেকে একে একে বেরিয়ে আসত সকলেকেউ কেউ মুখ চেনা, যারা প্রতিদিন আমার অপেক্ষার কথা জানে, তারা চাপা ঠাট্টার সুরে  বলত:বিদিশা ? ঐ যে , পিছনে, আরেকটু দাঁড়াও...দেখতাম বিদিশা সরকার কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে আসছে হাসি মুখে
   আজ অনেক দিন পর তাকে স্বপ্নে দেখলামভেবে ছিলাম ভুলে গেছিঅথচ বিস্মৃতি কোন অতল প্রান্তথেকে ধীর পায়ে হেঁটে এসে সে অপেক্ষা করছে আজ আমার জন্য ! সে কিছু বলতে চায় আমায় ?
   সামনের মাসে সম্বিতের বিয়েহ্যাঁ, অনেকটা বেশী বয়সেবিদিশা কি খবর পেয়েছে ? সে কিছু জানাতে চায় আমায়? জানাতে চায় কোনো পুরনো গোপন দলিল ? কিন্তুকি কথা তাহার সঙ্গে, তার সাথে সে তো বছর পনেরো আগেই বিয়ে করে বর নিয়ে সাত সমুদ্র পারের এক রূপকথা শহরে চলে গিয়েছিল ! যাওয়ার আগে আমরা জানতেও পারিনি সব কথা শুধু কয়েক দিন আগে এসে বলেছিল:বিয়ে, ...চললামতারো আগে বহুদিন ধরে সম্পর্ক আলগা হয়ে গেছে তখন ছিল একটা সময়, প্রথম জীবনের বণর্মাধুর্য্য উঠে গিয়ে স্বাধিষ্ঠান খুঁজে নেওয়ার কাল  একটা সময় যাদের ছাড়া জীবন মিথ্যে বলে মনে  হত, মনে হত আমাদের এই দ্বীপ ছাড়া আর সমস্ত জগৎ ভুল পথে দৌড়চ্ছে, মনে হত; এই দ্বীপের বালুকা থেকে একদি সোনা খুঁজে পাওয়া যাবে--- সেই দ্বীপ একদিন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল সেই ভুল পথের জগৎময়, সারা ভারত ভারতবর্ষ জুড়ে...
   সম্বিত গান্ধীনগরে  এন.আই.ডির সহকর্মী অধ্যাপিকাকে বিয়ে করবে স্থির করেছে সম্প্রতি একমাথা লালচে চুলের, ফর্সা, মাঝারি হাইটের সম্বিত এখন টেঁকোপ্রতিদিন নিয়ম করে কলেজে বেরোবার আগে গালে আর মাথায় রেজার চালায়একটা সম্ভ্রম জাগানো চেহারা হয়েছে তার। --এসব কথা বিদিশা জানে ?
   আজ কুড়ি কুড়ি বছরের পর স্বপ্নে দেখলাম বিদিশা সেই ময়ুরকণ্ঠি রঙের ঘাগরা চুড়িদার টা (কুড়ি বছর আগের ফ্যাশন) পরে দাঁড়িয়ে আছে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে,--যা ছিল একদিন আমাদের ভেঙে যাওয়া দ্বীপভুমির একটা অংশ


   সমস্ত স্বপ্নের মতো এই স্বপ্নটাও নিতান্ত অসময়ে ভেঙে যায়ঘুম ভেঙে উঠে দেখি আমার পাঁচ বছরের পুত্র তার মায়ের সাথে বেরোবে বলে রেডি হচ্ছে  ছেলে আমায় জেগে উঠতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে; ‘বাবা উঠে গেছিস? চল তুইও যাবি আমার সঙ্গে মা আমি আর তুই...চল
--না ,বাবা যাবে না, উঠে এসো,পোষাক নষ্ট হবে, উফ্ এই ছেলেটা...
-- না , বাবা যাবেই...
-- না সোনা , আমি যাবো না, তোমরা যাও, আমার বাড়িতে কাজ রয়েছে..
ছেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়টাটা করেউষাআমার বৌ, বেরোবার সময় বলে যায়
--রান্না ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দিওআজ দুপুর বেলা আবার বেড়াল এসেছিলআমি সন্ধের পরেই বাবাই কে নিয়ে ফিরবোবিকেলে বাজারে বেরোবে তো?
--বেরোবো...
--(হুইস্পারিং টোনে) একটা হুইস্পার এনোতো, এক্সট্রা লার্জ
--তুমি তো বেরোচ্ছোই...
বৌ একটা বিরক্তির চাউনি হেনে চলে যায়মানেওটা তোমার দ্বায়ীত্ব

