বৃহস্পতিবার, ২২ জুলাই, ২০২১

উৎসের দিকে...

 অনপেক্ষ অনলাইনের 'সূত্রপাতের স্বগতোক্তি'' বিভাগে শুভাশিসদার (মণ্ডল) আদেশে লিখিত হয়েছিল লেখাটি। 



ছবিঃ বাসুকি দাশগুপ্ত


 অপেক্ষার মতো ঝিমধরা উপত্যকা আর কিছুতে নাই। বালকবেলার সবুজ ঘাসের মতো অপেক্ষা, কৈশোরে এসে পাল্টে যায়! কিশোরের অপরাহ্ন একজন যুবকের নয়, যৌবনের প্রান্তে যে অপেক্ষা তা কার জন্য আমি জানিনা। একজীবন ঝিমধরা অপেক্ষা আমার নেশা হয়ে থাকল।  যা চেয়েছি তা যদি সেই বাল্যে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে,   সব সব পাওয়া হত ঠিক ঠিক! যথাসময়!  যদি আমার কোনো অপেক্ষা না থাকতো কোনো অনির্দিষ্টের প্রতি? কী হত?   


 


 এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে বুঝি এই অপেক্ষার খুব প্রয়োজন ছিল। একটা আজীবন অনির্দিষ্ট প্রতীক্ষা নিয়ে থাকার আত্মজৈবনিক আততি আমাকে একটা অন্ধ লেখার দিকে ঠেলে দেয় বারবার। সেই কবে থেকেই।  হয়ত তখন, সেই বাল্যে, কৈশোরে, তাকে এমন ভাবে চিনিনি। আর মনেও নেই কবে প্রথম সেই  প্রতীক্ষার শুরুয়াত হল।   


   বাহ্যিক একটা আরম্ভ থাকে, তারও আগে থাকে ভেতরের একটা আরম্ভ। তাকে এই এত বছর পর আর চিহ্নিত করা যায় না বিশেষ কোনো ঘটনা দিয়ে।    অথচ বাহ্যিক ঘটনাগুলি এতই অকিঞ্চিকর যে তাকে  বানানো গল্পের মতো মনে হয়। অন্য লোকের জীবন বলে মনে হয়। বয়ঃসন্ধির  সেই লাজুক আর ভয়ংকর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলিকে শুরুয়াত বলা যায় কিনা জানিনা। ১৯৯২ সালে একটি পত্রিকায় প্রথম নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে যে আত্মরতিময় কামুক অনুভুতি তাকেও কি শুরুয়াত বলা যায়?  অথচ সেই ছাপার অক্ষরে নিজনাম দেখার অনুভূতি প্রথম স্বমেহনের  মতোই মনে রয়ে গেছে। যা আজীবন লুকিয়ে রাখতে হয়।  যা আর অন্য কারো কখনোই কোনো কাজে লাগে না, এমন কি নিজেরও কোনো কাজে আসে না আর। তবু তা থেকে যায়।  


  হয়ত প্রত্যেক মানুষের জীবৎকালের সমস্ত কর্ম,  পাপ,  পূণ্য, অসহায়তা তার জন্মক্ষণ আর স্থানের মধ্যে লেখা থাকে। সেই জন্ম মুহুর্তের বয়ে যাওয়া বাতাস, নক্ষত্রের অবস্থান, আর এই মাটির কয়েক কোটি বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাসের মধ্যে সে তৎক্ষণাৎ ঢুকে পড়ে, আর তার ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়।  এক অভিশাপময় অন্ধকারের ভবিষ্যৎ সে বহন করতে থাকে, যা তার অন্তর্গত লোহু। তাকে এড়ানো যায় না। সে লিখতে শুরু করবে কোনো একদিন এইসব, পাপ স্খলনের মতো।


   জন্ম এক প্রতিদান। কবে কখন ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হবে তা? আমার জন্ম মাটি কেমন? লাল ল্যাটেরাইট। ঊষর। বন্ধুর। পাড়ার আনাচে কানাচে টেরাকোটা স্থাপত্যের প্রাচীন কাহিনি মূক ও মুখর। যে তার ভাষা বোঝে, সে বহুদূর অব্দি টের পায় বন ও প্রান্তরের বিধুরতা । আর বিশংশতাব্দীর শেষে যার শৈশব কৈশোর এইসকল পারিপার্শ্বিক নিয়ে হয়ে উঠবে অতি ব্যক্তিগত। এই শতক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যেহেতু, তাই জন্ম-নক্ষত্র ও মাটির ইতিহাস সুপ্ত থেকে যাবে শরীরে বহমান লোহুর ভেতর  । আর পুনরায় লিখে ফেলব আত্মরতি। কোনো বড়,  বৃহৎ ভাব,  বিশালের অংশ আমাকে ধরা দেবে না।  সবার জীবনে তা দেয়ও না। ছোটো ছোটো ভাব, দুঃখ, আনন্দ আর আত্মখোদাই এইসবই হয়ে উঠবে বিষয়। আর ক্রমশ নিজের জীবনকে এক্টি স্ব-লিখিত গল্পের মতো মনে হবে ক্রমশ। 


তখনো জানিনা এসব, তখনও জানিনা এই এক সামান্য আত্মখোদাই-ই আজীবনের কাজ হয়ে উঠবে। তখন শুধু পাতা ভরিয়ে রাখা। আর কেউ পরিচিত বন্ধুবান্ধব চেয়ে নিলে অপেক্ষা করা। রোজ গোছা গোছা পোস্টকার্ড আর চটি এক ফর্মা দু ফর্মা পত্রিকাগুলি ততদিনে আসতে শুরু করেছে নিজের ঠিকানায়। বিলুপ্ত টেলিফোন বুথের যুগ তখনও আসেনি। অপেক্ষা সেই ছাপার অক্ষরে আত্মরতির মতো নিজনাম টুকু দেখার। আজ তা বহুদূরের জীবন বলে মনে হয়।  তবু সেদিনের সেই শুরু ছিল একটা অপেক্ষা। 


    শৈশবের প্রবল জৈষ্ঠের দুপুরে পিসিমনি এসে দাঁড়ালো উঠোনে, ছোটো ভাই কোলে, সেই হঠাৎ আগমনের আনন্দ,  সে এক আনন্দ! যুবা বয়সের বন্ধু আসবে বিকেলে,  বহুদিন পর, তার জন্য অপেক্ষা এক আনন্দ। আর সেই,  অনিশ্চিত, যাকে আমি চিনি না, যে সেই শৈশবকাল থেকে আমার সঙ্গী, সে কি কোনো মানুষ? কোনো নারী, কোনো মহাপ্রলয়,  কোনো ঘটনা? আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। শুধু জানি সে আসবে একদিন। এসে বলবে,  মাধব, তোমার কথার ভেতর দুদণ্ড বসলাম, এবার চলে যাচ্ছি। সেই এক ঝিমধরা উপত্যকা, যার জন্য আমি প্রথম,  কোনো একদিন মধ্যরাতে খাতার সামনে বসে  পড়েছিলাম।  তখন কৈশোর বিদ্ধস্ত হচ্ছে...     "

২টি মন্তব্য:

  1. কৌশিক বাজারীর রচনা - কিবা গদ্যে, কিবা পদ্যে - পেলেই পড়ি । পোষায় . . . খুবই পোষায় । সর্বদাই ।

    উত্তরমুছুন
  2. জিম ধরিয়ে দিলে ভাই। অপেক্ষা করতে রাজি, এমন আরও আরও পড়িও ❤️

    উত্তরমুছুন