বৃহস্পতিবার, ২২ জুলাই, ২০২১

উৎসের দিকে...

 অনপেক্ষ অনলাইনের 'সূত্রপাতের স্বগতোক্তি'' বিভাগে শুভাশিসদার (মণ্ডল) আদেশে লিখিত হয়েছিল লেখাটি। 



ছবিঃ বাসুকি দাশগুপ্ত


 অপেক্ষার মতো ঝিমধরা উপত্যকা আর কিছুতে নাই। বালকবেলার সবুজ ঘাসের মতো অপেক্ষা, কৈশোরে এসে পাল্টে যায়! কিশোরের অপরাহ্ন একজন যুবকের নয়, যৌবনের প্রান্তে যে অপেক্ষা তা কার জন্য আমি জানিনা। একজীবন ঝিমধরা অপেক্ষা আমার নেশা হয়ে থাকল।  যা চেয়েছি তা যদি সেই বাল্যে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে,   সব সব পাওয়া হত ঠিক ঠিক! যথাসময়!  যদি আমার কোনো অপেক্ষা না থাকতো কোনো অনির্দিষ্টের প্রতি? কী হত?   


 


 এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে বুঝি এই অপেক্ষার খুব প্রয়োজন ছিল। একটা আজীবন অনির্দিষ্ট প্রতীক্ষা নিয়ে থাকার আত্মজৈবনিক আততি আমাকে একটা অন্ধ লেখার দিকে ঠেলে দেয় বারবার। সেই কবে থেকেই।  হয়ত তখন, সেই বাল্যে, কৈশোরে, তাকে এমন ভাবে চিনিনি। আর মনেও নেই কবে প্রথম সেই  প্রতীক্ষার শুরুয়াত হল।   


   বাহ্যিক একটা আরম্ভ থাকে, তারও আগে থাকে ভেতরের একটা আরম্ভ। তাকে এই এত বছর পর আর চিহ্নিত করা যায় না বিশেষ কোনো ঘটনা দিয়ে।    অথচ বাহ্যিক ঘটনাগুলি এতই অকিঞ্চিকর যে তাকে  বানানো গল্পের মতো মনে হয়। অন্য লোকের জীবন বলে মনে হয়। বয়ঃসন্ধির  সেই লাজুক আর ভয়ংকর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলিকে শুরুয়াত বলা যায় কিনা জানিনা। ১৯৯২ সালে একটি পত্রিকায় প্রথম নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে যে আত্মরতিময় কামুক অনুভুতি তাকেও কি শুরুয়াত বলা যায়?  অথচ সেই ছাপার অক্ষরে নিজনাম দেখার অনুভূতি প্রথম স্বমেহনের  মতোই মনে রয়ে গেছে। যা আজীবন লুকিয়ে রাখতে হয়।  যা আর অন্য কারো কখনোই কোনো কাজে লাগে না, এমন কি নিজেরও কোনো কাজে আসে না আর। তবু তা থেকে যায়।  


  হয়ত প্রত্যেক মানুষের জীবৎকালের সমস্ত কর্ম,  পাপ,  পূণ্য, অসহায়তা তার জন্মক্ষণ আর স্থানের মধ্যে লেখা থাকে। সেই জন্ম মুহুর্তের বয়ে যাওয়া বাতাস, নক্ষত্রের অবস্থান, আর এই মাটির কয়েক কোটি বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাসের মধ্যে সে তৎক্ষণাৎ ঢুকে পড়ে, আর তার ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়।  এক অভিশাপময় অন্ধকারের ভবিষ্যৎ সে বহন করতে থাকে, যা তার অন্তর্গত লোহু। তাকে এড়ানো যায় না। সে লিখতে শুরু করবে কোনো একদিন এইসব, পাপ স্খলনের মতো।


   জন্ম এক প্রতিদান। কবে কখন ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হবে তা? আমার জন্ম মাটি কেমন? লাল ল্যাটেরাইট। ঊষর। বন্ধুর। পাড়ার আনাচে কানাচে টেরাকোটা স্থাপত্যের প্রাচীন কাহিনি মূক ও মুখর। যে তার ভাষা বোঝে, সে বহুদূর অব্দি টের পায় বন ও প্রান্তরের বিধুরতা । আর বিশংশতাব্দীর শেষে যার শৈশব কৈশোর এইসকল পারিপার্শ্বিক নিয়ে হয়ে উঠবে অতি ব্যক্তিগত। এই শতক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যেহেতু, তাই জন্ম-নক্ষত্র ও মাটির ইতিহাস সুপ্ত থেকে যাবে শরীরে বহমান লোহুর ভেতর  । আর পুনরায় লিখে ফেলব আত্মরতি। কোনো বড়,  বৃহৎ ভাব,  বিশালের অংশ আমাকে ধরা দেবে না।  সবার জীবনে তা দেয়ও না। ছোটো ছোটো ভাব, দুঃখ, আনন্দ আর আত্মখোদাই এইসবই হয়ে উঠবে বিষয়। আর ক্রমশ নিজের জীবনকে এক্টি স্ব-লিখিত গল্পের মতো মনে হবে ক্রমশ। 


