মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২

যখন আমি ছিলাম না কোথাও


যখন আমি ছিলাম না কোথাও





কৌশিক বাজারী



আমার বাবা বরাবর চা-দোকানি।

মাঝে একবার মুদি খানার দোকান দিয়েছিল। আমি যখন চার কেলাস তখনি সেই দোকান উঠে যায়। পরপর তিনবার চুরি হয় সেই দোকানে । একবার উপরের খোড়ো চাল সরিয়ে, একবার তালা ভেঙে আর একবার রাত্তিরে তালা না লাগিয়েই বাবা শুতে চলে গিয়ে ছিল । বাবা প্রায়ই রাত্তিরে দোকানে তালা লাগাতে ভুলে যেত। কখনো বেদম ঠাট্টার মতো তালার সাথেই সারারাত ঝুলে থাকত চাবির গোছা । আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বাবা কে নিয়ে আমাদের সামনেই হাসি ঠাট্টা করত । তবে এই দোকান বন্ধের কারণ হয়ত চুরি নয়।

   …দোকানে খদ্দের এসেছে, চার আনার পোস্ত আর আট আনার সরষের তেলের জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে । বাবা নেই । তিনি তখন মুদি-দোকান ছেড়ে বহুদূর পৃথিবীর উল্টোপিঠ কিউবায় । সেখানে অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে একজন সরকারি এ্যাটর্নি, ফিদেল কাস্ত্রো, একলা পথ হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছয় এক পার্কের ভিতর । বাতিস্তার স্বৈরশাসন উপেক্ষা করে অবদমনের চুড়ান্তে পৌঁছে সে হঠাৎই বিস্ফোরিত হয়, বাবা তখন তার ঠিক পাশটিতেই । এক পড়ন্ত বিকেলে পার্কের বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন তিনি, সমুদ্র তিরের পামগাছ গুলি আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল । আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সেই দু:সাহসী ভাষণ শুনতে পথচলতি মানুষের ভিড়ে ভেঙে পড়ে পার্কের পাঁচিল । আর বাবা তখন, সম্ভবত, সেই ভিড়ের মধ্যেই পোজিশান নিচ্ছিল গেরিলা যুদ্ধের । এদিকে সেই খদ্দের চারানার পোস্তের খোঁজে অন্য দোকানে পাড়ি দেয় । আর পিছনে দোকানের ভিতর জ্বলন্ত কুপির আলোয় আলোচনা চলছে তেভাগার স্থানীয় বাঁধগাবা আন্দোলন কতখানি সফল হল…।

গল্প হত সেসব পুরনো উত্তপ্ত দিনের:

--বাঁধগাবার কী খবর জিতেশ? উখ্যানে রেড্ হব্যেক শুনলম...

--হ, কিন্তক আর একটা সমস্যা হইচে দাদা...

--ব্যাপার কী গো...?

--কাল সন্ধ্যায় মিটিন আছে মনসাতলা মন্দিরের পেছুনে, বটতলে...নন্দীদা থাইকব্যেক, তুমাকেও যেতে বল্যেচে...

--কিন্তু উদিকের খবর কী?

--গতমাসে নন্দীদা আর বাঁধগাবার কমরেডরা পূবদকের জঙ্গলে বাঁধপাড়ে তিনখানা ওয়ান-সাটার রেখে আইছিল, মাটিতে পুঁতে, যাতে ইদিক থেকে এ্যাটাক হ্যলে জঙ্গলে লুকিই পড়ে একটা জবাব দিয়া যায়...

--হ, সেকথা ত শুন্যেছিলম...

---এখন বর্ষার জলের পর জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে...কীষ্টবাঁধের মুয়ান ভেঙে জল হো-হো করে বেরিই যাচ্চে, সারা জঙ্গল জলে জলাময়...বন্দুকগুলা খুঁজে পাওয়া যাচ্চে নাই...

.....


