মাতৃমুখী
কৌশিক বাজারী
আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ ।
সাইকেলে যেতে যেতে সারা পথ সে অং বং নানান কথা ভেবে ভেবে প্যাডেল ঘুরায়, শুকনা শীতের পথে লাল মিহি ধুলা উড়ে উড়ে যায় । তার হইলদা পাজামা আরঅ লাল হয়ে যায় বাঁকুড়ার মাটির আল-পথে , হাওয়াই চপ্পল মিহি ধুলায় ঢেকে যায় । পথ-জুড়ে আধ-মাইল লম্বা গরুর পালের মধ্যে পড়ে দিশাহারা হয়ে তার চুল পয্যন্ত ধুলায় মাখামাখি হয়ে যায় । সাইকেল ঠেলে লিয়ে কিছুদূর যায়, আবার চাপে,--এই হল তার পথ। ফাঁকা ধূ-ধূ দ্বারকেশ্বরের বালি ঠেলে ঐ পারে আরো পাঁচ মাইলটাক লাল-ধুলার পথ পেরিয়ে তবে পাকারাস্তা । সেই বড় রাস্তা ধরে আরঅ দু কিমি পথ পেরালে বিষ্টুপুর বাজার । ফাঁকা রাস্তায় হঠাৎ চেনা কেউ ডেকে তার সাড়া পায় নাই। লোকে তাকে আড়ালে বলে ক্ষ্যাপা। বলে; আটিস মানুষ । পঞ্চানন তখন আতাল পাতাল ভাবে , কি যে ভাবে, সে নিজেই জানে নাই। ভাবে; তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা, হারিয়ে যাওয়া বাপের কথা । ভাবে ; তারা কি আজঅ বেঁচে আছে! সেই তার দু-বছর বয়সে পালিয়ে যাওয়া মায়ের সামনে এই পঞ্চাশ বছর পর যদি দাঁড়ায় ? মা কি চিনবেক ? একটা বহুদিনের হইলদা হয়ে যাওয়া ছবি ছিল পালিয়ে যাওয়া মায়ের ফেলে যাওয়া টিনের তোরঙের ভিতর । বাপ আর মা। তারকেশ্বরে বেড়াতে গিয়ে ফটোঅলার কাছে তুলা ছবি । কাকি জেঠির সংসারে, তাদের মাটির বাড়ির উপরের কোঠার জঞ্জালের ভিতর হঠাৎ আবিস্কার করা সেই ফটো, লুকানো অতীতের অন্ধকার ছায়ায় সে লুকিয়ে দেখেচে অনেকদিন। কল্পনায় সেই হলুদ হয়ে যাওয়া ঝাপসা মায়ের মুখটায় দেখে সে ।
পঞ্চানন কর্মকার, তার বাপের দিয়া নাম । এখন তার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে যায় । পঞ্চাননের বাবারা তিন ভাই , তাদের কামারশালে লোহার কাজ ছিল নাই । ছিল কাঁসার কাজ। কাঁসার চাকতি আসত বিষ্টুপুরের গোলাদারের ঘর থেকুন । তারা অর্ডার দিত কাঁসার বাসনের । বাসন বলতে শুধু থালা । কাঁসার চাকতি পিটিয়ে থালা বানানো ছিল তাদের ঘরোয়া ব্যাবসা । পঞ্চাননের বাবা কাঙাল কামার ভাইদের মধ্যে মেজ । থালা তৈরি হয়ে গেলে থালার চারপাশে ফুল, লতা, পাতা আঁকা ছিল তার কাজ, এই কাজটা গাঁয়ে তার মতন আর কেউই পাত্তো নাই, উসব হাতুড়ির ভোঁতা কাজ তার পোষাত নাই, বিষ্টুপুরের বাজারেও কাঙাল কর্মকারের মিনা করা লাল-কালো ফুলকাটা থালার আলাদা কদর ছিল সেকালে। কামার পাড়ার অন্যরাও থালা বাটি