বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

কালের কল্লোলের সাক্ষাৎকার

 কালের কল্লোলের সাক্ষাৎকার




(পূর্ব মেদিনীপুর থেকে প্রকাশিত 'কালের কল্লোল' নামে একটি পত্রিকাতে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল গতবছর। সম্পূর্ণ কথোপকথনটি ই-মেলে সংঘটিত হয়। কথা হয়েছিল পত্রিকার প্রতিনিধি অনিমেষ সাউ-এর সঙ্গে। অনিমেষকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানাই)



অনিমেষঃ 

 মাধবী কে ? কবিতা থেকে গল্পে তাঁর যাতায়াত কেমন প্রশ্রয় পায় আপনার কাছে।

কৌশিকঃ

* তুমি বোধয় 'মাধবী বাগান'এর কথা বলছ। 'মাধবী' শব্দটি কবিতায় আর গল্পে একেবারেই আলাদা ভাবে এসছে। গল্পে 'মাধবী বাগান' নামগল্পটি পড়লেই বোঝা যাবে,  এটা আমার ছোটবেলা।  একেবারেই আমার ছোটবেলার সেই ঘরের বর্ণনা, যেখানে সদর দরজার উপরে মাটির পাঁচিলের মাথায় ছিল সেই বিশাল মাধবীলতার ঝাড়। এ খুব বলার মতো কোনো বিরাট ব্যাপার কিছুই নয়। অনেকের বাড়িতেই থাকে, আছে। কিন্তু কারো কারো শৈশবের কিছু চিহ্ন আজীবন মনে থেকে যায়, যা ছেড়ে যায় না। আমার হল এই সেই মাধবী বাগান। আর কবি কবি লোকেরা কেমন হয় জানোতো নিশ্চয়, নিজের মাটির ঢেলাটিকেও এত্তটা গ্লোরিফাই করে সোনার মতো বাড়িয়ে বলে। তো এ হল সেই বাড়িয়ে বলা। 

কবিতায় মাধবী আছে? আচ্ছা মাধবী ফুল আছে বোধহয়। ওটা কিছু না, ওটা ওই ফুল তারা চাঁদ নিয়ে বাঙালির কবিতা আরকি।


অনিমেষঃ 

 "বকুল ডালের আঙ্গুল" কাব্যগ্রন্থের  দুটো লাইন এরকম-

"এই সেই অনামিকা, কাঠের আঙুল। / গতজন্মে বকুলের শীর্ণ শাখা ছিল।"

আপনার কবিতায় পুনর্জন্ম গত ভাবনার উৎস অভিমুখ ঠিক কীরকম। 

কৌশিকঃ

* দেখো, আলাদা ভাবে কবিতায় তো কিছু নয়, পূর্বজন্ম বা পুনর্জন্ম একটা মিথ। আমাদের রামায়ণ, মহাভারত আদি পুরাণগুলিতে,  এছাড়া নানা গল্পে মানুষ এই ধারণাটি লালন করে এসছে বহুকাল যাবৎ। পরবর্তীতে  আধুনিক শিক্ষার ধারণায় পূর্বজন্ম স্বীকার করা হয় না। আধুনিক কালে শুধু কেন, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও বলা হচ্ছে এই দেহ পঞ্চভূতের সমাহার। যা মৃত্যুর পর সেই পঞ্চভূতেই বিলীন হয়।    কথা সেটা নয়, কথা হল আমরা,  এই জীবিত  মানুষ, সেই বিলীন হয়ে যাওয়া কতটা মেনে নিতে পারি? অনেকাংশেই পারিনা। এই না-পারা থেকেই রয়েছে আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা। প্রিয়জনের মৃত্যু সহনীয় হয়ে ওঠে এই অবিনশ্বরতার ভেতর দিয়ে। মানুষ নিজের না-থাকাটুকুও সেই পূর্বজন্মের দিকে ঠেলে দিয়ে শান্তি পেতে চায়। এই ভালবাসার সংসারকে সে  ইনফিনিটির দিকে নিয়ে যায়। তাই নিয়েই কাব্য কবিতা উপকথার জন্ম হয়ে আসছে যুগে যুগে।  একদিকে বিশ্বাস করছি মৃত্যুর পর কিছু নেই, অন্যদিকে এই আমার না-থাকাকে মেনে নিতে না পেরে পুনর্জন্মের দিকে চালিত হই। এই ত নিয়তি।


অনিমেষঃ 

 আপনি ব্যবহারিক সময় ও আয়ুকে কবিতার কাল চিন্তার অনুষঙ্গে এনেছেন কখনো কখনো।  কিরকম ভাবে দেখেছেন তা আমরা কবিতায় পাই।  এই কালের গর্ভে ঢুকে যাওয়ার পথ আপনার কাছে ঠিক কিরকম। 

কৌশিকঃ

* কাল বা সময় জিনিসটা বেশ মজার মনে হয় জানো! পৃথিবীতে কাল মানে সকাল, বিকাল,  সন্ধ্যা, দিন,রাত্রি,  মাস, বছর, নানাভাবে তাকে ভাগ করা। আবার দিনকে প্রহরে ভাগ করেছিল মানুষ। দণ্ড,  পল, মুহূর্তে ভাগ করা হল।  আধুনিক সময়  আবার একই নিয়মে ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডে ভাগাভাগি। তো এ সবই আমাদের কাল যাপনের সুবিধার্থে। এ হল খণ্ডিত কাল। অথচ এই পৃথিবীর বাইরে যে মহাজগৎ সেখানে এর কানাকড়ি  দাম নাই। কোনো কাজ নাই তার। সেখানে এক মহা গম্ভীর বিরাজ করছে। যাকে মহাকাল ছাড়া আর কিছু দিয়ে কল্পনা করা যায় না। আবার এই মহাকাল, বা মহাজাগতিক সময় আমাদের এই দিন আনি দিন খাই জীবনে এসে মিশে যায় কখনো কখনো, যখন হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলা আকাশে তাকাই। দেখি,  অসংখ্য নক্ষত্র আলোকবর্ষ দূর থেকে আলো নিয়ে এসে পড়ছে রোজ রাত্রে আমাদের পৃথিবীতে । যার অনেকগুলিই হয়ত নেই। নিভে গেছে বহুকাল আগে। তবু তার ছেড়ে যাওয়া আলো আরো অনেকদিন ধরে পৃথিবীতে এসে পড়বে। এ এক পরম আশ্চর্য আমার কাছে,  যেন  চাক্ষুষ টাইম মেশিন! যা নেই তাকে প্রত্যক্ষ করছি। হাজার বছর    আগের আলো এই চর্মচোক্ষে তাকিয়ে দেখছি। কাল, দেশ ভেঙ্গে যাচ্ছে। এগুলো আমার মতো একজন অতি সাধারণ লোক যখন ভাবে, এইসব দেখে, তখন ভ্যাবাচেকা মেরে যাই।   এসব লিখে রাখার ক্ষমতা তো নেই। আমরা আমাদের সামান্য আয়ু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তো সেটুকুই হয়ত কোনো কবিতায় তোমার চোখে পড়েছে কোথাও।


অনিমেষঃ 

জাতিস্মর আমাদের কাছে একটা মিথ। জাতিস্মর বিষয়টি আপনার কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে। যেমন "বকুল ডালের আঙ্গুল" কাব্যগ্রন্থের তিন নম্বর কবিতায় লিখছেন "আমার জাতিস্মর দিন জেগে ওঠে"। আপনার কাছে এটা কতটা সত্যি। 