   ...বাতিস্তার স্বৈরশাসনের মতো বাবার দোকান ভেতরে ভেতরে দুর্বল হতে থাকে। আর দোকানের কুপির আঁধার ঘিরে জমে ওঠে সান্ধ্য মজলিস্ ; “বল ত হে গোপেশ্বর—এই পথিমি যদি এ্যাত বড় হয়, থাইলে ( মহা শূন্যের দিকে ইঙ্গিত ক’রে) এই ফাঁক টা কত বড়?” – বাবার মুদিখানা মহাশূন্যে এক বাতিল উপগ্রহানুর মতো ভেঙে পড়ে ।

   সেই সময় আমার বছর পঁয়তাল্লিশের বাবা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে সাইকেল চড়ে কোথায় কোথায় চলে যেত। যামিনী জেঠু, সন্তোষ জেঠু, ত্রিভঙ্গ জেঠু এদের সাথে আলোচনা চলত কিসের যেন? ওরা সবাই এক স্বপ্নালু বর্ণময় নদীতে একটা নৌকা ভাসানোর কথা বলত । আর আলোচনা করত সম্ভাব্য ঝড়ে হাল ধরে থাকা এক অনুদ্দিষ্ট কান্ডারীর কথা । আর আমার বাবা, যার বাস্তব জগত বলে কোনোদিন কিছু ছিলো না কখনো, সে তার স্বপ্ন জগতের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আরো হ্যালুসিনেশনের দিকে চলে যেতে থাকে...। উপার্জনহীন দীর্ঘ দুপুরগুলিতে বাবা টিনেরচালের কোঠায় কাটিয়ে দিত সারা দুপুর আর বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে উপহার দেওয়ার আগে আরো একবার পড়ে নিত ‘আঁখের স্বদ নোনতা’ হয়ে যাওয়ার বহুল পঠিত সেই কাহিনী ।


-- বাবার এইসব গল্পগুলি রয়ে গেল। বানানো গল্পগুলি, রঙ চড়ানো গল্পগুলি।  সোভিয়েতের পতন বাবা বিশ্বাস করেনি। কাস্ত্রোর মৃত্যু বাবা বিশ্বাস  করেনি। শুধু নন্দীগ্রামএর পর বাবা চুপ হয়ে গিয়েছিল। একবার শুধু বলেছিল--চাষীর ছেলা চাষ না করলে তরা খাবি কী? বাবা আর কোনো বানানো বিপ্লবের গল্প বলত না, শুধু ছোটবেলার গ্রামের গল্প বলত বুবুকে। বাবার জ্যাঠাকে মধ্যরাতে নিশিতে ডেকে নিয়ে যাওয়ার গল্প বলত।নিশির ডাকে বাবার জ্যাঠামশাই মাঝরাতে উঠে সেঁউতি খুলে কাঁধে গামছা ফেলে চলে গিয়েছিল পাঁচ মাইল দূরের  রুখা ক্ষেতে। খালের জল সেঁউতি দিয়ে সেচ করেছিল দুজনে। একদিকে বাবার জ্যাঠামশাই, অন্যদিকে সেঁউতিতে পা রেখে তার রামুকাকা। অন্ধকারে কেউ কাউকেই দেখতে পায়না। অঘ্রানের হিম নক্ষত্রের আলোয় দুই ছায়া মূর্তি জল সেচে করে যায় সারারাত। রুখা ক্ষেত উপচে পড়ে বাবার গল্পের ভেতর। ছোট্ট বুবু হাঁ করে শোনে গল্প, সে জানে বহুবার শোনা এই গল্প। আমিও বহুবার শোনা গল্প শুনি আনমনে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে। দুপুরের রোদ এলিয়ে আসে আমাদের ছাদের কার্নিশে।   গল্পের শেষে ভোরবেলা রামুকাকা দূর থেকে দেখতে পায় বাবার জ্যাঠা   ক্ষেতের আলের  উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষেত জলে ভেসে যাচ্ছে! 

 খুব ধীরে দিন বদলে যায়। যে দিনবদলের কথা ছিল তার থেকে অন্যতর দিকে দিন বদলে যেতে থাকে। গ্রাম শহর মানুষ মন আত্মা বদলাতে থাকে।  রুখা টাঁড় বাঁকুড়ার মাটির তলা থেকে হাজার হাজার গ্যালন জল উপরে উঠে আসে। মাটির তলা শূন্য হচ্ছে ক্রমশ। মফস্বলি সন্ধ্যার অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠছে বেমানান আলোয়। রাজদরবারের ধু-ধু অন্ধকার মাঠ অকারণ আলোকিত হয়ে ওঠে।  শ্মশানের ঝোপঝাড় আলোকিত হয়ে উঠছে। আলোর ভেতরে এক অচেনা অন্ধকারে    আমাদের আত্মক্ষয়ের ভাঁড়ার পূর্ণ হতে হতে উপচে ওঠে। একলা ভুতে পাওয়া মানুষগুলি অল্প আঁধারের খোজে লুকিয়ে শহর ছাড়িয়ে চলে যায় আরো আরো ভেতরের দিকে। 