বাসন-কুসনের আঁকা-জুকার কাজটা কাঙালকে দিয়েই করাতো। সবাই জানত কাঙাল একজন আটিস –সে থালায় ফুল কাটে, আর সইন্ধা হলেই তার দল বল লিয়ে চলে যায় দ্বারকেশ্বরের চড়ায়, শ্মশানকালীর মন্দিরে। সিখেনে তাদের মজলিশ বসে । কেত্তন গায় কাঙাল, তখন সে রাধা। কীষ্ট-ভাবে ভিভোর । তার সংসারে মন নাই । বৌ-টা দু বছরের ছেলাটারে রেখে সেই যে চলে গেল্যাক, তারপর থেকে কাঙাল উদাস হয়ে গেল আরঅ, ফুল-লতা-পাতার আড়ালে কাঙাল বৌ-এর মুখ আঁকত, ল্যাংটা ছেলাটা পাশে বসে বসে দেখত বাপের হাতের অস্তাদি। মাতৃমুখি ছা-টা কে দেখলে ভিতরটা হু-হু করে উঠত কাঙালের...। সেই ছেলা-- পঞ্চানন কর্মকার ।
উসব বহুদিনকার ঘটনা, পঞ্চাননের আবছা মনেও পড়েনাই আর । কাঁসার বাসনের দিন-কাল আর নাই । পঞ্চানন যখন ইস্কুলে, তখনি বাপটা বিবাগী হয়ে গেল । জেঠি খুড়িদের হাতে মানুষ। কাকা কিছুদিন পয্যন্ত ব্যাবসাটা চালিয়ে ছিল, এখন কাকার এক ছেলা টুকটাক কাজ করে, তবে শুধু কাঁসার কাজে আর ঘর চলে নাই , সাথে একটা পানের গুমটি চালায় । ইস্টিলের বাসন বাজারে আসার পরে পরেই কাঁসার বাজার নামতে নামতে শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু বিয়া, মুখেভাতের কাজঘর ছাড়া আর কাঁসার বাসনের কাটতি নাই । পঞ্চানন বাপের হাত পেয়েছিল, সেও আটিস। বিষ্টুপুর বাজারের মডান-আট-এ কাজ করে সে । সাইনবোড় আঁকা, ঘর সাজানো, বিয়াঘরের গাড়ি সাজানো ইসবের কাজ। সাইনবোড়ে মেয়া মানুষের ছবি গুলান পঞ্চাননের হাতে খোলতায় হয় ভাল, মালিক ছকরা তাকে দিয়ে ইসব কাজ গুলানই করায় । তা এইসবে তার চলেও যায় । ঘর-উঠান ভাগ হয়ে গেছে বহুদিন, তার বাপ যিখ্যানে কাঁসার থালায় ফুল কাটত বসে, সেটা এখন কাকার ছেলার ভাগে । একফালি ভাগের ঘরের লাগোয়া পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনি দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে লিয়েচে পঞ্চানন। একটায় ছেলা দুটা লেকাপড়া করে, লোকজন এলে বসতে দেয়, সে আর তার বৌ অন্যটায়, রাত্তে ঘুমায় । পঞ্চানন সকালে বেরিয়ে যায় সাইকেল লিয়ে বিষ্টুপুর ।
আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ । লালমেঘ বিকালের মতন ক্যানে !! ভাবতে ভাবতে পঞ্চাননের মন খারাপ হয়ে যায় । তার এই স্বভাবের জন্যি বৌ তাকে খোঁটা দেয়, বলে; মেয়ালি পারা লোক । অথচ তার এই মন খারাপটা সত্যি। হয়ত অকারণ, তবু পঞ্চানন সাতসকালে একটা ভর-ভত্তি বিকালের মনখারাপ লিয়ে নদীর নাবাল থেকে উঠে আসে...