* দেখো, ওই লাইনটার কথা ছেড়ে দাও। কবিতায় তো কত কি এসে যায়, কীভাবে, তা কেউ জানেনা। তো এই মিথও কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে করি। যদিও অনেক 'সত্য ঘটনা' রূপী গল্প রয়েছে।  তা কতদূর সত্যি জানিনা। আবার বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে! এটাই রহস্য! এই যে কল্পনা, এর মধ্যে একটা কবিতার মতো রহস্য রয়েছে। আগে পুনর্জন্ম বিষয়ে যে কথাগুলি বললাম, এখানে তার চুড়ান্ত রূপ যেন। শুধু পুনর্জন্মের ভেতর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই নয়, বরং আরো একধাপ এগিয়ে তার কল্পনা গতজন্মের স্মৃতিকেও জুড়ে দিল।  তার পূর্ব স্মৃতি, পূর্ব নাম, ঠিকানা,  সংসার সমস্ত মিলে এক জটিল রহস্য তৈরি হল কথাকারদের কলমে। 

এসব তো ব্যক্তিগত কিছু নয়, তাই আমার কাছে কতটা সত্য বা মিথ্যা তা বিষয়ই নয়। বরং বলতে পারো সেই অলীক সত্যটিকে ধরে নিয়ে একটা ইমেজারি রচনার চালাকি মাত্র এই কবিতা।


অনিমেষঃ 

আপনার  অনেক কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব স্পষ্ট । তবুও তার একটা বাহিরানা আছে । আপনি কি মনে করেন , কবিতা আপনার কাছে আত্মজীবনী হয়ে উঠছে? 

কৌশিক

* তুমি যে অর্থে আত্মজীবনী বলছ, সে অর্থে, আমার মনে হয়,  প্রত্যেক কবিতাই কবির আত্মজীবনীর অংশ। প্রতিটি ছবিই শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। তাছাড়া আলাদা করে জীবন থেকে খুলে নিয়ে কোনো আর্টফর্ম তো হয় না। একেবারেই হয় না নয়, হয়। সেই জীবন বর্জিত সৌখিন আর্ট কেন হয় আমি জানিনা। আসলে  সবটাই  প্রচণ্ড সম্পর্কিত, পরস্পরের সাথে, জীবনের সাথে। যদি সেটা না হয়, তাহলে কোথাও ত্রুটি রয়ে গেছে ধরতে হবে।   হ্যাঁ, তোমার প্রশ্নের সূত্র ধরে বলি, আমি ডায়েরির মতো করে লেখা বাড়ির কথাও দু'একটা ক্ষেত্রে কবিতা হিসেবে বইয়ে তুলে দিইছি কখনো । বাবার কথা আছে একটা লেখায়--'আমার বাবা বরাবর চা-দোকানী, মাঝে একবার মুদিখাখানার দোকান দিয়েছিল...' এটা একেবারেই ডায়েরির মতো গদ্যে লেখা। তুমি যাকে বলছ 'আত্মজীবনী হয়ে ওঠা'।  তাই হয়ত।   


অনিমেষঃ 

আপনার কবিতা লেখার বয়স প্রায় 25 বছর হতে চলল। সাহিত্য চর্চায় মফস্বল তুলনামূলক সংকীর্ণ জায়গা। বিশেষতঃ সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। আপনার অবস্থান সেখানে ঠিক কিরকম  উপলব্ধি করেন। 

কৌশিকঃ

* এই ধারণাটি কি স্বতসিদ্ধ?   মানে ঠিক কোন পথে এই সিদ্ধান্তে এসে পড়া গেল?  তাহলে কি সাহিত্যের প্রশস্ত জায়গা বড় শহরগুলিই? সেখানে উদাসীনতার বিপরীতে সকলেই খুব সাহিত্য সচেতন?  এই দেখো, কথাটি উল্টে নিতেই দেখা গেল ধারণাটি স্বতসিদ্ধ ত নয়ই বরং বেশ গোলমেলে। এবার বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি বইয়ের নাম দেখা যাক। 

১. তিতাস একটি নদীর নাম (লেখক তিতাস পারের গণ্ডগ্রামের মানুষ।  লিখছেন সেখানকার মালো সম্প্রদায়ের মানুষের কথা)

২. ঢোঁড়াই চরিত মানস (পটভুমি বিহারের, মফস্বল, সেই নিম্নবর্গের মানুষের কথা। 

৩. আরণ্যক, ৪. পথের পাঁচালী, ৫. এবং সর্বশেষ যদি দেখি,  তিস্তা পারের বৃত্তান্ত। লেখক পরে কলকাতাবাসী,  কিন্তু লিখছেন তার ফেলে আসা জীবন, সেই মফস্বল। যে স্মৃতি তাকে আজীবন ছেড়ে যাচ্ছে না। 

যাইহোক। ধারণাটি স্বতসিদ্ধ নয় এটুকুই বলার। আর সাহিত্য শিল্প যাই বলো, সেটার জন্য নিজের জীবনটুকু দরকার হয় শুধু, যা আরো আরো জীবনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।  একটা আস্ত জীবন, তার  আনন্দ, হাসি, কান্না, বেদনা, আর অল্প অবসর--ব্যাস। 


অনিমেষঃ 

অর্থাৎ আপনার ক্ষেত্রে এই ধারণার কোন প্রভাব নেই বা পড়ে না । 

কৌশিকঃ

* না। একেবারেই না। শুধু আমার ক্ষেত্রে বলি কেন, আমি মনে করি কারো ক্ষেত্রেই পড়ার কথা নয়। এটি কোনো বিষয়ই নয়।


#  ব্যক্তি মানুষের মুখের ভাষা, আর কবিতার ভাষা। এই দুটি ভাষার মধ্যকার ব্যবধান বা দূরত্ব ঠিক কী রকম বলে আপনার মনে হয়। 


এটা নিয়ে আমার কিছু বলতে যাওয়া মূর্খামি হতে পারে। গুণীজনেরা অনেকেই এই বিষয়ে অনেক কথা বলে গেছেন। এখন বলা হচ্ছে মানুষ তার জন্মভাষার মধ্যে দিয়েই ভাবনার জগতে প্রবেশ করে। এটা একটা আজন্ম অভ্যেস।   তবু, আমি মনে করি  আমাদের ভাবনার  কোনো ভাষা নেই। ভাবনা মূলত এক অলৌকিক ভিস্যুয়াল।  তার ধ্বনি ও রঙ নিয়ে  সে এক বোবা জগত। বোবা, অথচ মুখরিত।  মূক মানুষের যেমন অগাধ কথা সারাজীবন চাপা থেকে যায়, সে সব কথা কোনোদিন আর তার বলা হয়ে ওঠে না, এও খানিক তেমন।  তবু ভাবনার ভাষাহীন যে ভ্যিসুয়াল তাকে লিপিতে রাখতে গিয়ে বারবার হতাশ হতে হতে তার সবচে কাছাকাছি পৌঁছনোর নামই হয়ত নির্মাণ। 

   একদিকে এই হতাশা মূলত ভাবনার অবাধ অসীমত্ব আর অন্যদিকে ভাষার অল্পপরিসরের সীমার চিরকালীন  দ্বন্দ। যেখানে ভাবনাকে কেটে ছেঁটে অনন্যোপায় আঁটিয়ে নিতে হবে।  

এইটুকু বলে কি কিছু বোঝানো গেল?


# সমসাময়িক বেশকিছু বাংলা কবিতায় বা আমাদের পূর্বের কিছুটা সময়ে, বাংলা কবিতা র কিছু ক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতার অভিযোগে দুষ্ট। সে ক্ষেত্রে কি ভাষার ব্যবধান কাজ করে না? 