তখনো জানিনা এসব, তখনও জানিনা এই এক সামান্য আত্মখোদাই-ই আজীবনের কাজ হয়ে উঠবে। তখন শুধু পাতা ভরিয়ে রাখা। আর কেউ পরিচিত বন্ধুবান্ধব চেয়ে নিলে অপেক্ষা করা। রোজ গোছা গোছা পোস্টকার্ড আর চটি এক ফর্মা দু ফর্মা পত্রিকাগুলি ততদিনে আসতে শুরু করেছে নিজের ঠিকানায়। বিলুপ্ত টেলিফোন বুথের যুগ তখনও আসেনি। অপেক্ষা সেই ছাপার অক্ষরে আত্মরতির মতো নিজনাম টুকু দেখার। আজ তা বহুদূরের জীবন বলে মনে হয়।  তবু সেদিনের সেই শুরু ছিল একটা অপেক্ষা। 


    শৈশবের প্রবল জৈষ্ঠের দুপুরে পিসিমনি এসে দাঁড়ালো উঠোনে, ছোটো ভাই কোলে, সেই হঠাৎ আগমনের আনন্দ,  সে এক আনন্দ! যুবা বয়সের বন্ধু আসবে বিকেলে,  বহুদিন পর, তার জন্য অপেক্ষা এক আনন্দ। আর সেই,  অনিশ্চিত, যাকে আমি চিনি না, যে সেই শৈশবকাল থেকে আমার সঙ্গী, সে কি কোনো মানুষ? কোনো নারী, কোনো মহাপ্রলয়,  কোনো ঘটনা? আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। শুধু জানি সে আসবে একদিন। এসে বলবে,  মাধব, তোমার কথার ভেতর দুদণ্ড বসলাম, এবার চলে যাচ্ছি। সেই এক ঝিমধরা উপত্যকা, যার জন্য আমি প্রথম,  কোনো একদিন মধ্যরাতে খাতার সামনে বসে  পড়েছিলাম।  তখন কৈশোর বিদ্ধস্ত হচ্ছে...     "

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

কথোপকথন : স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত ও কৌশিক বাজারী

কথোপকথন :  

স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত ও কৌশিক বাজারী ।

 

 

(আমাদের এই কথোপকথন পর্যায়টি  ঘটেছিল কয়েকবছর আগে। স্বর্ণেন্দুর একটি কবি সম্মান প্রাপ্তি উপলক্ষে,  একটি পত্রিকার সম্পাদক বন্ধুর অনুরোধে।  ঘটনাচক্রে তা আর প্রকাশিত হয়নি। আমার গুগুল ড্রাইভে থেকেই গেছে কথাবার্তাগুলি। মনে হল ব্লগে তুলে বন্ধুদের পড়তে দিই। তাই...

--কৌশিক বাজারী)




কৌশিক বাজারী :

আচ্ছা, স্বর্ণেন্দু, শুরু করি তাহলে ? প্রশ্ন তো একটাই সকলে করে, কেন কবিতা লেখো? ত একজন এর উত্তরে বলেছিলেন সিনেমা বানাতে পারিনা, ছবি আঁকতেও পারি না, অগত্যা কবিতা! গান গাইতে পারলে হয়ত কবিতা লেখার প্রয়োজন হতই না আর...। তোমার ব্যাপারটা কী? মানে ভিউটা, একটু বল, অন্য কারো কথা না, তোমার কথা, কীভাবে এসে পড়লে এই জগতে?


স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত:

কেন কবিতা লিখি, এবং কীভাবে এসে পড়লাম এ জগতে, দুটো প্রশ্ন দু-রকম হলেও, এখানে বোধহয় একটি প্রশ্নেরই বাতাবরণ গড়ে তুলেছে ।  এই যে কেন লিখি কবিতা,বা কবিতা লিখে কী হতে পারে এর উত্তর ভাবতে গিয়ে, যেগুলো মনে আসছে, কবিখ্যাতি, সবার মাঝে থেকেও সবার থেকে আলাদা, বা বিশিষ্ট হয়ে ওঠা, বা তুমি যেভাবে বললে, আর অন্যকিছু পারিনা বলেই কবিতা লেখা ইত্যাদি, এগুলো সবই আসলে খুব পরিণত বয়সের চিন্তা, তাই এই ধরনের উত্তর থেকে দূরে থাকতে চাইছি । দূরে থাকতে চাইছি কারণ,  আমি প্রথম যেদিন কবিতা লিখেছিলাম, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন আর এভাবেই নির্ধারিত হয়ে গেল আমার পরবর্তী জীবনের গতিপ্রকৃতি, সেদিন কি আর বুঝতাম এতসব কিছু্র মানে, কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনাটি তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, সেই কবিতা লিখে ফেলাটি ! সেদিনের প্রথম কবিতার আমি-ই তো আজও এগিয়ে চলেছে একটি পরিণতির দিকে, বিরামহীন । কবিতা কেন লেখে সেদিন বোঝার বয়স ছিলো না, কিন্তু না থেমে লিখে যেতে যে চাইতাম তা জানি, কারণ প্রতিদিন সন্ধেবেলা ঠাকুর প্রণামের সময়, আমার একটাই ছিল নিয়মিত প্রার্থনা, যে আমি যেন লেখক হয়ে উঠতে পারি !