***
উত্তরের দ্বারকেশ্বর থেকে সোজা উঠে এসে যে রাস্তাটা বিষ্টুপুরের ভিতর ঢুকেচে, ছোটো নদীর পুল পার হয়েই সেই রাস্তায় একটা চৌ-মাথা। এটা সোনামুখী মোড় । চা-দোকান, সাইকেল সারাই , ট্রাকের গ্যারাজ আর ট্রাক-ড্রাইভারদের লাইন-হোটেলে জায়গাটা সকাল থেকেই ভীড় হয়ে থাকে আজকাল । পূবে কইলকাতা ১৫০ কিমি, পশ্চিমে বাঁকুড়া সদর, উত্তরে সোনামুখী,দূর্গাপুর আর দক্ষিণে সোজা বিষ্টুপুর বাজার মাত্র ২কিমি । দ্বারকেশ্বরের দিক থেকে যে লোকটা সাইকেলে আনমনে রাস্তা পার হচ্ছিল, সে দেখে নাই কিছুই, কইলকাতার দিক থেকে একটা ট্রাক রাস্তার মাঝ বরাবর তার সাইকেল ঘেঁষে পার হয়ে পশ্চিমে বাঁকুড়ার দিকে চলে যায় ধুলা উড়িয়ে। চা-দোকানের , লাইন-হোটেলের, সাইকেল-সারাই-এর লোকজন হৈ-হৈ করে ওঠে । মোড়ের শিরিশ গাছের মাথায় বসে থাকা একটা ধূসর কাক তার রোজকার অভ্যস্ত উপর-তলা থেকে দেখে; লোকটা ঘাবড়ে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার মাঝ-বরাবর, আর লাল ধুলা-মাখা পিচের উপর নিপাট পড়ে যায়। কাকের দল কা-কা- হাহাকারে উড়ে যায় মিনিসিপালটির ভাগাড়ের দিকে। লোকজন দৌড়ে এসে তাকে ধরা ধরি করে হোটেলের দড়ির খাটিয়ায় শুয়িয়ে দেয়, জলের ঝাপটা দেয় মুখে, লাল ধুলা মাখা পা ধুয়িয়ে দেয় একজন, মাথায় কপালে জল দেয় , তার ভিজা মাথার চুল থেকে লাল ধুলা মাখা জল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা । লোকটা নড়ে না । তার বুকের হাপর নড়ে না । এমন সময়, সকাল আটটায়, তার মাথার উপর একটা লাল সাঁজ-বিকালের মেঘ নদীর দিক থেকে এসে থামে। তার মুখ গম্ভীর । থমথমা... ।
......
বিষ্টুপুর মহকুমা হাসপাতালে আনা হলে গম্ভীর ডাক্তার বাবু বুকে নল ঠেকিয়ে সামনের ভীড়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়; বাড়ির কেউ আছেন ? -- কেউ নাই । পকেটে কাগজ-পত্ত কিছু পাওয়া গেছে ?—উত্তর নাই... ।
এরপর একটা অজ্ঞাতপরিচয়-লাশ হতে হতে শেষবার ঘুরে দাঁড়ায় লোকটা...
শিবপদর ভাইরাভায়ের পেটে পাথর । হাসপাতালে ভত্তি আজ তিনদিন। হাসপাতালের সামনে বটতলে বসে সে বিড়ি টানছিল। কৌতুহলে ভীড়ের দিকে উঘু মেরে চমকে উঠে শিবপদ । ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে, চেঁচিয়ে উঠে ; পঞ্চানন ! ইত আমাদের গাঁয়ের পঞ্চানন-আটিস !
ডাক্তারবাবু চশমার ভিতর থেকে বলেন; ফোন আছে? বাড়িতে খবর দিন একটা, আর আমার সাথে আসুন...
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ বুক-পকেটের দড়ি বাঁধা মোবাইল ফোন বার করে পঞ্চাননের কাকাতো ভাই নিতাই কর্মকারকে ফোনে ধরে ।
আটিস-পঞ্চাননের খবরটা আধ-ঘন্টার ভিতর গাঁয়ে চাউর হয়ে যায় । একটা প্রায় অজ্ঞাতপরিচয় হতে যাওয়া লাশ তার বৌ, ছেলা আর গাঁয়ের-লোকদের ফিরে পায় আরবার।
.......