  ওরা বেরিয়ে যেতেই একলা ঘরে শেষ দুপুরের চৈত্রমাস যেন অনেক দিন পর জানলা দিয়ে হাত বাড়ালএখন আর ঋতু পরিবর্তন খেয়াল রাখিনা বহুদিন হল, চোখে পড়েনা কখন শীতের ধুসরতা কেটে গিয়ে শান্ত সজিনার ফুল ঝরে গেল, এই ছোট্টো শহরের সীমানা ছাড়িয়ে পলাশের উল্লাস দেখতে যাওয়া হয়না বহুদিনশুধু এই রক্ষণশীল সমাজের মাথায় যেদিন দোল পুর্ণিমার চাঁদ খেলা করে, সেদিন বুঝি বসন্ত পার হয়ে গেলভেতরে বহু পুরনো প্রায় বিবর্ন ফটোগ্রাফের মতো একটা মন্দ লাগা বেজে ওঠে
   আজ হঠাৎ এই ফাঁকা ঘরে অনেক দিন পর একটা সর্বমঙ্গলা বাতাস এসে জানলার পর্দাগুলো এলোমেলো করে দেয়কুড়ি বছর আগে লীলা সায়রের কিনারে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পিছনে এরকম হাওয়া দিতঅশত্থ গাছের হলুদ পাতা গুলো উড়ে যেত সায়রের জলের উপর দিয়েউড়ে উড়ে বহুদূর গিয়ে জলে পড়ততারপর ভেসে ভেসে যেত জলের ঝিলমিলের সাথে
বিদিশা বলত—‘ঐ দেখ, নীল পানকৌড়িআমার খুব ইচ্ছে হত ঐ সময় বিদিশার হাত ধরে বলি; ‘নীল পানকৌড়ি ! হয় নাকি রে ! ...তুই বললে সত্যি মনে হয়অথচ তা বলা যায় না কখনোই , অন্তত কুড়ি বছর আগের মূল্যবোধে তা ছিল অসম্ভববিদিশা আমার নিজস্ব প্রেমিকা নয় আমি এক মধ্যস্থতাকারী মাত্র সে সম্বিতের প্রেমিকা হতে চায় লালচে চুলের ফর্সা সদাহাস্য সম্বিতদারুন ছবির হাতগত বছর কলাভবনে চান্সপেয়ে চলে গেছে সে এখন শান্তিনিকেতনেআমি সুমিত, কালো রোগা চেহারা নিয়ে সম্বিত হয়ে বসে থাকি বিদিশার পাশেঅশত্থ গাছের থেকে টুপটাপ জীর্ন পাতা গুলি ঝরে পড়ে বিদিশার কোলে চৈত্রবাতাস মাঝে মাঝে বিদিশার চুল নিয়ে খেলা করেআমি ঝোলা থেকে গোলাপীখাম বার করিআমার ঠিকানায় সম্বিতের চিঠি আসেবিদিশার চিঠিবন্ধখাম বিদিশাকে দিইবিদিশা আনমনে নেড়েচেড়ে আমার হাতে দেয়, বলে; ‘তুই পড়, পড়ে শোনা...আমি ইতস্তত করি, তার পর মধ্যস্থতাকারীর মতো নিরপেক্ষ স্বরে সম্বিত হয়ে সেই চিঠি পড়িআমার কণ্ঠ কি কেঁপে কেঁপে যাচ্চে...?
  “... এখানে এখন বর্ষাকালআম্রকুঞ্জে ধারা বর্ষণ চলছেগতকাল বৃক্ষরোপন উৎসব হয়ে গেল বিদিশা বর্ষাকালে শান্তিনিকেতনের এক অজানা অপরূপ রূপ আছে, জানোএখন মেঘ মাথায় নিয়ে ভাঙাখালের কিনারে বসে আছিসারা বছর যে ভাঙাখাল শুকনো পড়ে থাকে, বর্ষায় সেখানে খরস্রোত বয়ে যায়দেখো বিদিশা, আমার চারিদিকে খোয়ায়ের পাড় ভাঙছে, ধারা নামছে, আমি ভিজে যাচ্ছি, তুমি কোথায় বিদিশা... 
 বিদিশা আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে;-- ‘ আমার মিথ্যেকথা ভাল্লাগেনা সুমিত...
  আমি থতমত খাই, পড়া থেমে যায়
--মানে?
--মানে এসব কথা সম্বিত সত্যি লিখেছে ?
--হ্যাঁ, বর্ষার শান্তিনিকেতন তো এমনই শুনেছি...
--সে তো বিঞ্গাপিত সত্য ক্লাস টেনের রচনা বই তেই পাওয়া যায়, ওখানে যেতে হবে কেনো...
--কি বলছিস...?
--তাছাড়া আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এই লেখা হস্টেলের অন্ধকার বিছায় বসে লেখা...ভাঙাখালের কথা বানানো...
--তাতে কি , হয়তো দুদিন আগে গিয়েছিল, বা পরে...
--তাহলে মিথ্যে লিখবে কেন ?
--মিথ্যে কেনো হবে ?
--মিথ্যে মিথ্যেই... এই যে তুই বসে আছিস, পাশে, সম্বিতের লেখা পড়ে শোনাচ্ছিস...এইটা, এইটা বরং অনেক বেশী সত্যি। (একটু থেমে, খানিকটা যেন অন্য মনে) সারা বছর শুকনো, খরা বর্ষাকালে আমি খরস্রোত নিয়ে কি করবো সুমিত...? আমি আসছি...
   বিদিশা তার লাল মেয়েলি সাইকেল নিয়ে সায়রের পাড়ের রাস্তা দিয়ে চলে যায়সর্বমঙ্গলা বাতাস সায়রের কালো ঝিলমিল জলে ঢেউ তোলে নীল পানকৌড়ি ডুব দেয়, মাছ পায় না, উড়ে যায়...