সুতরাং লিখি, এবং লিখে যে যাচ্ছি এটা সত্য । কিন্তু কেন লিখি ? আজকের আমি সেদিনের আমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেদিনের আমি আজকের আমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু কেউ কাউকে এর প্রকৃত উত্তর বলে দিতে পারছে না!


কৌশিক :

হ্যাঁ, একটা অন্তর্গত সুরবোধ, যা কারো কারো ভেতরে বেজে ওঠে! সেটাই তোমার কথা থেকে বোঝা গেল। হয়ত খুব শিশুকাল থেকেই । তবে সবাই হয়ত দীর্ঘকাল বহন করতে পারেনা সেই সুর, হয়ত পারিপার্শ্বিক এর চাপ তাকে নষ্ট করে । অবশ্য এতে কোনো অসুবিধা বোধ হয় না । অর্থাৎ বিষয়টা একেবারেই ভেতরের, অন্তরের একটা রহস্যময় জগত, যার নাগাল সচেতন মন পায়না, তাইতো ?



স্বর্ণেন্দু :

এই কয়েকদিন আগে একটা পুরানো ডায়েরি খুঁজে পাই, এই ডায়েরি থেকে আমার লেখালিখির প্রথমদিকের একটা ঘটনা, সামান্যই সে ঘটনা, মনে পড়ে যায়! সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন, সে সময়ের ডায়েরি এটি । কবিতা লিখতাম, এবং কবিতার নিচে, কবির নাম লেখা হয় যেখানে, উলটো পালটা নাম লিখে রাখতাম, নিজের নাম লিখতাম না । আমি ব্যতীত অন্য কেউ যদি আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত জীবনটির খোঁজ পেয়ে যায়, এমন একটি সংকোচের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এই বিভিন্ন নামের আড়াল খুঁজে নেওয়া । ক্রমে আর এই সংকোচটি থাকল না । আমার যে একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে, সেখানে আমি স্বাধীন, আমার কথাগুলি, ভাবনাগুলি  একান্তভাবে আমারই, আমার ভাবনাগুলি আমার মতো করে ব্যক্ত করতে পারি, এগুলি সবাইকে জানাতে আর সংকোচ থাকল না । তাই কবিতার নিচে নিঃসংকোচে যেদিন প্রথম লিখে দিতে পারলাম নিজের নাম, সংকোচ বিসর্জনের থেকেও সেদিন আমার কাছে বেশী করে গুরুত্ব পেল যা, তা হল একান্ত ব্যক্তিগত ও স্বাধীন এক জীবন যাপনের ইচ্ছে! তোমার প্রথম প্রশ্নের হয়তো এটিও আর একটি উত্তর, একটা স্বাধীনতা বোধ, আমরা সকলে যা প্রত্যাশা করি, তা আমি এখানে সবচে বেশী অনুভব করে থাকি । তাই এখন এটি শুধু আর অন্তরের রহস্যময় জগতের ব্যাপার থাকল না,  বাইরের একটি কারণও খুঁজে পাওয়া গেল বোধহয়, তোমার এই দ্বিতীয় প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ।


কৌশিক :

দেখ, ব্যক্তিগত জীবন যাপনের বোধ, একটা বয়সের পর আসেই । প্রকাশেচ্ছা, নিজেকে উপস্থাপন, সেটা আবার কিঞ্চিত আলাদা । অর্থাৎ আমারও কিছু বলার আছে, বলতে চাই, এই ইচ্ছা । সকলেই হয়ত পথ খুঁজে পায়না । তবু খোঁজটা থাকে আজীবন । আচ্ছা তুমি কবিতায় মূলত কী বলতে চাও? এবং আরো বড় কথা হল, কিছু কি আড়াল করতে চাও? প্রশ্ন কি ঠিক করতে পেরেছি?


স্বর্ণেন্দু :

নিজের কথা নিজের মুখে বলার সংকোচটি সহজাত হলেও, আমরা আত্মজীবনী লিখি । কারণ, আত্মজীবনী প্রথমত নিজের চোখ দিয়ে নিজেকেই দেখা, দেখতে দেখতে নিজেকে জানা ও বোঝা, অন্য আর পাঁচজনকে জানানো ও বোঝানোর ব্যাপারটি অনেক পরে আসে । আত্মজীবনী রচনার মতো আমার কাছে কবিতা লেখাও আসলে নিজের চোখ দিয়ে নিজেকেই দেখা, নিজেকে বোঝা, যদি কিছু বলার বিষয় থাকে সে বলাটাও নিজেকেই বলা । আমার কবিতা কিছু বলতে চায় না, যদিও কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলাই যায় । যে অনুভূতিগুলির কথা, হঠাত হঠাত উদ্ভাসনগুলির কথা কাউকে বলা যায় না, অথচ নিজেকে বলতে কোনো বাধা নেই, লেখার ছলে সেগুলি নিজেকেই বলে ফেলা হয় আসলে । কারণ সেগুলি না লিখলে, না বললে, চিরকালের জন্য অধরাই থেকে যেত তারা, সেগুলি-ই  আমার কবিতা, তারপরেও আরো অনেক অনেক অধরা থেকে যায়, সবগুলোকে তো আর কবিতায় ধরতে পারি না! কিন্তু একজনের সব কথাই তো আর নিজেকে বলার জন্য হতে পারে না, আমারো কিছু কথা আছে যা অপরকে বলা যায় বা বলতে চাই । সে সকল কথার জন্য আমি গদ্য লিখি, সেখানে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে চাই, আমার বক্তব্যটি সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে চাই ।