--ভালকরে দেখ , চিনতে পার ?
বিষ্টুপুর হাসপাতালের বারান্দায় কুকুর আর রুগীর লোকজনের ভীড় যাতায়াতের পাশে টিনের স্টেচারে শোয়ানো ময়লা সাদা কাপড়ে ঢাকা মুখটা খুলে দেয় লোকটা । ঘাড় হেলে আছে একপাশে । মাথায় চুলে লাল ধুলা মাখামাখি । কপালের পাশে জল শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে । সমীর দেখে তার বাবার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিলটা ঠিক সেরকম, যেমন বাবা ঘরে ঘুমিয়ে থাকার সময় । তার ভিতরটা আবার হু-হু করে ওঠে । চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসে ... কোনো কথা না বলে সে তার বাবাকে সনাক্ত করে ।
--নাম কি ?
--সমীর কর্মকার।
--বাবার নাম ?
--পঞ্চানন কর্মকার ।
--বয়স ?
--??
-- বাবার বয়স কত হইছিল ?
-- ৫৩-৫৪ ।
-- আর কে কে আছে ঘরে ?
সমীর পাশে দাঁড়ানো ইস্কুলে পড়া ছোটো ভাই ছোটনকে দেখায় । বলে; ঘরে মা আছে ।
হাসপাতালের ক্লার্ক চশমা তুলে একবার সামনের ভীড়টার দিকে দেখে লেয়।
--এদের সঙ্গে বড় মানুষ কে আছে ?
-- এই যে স্যার..
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ এগিয়ে আসে ।
--শুনুন, লাশ ফাড়াই হবেক, তারপর ডাক্তার বাবু সাট্টিফিকেট সই করবেক। অপঘাতের মড়া, বুঝতেই ত পাচ্ছেন, থানার সাট্টিফিকেট লিয়ে আসবেন। তবে বডি পাবেন । এখন ঘরে চলে যাওয়ায় ভাল, সবাইকার থাকার দরকার নাই । আর সব ঠিকঠাক হলে কাল সকালেই বডি পেয়ে যাবেন । এই যে দাদা, আপনি ইখেনে একটা সই করুন ত...
সমীর কলেজে পড়ে । ভাত খেয়ে সকাল সকাল রেডি হচ্ছিল। বেলার দিকে খবরটা পেয়ে তার অসাড় পা-দুটা কাঁপছিল বাবুই পাখির মতন, দাঁড়াতে পারছিল নাই । ঘর-ভিত্রে মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল । কাকিমা সারাক্ষণ মায়ের পাশেই ছিল। শিবপদকাকা আর নিতাইকাকা বাইরেটা সামলেছে । সে আর ছোটন সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে । এখন নিজেকে অনেকটা সামলে লিয়েছে সমীর, যেন্ এক বেলাতেই সে অনেকখানি বড় হইয়ে গেছে...। ছোটনের সবে আট কেলাস । তার শুকনা চোখ দুটা ফুলে আছে অবেলায়। ভায়ের দিকে তাকাতেই সমীরের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে আবার...
