রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

 দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

কৌশিক বাজারী





   এই সময়, মূলত এক দর্শন 

-বিরহিত কাল। দর্শন বিরহিত সময় তার চিহ্নগুলি পরিস্ফুট করে চলেছে দশকের পরদশক জুড়ে। গানে, গল্পে, কবিতায়, আচারে, বিচারে এক অসুর-দর্শন। অসুর যেহেতু সর্বদা ছদ্মবেশী, যেহেতু তার মোহময়ী রূপ আমাদের আত্ম-বিমোহিত করে রাখে সর্বদা, আমরা ভুলে যাই তার প্রকৃত স্বরূপ। তার ভিতরের শয়তান নীরবে আমাদের অন্তরাত্মা গ্রাস করে চলে। তার ছলা কলায় আমরা বিমোহিত হয়ে পড়ি আর শয়তান সেই সুযোগে আমাদের নিদ্রিত স্বপ্নেরভিতরে হানা দেয়। আত্মার বাগান তছনছ করে দিয়ে আমাদের ভেতরে ভেতরে হত্যা করে রাখে ।

   না, এ কোনোরূপকথার গল্প নয়। এ হল আমাদের ঘটমান-বর্তমান-ইতিহাস। সেখানে যেহেতু দর্শন নেই, তাই জাগলিং রয়েছে। জীবনে প্রকৃত কাব্যের অভাবে, রসের অভাবে, সময় অতিবাহিত করবার ছলে আমরা জাগলিং এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি একদা আর এখন সেই জাগলিংকেই প্রকৃত আর্ট ভেবে নিয়ে জীবনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নইলে জীবন মানে যে জাগলিং নয় কখনোই, সে তো আমরা জানি।

   এইসব কথাগুলো মনে পড়ল কবি বন্ধু সপ্তর্ষি বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘দাহ্য মাধুকরী’ পাঠ করতে গিয়ে। দাহ্য মাধুকরী পাঠ করতে গিয়ে মনে হল—এ জীবন হারিয়ে ফেলেছি। এর সাথে আর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এই তছনছ আত্মানিয়ে তবু কোথাও তার সঞ্জীবনী শক্তি আমাদের সুপ্ততাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়, হয়তো, সে কারণেই এই আলোচনার প্রবঞ্চনা।

      হয়তো সে প্রবঞ্চনার কথা সপ্তর্ষিরও একান্ত অনুভব। যা তার কবিতার ছত্রে ছত্রে কবি ও পাঠক উভয়কেই ছত্রখান করে দেয়। কবিতা শুধুই আর শব্দের মায়াজালে আবদ্ধ থাকেনা, অথবা শুধুই কনটেম্পোরারিও হয়ে উঠতে চায় না। তা একাধারে যেমন সমসাময়িক, অন্যদিকে তেমনি সময়কে পেরিয়ে বহুদূর চলে গিয়ে পথ হারিয়ে কোনো গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে । হয়তো সেই গ্রাম আর সমকালে নেই, সেই প্রেম, যা বহুদিন আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা তাকে কবিতায় পুনরায় প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠি ।


তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি এদেশেও নদী ছিল এক—

অনেক নৌকা ছিল, হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়শালে ঘোড়া ছিল আর—

তুলোর পুতুল হেন সংখ্যাতীত পরী ছিল ছদ্মবেশী উদাসী রাজার,

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি আমিই ছিলাম সেই ছদ্মবেশীরাজার সারথি ?...

ভাঙা রথ আছে আজো তবে

হারিয়ে গিয়েছে সেই নদী...

 

এখন কিছুই নেই এই দেশে তবু

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি তুমি ছিলে সে দেশের পলাতকারাজকন্যা আর

আমারই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে তুমি

খুলে দিয়েছিলে কবে বুনোফুলে গাঁথা এই সাতনরী হার ?