* এও ওই একই কথা। আসলে ভাবের ব্যাবধান। প্রতিটি মানুষের ভাবনা জগৎ আলাদা। মূলত একজনের ভাবনা-জগৎ গড়ে ওঠে তার বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিক, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা,  আর প্রকৃতির উপর। একজনের ভাবনা জগৎ যখন আমার ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় তখন আমি তার সঙ্গে সেই ভাবে রিলেট করতে থাকি। যখন মেলে না, তখন আরেক ভাবে। তবে কবিতায় দুর্বোধ্যতা দুরকমই  হয় বলে মনে হয়, ভাষাগত আর ভাবগত। ধরা যাক শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। তার কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ রয়েছে। কেন? 

   'একজন মানুষ তথা কবির ভাবনা জগৎ কীপ্রকার জটিল আবর্তের খনি তা সেখানে তলিয়ে যাবার আগে বোঝার উপায় নেই।    তা কখনো ধরার বা বোঝার ঘটনা থাকে না আর, যতক্ষণ না সেই ভাবনাগুলি ভাষায় অনুবাদের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাষায় অনুদিত মহৎ কবিতাগুলি  হয়ত বোঝা যেতে পারে।  শম্ভু রক্ষিত কোনোদিন সেই চেষ্টার ধারেপাশে না গিয়ে উল্টোদিকে গেলেন। তিনি তার ভাবনাগুলি ভাষার সীমার প্রান্তে রেখে ছেপে দিলেন। তিনি ভাবনাকে কেটে ছেঁটে ভাষায় আঁটানোর চেষ্টা না করে এক অন্যপ্রকার ভাষা নির্মান করলেন। যা আমাদের পরিচিত ভাষাগণ্ডির বাইরে এক অদ্ভুত    জগত। যা আমরা ধরতে পারি না। বাংলা কবিতায় দেশি বিদেশি ইং ফার্সি হিন্দি মাগধী পালি সহ এমন সব শব্দ বসালেন যা ভাষাভূমিকে বন্ধুর প্রান্তর করে পাঠককে একা ছেড়ে দিলেন। আমার খুব সন্দেহ হয় ! না সন্দেহ নয়,  এ সত্যিই, শম্ভু রক্ষিতের কবিতায় এমন প্রচুর শব্দ আছে যা এই পৃথিবীর নয়।  তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই শব্দ অন্য কোনো জগতের'

শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লেখা একটা গদ্যের অংশ তুলে দিলাম। যাতে বিষয়টা বোঝা যায়। 


# আপনার কি মনে হয় না , শম্ভু রক্ষিত উপেক্ষিত মূলত দুর্বোধ্যতার কারণে?

*  দেখো, আমি যেটা মনে করি, যদিও তা-ই সঠিক বলে দাবী করার কোনো মানে হয় না, সেটা হল,  এই যে আমাদের সমস্ত কিছুকে বুঝে নিতে চাওয়ার আকুতি, সেটা তো সবসময় সম্ভব হয় না। কারণ আমাদের বোধ্য জগতের বাইরেও একটা, অথবা একাধিক, জগত রয়েছে। কেউ কেউ সেই  আপাত দুর্গম জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন হয়ত। সকলে তা পারেন না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সেই বহু যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে দু'দল মানুষের ঝগড়া। তো    আমরা সেই ঈশ্বরকেও 'মূর্তি' বানিয়ে ছাড়া পূজা করতে পারিনা। অথচ ভাব-জগত বিমূর্ত।    'মূর্ত ভাবনা' বলে কিছু হয় না। ভাবনা মাত্রই বিমূর্ত । আর যেহেতু শিল্প মাত্রই ,সে যে কোনো মাধ্যমই হোকনা, তা মানুষের ভাবনারই বহি:প্রকাশ যেহেতু, সেহেতু শিল্প 'বিমূর্ত' হতে বাধ্য ।কোনো একেমেবদ্বিতীয়ম ধ্রুব অর্থ তার হতে পারেনা কখনো ।অথচ আমরা যা ভাবি, তাকে 'মূর্ত' বলেই ভাবি ! এ আমাদের আজীবন লালিত অভ্যাসের সংস্কার বা সংকট মাত্র। আমরা বাঙালীরা যা ভাবি, 'বাঙলাতেই' ভাবি ! অথচ 'ভাষা' সেও এক বিমূর্ত প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়।  ওই যে, জীবনানন্দ বলেছেন না-  'কোনো এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে', তাকে ভাষায় প্রকাশ করা,সম্পূর্ণত, এতই সহজ নয় !জৈবিক প্রয়োজনের কথা গুলি আমরা যে ভাষায় প্রকাশ করি , সেই একই ভাষায় হৃদয়ের গভীর ভাবটি প্রকাশ কখনোই সম্ভব যে নয় তা আমরা জেনেছি, আর জেনেছি বলেই, ভাষাকে করে তুলেছি তীক্ষ্ণধার সূক্ষ্ণ, তবু ততখানি সূক্ষ্ণ  বোধহয় আজো সম্ভব হয়নি,যা হলে ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। তাই ভাব ্প্রকাশের নিত্য নতুন ভাষা আজো প্রকাশিত হয়ে চলেছে --- 

কবি শম্ভু রক্ষিত হয়ত তেমনই একজন কবি। যিনি সেই নতুনতর কাব্যভাষা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তার লেখায়। যেকারণে আমাদের প্রচলিত কাব্যভাষায় অভ্যস্ত মন তাকে দুর্বোধ্য ঠাউরেছি।   এ চেষ্টা অনেকেই করেছেন,  করছেন, কখনো শিল্পীর হাতে পড়ে তা কবিতা হয়ে উঠছে,  কখনো বে-হাতে পড়ে শুধুই কায়দা হয়ে থেকে যাচ্ছে। 


# বিশেষত ষাটের দশকের পর থেকে কবিতাকে দশক ধরে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। নব্বইয়ের পরে এই  ধারণা আরও প্রকট হয়েছে। কবিতার পর্যায়ক্রমিক বিভাজনে  এই দশক ভিত্তিক চিন্তাভাবনা  আপনার মনে কতটা প্রশ্রয় পায়। 

* আসলে এটা নিয়েও এত বেশি কথা হয়েছে চারদিকে যে নতুন করে কিছুই বলার নেই। বরং কবির জন্ম সালটি জানলে কাজ হয় কিছুটা।  অর্থাৎ কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।  বাকি সব বাতুলতা। একটা দশকেই যদি কবির জীবৎকাল সীমাবদ্ধ হত তাহলে কিছু বলার ছিল না। তা তো নয়। যাকে সত্তরের  কবি বলা হচ্ছে তিনি কেন  সত্তরের? এর সঠিক উত্তর কিছু নেই।   নব্বইয়েও তিনি ছিলেন। এখনো তিনি লিখছেন।  সম্পূর্ণ জীবৎকালটিই তিনি ধরে রাখছেন তার কাজের মধ্যে। কবির উত্থানের সময়টিই যদি তার নিজস্ব দশক ধরা হয় তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। আজীবন কবি কি সেই দশকটিতেই বন্দী রইলেন? এটা নিয়ে আর ভাবিনা। 


# আপনার মনে হয় না এই দশক ধরে চিন্তাভাবনা আসলে দুর্বল কবিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটা প্রয়াস। 

* 'দুর্বল কবি' বলে কিছু হয় না। হয় ''কবি' নয়ত 'কবি নয়'। কবি মানেই যে সে তাড়া তাড়া কবিতা লিখবে,  তাও নয়। কবি একটা বিশেষ ভাবের মানুষ আরকি। হয়ত সে ভ্যান রিক্সা চালায়, অথবা সফটওয়্যার বানায়, কিম্বা বেশ্যা, যে কেউ,  যাদের মাথার ভেতরে  এক অলীক জগত রয়েছে। 