***
...সে নদীর নামোতে এসে আজো একবার উপ্রের দিকে চায় । ভাবে, এই পথেই কি তার ঘর ? রাতের কালো আকাশে ইধার থেকে উধার অবদি সাদা ধুঁয়ার মতন ছায়াপথ । প্রথম শীতের পরিস্কার আকাশটা তারায় ছেয়ে আছে । নদীর সরু জলের ধারা পা ডুবিয়ে পার হয় । উপারে গাঁয়ের আলো দেখা যায় বিন্দু বিন্দু । আজ কি একটু দেরী হয়ে গেল ? ঠান্ডা জলে পায়ের চেটা ডুবতেই শরীরটা কেমন হালকা হইয়ে যায় তার । সে ভাবে, মরণের পর শরীরের আর কুনু ভার থাকে নাই... নিজের ভাবনায় সে নিজেই ভয় পায় ।
রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে । গ্রামদেশে শীতের সাড়ে আটটা অনেক রাত । গাঁয়ের রাস্তার উপরে নিমতলার চাতাল, সিমেন্টে বাঁধানো । বহু পুরনো বিশাল নিম গাছটার ডাল-পালা মেলা ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকার হয়ে আছে । নিমায়ের সদরের ডুমবাতির আলো এসে পড়েছে পথ পেরিয়ে নিমতলা চাতালে । সেই আধো-অন্ধকারে কামার পাড়ার লোকজন, শিবপদ, গাঁয়ের আর কয়েকজনের একটা দল বসে ছিল, তারা কেউ পঞ্চাননের কথা ভাবছিল, কেউ মানুষের অন্তিম নিয়তির কথা ভেবে নিঝুম বসেছিল, কেউ শুধুই বিড়ি টানছিল। সমীর একবার ওদের চা দিয়ে গেছে কিছু আগে । শিবপদ প্রথম লক্ষ করে লোকটাকে , সাইকেল থেকে নামছে , সেই ধুলা মাখা গা, লালচে হয়ে যাওয়া পাজামা, ধুলি ধুসর পা। ঘরে ঢুকার আগে একবার নিমতলার জটলার দিকে অবাক হয়ে চায় লোকটা, রাস্তার আলোয় তার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিল দেখা যায়! পঞ্চানন ! শিবপদ থমকায়, যারা বসেছিল সহসা উঠে দাঁড়ায়, যে লোকটা বিড়ি টানছিল তার হাত পুড়ে যায় –পঞ্চানন ! নিতায়ের সদরের ডুমবাতি হাওয়ায় দপদপ করে উঠে কেরাসিন লম্ফর মতন নিমে যায়, আবার জ্বলে উঠে । শিবপদর গলার রা বন্ধ হয়ে গেছল, কুনু রকমে বলতে পারে-পঞ্চাদা ! এইসময় সমীর দুয়ারের বার হতে যেয়ে সামনে পঞ্চননকে দেখে প্রথমত কাঠ হয়ে যায়, তারপর বাবা বলে মাটিতে বসে পড়ে ।ঘরে ভিতরে ততক্ষণে খবর গেছে, সমীরের মা, পঞ্চাননের বৌ পাগলের মতন আধখুলা কাপড়ে সদরদুয়ারের চৌকাঠে এসে বসে পড়ে –আর এসব দেখে রীতিমত বিরক্ত ও ক্লান্ত পঞ্চানন ক্রমশ আরো ক্লান্ত হয়ে ওঠে।
আজ সকালে বিষ্টুপুর বাসস্ট্যান্ডে সাইকেল রেখে সে গেছল বাঁকুড়া সদর । কেরাণীবাঁধ বাইপাশে একটা ওয়ালিং এর কাজ ছিল । দুতলা ঘরের দেয়ালে শাড়ির দুকানের বিজ্ঞাপণ। মিনুশাড়ি পরা মেয়া-মানুষের দুতলা সাইজের ছবি । তিনদিনের কাজ । আটিস পঞ্চানন ভেবেছিল আজ আউট-লাইনটা সেরে রাইখবেক । দেরী হল একটু, দুটা বাস মিস্। এর মধ্যে কি এমন হল সে ভেবে তল পাই নাই...।
দিনভর উপাসী, চোখ-মুখ কালো হয়ে যাওয়া পঞ্চাননের বৌ খুব মিহি সুরে জিগ্গাসে
—‘হ্যাঁ গা, তুমি ফিরে আসতে পাল্লে থালে? ফিরে আসা যায় সিখ্যান থাকতে!’
পঞ্চানন রাগে, দুখে: বৌ-এর দিকে চায় ।
......