   কবিতাটি পাঠ করেমনে হবে বুঝি কোনো দীর্ঘ কবিতারি অংশ! না এটি গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ কবিতা । তবু ,যদি শিল্পকে জীবনেরই প্রতিরূপ বলে ধরে নিই, তবে তো এ কবিতা এক দীর্ঘ-দীর্ঘ কবিতার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। হ্যাঁ তাই, কবি সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করছেন, এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেই সঙ্গে তা পাঠকেরও আত্মজীবনীই। জীবন বর্জিত অধুনাকাব্য-গড্ডালিকার বিরুদ্ধে এ এক বিষণ্ণ মুচকি হাসি যেন বা । 

   তাহলে আরো একটি কবিতা পাঠ করা যাক । একেবারে অনাধুনিক পদ্ধতিতে লেখা এক অশ্রু।


আসিল আষাঢ় মাস ধারা খরতর।

সীমানার বেড়া খানি যবে পড়ো পড়ো

দড়িদড়া বাঁশ হাতে রামপ্রসাদ সেন

বেড়া বন্ধিবার কাজে মেয়েরে ডাকেন।

কন্যা বলে, ‘যাও বাবা, আসিতেছি আমি’

রামপ্রসাদ সেন আজ নিজেই ঘরামি।।


( ভাবা যায় ! এই ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত এক কবিতায় কবিএই সব শব্দ-বাক্য-আঙ্গিক ব্যবহার করছেন! যা আমরা বহু পিছনে ফেলে এসেছি কালের নিয়মেই। সেই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাবটি আজ আর ফিরে পাওয়ার উপাই নেই ।  তাহলে কেন এই 'অনাধুনিক' প্রয়াস? )

 

বেড়া বাঁধা কর্ম চলে, সঙ্গে চলে গান।

কন্যা আসি দড়িদড়া পিতারে যোগান।।

কিয়ৎক্ষণ পরে কন্যা উঠি যায় চলে।।

তখনি কন্যার কণ্ঠ সাধকেরে বলে

‘এ’ত দেখি বেড়া বাঁধা শেষ হল প্রায়

 কে তোমারে দড়ি দড়া দিয়েছে জুগায় ?’


    পরবর্তী গল্পটি আমাদের সবারি জানা যেহেতু তাই সেই অংশটি, কবিতায় বাকি গল্পটি, এক্ষেত্রে অনুদ্ধৃত থাক, ক্ষতি নেই। আমরা বরং কবিতাটির একেবারে শেষ প্রান্তে কবির নিজস্ব অনুভবটুকু দেখেনিই। আর তার আগে জানিয়ে দিই—কবিতাটির নাম ‘মীথ’


হায়, জানি, সত্য নয় এসব কাহিনী।

তবু যেন মনে হয় কন্যাটিরে চিনি।

রাজপুত্র ছেড়েছিল তারি ডাকে ঘর

তারি তরে ডিঙা বায় চাঁদ সদাগর

সে আমার বন্ধঘরে খোলা জানালাটি

তারি স্পর্শে গর্ভবতী অহল্যা এ মাটি

কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার

মীথ্ গুলি মর্মে তাই আসে বারম্বার।


   এইবার আমরা মূলজায়গায় এসে উপনীত হলাম—‘কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার’। হয়তো এটাই মূল কথা এই রচনাটির। এবং এই সত্যে উপনীত হতে যেন ঐ অনাধুনিক ভাষা-স্টাইল আমাদের অনেক খানি দ্রুত আগিয়ে দেয় গন্তব্যে। আর মিথোলজি বোধহয় সমকালীন ভাষায় খোলেও না ভালো।