   ....                   ....                    ....

   

    সন্ধের বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি মা-ছেলে বাড়ি ফিরেছেছেলের মায়ের হাতে হুইস্পারের প্যাকেট দিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসিসামনের দেয়ালে একটা সস্তার ঘড়ি ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ভেতরের দিকে এগোচ্ছেছেলে পাশের ঘরে সুর করে পড়ছে—“তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্না ঘরের চালে, ...দূরে কাদের ছাদের পরে ...ছোট্টো মেয়ে রোদ্দূরে দেয় বেগনী রঙের শাড়ি...না:, সুরটা কেমন যেন পাল্টে গেছেআমাদের ছোটোবেলায় অন্য সুর ছিল এই কবিতা টার ! মনে করার চেষ্টা করি মনকে স্থির করার চেষ্টা করিএকটা সিগারেট ধরায় টেবিলে বসেজানলাটা খুলে দিইদূরে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের পরেও একটা বহু পুরানো কালচে লাল আভা ছড়িয়ে রেখেছে কেউদত্তদের ভাঙা পরিত্যক্ত বাড়ির উঠোনেও অযথা নেমে আসছে সন্ধেসেই সন্ধেও অনেক পুরোনোএকদিন এরকম এক পুরোনো সন্ধেবেলায় এই জানলার পর্দা সরিয়ে বিদিশা বলেছিল;-- এটা পশ্চিম দিক? তোর এই জানলায় প্রতিদিন সূর্যাস্ত হয় ?’ জানলার মরচে পড়া গরাদে মাথা ঠেকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল; ‘আমাদের বাড়িতে কোনো পশ্চিমের জানালা নেই জানিস...সূর্যাস্তও নেইআর সূর্যাস্ত না থাকলে, বল, সে বাড়িতে পাখিদের উড়ে যাওয়া থাকে কি ?
  