যাইহোক,  তোমার প্রশ্ন অনুযায়ী বল্লে, বলতে হয়,   আমি এই বিষয়টি ভেবে দেখিনি, মানে,  কেউ টিকে থাকার জন্য চালু করেছে কিনা। আমার মনে হয়,  যারা বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে একাদেমিক গবেষণা করেন এটা তাদের হাত ধরেই এসছে সম্ভবত। বিষয়টি তাদেরই কাজের জায়গা।   ও নিয়ে কবিদের না ভাবলেও চলে।  



# আপনার কবিতার ঋতুবদল ঠিক বলব না, অনেকটা পরিবর্তন এসেছে "মাধুরীর সঙ্গে কেউ নেই" কাব্যগ্রন্থের। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা। এই পরিবর্তনের পেছনের গল্পটা ঠিক কি রকম। 

* নিজের লেখালিখি নিয়ে আমার খুব ভাবনাচিন্তা নেই। এই অতি আবাল লেখালিখি নিয়ে বলতেও সংকোচ লাগে। কি বলি বলতো? ঋতুপরিবর্তন সম্পর্কে যেটুকু বলার তা হল পৃথিবী ঘুরছে, উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ণ ঘটছে আর ঋতু পাল্টে যাচ্ছে। সেম কেস। একেকটা ফেজ পাল্টে যায় তো সময়ের সঙ্গে,  মানুষের ভাবনা চিন্তার গতিও পাল্টায়। সেই পরিবর্তনের প্রভাব তার কাজের মধ্যে পড়ে।  এটুকুই। সেই হিসেবে জীবনের বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তন থাকারই কথা। এক সরলরেখায় চলবে না এটাই স্বাভাবিক।       এই বইটা সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় এটা একজন নারীর বয়ান। যে বলছে সে পুরুষ নয়।



# আচ্ছা, আপনার প্রথম কলকাতা আসা -

* হ্যাঁ,  তখন খুব ছোট,  পাঠশালের ছাত্র। আমার অনুপুঙ্খ মনে আছে সেসব কথা। কিন্তু তার আগে আমার বিনীত এবং বিস্মিত প্রশ্ন-- কেন? মানে কেন এই প্রশ্ন? অথবা কেন বিশ্বের সবচে বড় ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন নয়? যা আমি দেখিনি।  কেন  উত্তরের বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, যার সামনে দাঁড়ালে  মানুষ নত হয়,  উদার হয়ে যায় শুনেছি ।  কেন গৌড় নয়? কেন মেদনীপুর নয়,  পুরুলিয়ার টাঁড় প্রকৃতি নয়? কেন এমন কি শান্তিনিকেতনও নয়? কেন কলকাতা ভ্রমণের কথা?  অবশ্য কলকাতাও এক্টা ঐতিহাসিক  স্থান, অন্তত বৃটিশ শাসনের যুগের তিনশ বছরের ইতিহাসের একটা বিশাল অংশ এখানে ছড়িয়ে আছে। যা আমি সব জানিনা। আর কলকাতা গেলে আমি যেখানে বারবার যাই সেটা ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম। সেই কেলাস ফোরে প্রথম দেখি। এত বড় মিউজিয়াম    তারপর আর কোথাও দেখিনি।    যাইহোক, এই প্রশ্নটির সঠিক অর্থ হয়ত আমি বুঝিনি। 


# আর college street 

* কেলাস ফোরের প্রথম স্মৃতিতে কলেজ স্ট্রিট নাই। সত্যি বলতে জীবনে দুবার পাতিরাম আর তিনবার ধ্যানবিন্দু গেছি। কলেজস্ট্রিট বলতে আমার এটুকুই অভিজ্ঞতা। আর আমি একেবারেই পড়ুয়া নই। বরাবর ফেল করা ছাত্র। সেই কেলাস ফোরেও পড়তাম না। আর এখনও তোমার সাক্ষাৎকারে ফেল করছি।  


# মফস্বলের জীবন আপনার কাছে কতটা প্রাধান্য পায়.. আর তা কিভাবে আপনার কবিতায় ঢুকে পড়ে। 

* ওই যে একটা প্রশ্ন ছিল, কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব...। তো সেখানেই বলা হয়ে গেছে, প্রত্যেকেই যা কিছু কাজ করে তা তার জীবনের থেকে আলাদা কিছু নয়। খুলে দেখানো যায় না। এই প্রশ্নটিও  প্রায় একই। আমার জন্ম বেড়ে ওঠা সবই বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর নামের এই শহরটিতে। এর চারপাশের ল্যাটেরাইট মাটি। শাল মহুয়ার জঙ্গল,  যা বর্তমানে ফাঁকা হয়ে ইউক্যালিপটাসের প্ল্যান্টেশন,    মল্ল রাজাদের প্রাচীন সব মন্দির, আরো আরো পুরো একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর জৈন  মন্দিরগুলি দ্বারকেশ্বরের তীরে, এই সমস্ত ভাঙা ইতিহাস,  ভাঙা বর্তমান হয়ত আমার ভেতরে ঢুকে গেছে জন্মসূত্রেই। একে ত আলাদা করা যায় না কোনো ভাবেই। একই ভাবে যিনি কোনো বড় শহরে জন্মেছেন, বাস করেন, তার ভেতরে জন্মসূত্রেই নাগরিকতা বেড়ে ওঠে,  তার কাজের ভেতরেও সেই প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। আবার এসব ছাড়িয়ে  চিন্তার একটা কমন স্পেস গড়ে ওঠে, যেখানে সমস্ত বাংলা এক।  কলকাতা, বাঁকুড়া, আসাম, ত্রিপুরা, ঢাকা, চাঁটগাঁ যেখানে একসঙ্গে শ্বাস নিতে পারে-- এর একটা সামগ্রিক ইতিহাস রয়েছে, ভাষা রয়েছে, আচার অনুষ্ঠান  রয়েছে যা এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে বেঁধে রাখে। একই সঙ্গে প্রত্যেকেই আলাদা এবং এক।  আমিও তাই।



# আপনার প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন।

* কে প্রতিষ্ঠানের বাইরে? আমি! না তো।  সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র এই তিন প্রতিষ্ঠান আমাদের যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তার বাইরে যাবার সামর্থ কই। আমাদের যা কিছু করার এর মধ্যে থেকেই করতে হয়। নিজের মতামত, নিজের ভাবনা সেও কি আমার একান্ত?  নাকি  সংসার, সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে সেসব? রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব? এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে আমি আমার কথাটুকু কতটা বলতে পারছি? গিলে ফেলতে বাধ্যই বা হচ্ছি কতটা। তার চেও বড় কথা আমি যা ভাবছি,  তা আমারই ভাবনা কিনা। এই ভাবনা কেউ ভেবে রেখেছিল আগেই,  আমি শুধুই তাতে লিপ দিচ্ছি না তো?   আমি যা ভালো বা মন্দ বলছি তা কতটা আমার নিজস্ব? নাকি এই অনুভবও নিয়ন্ত্রিত। এগুলো যখন ভাবি তখন বুঝতে পারি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ভাবনা   বলেও কিছু নেই। সমস্তই এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে বেরোতে পারিনি।  


# আপনার  লেখায় কি রাষ্ট্রীয় রাজনীতি প্রভাব ফেলে? 

* আমি দু চার লাইন লিখে ফেলেছি বলে আমাকে এই প্রশ্নটা করা গেল। এবার ধর,  যে লেখেনা? আঁকে না, গান করে না,  শুধু টিকে থাকে,  কাজ করে, ঘুমোয় আর সংসার প্রতিপালন করে,  মানে এই ঢপের কবি বাজারের বাইরে যারা, তাদের কাছে প্রশ্নটা কীভাবে রাখা যায় ভাবছি। 

...