   এই যে শহর দেখছিস এখন, আগে পুরোটাই ছিল বনবিষ্ণুপুর। শাল আঁকড় আর চাকলদার বন, লালবাঁধ পেরিয়ে আর যাওয়ার উপাই নাই, এত ঘন, মোল গামারের বন। ওইদিকে এরোড্রম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরর মহড়ার এয়ারস্ট্রিপ। বাবা তার পুরনো দিনের গল্প শুরু করে--

...আমার বাবার বালক বয়সের কথা।  তখন সে সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে। তার বাবা থাকে সুদুর কলকাতা শহরে। সেখানে এক সওদাগরী অফিসের হিসাব লেখক । একমাসে দুমাসে একবার বাড়ি আসে। এই বিষ্ণুপুরের ভাড়া বাড়ি থেকে দেশের বাড়ি মেঠানাগ্রামে যায় দাদা-ভাইদের সাথে দেখা করতে, তখন এই ছেলেটিকেও সঙ্গে নেয় কখনো। যুবতী স্ত্রী কলাবতীকেও সঙ্গে নেয়। দেশের বাড়ি থেকে ভাই গরুরগাড়ি পাঠায়। কখনো সেই গাড়ির সঙ্গে আসে বাল্য-বিধবা বোন। বালকটির পিসি। পিসি এলেই আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় বালকটিকে। আদর করে ডাকে ‘পরি’। ‘অ পরি, অ পরিয়া, ওরে অলাওঠা কোথায় গেলি রে...’—এইসব তার পিসির সুবচন। পরির শুনতে ভালো লাগে। দেশেরবাড়ি গেলে তার আর আসতে মন চায় না। সেখানে লেখাপড়া নাই, ইস্কুল নাই, চারিদিকে আদিগন্ত ধু-ধু টাঁড়, বাড়ির পিছনে জঙ্গল, ক্ষেত খামার আর কাকাতো ভাইয়েরা। সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা।

   সেবার তার বাবার ছুটি ফুরিয়ে গেল। তখন পরি  আরো ছোটো । কলকাতায় নাকি বোমা পড়েছে। সব লোক পালাচ্ছে সেখান থেকে। তখন পরির বাবা কলকাতা গেল এক ফাঁকা ট্রেনে। কলাবতী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদলো কদিন। পরিকে নিয়ে দেশের ঘরে থেকে গেল আরো কদিন। তার পর সেও ফিরে গেল বিষ্ণুপুরে নিজের সংসারে। আরো কদিন পরে পরি তার পিসির সাথে মেঠানাগ্রাম থেকে এক ভোরবেলা হেঁটে পাড়িদিল বিষ্ণুপুরের দিকে। সঙ্গে আরো দুই ভাই, একজন কাকাত ভাই সুবিমল আর একজন পরির নিচের জন। ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লে হেঁটে বিষ্ণুপুর পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাবে। প্রায় দশ-বারো ক্রোশের পথ। পরির পিসি মনে মনে ভাবে—সাইরেন বাজার আগে লিশ্চয় গামারবনীর জঙ্গল পার হয়ে যেতে পারব। ছোটো ছেলা-পুলা গুলা সাইরেনের কিছুই জানে নাই। মুখে বলে—‘চ রে সব, পা চলিয়ে চ...’। কিন্তু পিসি যা ভয় ছিল তাই ঘটল। ছেলা গুলা একটানা বেশী পথ হাঁটতে পারে নাই, মাঝে মাঝে থামতে হয়। গামারবনীর জঙ্গলে পৌঁছতে অনেকটা বেলা হয়ে গেল। 

  সেই সময়টা চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় । ভারতবর্ষ সেই যুদ্ধ দেখেনি, তবু সেই ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত অখ্যাত গ্রামের এক বাল্য বিধবা বুড়ি তার শিশু সঙ্গীগুলি নিয়ে যুদ্ধের মাঝে পড়ে গেল। যুদ্ধের মহড়া চলছে গামারবনী এরোড্রমে। প্রতিদিন সকাল নটায় সাইরেন বাজে। আশেপাশের গাঁ, বন জঙ্গলের মানুষ সাবধান হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সাইরেন বাজার পর এইবার সেখানে শুরু হবে যুদ্ধের মহড়া। সাইরেন থামলেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়োজাহাজ গুলো আকাশে উড়বে আর জঙ্গলের মধ্যে শুরু হবে গুলি বর্ষণ। 