কৌশিক :

আচ্ছা, ধরো, পৃথিবীতে এক বিশাল বিপর্য্যয় ঘটে গেছে! আনবিক যুদ্ধে, বা মহাশূন্য থেকে খসে পড়া গ্রহাণু সংঘাতে মানব সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে! কেউ নেই । বা থাকলেও কোথাও, তুমি তা জানোনা । একা, পোশাকহীন, ঠাঁইহীন ঘুরে বেড়াচ্ছ।
ধরা যাক,প্রকৃতি খাদ্য যোগাচ্ছে ।

কবিতা লিখবে ?



স্বর্ণেন্দু :

চূড়ান্ত সংকটের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষ শিল্পের সম্মুখীন হয়, এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যায় । কিন্তু তুমি যদি জিজ্ঞেস করতে প্রচণ্ড বৈভব, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও আমি কবিতা চর্চা চালিয়ে যেতে পারবো কী না, তার উত্তর দেওয়া আমার ক্ষেত্রে আরো কঠিন হত, আমাদের সামনে তেমন দৃষ্টান্তও খুব একটা আছে বলে মনে হয় না । এ প্রসঙ্গে, এই মুহুর্তে মনে পড়ছে, মোয়াজ্জাম বেগ এর কথা । আমেরিকা অধিকৃত কিউবার গুয়ান্তানামো উপসাগরের তীরে অবস্থিত কুখ্যাত ডিটেনশন ক্যাম্পে, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে, মোয়াজ্জাম বেগ তিনবছর বিনা বিচারে কারারুদ্ধ ছিলেন । অকথ্য, অবর্ণনীয় মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে  তাঁকে এখানে কাটাতে হচ্ছিল যখন, কবিতা লেখা শুরু করেন! এই  কারাগারের ভিতরের অবস্থা, মানব সভ্যতা শেষ হয়ে যাওয়ার যে কথা তুমি বলেছ, তার চেয়েও খারাপ বই ভাল নয় । হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভিতরেও যে কবিতা লেখেন নি কেউ, ব্যাপারটি আদৌ এমন নয়! বেগ এর বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয় নি, শেষপর্যন্ত তিনি মুক্তি পান ।

এক সাক্ষাৎকারে কবিতা লেখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হোলে, মোয়াজ্জাম বেগ বলেছিলেন...‘I liked writing poetry, but having said that, poetry is something I only discovered in Guantánamo, and it was solitary confinement that produced that response in me.’ বাস্তবিকই এক বিচ্ছিন্ন কারাগারে তিনি প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন, সম্পূর্ণভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় । মুক্তির পরে, আরও কবিতা লিখতে চান কী না জিজ্ঞেস করা হোলে, তিনি বলেন...‘It’s sad, because it means that I need that isolated environment to write, and I can’t do it in just any situation’।



কৌশিক :

আমার প্রশ্নের মূল জায়গাটা, স্বর্ণেন্দু, একটু আলাদা ছিল, একটু নয়, পুরোটাই, হয়ত আমি বোঝাতে পারিনি, আসলে বৈভব না অভাবের প্রশ্ন নয় এটা, আমি বলতে চেয়েছি পৃথিবীতে একা একজন মানুষের কথা, যার কথা শোনার জন্য আর কেউ নেই তার সামনে, সেই তখন, যখন কবিতা বা যেকোনো শিল্প আর কাউকে দেখানোর বা শোনানোর নেই, কী করবে সে? যদি তুমি হও সেই ব্যক্তি, কী করবে ?



স্বর্ণেন্দু :

তুমি পাঠকহীনতা কে গুরুত্ব দিতে চেয়েছ, আমি গুরুত্ব দিয়েছি সংকটটাকে । সেদিক থেকে দেখলে, একজন লেখকের সামনে আর যখন কোনো পাঠক নেই, এটিও আর এক ধরনের সংকট ! লেখকের সংকট । সেদিকেই হয়তো আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ এগিয়ে চলেছে, যা অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, এমন একদিন এগিয়ে আসছে যখন কেউ আর সাহিত্য পাঠ করবে না । তখন এটা শুধু  একজন লেখকের সংকট হতে যাবে কেন, সভ্যতারই তো সংকট এটা !