রাষ্ট্র নামে প্রতিষ্ঠানের থাবার বিষয়টি হয়ত আমি আগের প্রশ্নের উত্তরে বোঝাতে পারিনি।  ঘটনা হল আমি যে চাল কিনি, ভাত খাই, তার দাম রাষ্ট্র বেঁধে দেয়, আমি পাঠশাল থেকে ইস্কুল কলেজে যে বই পড়েছি তা রাষ্ট্র বেঁধে দিয়েছিল। আমি কোন পথে হাঁটব আর কোন পথে হাঁটব না তা তখনই ঠিক হয়ে গেছে। 

এইবার আমি ভাত খেয়ে প্রেমের কবিতা লিখতে বসি, মৃত্যু বিষয়ক ঔদাসীন্য লিখি, মহাকাল লিখি-- তা সেখানে রাষ্ট্রের প্রভাব আছে কিনা ভেবে দেখিনি। 


# সমসাময়িক কবিতায় প্রচুর ভাঙচুর হচ্ছে। হয়েছেও। সমসাময়িক কবিতার সঙ্গে আপনার পরিচয় কেমন। 

* অপরূপ ভাবে ভাঙা গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো-সখনো-- এরকম একটা কথা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন না?   

সে যাইহোক। হঠাৎ করে কিছু ভাঙা যায় বলে আমার মনে হয় না। সমস্ত ভাঙনেরই একটা ইতিহাস থাকে। একটা নির্দিষ্ট পথ থাকে আড়ালে। এটা আমার বিশ্বাস। সেই ভাঙন সমসময়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করা খুব কঠিন।। যেমন একজন মানুষের জীবনে ভাঙচুর আসে, তার ছাপ পড়ে তার মুখে,  চেহারায়, তুমি হয়ত অনেকদিন পর তাকে দেখলে হঠাৎ রাস্তায়। সেই চেহারা আমূল বদলে গেছে। দেখে চমকে উঠলে। অথচ দেখো, তার কাছের মানুষেরা সেই তিল তিল চেহারার বদল  টেরই পেলোনা। তো সেটা দুদিনে হয়নি। আর ভাষার বদল হল আরো দীর্ঘ একটা প্রসেস। প্রজন্ম পেরিয়ে যায়।  তাই সমসাময়িক কবিতায় হঠাৎ করে খুব ভাঙচুর হচ্ছে এমনটা মনে করি  না। জোর করে ভেঙে ফেলতে চাইলে এ্যাবনর্মাল কিছু একটা হবে। হয়েছেও সেসব।   সেইসব কায়দার ব্যাপার মূল ভাষাপথে থাকে না,  পরে তা সরে যায়। 

আর মোদ্দা কথা হল ভাষা আলাদা একা কোনো বিষয় নয়,  তার কাজ তো ভাবকে ধারণ করা। আগেও এ নিয়ে কথা হল। তাই যেটা বলার তা হল,  ভাব বা কনসেপ্টস যখন ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়ায়, সে তখন তার মতো ভাষার খাপ বানিয়ে নেয়। কনসেপ্টস ছাড়া ভাষা ভাঙার খেলা ওই সুদোকু খেলা মাত্র। সমসাময়িক লেখার ক্ষেত্রে দুটোই আছে।   থাকার কথা আরকি।


#  মূলত আপনি একজন কবি, তো আমার প্রশ্ন, একজন কবির কতটা দায় থাকে , তার কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। 

* এইটা বেশ কঠিন প্রশ্ন। কবির আদৌ দায় থাকে কিনা তার লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁচানোর তা তো ভেবে দেখিনি কখনো। কিন্তু কবিরা খুব উৎসাহের সঙ্গে তার লেখাটি পাঠকের গোচরে আনতে উদগ্রীব, এটাই দেখে আসছি। সেটা তার দায় থেকে নাকি খ্যাতি যশের আকাঙখা থেকে সেটা কে জানে! আমরা যখন লেখালিখি শুরু করি, সেটা ৯৪/৯৫ সাল নাগাদ, তখন একটা খুব ঊচ্ছাস ছিল লেখাটি প্রকাশের। দায় নয়, বরং নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখার লোভ। কালে কালে আর নিজের নাম দেখে সেই ঢেউ জাগে না। সে যাইহোক, তখন প্রকাশ মাধ্যম এত সহজ ছিল না। এখন সামাজিক মাধ্যমে যে কেউ সদ্যজাত লেখা কয়েক হাজার পাঠকের সামনে রেখে দিচ্ছে। সরাসরি    পাঠক-যোগ ঘটছে। এ পরিবর্তিত সময়। কিন্তু সেও কি দায় থেকে? না বোধয়। আর কবিতার প্রত্যক্ষ সামাজিক দায়  কতটা, সে বিষয়েও আমার কোনো ধারণা নেই। তবু এইসব লেখাগুলি,(আমার লেখার কথা বলছি না শুধু) সৎ লেখাগুলি, সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে। (সৎ বা অসৎ সমকালে বোঝা দুষ্কর) যা দলিল হিসেবে ভবিষ্যৎ বুঝে নেবে রাখবে নাকি ফেলে দেবে। তাই বন্ধুবান্ধব দু-পাঁচ জনের হাতে সেই লেখা ছড়িয়ে রেখে দেওয়া ভাল।   এই আরকি।


#  মুদ্রিত পত্রিকার পাশাপাশি virtual magazine গুলো বাংলা সাহিত্যে ধিরে ধিরে প্রাধান্য রাখতে শুরু করেছে। lockdown এর পর এই virtual magazine আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আপনার কাছে মূদ্রিত পত্রিকা ও virtual magazine কিরকম প্রাধান্য পায়। 

* পড়ার ক্ষেত্রে কিছুদিন আগেও ওয়েব ম্যাগাজিনগুলোতে অসুবিধা হত। মন বসতো না পুরনো অভ্যাসের জন্য। এখন ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসই তো ব্যাপার, আর কিছু না।  এখন বহুদিন কোনো ছাপা পত্রিকা আসেও না বিশেষ। আসে না মানে, ধর আমাদের সেই প্রথম লেখালিখির যুগে, তখন চিঠিপত্রের যুগ। রোজ এক তাড়া চিঠি আর পত্রিকা আসতো ঘরে,  পিওন চেনা হয়ে যেত। চেনা বন্ধুর পত্রিকা,  অচেনা পত্রিকা। মোবাইলফোন বলে কিছু নেই। হলুদ ডুমবাতির যুগ। এখন সেটা বদলে গেছে। রোজ কিছু না কিছু লিংক আসে।  ওয়েব ম্যাগাজিনের। ব্যাপারটা এই রকম আরকি। 

তবে কি জানো! ছাপা বই পত্রিকা ছুঁয়ে হাতে নিয়ে একটা স্পর্শ সুখ হয়। কোনো কোনো বই বা পত্রিকার প্রতি ধীরে একটা মায়া তৈরি হয়। পুরনো হয়। হলদেটে হয়ে যায়। তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে খুলে দেখি। দেখি ১৯৯৮ সাল। কবিতায় কোনো এক বন্ধুর নাম। যে মারা গেছে বহুদিন। আবার মলাট উল্টে রেখে দিই তাকে। বন্ধুকে। এই মায়া,  এই স্পর্শ, ওয়েবে নেই। 


# আজকের তরুণ কবিদের স্বাধীনতা ও কবিতার স্থায়িত্ব নিয়ে আপনার মতামত ঠিক কিরকম। 


* তরুণের স্বাধীনতা মানে কী? একটু বুঝিয়ে বল প্রশ্নটা?