   সেই সাইরেন বেজে উঠতেই তিনটে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে পিসি আতান্তরে পড়ে যায়। ফাঁকা শুনশান জনমানবহীন সেই গভীর শাল জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাচ্চা তিনটাকে জড়িয়ে ধরে পিসি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়—আর বোধয় ঘরে ফেরা হল নাই রে। বাল-বিধবা পিসি নিজের জন্যে কাঁদে না, কাঁদে অবোধ বাচ্চা গুলার জন্যে। এই বিশাল জঙ্গলের ভিতর কে তাকে রক্ষা করবে ভেবে পায় না। 

   এমন সময় ঈশ্বর প্রেরিত দেবীর মতো, নাকি দুজন কষ্ঠি পাথরের দেবীই ! সাঁতালমেয়ের বেশে  জঙ্গল ভেদ করে সেখানে উপস্থিত হল। তখনো সাইরেন বেজে যাচ্ছে, কানে ঝিঁ-ঝিঁ ধরার মতো অবস্থা সকলের। তারা এসে পিসিকে সান্তনা দেয়। বলে—কাঁদিস না, আমাদের সাথে আয়। যেমন যেমন বলব, তাই তাই করবি। তুরা তিন জন তিন দিকে থাকবি, ভাবিস না, যুদ্ধুখেলা শেষ হলে তুদের আবার এক করে দুব...। তারা পিসি আর বাচ্চাগুলো এক এক জনকে এক একটা গাছের কোটোরে লুকিয়ে রাখে। জঙ্গলের মধ্যে কোথায় বিশালাকৃতি গাছগুলো আছে, কোথায় মাথার উপর ছাদের মতো তাদের ডালপালা মেলা, কোথায় একটা গাছ আরেকটার উপর হেলে পড়ে মধ্যিখানে খোঁদল তৈরী করেছে, সব তাদের নখদর্পনে। পিসিদের সেইসব নানান স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তারা বলে যায়—নড়িস না, যেমন আছু, তেমন থাকবি। এই বলে তারা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন থামে। কিছুক্ষণ পুর্ণ স্তব্ধতার পর শুরু হয় একটানা গোঁ-গোঁ আওয়াজ। মাথার উপর সূর্যের আলো আড়াল করা ডালপালা মেলা জঙ্গলের ছাদ। কিছুই দেখা যায় না। বোঝা যায় আগুনের পাখিগুলো আকাশে উড়েছে। এইবার শুরু হয় গোলা বর্ষন, একটানা, গাছের পাতা খসে পড়ছে। ছোটো, মাঝারি ডাল ভেঙে পড়ছে চারদিকে। আর মাটিতে গভীর ক্ষত করে ধুলো উড়িয়ে এসে পড়ছে গোলা। পরি আর পিসি একটা গাছের কোটোরে বসে দেখছে, মৃত্যু পাশ দিয়ে গম্ভীর মুখে চলে যাচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে। তার পায়ে পায়ে তছনচ হচ্চে জঙ্গল।…

  কতদিন আগের গল্প এইসব? আমার মা তখন কোথায়? আমার জন্মের হাওয়া কোথায় কোন অনিশ্চিতের ভেতর থমকে আছে কেউ জানেনা। অথচ ছিল নিশ্চয় কোথাও। কারণ ভবিষ্যৎ একমাত্র নিশ্চিত এক ঘটনা। যা ঘটবার জন্য আগাম প্রস্তুত হয়ে থাকে। 

    কারন ওই ঘটনার থেকে কিছুদূরে, অন্য এক গ্রামের মাঠের কিনারে তখন দাঁড়িয়ে এক বালিকা।    গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ‘মোহরী—মোহরী’ বলে ডাক নামে ডেকে ডেকে ফেরে । মোহরীর বাবা তাদের মাজুরিয়া গ্রামের লাগোয়া জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে খামারের মাঠে আগুন জ্বালায়, কোনো হেমন্তের সন্ধাবেলা আকাশ লাল হয়ে ওঠে সেই আগুনের আঁচে। 