তুমি একেবারে ব্যক্তি আমার কথা জানতে চেয়েছ— যে আমি কী করব তখন— আর সত্যি-ই তা আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছি আমার আগের উত্তরে । একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলতে যাওয়া মানে, আরও বেশী করে সেই কল্পনারই আশ্রয় নিতে যাওয়া, আমি কিছুতেই বুঝতে পারব না, সে কল্পনা কতদূর প্রকৃত বাস্তবকে অনুসরণ করছে । তাই সেই প্রশ্ন থেকে মুখ ঘুরিয়ে চারপাশটাকে দেখে নিতে চেয়েছি, যে প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে কী কী ঘটে থাকে, সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছি । আর একটি কথা বলা হয় নি, সম্পূর্ণ আইসোলেশনের মধ্যে সেই কয়েদি কবিরা, নুড়ি দিয়ে, কাঁকর দিয়ে, কারাগারের দেওয়ালে মেঝেতে কবিতা লিখত । কারণ, প্রথম প্রথম লেখার কোনো সরঞ্জাম ছিল না তাদের । দেওয়ালে, মেঝেতে লেখা কবিতাগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যেত দেওয়াল থেকে, মেঝে থেকে, একটি পাঠকেরও মুখ দেখতে পেত না সেগুলি যেমন, কোনো পাঠক পড়বে এমনটা ভেবেও নিশ্চয় লেখা হত না কবিতাগুলি ! সুতরাং লেখা যায়, একেবারে নিজের জন্যও লেখা যায় তাহলে ! লেখা যখন যায়, আমিও কবিতাই লিখব তখন, একা একাই মুছে দেব সেগুলি , কারণ বেঁচে থাকা ব্যতীত অন্য কোনো কাজই তো রইল না আর ।




কৌশিক :

খুব সুন্দর বলেছ স্বর্ণেন্দু ! সত্যিই ত, নিজেকেই নিজে বলে যাওয়া এইসব কথা! কবিতায় ছবিতে গুহাশিল্পে, প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে, ‘সুতনুকা নামে সেই দেবদাসী’ অজ্ঞাত কোনো কবি যাকে পাথুরে লিপিতে প্রেম জানিয়ে ছিল হাজার সহস্র বছর আগে! তাহলে ভাই এই পুরস্কার খ্যাতি যশ এর সঙ্গে কোথায় কোন সম্পর্কে তুমি যুক্ত করবে আজকের শিল্পকে ? কিছু আলোকপাত কর দেখি এর উপর ?


স্বর্ণেন্দু :

এই বিষয়টি, এমন কী জগতের কোনো বিষয়ের ওপরেই, যথাযথ আলোকপাত করবার মেধা ও পাণ্ডিত্য আমার নেই । এখন ঘটনাচক্রে তুমি প্রশ্নদাতা আর আমি উত্তরদাতা, উল্টোটিও হতে পারত । আমাকে এখানে কিছু বলতে হচ্ছে, যদিও বলার আগে, বলার সময়ে, এবং বলার পরেও সেই ‘বলা’ নিয়ে সংকোচ কিছুটা হলেও থেকেই যাচ্ছে। থাকবেও ।

এবার কাজের কথায় আসি,শিল্পচর্চা করে কেউ কেউ পুরস্কার খ্যাতি ও যশের অংশীদার হয়ে ওঠেন এটি ঠিক, তা বলে শিল্প চর্চার লক্ষ্য কখনোই পুরস্কার খ্যাতি বা যশ হতে পারে না । আবার, শিল্প চর্চার সরাসরি ফল হিসেবেও এগুলোকে দেখা যায় না, বাংলাভাষায় লিখে কজনই বা আর পুরস্কার খ্যাতি বা যশের মুখ দেখেন! কেউ কেউ দেখেন, এটিও একরকম সত্য, কিন্তু এই সত্যের জন্য অপর সত্যগুলো মূল্যহীন হয়ে যায় না । এই পুরস্কার খ্যাতি যশকে গ্রহণ করবার ধরনের মধ্যেও তারতম্য দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ তিনটি-ই পেয়েছিলেন, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অসূয়া নেই, সহনশীলতা রয়েছে । আজকের সময়ের কেউ তা পেলে,  এ বিষয়টিকে আবার এতটা উদার দৃষ্টিতে দেখতেও পারি না । অবশ্য তার জন্য কিছু যাবে আসবে না, এই পাওয়া না-পাওয়া, দেওয়া না-দেওয়া, ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক এবং-অথবা রাজনৈতিক খেলাটি চলতেই থাকবে ।

কিন্তু কথা হল, এইসব বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা আমাদের জন্য কতটা জরুরি ? আলোচনার মাঝে তারা হঠাত এসে ঢুকে পড়ছে যখন, তাদের একটি প্রভাব রয়েছে আমাদের চিন্তায়, কথাবার্তায়, এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই আর । এইসব প্রভাব থেকে যত দূরে রাখতে পারবেন একজন নিজেকে, ততটাই গভীর ও একাত্ম হয়ে উঠবেন তিনি, আমার এটুকুই বিশ্বাস । আবার দেখ, আমরা যে সকল কবি-লেখকের সঙ্গে ঘর করি, আমি জানি তুমিও, তাঁদের সিংহভাগই তো পুরস্কার খ্যাতি ও যশের বাইরে থেকেই সারাজীবন শিল্পচর্চা করেছেন, বা এখনও করছেন । এর জন্য তাঁদের শিল্পচর্চায় তো কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি, তাঁদের গ্রহণ করতেও আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি, আমরাই তো খুঁজে খুঁজে গিয়েছি তাঁদের কাছে । শিল্পীর থেকে, শিল্পর থেকে, কোনো পুরস্কার-ই কখনো বড় হতে পারে বলে আমার মনে হয় না ।