পঞ্চানন সমস্ত শোনে আর অবিশ্বাসে, ভয়ে, শিহরণে কেঁপে কেঁপে ওঠে । সমীরের দিকে ফিরে অস্ফুট ধমকের মতন বলে ; নিজের বাপ কে চিনতে লারলি আজ পয্যন্ত... !
শিবপদ আর গাঁয়ের আরো যারা সঙ্গী ছিল তারা পঞ্চানন কে বোঝায়; উয়ার দুষ কিছু নাই, উ ত ছেলা-মানুষ, আমরাও ভুল কল্লম ক্যামনে, বুঝতে লারচি রে ভাই...।
***
.... এদিকে পঞ্চাননের ঘর থেকে অনেক দুরে, মহকুমা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের সেই লোকটা পুনরায় অজ্ঞাতপরিচিতির দিকে চলে যায় । সে তার ভুল সন্তান, বৌ, পরিজন আর গাঁয়ের লোকদের সঙ্গ হারায় । পরিত্যক্ত, দাবিহীন, নি:সহায় লাশ হয়ে শাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে আবার শুয়ে পড়ে , লাশকাটা ঘরের অন্য বাসিন্দারা পাথরের মতন চোখে চায়, তাদের চোখে অশ্রু নাই , শুকনা, বরফ...
...সার রাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে ভোর-রাতে এই রকম একটা স্বপ্ন দেখে পঞ্চানন বিছানায় উঠে বসে । টিনের বালতি থেকে গেলাসে জল ডুবিয়ে খায় । সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও আজ তার ঘুম নাই চোখে । ভাবে; থাইলে কে সেই জন ? হুবহু আমারি মতন ? কুথা থেকে তার আগমন ছিল ? কুথায় বা গমন ? পঞ্চাশ বছরের জীবনে তার সাথে একবার মুখামুখি দেখা হল কৈ ? একবার কি দেখা হওয়া নিয়তি ছিল নাই ? তবে, সে কি আমিই ? সে আমি এখন কুথায় ? কুন সাদা কাপড়ের নিচে শুয়ে আছি কার অপেক্ষায় ?
আমার হারিয়ে যাওয়া মা কি তারও মা ? আমার বিবাগী বাপের খবর ছিল তার কাছে ?
সে কি আমার মাতৃমুখী দোসর কুন ?
মা কি জানে ? খবর পেয়েছে ?
পঞ্চানন উতলা হয়ে ভাবে; একবার যাওয়া দরকার । সেই মৃত অজ্ঞাতপরিচয়ের কপট অপরিচয় খুলে ফেলা দরকার । সে দরজা খুলে একটা অতিজাগতিক ভোরবেলার ভিতর বেরিয়ে আসে । দেখে ভোরের আকাশে সুয্যদেব উদিত হয়েছেন । এখন কুথায় তবে তিনি অস্তমিত ? সিখেনে কি সাঁজ-বিকালের পারা লাল মেঘ ছড়ানো রয়েছে ? সিখানে তার হইলদা, ঝাপসা, কীটে-খাওয়া কিশোরী মাতৃমুখের কাছে ফিরে আসছে তার মাতৃমুখী সন্তান । একটু উদাসীন, ক্ষ্যাপাটে, তার মাথার চুলে লাল ধুলা জলে মাখামাখি, কানের পাশ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে। মায়ের আঁচল মুছে দিবেক বলে তার ধুলা মাখা মাথা নিচু হয়ে আসে...
পঞ্চানন ঘুমন্ত বৌ আর ছেলাদের রেখে সাইকেল লিয়ে নদীর নাবালে নেমে আসে, তখন পুবদিক জাগ্রত হচ্চে , লাল হচ্চে আকাশ …
আহা! অসামান্য! যেন কোন হারিয়ে যাওয়া অথবা সমান্তরাল এক সময়ের কথা।
উত্তরমুছুনধন্যটি বাদ
উত্তরমুছুন