    আমি জানলাটা পুনরায় বন্ধ করে দিই উষা আর আমার ছেলের মধ্যে ফিরে যেতে চাই আমিতবু অভিশাপের মতো কেন ফিরে ফিরে আসছে ভাঙা স্বপ্নসূত্র...!
 সেদিনের লীলাসায়রের নীল পানকৌড়ি উড়ে যাওয়ার পর, তার পরের সপ্তাহেই কি ? মনে পড়েনা ঠিককুড়ি বছর পূর্বের স্মৃতি পারম্পর্য রেখে ফিরে আসেনাপরের সপ্তাহে বা পরের মাসেই... সম্বিত বাড়ি এসেছেবিজন ও বাড়ি এসেছে সে কলকাতা রবীন্দ্রভারতীর আর্টের ছাত্রমূলত বিজনদের বাড়িটায় ছিল আমাদের বৈকালিক আড্ডার পিঠ
   সেদিন বিকেলে বিজন একটা ২/২ ক্যানভাসে এক্রেলিক চড়াচ্ছিলবিদিশা এসেছেবিজনের পিঠোপিঠি বোন জয়ীতার সঙ্গে তার খুনসুটির সম্পর্কদেখে মনে হয় খুশ মেজাজশুধু সম্বিত একা লাগোয়া ব্যালকনোতে গম্ভীর হয়ে অযথায় চেয়ে আছে দূরে নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের চুড়ার দিকেএই সম্বিত কখনোই মনের ভাব চেপে রাখতে পারেনাতার ভেতরের উত্তেজনা চেহারায় ফুটে ওঠে
  আমি বিজনদের বাড়ি আসার পথে মধুদার গুমটি থেকে দুটো পান কিনেছিলামমাঝে মাঝে পান খেতে বেশ লাগেএকটা আমার , অন্যটা বিজনের নিজের পানটা মুখে পুরে অন্যটা বিজনের দিকে বাড়িয়ে দিইবিজন পান চিবাতে চিবাতে রঙ চড়ায় ক্যনভাসেএকবার আমার দিকে তাকিয়ে সম্বিতের প্রতি ইঙ্গিত করেতাকে ঐ ভাবে বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে বসি;
--কিরে, মুড্ অফ ?
--চিল দেখছি, নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের চুড়ায় চিলে বাসা বেঁধেছে...
--যা: শালা... এত দূর থেকে দেখতে পেলি !
--চল মন্দিরে যাবি ? কাছে থেকে দেখে আসি...
--সে কি? এখানে সবাই রয়েছে, বিদিশা এসেছে, ধূমল আসবে এক্ষুণি...
   এমন সময় বিদিশা ধীর পায়ে  ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়যেন সম্বিত নেই , এমন ভাবে বলে;
--সারা বছর শুকনো খরা আমার ভাল্লাগে না সুমিত, কখন বর্ষা আসবে,খরস্রোত হবে , তার জন্য আমি বসে থাকব কেনো?
   বুঝি, এই কথার উদ্দেশ্য আমি নইঅন্য কেউ কিন্তু সে ত কাছেই রয়েছেতবে আবার আমায় কেনো ? একটু থেমে বিদিশা বলে;
--আমার জন্য পান আনিস নি সুমিত ?
--তুই পান খাবি...?
--খেতাম...
--আচ্ছা আনছি দাঁড়া, তোরা বস, সম্বিত তুই খাবি তো...?
বিদিশা আমার জামা খামচে ধরে, আমাকে বসায়, নিজেও বসেবলে;
--না, যেতে হবে নাতোর মুখের থেকে দে...
এই সময় আমি অদ্ভূদ একটা ভুমিকম্পের গন্ধ পাই মুখে বলি ;
--ধুৎ, এঁটো পান...
--আমরাতো কোনোদিন এঁটোর বিচার করিনি সুমিত...এই দেখ, আমি তোর থেকে নিচ্ছি, কোনো বাধা দিতে পারবিনা তুই...
 
  নীলমনি মন্দিরের গম্বুজের অবাক চিল আর লীলা সায়রের থেকে উড়ে আসা সন্ধের নীল পানকৌড়ি (সেই একবারই দেখেছিলাম) কালচে নীল আকাশের পথে উড়ে যেতে যেতে দেখেবিদিশা সরকার তার শুকনো খরা ঠোঁট দিয়ে সুমিত সিদ্ধান্তর অপুষ্ট ফাটা ঠোঁট থেকে লাল মিঠাপান শুষে নিচ্ছেপানকৌড়ি অবাক বিস্ময়ে আকাশের গা থেকে খসে যেতে যেতে পুনরায় উড়ে যায় পূর্ব দিগন্তের দিকে, যেদিকে বাসায় তার অপেক্ষার পুরুষ পাখিটি


....                        .....                   .....

 


    উষা মশারি টাঙাচ্ছিলবাবাই পাশের ঘরে সিঙ্গেল খাটিয়ায় বই পত্তরের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেওকে নিয়ে এসে এঘরে শুয়িয়ে দিই উষা মশারির ধার গুঁজতে গুঁজতে বলে;--সন্ধেবেলা তোমার বন্ধু সম্বিত ব্যানার্জী ফোন করেছিল
--হ্যাঁ ,ওর বিয়ে তো, কিছু বলল...?
--এমনি খবর নিচ্ছিল, ছেলে কেমন আছে, এই সব...
--বিশেষ কিছু ?
--না:, বলল তোমকে মেল করেছে, দেখতে...
সম্বিত মাঝে মাঝে মেল করে, ওর সদ্য আঁকা কোনো ছবি পাঠায়, ফটোগ্রাফঅথবা কবিতাহ্যাঁ, সম্বিত এখনো লেখে


....                     ....                        ....