কৌশিক :

দেখ স্বর্ণেন্দু, এখানে আমারও একটা কথা বলার ছিল, আমার মতামত এখানে যদিও বেশি কাম্য নয়, তবু যেহেতু এটা প্রথাগত সাক্ষাতকার নয় তেমন, দাদা - ভাই এর কথোপকথন বলা যায়, তাই তোমার কথার সূত্রে বলি-- প্রথমত এই পুরস্কার শব্দটাই আমার কাছে খুব ফিউডাল গন্ধযুক্ত মনে হয় । যেকোনো কবিশিল্পী বিজ্ঞানী অর্থাৎ সৃজনশীল মানুষকে পুরস্কৃত করার কিছু থাকে না । কেইবা তাকে পুরস্কৃত করতে পারে! আমরা শুধুমাত্র তাকে সম্মান জানাতে পারি । নত হতে পারি তার কাছে, যে প্রকৃতই কল্যানের কাজে ব্রতী, এটুকুই ।




স্বর্ণেন্দু :

সুন্দর বলেছ, কৌশিকদা । এই বিষয়ে তোমার একটি লেখাও ছিল, মনে আছে আমার, লেখাটি খুব ভাল লেগেছিল । যাই হোক, কাজের শেষে সম্মান বা স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার আসে, তাই এসব কথাবার্তা প্রকৃত অর্থেই শেষের কথা, শেষ নিয়ে কথা । আমরা এখন শুরুর দিকে আছি, কবিতায় আছি, কবিতা নিয়েই কথা বলি চলো —


কৌশিক:

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন। এই যে কবিতার বিবর্তন, চর্যাপদ থেকে, বৈষ্ণবকাব্য, মঙ্গলকাব্য হয়ে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পেরিয়ে বিনয় গৌতম বসু বা চৌধুরীদের সময়ে এসে পৌঁছল বাংলা কবিতা, এবং এখন প্রবহমান, এই প্রবাহে সমকালীন ধারাটিকে কোথায় রাখবে? নিজেকে এর মাঝে কোথায় আবিষ্কার করতে চাও? কিছু বলবে?


স্বর্ণেন্দু :

প্রবাহ, প্রবহমান, ধারা এই শব্দগুলি মিলেমিশে, আমি একটি জলধারার ছবিকেই দেখতে পাচ্ছি এখানে । বাংলা কবিতার ধারা, বিরামহীন গতিতে এগিয়ে চলা একটি নদীর বয়ে যাওয়ার মতো, চর্যাপদের পদকর্তারা যেমন, একেবারে আমাদের সময়ের গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী প্রমুখ সে ধারায় সামিল রয়েছেন, তুমি বলেছ । তাহলে সমকালীন ধারাটিকেও তো সে প্রবাহেরই অন্তর্গত করে দিলে তুমি ! এখন সমকালীন ধারা বলতে যদি গৌতম বসু বা চৌধুরীর  পরবর্তী সময়ের লেখালিখির কথা বলতে চাও, তাহলেও আমি একই কথা বলব, যে এটিও সে প্রবাহেরই অন্তর্গত রয়েছে । তোমার এই প্রশ্নটি আমাকে এমন একটি ছবির সামনে পৌঁছে দিল আসলে ।

বাংলাকবিতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে জুড়ে থাকার সৌজন্যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমিও যে একেবারে ভাবিনি এমন নয়, কিন্তু আমার ভাবনার ছবিটি সামান্য আলাদা । সেখানেও প্রবাহ আছে, তার প্রবহমানতা নিয়েই আছে, ধারাও আছে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একটি জলধারা নেই, একাধিক, বলা ভাল যতজন কবির কথা আমরা ভাবতে পারি ঠিক ততগুলি জলধারাই এখানে রয়েছে । একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত হয়ে, একক ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যে যার নিজের পথটিকে গড়তে গড়তে, ভাঙতে ভাঙতে, এগিয়ে চলেছে । আজ আমার যা মনে হয়, কবিতার যাত্রা বা একজন কবির যাত্রা আসলে এক  নিঃসঙ্গতার যাত্রা, একাকিত্বের যাত্রা । এখানে রবীন্দ্রনাথ একটি জলধারা, জীবনানন্দ আর একটি, বিনয় মজুমদার আরও একটি, এবং এভাবেই গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী প্রমুখ, এক একজন এক একটি একক ও বিচ্ছিন্ন জলধারা, সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন নিজ নিজ লক্ষ্যে অবিচল  থেকে । জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে বইলেন, বিনয় মজুমদার তবুও কিছুটা জীবনানন্দমুখি বয়ে গেলেন, এবং এমন ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে, থাকবে । সময় যত এগুবে, প্রকৃত কবি যাঁরা সেই জলধারাগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, বলা বাহুল্য যে, অন্যান্যগুলি ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকবে । কিন্তু এমনভাবে একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত বিভিন্নমুখি জলধারার কথা ভাবলাম কেন ? ভাবলাম, কারণ এমনটি ভেবে নিতে পারলে, বাংলাকবিতার বিভিন্নমুখি স্বরগুলোকে যেমন সহজে চিহ্নিত করা যায়, তেমনই একটি নির্দিষ্ট সময়খণ্ডের মধ্যে যুগপৎভাবে উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট মানের কবিতা কিভাবে রচিত হতে পারে, এই দ্বন্দ্বটির একটি সহজ সমাধানে পৌঁছে যাওয়া যায় । জীবনানন্দ বাংলা কবিতার ভাষা, ভাবনা ও পরিধিকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন, বিনয় মজুমদার, আলোক সরকার, বীতশোক ভট্টাচার্য প্রমুখ যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন, তারপরে লিখতে এসেছেন এমন অনেক কবি, এইসব মহৎ কবিদের মাথার ওপর তুলে রাখলেন ঠিকই কিন্তু একইসঙ্গে লেখায়, ভাবনায় ও ভাষায় অতি তরল, অতি সাধারণ থেকে যেতে পারলেন সহজেই এবং এর জন্য কোনো আত্মপীড়াও অনুভব করলেন না, এমন একটি আপাত বিপরীতমুখি বাস্তবকেও মেনে নিতে আর অসুবিধা হয় না তখন । এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়, যে কোনো একজন মহৎ কবি আসলে একজন ব্যর্থ কবিও । যে দায়বোধ থেকে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নতুন করে তুলতে চান, অনুসরণীয় করে তুলতে পারেন, সেই দায়বোধ, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন না সহজেই । তাঁর লেখা নয়, তিনি, তাঁর এই দায়বোধ, খুব কম ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় হয়ে ওঠে, বা হয়ে ওঠে না বললেই চলে, তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ থেকে যান । তাই বাংলা কবিতা, বা বিশ্বে যে কোনো ভাষার কবিতার বিবর্তনকে একরৈখিক, সদা অগ্রসরমান কোনো সরলরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভবপর নয় বোধহয় ! 

বাংলা কবিতায় আমার নিজের অবস্থান নিয়ে আমাকে নিজেকেই বলতে বলছ ? শুধু এটুকুই বলতে পারি, তা বলার মতো সময় এখনও তৈরি হয় নি । যে বিন্দুর কথা আমি আগে বললাম, যেখান  থেকে বিভিন্ন জলধারা উৎসারিত, আমি সে বিন্দুর মধ্যেই কোথাও একটা রয়েছি, নিজস্ব একটি পথ খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি, এটুকুই বলতে পারি ।     



কৌশিক:

খুব সুন্দর বলেছ স্বর্ণেন্দু। আরেকটা কথা বলে আমরা আপাতত শেষ করব। এই যে এত কবি। কেউ কেউ মুখ্য, আর সকলেই ত আমরা গৌণ।আবার এর মধ্যেই কেউ হয়ত ভবিষ্যতের মুখ হয়ে উঠবে। ইতিহাস অন্যদের মনে রাখবে না। সেই গৌণ আমাদের কী অবদান রয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায়? থাকছে কিছু? কী মনে হয় তোমার?



স্বর্ণেন্দু :

তোমার প্রশ্নের উত্তরে আসছি, তার আগে, একটু ঘুরে আসি । আমি একজনকে চিনি, যিনি এমন এক রাজনৈতিক দলের কর্মী, যে দলের প্রভাব একসময়ে থাকলেও, এখন তা অনেকটাই ম্লান । কিছু প্রাচীনস্বভাবী মানুষ নিজেদের বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে এই দলটি এখনও করেন আমাদের এই মফঃস্বল শহর এলাকায়, আমি লক্ষ্য করি, ইনি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন । দারিদ্র রয়েছে, নিজের একমাত্র মেধাবী সন্তানের চিকিৎসার জন্য সর্বস্ব খুইয়েছেন, তারপরেও তিনি নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের জায়গায় স্থির । একদিন সকালে দেখি, এই মানুষটি আরও সামান্য কয়েকজনের সঙ্গে, ক্ষমতাসীন সরকারের নানা অপকর্মের বিরোধিতায় একটি স্ট্রিটকর্নারে পরিবেশিত গণসংগীতে গলা মেলাচ্ছেন, যিনি মাত্র আগেরদিন সন্ধ্যায় অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত নিজের একমাত্র সন্তানকে দাহ করে ফিরেছেন শ্মশান থেকে ।

প্রশ্নটি আত্মজৈবনিক, কারণ ‘সকলেই তো আমরা গৌণ’, বা, ‘সেই গৌণ আমাদের কী অবদান—’ এই পর্যবেক্ষণ ও আত্মজিজ্ঞাসায় ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ শব্দদুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । আজীবন যে কাজটার জন্য আমরা নিজেদের উৎসর্গ করি, বা যে কাজটা নিয়ে থাকি, তার আদৌ কোনো তাৎপর্য থেকে যাচ্ছে কিনা, এমন একটি সংশয়, মনের অবচেতনে হলেও ক্রিয়াশীল থাকে । সন্তান যেমন জন্মদাতার পরিচয়কে বহন করে, এই কাজটির মধ্য দিয়ে আমি থেকে যাব কিনা, কাজটির প্রতি যেভাবে সততা ও আন্তরিকতা থাকে, এই সংশয়টিও সমভাবে ক্রিয়াশীল থাকে । এইটির মতো, যে কোনো আত্মজিজ্ঞাসার আশু সমাধানে পৌঁছে যাওয়া প্রায়শই একটু জটিল, কারণ নিজেকে নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে যা-কিছু ভাবনা আমাদের, সেগুলি বেশিরভাগ সময়ই সংশয়ে আচ্ছন্ন ! আর তখনই, আপন হতে বাহির হয়ে বাহিরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যদি সামান্যও একটু দিশা পাওয়া যায় !  