   সম্বৎসরের চাষ শেষ হয়ে গেছে। বাঁকুড়ার রুক্ষ মাটিতে বছরে একবার মাত্র ঐ চাষ-আবাদ। এখন হেমন্তের মাঠ খাঁ খাঁ শূন্য । গ্রাম থেকে বহুদুর, রেললাইন পার হয়ে ধান-ক্ষেত। মোহরীর বাবা নিজে হাতে টাঁড় জমি কেটে বানিয়েছে চাষ-জমি। জমির পাশেই একটা শীর্ণ ঝোরা। ঝির ঝির সারা দিন জল বয়ে যায়। সেই জল সেঁউতি ছেঁচে চাষ হয়। শীতের শুরুতেই ঝোরা শুকিয়ে যায়। পড়ে থাকে মোটা দানার বালি। কেটে নেওয়া ধানের গুছি শুকিয়ে শক্ত হয়ে থাকে ক্ষেত জুড়ে। পায়ে লাগলে পা কেটে যায়। এখন আর চাষী পরিবার গুলির কোনো কাজ নেই তেমন। শীতের সব্জি কোথাও বা ফলে উঠছে মাঠে মাঠে। সেও সামান্যই । রান্না-চালায় ঘরোয়া লাউয়ের লতা ফেনিয়ে উঠছে কারো। 

    মোহরীর বাবা কাঠগুলি অর্ধদগ্ধ মাটি চাপা দেয় । একসপ্তা মাটি চাপা থাকার পর সেই কাঠ-পোড়া কাঠকয়লা গরুর গাড়িতে বোঝাই করে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। সঙ্গে শুকনো খাবার—চিড়ে, মুড়ি, গুড় আর গমের ছাতু...। বলদ দুটির জন্য খড় ক’আঁটি। প্রথমে উত্তরে পাঁচ ক্রোশ মতো পথ পেরিয়ে বিষ্ণুপুর বাজার। বাজার পেরিয়ে, পুরনো শহরের একমাত্র লালমাটির পথ ধরে পূবে সে রাস্তা সোজা চলে গেছে কামারপুকুর জয়রামবাটি পারহয়ে দ্বারকেশ্বরের তীর অবধি। বিষ্ণুপুরের বাজার পেরোলেই দুপাশে ঘন শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। সন্ধার আগে এই জঙ্গল পার হয়ে যেতে হবে। দাঁতাল শুয়োর আর চিতাবাঘের ভয় বেশী এই জঙ্গলে। বিষ্ণুপুর পার হয়ে মোহরীর বাবা লণ্ঠনের আলো জ্বেলে নিয়ে গাড়ির নিচে আংটায় ঝুলিয়ে দেয়। পূবে কাঠকয়লার চাহিদা ভালো । যেতে হবে বহুদূর গাঁয়ের হাট গুলিতে, দ্বারকেশ্বরের তীর অবধি, ঐ পার আরামবাগ। নদী পার হয়ে ঐ পথে সোজা চলে যাওয়া যায় গঙ্গার পাড় অব্দি, ঐপারে দক্ষিণেশ্বর।  সেখানে সারা বছর বড় বড় নৌকা চলে।  সে অনেক দূরের পথ। মৌহরীর বাবা যায় দ্বারকেশ্বরের পার অবদি, শীতে-গ্রীষ্মে মানুষ হেঁটে পার হয় এই নদী, বর্ষায় জলের তোড় এসে সেই পায়ে চলা পথ ভেঙে দেয়, তখন নদীতে বান আসে, খেয়া চলে। 

   মোহরীর বাবার যাওয়া আসা প্রায় ১৪/১৫ দিনের পথ। গাড়ি ছেড়ে দিলে মোহরী বাবার পিছু পিছু গাঁয়ের কিনার পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে থাকে । বলদ-গরু দুটির গলার ঘন্টার টুং-টাং দুরে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেলে, সে ধুলো খেলতে খেলতে ঘরে ফিরে আসে...।

    ধুলো পায়ে বাড়ি ফিরে এসে মোহরী দেখে তার বড় দিদি এসেছে। মায়ের পাশে বসে গল্প করছে হাত নেড়ে নেড়ে। বড়দিকে কত সুন্দর দেখতে। তার ধপধপে ফর্সা চেহারার মাঝে কত গল্প । সব শ্বশুর বাড়ির গল্প। বড়দির বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়েই । গাঁয়ের নাম ঘুঘুডাঙা। ঐ যে গাঁ ছাড়িয়ে ধু-ধু ডাঙা জমি পেরিয়ে  মিলিটারি রাস্তা, ঐ রাস্তাদিয়ে কিছুদুর হেঁটে গেলেই ঘুঘুডাঙা। চারদিকে বাঁশের জঙ্গল আর কয়েকটি মাত্র মাটির ঘর। বাবার গরুরগাড়ি এতক্ষণে মিলিটারি রাস্তা ধরে ঘুঘুডাঙা পেরিয়ে যাচ্ছে।