# বাংলা কবিতার জগতে কী কাব্য অনুশাসন তৈরি হয়? আপনার অভিজ্ঞতায় তা ঠিক কিরকম। 


* আমার অভিজ্ঞতা যদি বলতে হয় তাহলে বলব  এসব বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। কোনো বাঁধা ধরা পত্রিকায় কখনোই লিখিনি। প্রথম থেকেই যেহেতু স্বভাব কুঁড়ে তাই বড় মেজো লিটিল ম্যাগগুলোতেও কখনো পাঠানো হয়নি। দু একটা জায়গায় ডাক পেলে কখনো পাঠিয়েছি। মূলত বন্ধুবান্ধবদের পত্রিকায়। এখনো তাই। সুতরাং যা হয়েছে আপাত স্বাধীন মতেই হয়েছে। কোনো অনুশাসন ছিল না, অন্ত্যত আমার ক্ষেত্রে। 

এবার বাংলা কবিতার জগতে কাব্য অনুশাসন তৈরি হয় কিনা সেটা আলাদা ব্যাপার। এটা কেউ নিজে না চাইলে হয়না বোধহয়। সাধারণত বিখ্যাত কবিদের সঙ্গ লাভের মোহ, একটু নামডাকের ইচ্ছে, তা কার না আছে বল? তো এই থেকেই অনেক সময় নতুন যারা লিখতে আসে, কোনো     দাদা দিদির সঙ্গে ভিড়ে যায়।  অনেক ক্ষেত্রেই তার বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। একটা তীব্র  আত্মবোধ না থাকলে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বেরোনো মুশকিল। আর এটা না থাকলে নিজের কাজ করাও যায় না। 

সে যাইহোক, শেষ পর্যন্ত একা হয়ে যেতে না পারলে সম্ভবত কবিতাকে পাওয়া যায় না। একা হলেও যে পাওয়া যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।  তবে ভিড়ের ভেতর হয় না এটা নিশ্চিত। এর মানে কিন্তু এই নয় যে কবি কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন কেউ। সে তো সংসার, সমাজ, লেনদেন,  বাজারের দর দাম সমস্ত কিছুর মধ্যেই থাকতে হয়। আলাদা করে কবির ভিড়ে আর কেন যাওয়া।

ভালো থেকো অনিমেষ। শুভ হোক জগতের।


...

রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

 দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

কৌশিক বাজারী





   এই সময়, মূলত এক দর্শন 

-বিরহিত কাল। দর্শন বিরহিত সময় তার চিহ্নগুলি পরিস্ফুট করে চলেছে দশকের পরদশক জুড়ে। গানে, গল্পে, কবিতায়, আচারে, বিচারে এক অসুর-দর্শন। অসুর যেহেতু সর্বদা ছদ্মবেশী, যেহেতু তার মোহময়ী রূপ আমাদের আত্ম-বিমোহিত করে রাখে সর্বদা, আমরা ভুলে যাই তার প্রকৃত স্বরূপ। তার ভিতরের শয়তান নীরবে আমাদের অন্তরাত্মা গ্রাস করে চলে। তার ছলা কলায় আমরা বিমোহিত হয়ে পড়ি আর শয়তান সেই সুযোগে আমাদের নিদ্রিত স্বপ্নেরভিতরে হানা দেয়। আত্মার বাগান তছনছ করে দিয়ে আমাদের ভেতরে ভেতরে হত্যা করে রাখে ।

   না, এ কোনোরূপকথার গল্প নয়। এ হল আমাদের ঘটমান-বর্তমান-ইতিহাস। সেখানে যেহেতু দর্শন নেই, তাই জাগলিং রয়েছে। জীবনে প্রকৃত কাব্যের অভাবে, রসের অভাবে, সময় অতিবাহিত করবার ছলে আমরা জাগলিং এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি একদা আর এখন সেই জাগলিংকেই প্রকৃত আর্ট ভেবে নিয়ে জীবনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নইলে জীবন মানে যে জাগলিং নয় কখনোই, সে তো আমরা জানি।

   এইসব কথাগুলো মনে পড়ল কবি বন্ধু সপ্তর্ষি বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘দাহ্য মাধুকরী’ পাঠ করতে গিয়ে। দাহ্য মাধুকরী পাঠ করতে গিয়ে মনে হল—এ জীবন হারিয়ে ফেলেছি। এর সাথে আর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এই তছনছ আত্মানিয়ে তবু কোথাও তার সঞ্জীবনী শক্তি আমাদের সুপ্ততাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়, হয়তো, সে কারণেই এই আলোচনার প্রবঞ্চনা।

      হয়তো সে প্রবঞ্চনার কথা সপ্তর্ষিরও একান্ত অনুভব। যা তার কবিতার ছত্রে ছত্রে কবি ও পাঠক উভয়কেই ছত্রখান করে দেয়। কবিতা শুধুই আর শব্দের মায়াজালে আবদ্ধ থাকেনা, অথবা শুধুই কনটেম্পোরারিও হয়ে উঠতে চায় না। তা একাধারে যেমন সমসাময়িক, অন্যদিকে তেমনি সময়কে পেরিয়ে বহুদূর চলে গিয়ে পথ হারিয়ে কোনো গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে । হয়তো সেই গ্রাম আর সমকালে নেই, সেই প্রেম, যা বহুদিন আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা তাকে কবিতায় পুনরায় প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠি ।


তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি এদেশেও নদী ছিল এক—

অনেক নৌকা ছিল, হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়শালে ঘোড়া ছিল আর—

তুলোর পুতুল হেন সংখ্যাতীত পরী ছিল ছদ্মবেশী উদাসী রাজার,

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি আমিই ছিলাম সেই ছদ্মবেশীরাজার সারথি ?...

ভাঙা রথ আছে আজো তবে

হারিয়ে গিয়েছে সেই নদী...

 

এখন কিছুই নেই এই দেশে তবু

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি তুমি ছিলে সে দেশের পলাতকারাজকন্যা আর

আমারই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে তুমি

খুলে দিয়েছিলে কবে বুনোফুলে গাঁথা এই সাতনরী হার ?



   কবিতাটি পাঠ করেমনে হবে বুঝি কোনো দীর্ঘ কবিতারি অংশ! না এটি গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ কবিতা । তবু ,যদি শিল্পকে জীবনেরই প্রতিরূপ বলে ধরে নিই, তবে তো এ কবিতা এক দীর্ঘ-দীর্ঘ কবিতার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। হ্যাঁ তাই, কবি সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করছেন, এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেই সঙ্গে তা পাঠকেরও আত্মজীবনীই। জীবন বর্জিত অধুনাকাব্য-গড্ডালিকার বিরুদ্ধে এ এক বিষণ্ণ মুচকি হাসি যেন বা । 

   তাহলে আরো একটি কবিতা পাঠ করা যাক । একেবারে অনাধুনিক পদ্ধতিতে লেখা এক অশ্রু।


আসিল আষাঢ় মাস ধারা খরতর।

সীমানার বেড়া খানি যবে পড়ো পড়ো

দড়িদড়া বাঁশ হাতে রামপ্রসাদ সেন

বেড়া বন্ধিবার কাজে মেয়েরে ডাকেন।

কন্যা বলে, ‘যাও বাবা, আসিতেছি আমি’

রামপ্রসাদ সেন আজ নিজেই ঘরামি।।


( ভাবা যায় ! এই ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত এক কবিতায় কবিএই সব শব্দ-বাক্য-আঙ্গিক ব্যবহার করছেন! যা আমরা বহু পিছনে ফেলে এসেছি কালের নিয়মেই। সেই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাবটি আজ আর ফিরে পাওয়ার উপাই নেই ।  তাহলে কেন এই 'অনাধুনিক' প্রয়াস? )

 

বেড়া বাঁধা কর্ম চলে, সঙ্গে চলে গান।

কন্যা আসি দড়িদড়া পিতারে যোগান।।

কিয়ৎক্ষণ পরে কন্যা উঠি যায় চলে।।

তখনি কন্যার কণ্ঠ সাধকেরে বলে

‘এ’ত দেখি বেড়া বাঁধা শেষ হল প্রায়

 কে তোমারে দড়ি দড়া দিয়েছে জুগায় ?’