এই যে মানুষটির কথা বললাম আমি, তিনিও আসলে একজন গৌণ-মানুষ ! ইতিহাস লেখা হবে, এখনের রাজনীতি আগামীর ইতিহাস-পাঠকের পড়ার বিষয় হবে, তারপরেও এই মানুষটি কোনোদিনও ইতিহাস তো অনেক দূর, ইতিহাসের ফুটনোটেও উল্লেখিত হবেন না । এমন অনেক অসংখ্য গৌণ-মানুষ আবিশ্ব ছড়িয়ে রয়েছে । কিন্তু তা বলে, যে আদর্শ সততা আন্তরিকতা নিয়ে এই মানুষটি আজও বেঁচে থাকেন, নিঃস্বার্থভাবে আজও মানুষের কথা ভাবেন, পাশে দাঁড়ান, নিজের সীমিত ক্ষমতা ও পরিসরে এক-একটি আন্দোলন সংগঠিত করেন,  তার কোনো অবদানই কি থাকবে না ?  এই প্রশ্ন নিজেকে কর, এর একটি উত্তর পাবে, সেখান থেকে আবার নিজের প্রশ্নে ফিরে এস, উত্তরটাকে মিলিয়ে নাও ।

আসলে যে ইতিহাস রচিত হয়, সমাজ-রাজনীতি-সাহিত্য সবক্ষেত্রেই, তা মূলত ‘ঘটনা’-র ইতিহাস, ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে, কখনো ব্যক্তিকে কেন্দ্রে রেখে, অবদানের কথা আসে সেখানে । কিন্তু লিখিত হওয়া উচিত ছিল তো ‘অবদান’-এর ইতিহাস, তাই নয় কি ? অবদানকে কেন্দ্রে রেখে, ব্যক্তি বা ঘটনার কথা উঠে আসবে সেখানে ! এভাবে, অবদানের ইতিহাস লেখা হলে, ইতিহাস রচনার খোলনলচেই বদলে যাবে হয়তো ! তখন তথাকথিত ক্ষমতাশীল, বিখ্যাত, এমন অনেকেই বাদ চলে যাবেন, এবং এইসব গৌণ মানুষজনের অনেকেই সেখানে এসে সহজেই ঢুকে পড়বেন । পদ্ধতি যেখানে একপেশে, একরোখা, সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ, সেখান থেকে বড় কিছু আশা করা উচিত নয়, তা নিয়ে ভেবেও সময় নষ্ট করা উচিত নয় ।

কবিতা আমাদের সঙ্গে আছে বলে জীবনটা এখনও একঘেয়ে বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি বরং মূল্যায়িত হতে পেরেছে । এই লেখালিখির কারণে তবুও কিছু বড় মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি, বন্ধু পেয়েছি, বন্ধু হয়েছি, এটাই তো অনেক ।  


কৌশিক:

হ্যাঁ, স্বর্ণেন্দু। একদম তাইই। আমি আরেকটা কথা ভাবি, প্রকৃত অর্থে কবি, তথা সাধক, এক শতাব্দীতে অল্পই জন্মান। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ,  জীবনানন্দ, বিনয় এরকম যারা,  পথ প্রদর্শক। যারা একটা ভিন্ন মার্গ দেখান ভিন্ন ভিন্ন সময় কালে। বাকি রইলাম আমরা, যারা সেই সেতু বন্ধনের কাঠবেড়ালি। অল্প সাধ্য অল্প শক্তি নিয়ে বয়ে চলেছি বাংলা কবিতার ধুলো।  যা কিন্তু কম নয়! আবার বেশিও নয়। কিন্তু বড্ড প্রাণের কাজ। একজন কৃত্তিবাস থেকে একজন মাইকেলের মাঝে রয়ে গেছে অসংখ্য গৌণ কবি।  তারাই ধারক, যারা না থাকলে, ভাষা প্রকৃত অর্থে মৃত্যুর দিকে যায়। খুব ভাল হল তোমার সঙ্গে কথা বলে। অনেক ভালবাসা। ভাল থেকো। 


স্বর্ণেন্দু :

সত্যিই প্রাণের কাজ এটি আমাদের, খুব সুন্দর বললে তুমি । যাইহোক, কথায় কথায় অনেক বিষয় উঠে এল, ভাবলাম সেগুলি নিয়ে, তুমি ভাবনাগুলি উস্কে দিলে, আমারো ভালো লাগল কৌশিকদা । তুমিও ভালো থেক, ভালোবাসা ।