   সপ্তর্ষির কবিতার একটা মূল জায়গা হল, তার কবিতার ভেতর একটা অতি সূক্ষ্ম নিহিত গল্প থাকে, থাকেই।  এখন প্রশ্ন হল এত এত গল্প কাহিনী  কবিতার পক্ষে খুব ভারবাহী, হানি-কারক হয়ে যাচ্ছে না? কারণ কবিতাকে হতে হবে নির্মেদ,সূক্ষ্ম, বিদেহী আত্মার প্রায়—এমন মত পোষণ করেন কেউ কেউ।হয়তো তাই। এতদিনের কাব্য যাত্রার পথ অতিবাহিত হয়ে আমরা যেখানে এসে আজ পোঁছেছি সেখানে কবিতা আরো সূক্ষ্ম হবে, এটাই অভিপ্রেত। তবে সেই সূক্ষ্মতা কী কায়ায় নাকি মায়ায়? সেখানে গল্প থাকবে না কি ? হাজার হাজার বছর আগের কাব্যের ভিতরে যে সকল কাহিনী প্রবহমানছিল, তার মুছে যাওয়া আবছা স্মৃতির মতো? -- থাকবে না সেই সূক্ষ্ম মায়া?

   যেহেতু আমাদের আদি-কাব্যগুলি থেকে শুরু করে আধুনিকতার গোড়া অবধি সমস্ত সাহিত্যই কাব্যের আধারে। কাব্য বলতে এখানে পদ্য বোঝানো হচ্ছে না, কাব্যই । যে কাব্যের মধ্যে রয়ে গেছে আবহমান মানব-জীবন-ইতিহাস। মানুষের মৃত্যুর পরেও মানব থেকে যাওয়ার ইতিহাস। সেইগল্প। যা পাঠকের মনকে অতি সহজেই জারিত করে তোলে। 

     আর আধার বিহীন, অ-মূর্ত কবিতা ? তাও থাকবে । একদিকে তেত্রিশ-কোটি দেবতার রূপ-বিগ্রহ, অন্যদিকে অরূপ। কিন্তু সরল-সহজ, অল্প বোকা, আবেগ প্রবণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা মদ,মাৎসর্য, ঐশ্বর্য্য, কামের বশবর্তী হয়ে পথে পথে ছুটে মরে, তাদের জন্য তো নয় সেই অরূপের পথ । সে পথ সাধকের হতে পারে। আমাদের আপাতত কাব্যের সেই পরম রসে পৌঁছতে একটুখানি মূর্তির প্রয়োজন হয়। আধারের। হ্যাঁ, যা আমরা সহজেই পেয়ে যাই সপ্তর্ষির কবিতায়। যা মূলত তার ক্লাসিক মুড্ ।


আমাকে হত্যা করে আমারই ফেরার পথে ফেলে গেছে কেউ,

পাহাড়ি গ্রামের সন্ধ্যা কুয়াশায় সূচীভেদ্য হলে

আমারই শবের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমি

থমকে দাঁড়িয়ে দেখি চাঁদের কুহকে

ছেয়ে গেছে উপত্যকা, টিলা আর চালাঘর গুলি—

এবং হত্যাকারী, সে’ও পায়ে পায়ে

চুপে এসে দাঁড়িয়েছে আমারই কিনারে...

   

   সপ্তর্ষির কবিতায়এই হল আমাদের অসময় । আমাদের চূড়ান্ত ঘটমান-ইতিহাস। যেখানে শবদেহ একটি চরিত্র, যার কিনারেএসে দাঁড়িয়েছে নিহত ও হত্যাকারী। আর আকাশে, চাঁদের কুহকে ছেয়ে গেছে উপত্যকা—এটুকুই কবিতা, এটুকুই গল্প!

   একদিন কবি গৌতম বসুর সাথে এক ফোনালাপে কথা হচ্ছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস’ প্রসঙ্গে তিনি বললেন—“দেখ,প্রেম ছাড়া, ভালবাসা ছাড়া কিছু হয় না। মানুষের প্রতি এই যে অকৃত্রিম ভালবাসা, টান, এটাই ‘তিতাস’। তাঁকে(অদ্বৈত) চেষ্টা করতে হয়নি। তিনি শুধু মনের কথা বলেগেছেন” । আর সেখানেই উপন্যাসটিও কবিতা হয়ে উঠেছে। তো, মূল কথা হল প্রেম। বৈষ্ণব প্রেমে যেমন বলা হয়েছে ,আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ছেড়ে কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রিতীর কথা । সেই মহাপ্রেমও নয়।  এ হল অতি সাধারণ জাগতিক প্রেম। মানুষের প্রতি ভালবাসা। এই জগৎকে, আপন মাটিকে  ভালবাসা। প্রেম, যা না হলে সৃষ্টি হয় না । আর কবি তাই সদম্ভে সেইসব অতিদূর ঈশ্বরকে দূরেই সরিয়ে রেখেছেন।