   মোহরী বাবার কাছে গল্প শুনেছে। ক’বছর আগেও এই রাস্তা দিয়ে কত মিলিটারি ট্রাক যেত আসত। ঐ দুরে, জঙ্গলের মধ্যে গামারবনিতে উড়োজাহাজের আড্ডা। যুদ্ধের মহড়া চলত । এরোপ্লেন গুলো আকাশে উড়ত । মোহরীও দেখেছে সেসব। এখন যুদ্ধ নাকি থেমে গেছে। সাহেবরা চলে গেছে, আর আসবে না। এখন ঐ মিলিটারি রাস্তা দিয়ে বাবা গরুরগাড়ি নিয়ে যায়। দিদি বাপের বাড়ি আসে...। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে বিষ্ণুপুর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে চৌকানের জঙ্গলে যে এরোড্রম, সেই পর্যন্ত। এই রাস্তা ধরে বাবা চলে যাবে বিষ্ণুপুর অবদি, তারপর জয়রামবাটীর কাঁচা পথ...। 

এদিকে আমার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গিয়ে জুড়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়, যেখানে আমি কোথাও নেই! অথচ ঘটনা বহমান।  ওই গামারবনীর রাস্তায় খেই হারিয়ে ফেলছে অন্য একটি ঘটনা। আমার বাবার শিশুকাল। যোগাযোগহীন দুটি চরিত্র স্থান আর কালের কিঞ্চিৎ তফাতে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, তারা আরো কয়েক বছর ব্যবধানে জুড়ে যাবে আজীবনের মতো। আর হাওয়ার ভেতর থেকে এই পৃথিবীতে, এই দেশ গাঁয়ে   আমার জন্মের সম্ভাবনা আরো মূর্ত হয়ে উঠবে কয়েক দশক পর। 

 সেই সূদূর ভবিষ্যতে আমি ডায়েরিতে লিখে রাখব নিচের কথাগুলি--


 "...আমার মায়ের বালিকাবেলা সাদাকালো গরুগুলি খুলে দিয়ে বিচুলি খাওয়ায় । গ্রামের মেয়েরা তাকে  মোহরি মোহরি ব’লে ডাক নামে ডেকে ডেকে ফেরে । আগামী অঘ্রাণে তার  কোথাকার কোন্ এক পাত্রের সাথে বিবাহের সবকথা স্থির হয়ে আছে ...। 

   সেখানে কোথাও কোনো কল্পনার আধারে আমি দ্রবীভুত নই । আমার বাস্পটুকুও ভেসে নেই কোনো সুচতুর গম্ভীর বাতাসে । সেইখানে , চুড়ান্ত সংশয়ের মধ্যথেকে একবার পরিস্ফুট হয়ে, বালিকার দুই বুকে ভাঁজ করে রেখে দেব এইসব পান্ডুলিপি গুলি...

   ভবিষ্যতে পুনরায় শুষে নেব, লিখে রাখব ব’লে…"



(রচনাটি পঙ্কজ চক্রবর্তী সম্পাদিত 'সর্বনাম' পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতা লিখি এমতো গল্প পরিচিত মহলে প্রচলিত আছে যেহেতু,  পঙ্কজ আমাকে লেখালিখির গোড়ার কথা সম্পর্কে একটা গদ্য লিখতে বলে। আমি চালাকি করে আমার অসম্পূর্ণ এবং পরিত্যক্ত  একটা উপন্যাসের কিছু অংশের একটা কোলাজ বানিয়ে দিয়ে দিই। তবে এটাই আমার যাবতীয়,  সে লেখালিখি বা মুছে ফেলার,  যাইহোক না, গোড়ার কথা। এটা আমি বিশ্বাস করি।) 

 

1 টি মন্তব্য:

  1. কৌশিক'ভাই এই যদি 'চালাকি' হয়--তবে চালাকি চলুক অনন্তকাল!
    আপনার প্রিয়-ভক্ত পাঠক হিসাবে, একমাত্র চাওয়া এটাই।

    উত্তরমুছুন