এই মফস্বল শহরের দুর্বল সার্ভারের চাকা ঘুরতেই থাকেসম্বিতের মেইলের সাথে তিনটে এটাচমেন্ট ফাইলডাউনলোড হচ্ছেউষা মশারির ভেতর থেকে বলে;
--আচ্ছা, সম্বিত ব্যানার্জীর কি একটা এ্যাফেয়ার ছিলো না...?
--হুঁ...
-- সে এখন কোথায় ?
--জানিনা...
--জানোনা সত্যি !(উষার গলায় তাচ্ছিল্যের সুর) বেশ, আমি শুয়ে পড়লাম, আলোটা নিভিয়ে দিও...


  এ্যাটাচমেন্ট ফাইলে দুটো ফটোগ্রাফএকটা নদীর ছবি, অন্যটা একটা ব্রীজ, সম্ভবত ঐ নদীর উপরেইআর তিন নম্বরটা একটা বিদেশী কাগজের আর্টিকেলএর অংশ
  কিন্তু এটা কোন নদী ? কোথায় ? আরে ... ওগুলো কি ? পাখির ঝাঁক ! নদীর কিনারা জুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বসে আছে ডানা মুড়েযেন বহুযুগের ধূসর পাতা থেকে উড়ে আসা , আবছা দেখা যায় তার ধূসর নীলচে-রুপালী রং...!
    জুম ইন্ , জুম ইন্, ...নীল পানকৌড়ি !

   আর্টিকেলের বাংলা তর্জমা :
২৪শে মার্চ, ২০১৩ , মায়া টাইমস্
আজ ভোর সাড়ে ছটা নাগেদ এক অদ্ভুদ দুর্ঘটনার কারনে কশেরু নদী কতৃর্পক্ষ কশেরু ব্রীজের একটি লেন প্রায় ২৫মিনিট বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়খবরে প্রকাশ এক মহিলা তার গাড়ি সহ সেতুর রেলিং ভেঙে নদীতে পড়ে যানপুলিশ এখনো পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পায় নিপ্রবল ভাবে ক্ষতি গ্রস্ত গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছেনিখোঁজ মহিলা ভারতীয় নাগরিক শ্রীমতী বিদিশা সরকারের বেঁচে থাকার আসা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তদন্তরত পুলিশ অফিসার...

--উষা -- উষাউষা...
--কি হলো ? আস্তে, বাবাই উঠে পড়বে...
--তুমি কখনো নীল পানকৌড়ি পাখি দেখেছো উষা ?
--এতো রাতে কি শুরু করেছো বলতো...?
--তোমাকে বিদিশার কথা বলেছিলাম ?
--তোমাদের সেই বান্ধবী ?
--হ্যাঁ, দেখো, আমারা কেউ বিশ্বাস করিনি অথচ ও প্রায়ই বলত এক নীল পানকৌড়ি পাখির কথাঐ দেখএটা এক সাতসমুদ্র পারের নদী কিনারদেখো, তার আঘাটায় বসে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে নীল পাখি, পানকৌড়িঐ অতদূর সাতসমুদ্র পারে গিয়ে সে নীল পানকৌড়ির দেখা পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলএত বছর ধরে কি সে তবে নীল পাখির খোঁজে অর্ধেক পৃথিবী ফিরছিল ? আমরাতো কবেই ভুলে গেছি সেই পাখির কথা! ভেবেছি ওসব গল্পের পাখি, জীবনের সাথে তার হয় নাকো দেখা ! শুধু জীবনের অসতর্ক বিশেষ মুহুর্তে সে গল্পের মিনারে উড়ে আসে, মুহুর্তেই উড়ে যায়সে মুহুর্ত ভুলে যাওয়া ভালোআমাদের সমৃদ্ধ সংসারে তার কোনো উড়ে আসা নেই  বিদিশা সেই পাখির দেখা পেয়ে গেছেতার ক্যামেরায় পাওয়া গেছে এই দুটি ছবি...শোনো উষা, এবার যেকোনো দিন, আমাদের যেকোনো অসতর্ক নিদ্রার ভেতর সে উঠে আসবেআমার, সম্বিতের, অথবা তোমারো নিদ্রার ভেতরে , উষা...! এমন কি সম্বিতের সেই অনুদ্দিষ্ট অচেনা নারীর নিদ্রার ভেতরেও উঠে এসে সে জানাবে; নীল পানকৌড়ি পাখির দেখা সে পেয়েছেযাদের হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হয়ে গেছে, তারা আর সে পাখির পায় নাকো দেখা...উষা, জাগো, আজ রাতে ঘুমিয়ে পোড়ো না...



.....                 .....             .....