 

সেইসব দেবতাকে বিশ্বাসে নিরস্ত থাকি আমি

চোখের কাছে বা দূরে কোনোদিন দেখিনি যাদের...

সেই অর্থে প্রকৃতই ধর্মচ্যুত আমি—

 

অথবা


পাথরের গায়ে মাথা কুটে 

রাত যায়, কালরক্ত ছুটে...

বালক পাথর ছুঁড়ে মারে—

ঢেউ ভাঙে জলে, অন্ধকারে...

কে ছুঁড়েছে পথ থেকে তুলে

পাগলের মাথাতে পাথর ?

ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর

দেবতাও ব্যাথাতে কাতর...

 

হে দেবতা কবে তুমি ক্রোধে

তুলে নেবে নিজেও পাথর ?

 

   কবির অন্তরাত্মা, তার ক্রোধ, বিষন্নতা, ও অসহায়তা কবিতার ভেতর এত দিনের চেনা দেবতার বিনির্মাণ ঘটিয়ে দেয়। এতদিন যে নিরপেক্ষ, স্থবির দেবতার কথা আমরা জেনেছি, এ সে নয়। মায়ানমার,বাংলাদেশ, গাজা, --সমস্ত পৃথিবীর পাগলের মাথাতে পাথর, (‘পাগল’ অর্থে যে ‘কবি’, সে তো মহাকবি শিখিয়েই গেছেন!) ‘ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর’ কবি তার সমস্ত অসহায়তা নিয়ে মাথা কুটে মরে।

          এই কাব্যগ্রন্থের ভেতর ইতস্তত ভ্রমণের পর যখন পাঠক তার তোরণদ্বারের নিচ দিয়ে নিষ্ক্রমণ করবেন, যদি প্রবেশের পথে বেখেয়ালে ভুলেগিয়ে থাকেন, তাহলে আরেকবার তোরণের বাহির হয়ে ঘাড় তুলে দেখে নিন, সেখানে কি লেখাছিল--


নিরুপায় এসব অক্ষরে

এঁকে তুলি একটি ঠিকানা—

ঘুমঘোরে ছুঁয়ে গেছি তবু

মানচিত্র হয়নি’তজানা...

অগস্ত্য-গমন-পথ নয়

মৌন এক ছোটো পথ রেখা

হয়তো বা কিছু দূরে গেলে

সাঁকো এক যেতে পারে দেখা।

আজো সে সাঁকোটি খুঁজে মরি,

ঝুলি ভরে দাহ্য মাধুকরী ।।


(দাহ্য মাধুকরী : সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।। আদম প্রকাশনীর পক্ষে বন্ধুবর গৌতম মণ্ডল ।। প্রচ্ছদ:  কবি স্বয়ং। বছর সাতেক আগে আলোচনাটি লেখা। ধ্যানবিন্দু পত্রিকাতে প্রকাশিত। আজ ব্লগে তুলে রাখলাম।)

1 টি মন্তব্য:

  1. আমারই শবের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমি

    থমকে দাঁড়িয়ে দেখি চাঁদের কুহকে

    ছেয়ে গেছে উপত্যকা, টিলা আর চালাঘর গুলি—

    এবং হত্যাকারী, সে’ও পায়ে পায়ে

    চুপে এসে দাঁড়িয়েছে আমারই কিনারে...---বাহ

    উত্তরমুছুন