    পরবর্তী গল্পটি আমাদের সবারি জানা যেহেতু তাই সেই অংশটি, কবিতায় বাকি গল্পটি, এক্ষেত্রে অনুদ্ধৃত থাক, ক্ষতি নেই। আমরা বরং কবিতাটির একেবারে শেষ প্রান্তে কবির নিজস্ব অনুভবটুকু দেখেনিই। আর তার আগে জানিয়ে দিই—কবিতাটির নাম ‘মীথ’


হায়, জানি, সত্য নয় এসব কাহিনী।

তবু যেন মনে হয় কন্যাটিরে চিনি।

রাজপুত্র ছেড়েছিল তারি ডাকে ঘর

তারি তরে ডিঙা বায় চাঁদ সদাগর

সে আমার বন্ধঘরে খোলা জানালাটি

তারি স্পর্শে গর্ভবতী অহল্যা এ মাটি

কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার

মীথ্ গুলি মর্মে তাই আসে বারম্বার।


   এইবার আমরা মূলজায়গায় এসে উপনীত হলাম—‘কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার’। হয়তো এটাই মূল কথা এই রচনাটির। এবং এই সত্যে উপনীত হতে যেন ঐ অনাধুনিক ভাষা-স্টাইল আমাদের অনেক খানি দ্রুত আগিয়ে দেয় গন্তব্যে। আর মিথোলজি বোধহয় সমকালীন ভাষায় খোলেও না ভালো।

   সপ্তর্ষির কবিতার একটা মূল জায়গা হল, তার কবিতার ভেতর একটা অতি সূক্ষ্ম নিহিত গল্প থাকে, থাকেই।  এখন প্রশ্ন হল এত এত গল্প কাহিনী  কবিতার পক্ষে খুব ভারবাহী, হানি-কারক হয়ে যাচ্ছে না? কারণ কবিতাকে হতে হবে নির্মেদ,সূক্ষ্ম, বিদেহী আত্মার প্রায়—এমন মত পোষণ করেন কেউ কেউ।হয়তো তাই। এতদিনের কাব্য যাত্রার পথ অতিবাহিত হয়ে আমরা যেখানে এসে আজ পোঁছেছি সেখানে কবিতা আরো সূক্ষ্ম হবে, এটাই অভিপ্রেত। তবে সেই সূক্ষ্মতা কী কায়ায় নাকি মায়ায়? সেখানে গল্প থাকবে না কি ? হাজার হাজার বছর আগের কাব্যের ভিতরে যে সকল কাহিনী প্রবহমানছিল, তার মুছে যাওয়া আবছা স্মৃতির মতো? -- থাকবে না সেই সূক্ষ্ম মায়া?

   যেহেতু আমাদের আদি-কাব্যগুলি থেকে শুরু করে আধুনিকতার গোড়া অবধি সমস্ত সাহিত্যই কাব্যের আধারে। কাব্য বলতে এখানে পদ্য বোঝানো হচ্ছে না, কাব্যই । যে কাব্যের মধ্যে রয়ে গেছে আবহমান মানব-জীবন-ইতিহাস। মানুষের মৃত্যুর পরেও মানব থেকে যাওয়ার ইতিহাস। সেইগল্প। যা পাঠকের মনকে অতি সহজেই জারিত করে তোলে। 

     আর আধার বিহীন, অ-মূর্ত কবিতা ? তাও থাকবে । একদিকে তেত্রিশ-কোটি দেবতার রূপ-বিগ্রহ, অন্যদিকে অরূপ। কিন্তু সরল-সহজ, অল্প বোকা, আবেগ প্রবণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা মদ,মাৎসর্য, ঐশ্বর্য্য, কামের বশবর্তী হয়ে পথে পথে ছুটে মরে, তাদের জন্য তো নয় সেই অরূপের পথ । সে পথ সাধকের হতে পারে। আমাদের আপাতত কাব্যের সেই পরম রসে পৌঁছতে একটুখানি মূর্তির প্রয়োজন হয়। আধারের। হ্যাঁ, যা আমরা সহজেই পেয়ে যাই সপ্তর্ষির কবিতায়। যা মূলত তার ক্লাসিক মুড্ ।


আমাকে হত্যা করে আমারই ফেরার পথে ফেলে গেছে কেউ,

পাহাড়ি গ্রামের সন্ধ্যা কুয়াশায় সূচীভেদ্য হলে

আমারই শবের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমি

থমকে দাঁড়িয়ে দেখি চাঁদের কুহকে

ছেয়ে গেছে উপত্যকা, টিলা আর চালাঘর গুলি—

এবং হত্যাকারী, সে’ও পায়ে পায়ে

চুপে এসে দাঁড়িয়েছে আমারই কিনারে...

   

   সপ্তর্ষির কবিতায়এই হল আমাদের অসময় । আমাদের চূড়ান্ত ঘটমান-ইতিহাস। যেখানে শবদেহ একটি চরিত্র, যার কিনারেএসে দাঁড়িয়েছে নিহত ও হত্যাকারী। আর আকাশে, চাঁদের কুহকে ছেয়ে গেছে উপত্যকা—এটুকুই কবিতা, এটুকুই গল্প!

   একদিন কবি গৌতম বসুর সাথে এক ফোনালাপে কথা হচ্ছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস’ প্রসঙ্গে তিনি বললেন—“দেখ,প্রেম ছাড়া, ভালবাসা ছাড়া কিছু হয় না। মানুষের প্রতি এই যে অকৃত্রিম ভালবাসা, টান, এটাই ‘তিতাস’। তাঁকে(অদ্বৈত) চেষ্টা করতে হয়নি। তিনি শুধু মনের কথা বলেগেছেন” । আর সেখানেই উপন্যাসটিও কবিতা হয়ে উঠেছে। তো, মূল কথা হল প্রেম। বৈষ্ণব প্রেমে যেমন বলা হয়েছে ,আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ছেড়ে কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রিতীর কথা । সেই মহাপ্রেমও নয়।  এ হল অতি সাধারণ জাগতিক প্রেম। মানুষের প্রতি ভালবাসা। এই জগৎকে, আপন মাটিকে  ভালবাসা। প্রেম, যা না হলে সৃষ্টি হয় না । আর কবি তাই সদম্ভে সেইসব অতিদূর ঈশ্বরকে দূরেই সরিয়ে রেখেছেন।

 

সেইসব দেবতাকে বিশ্বাসে নিরস্ত থাকি আমি

চোখের কাছে বা দূরে কোনোদিন দেখিনি যাদের...

সেই অর্থে প্রকৃতই ধর্মচ্যুত আমি—

 

অথবা


পাথরের গায়ে মাথা কুটে 

রাত যায়, কালরক্ত ছুটে...

বালক পাথর ছুঁড়ে মারে—

ঢেউ ভাঙে জলে, অন্ধকারে...

কে ছুঁড়েছে পথ থেকে তুলে

পাগলের মাথাতে পাথর ?

ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর

দেবতাও ব্যাথাতে কাতর...

 

হে দেবতা কবে তুমি ক্রোধে

তুলে নেবে নিজেও পাথর ?

 

   কবির অন্তরাত্মা, তার ক্রোধ, বিষন্নতা, ও অসহায়তা কবিতার ভেতর এত দিনের চেনা দেবতার বিনির্মাণ ঘটিয়ে দেয়। এতদিন যে নিরপেক্ষ, স্থবির দেবতার কথা আমরা জেনেছি, এ সে নয়। মায়ানমার,বাংলাদেশ, গাজা, --সমস্ত পৃথিবীর পাগলের মাথাতে পাথর, (‘পাগল’ অর্থে যে ‘কবি’, সে তো মহাকবি শিখিয়েই গেছেন!) ‘ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর’ কবি তার সমস্ত অসহায়তা নিয়ে মাথা কুটে মরে।

          এই কাব্যগ্রন্থের ভেতর ইতস্তত ভ্রমণের পর যখন পাঠক তার তোরণদ্বারের নিচ দিয়ে নিষ্ক্রমণ করবেন, যদি প্রবেশের পথে বেখেয়ালে ভুলেগিয়ে থাকেন, তাহলে আরেকবার তোরণের বাহির হয়ে ঘাড় তুলে দেখে নিন, সেখানে কি লেখাছিল--


নিরুপায় এসব অক্ষরে

এঁকে তুলি একটি ঠিকানা—

ঘুমঘোরে ছুঁয়ে গেছি তবু

মানচিত্র হয়নি’তজানা...

অগস্ত্য-গমন-পথ নয়

মৌন এক ছোটো পথ রেখা

হয়তো বা কিছু দূরে গেলে

সাঁকো এক যেতে পারে দেখা।

আজো সে সাঁকোটি খুঁজে মরি,

ঝুলি ভরে দাহ্য মাধুকরী ।।


(দাহ্য মাধুকরী : সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।। আদম প্রকাশনীর পক্ষে বন্ধুবর গৌতম মণ্ডল ।। প্রচ্ছদ:  কবি স্বয়ং। বছর সাতেক আগে আলোচনাটি লেখা। ধ্যানবিন্দু পত্রিকাতে প্রকাশিত। আজ ব্লগে তুলে রাখলাম।)

বৃহস্পতিবার, ২২ জুলাই, ২০২১

উৎসের দিকে...

 অনপেক্ষ অনলাইনের 'সূত্রপাতের স্বগতোক্তি'' বিভাগে শুভাশিসদার (মণ্ডল) আদেশে লিখিত হয়েছিল লেখাটি। 



ছবিঃ বাসুকি দাশগুপ্ত


 অপেক্ষার মতো ঝিমধরা উপত্যকা আর কিছুতে নাই। বালকবেলার সবুজ ঘাসের মতো অপেক্ষা, কৈশোরে এসে পাল্টে যায়! কিশোরের অপরাহ্ন একজন যুবকের নয়, যৌবনের প্রান্তে যে অপেক্ষা তা কার জন্য আমি জানিনা। একজীবন ঝিমধরা অপেক্ষা আমার নেশা হয়ে থাকল।  যা চেয়েছি তা যদি সেই বাল্যে, কৈশোরে, প্রথম যৌবনে,   সব সব পাওয়া হত ঠিক ঠিক! যথাসময়!  যদি আমার কোনো অপেক্ষা না থাকতো কোনো অনির্দিষ্টের প্রতি? কী হত?   


 


 এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে বুঝি এই অপেক্ষার খুব প্রয়োজন ছিল। একটা আজীবন অনির্দিষ্ট প্রতীক্ষা নিয়ে থাকার আত্মজৈবনিক আততি আমাকে একটা অন্ধ লেখার দিকে ঠেলে দেয় বারবার। সেই কবে থেকেই।  হয়ত তখন, সেই বাল্যে, কৈশোরে, তাকে এমন ভাবে চিনিনি। আর মনেও নেই কবে প্রথম সেই  প্রতীক্ষার শুরুয়াত হল।   


   বাহ্যিক একটা আরম্ভ থাকে, তারও আগে থাকে ভেতরের একটা আরম্ভ। তাকে এই এত বছর পর আর চিহ্নিত করা যায় না বিশেষ কোনো ঘটনা দিয়ে।    অথচ বাহ্যিক ঘটনাগুলি এতই অকিঞ্চিকর যে তাকে  বানানো গল্পের মতো মনে হয়। অন্য লোকের জীবন বলে মনে হয়। বয়ঃসন্ধির  সেই লাজুক আর ভয়ংকর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলিকে শুরুয়াত বলা যায় কিনা জানিনা। ১৯৯২ সালে একটি পত্রিকায় প্রথম নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে যে আত্মরতিময় কামুক অনুভুতি তাকেও কি শুরুয়াত বলা যায়?  অথচ সেই ছাপার অক্ষরে নিজনাম দেখার অনুভূতি প্রথম স্বমেহনের  মতোই মনে রয়ে গেছে। যা আজীবন লুকিয়ে রাখতে হয়।  যা আর অন্য কারো কখনোই কোনো কাজে লাগে না, এমন কি নিজেরও কোনো কাজে আসে না আর। তবু তা থেকে যায়।  


  হয়ত প্রত্যেক মানুষের জীবৎকালের সমস্ত কর্ম,  পাপ,  পূণ্য, অসহায়তা তার জন্মক্ষণ আর স্থানের মধ্যে লেখা থাকে। সেই জন্ম মুহুর্তের বয়ে যাওয়া বাতাস, নক্ষত্রের অবস্থান, আর এই মাটির কয়েক কোটি বছরের লিখিত ও অলিখিত ইতিহাসের মধ্যে সে তৎক্ষণাৎ ঢুকে পড়ে, আর তার ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়।  এক অভিশাপময় অন্ধকারের ভবিষ্যৎ সে বহন করতে থাকে, যা তার অন্তর্গত লোহু। তাকে এড়ানো যায় না। সে লিখতে শুরু করবে কোনো একদিন এইসব, পাপ স্খলনের মতো।


   জন্ম এক প্রতিদান। কবে কখন ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হবে তা? আমার জন্ম মাটি কেমন? লাল ল্যাটেরাইট। ঊষর। বন্ধুর। পাড়ার আনাচে কানাচে টেরাকোটা স্থাপত্যের প্রাচীন কাহিনি মূক ও মুখর। যে তার ভাষা বোঝে, সে বহুদূর অব্দি টের পায় বন ও প্রান্তরের বিধুরতা । আর বিশংশতাব্দীর শেষে যার শৈশব কৈশোর এইসকল পারিপার্শ্বিক নিয়ে হয়ে উঠবে অতি ব্যক্তিগত। এই শতক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যেহেতু, তাই জন্ম-নক্ষত্র ও মাটির ইতিহাস সুপ্ত থেকে যাবে শরীরে বহমান লোহুর ভেতর  । আর পুনরায় লিখে ফেলব আত্মরতি। কোনো বড়,  বৃহৎ ভাব,  বিশালের অংশ আমাকে ধরা দেবে না।  সবার জীবনে তা দেয়ও না। ছোটো ছোটো ভাব, দুঃখ, আনন্দ আর আত্মখোদাই এইসবই হয়ে উঠবে বিষয়। আর ক্রমশ নিজের জীবনকে এক্টি স্ব-লিখিত গল্পের মতো মনে হবে ক্রমশ। 


তখনো জানিনা এসব, তখনও জানিনা এই এক সামান্য আত্মখোদাই-ই আজীবনের কাজ হয়ে উঠবে। তখন শুধু পাতা ভরিয়ে রাখা। আর কেউ পরিচিত বন্ধুবান্ধব চেয়ে নিলে অপেক্ষা করা। রোজ গোছা গোছা পোস্টকার্ড আর চটি এক ফর্মা দু ফর্মা পত্রিকাগুলি ততদিনে আসতে শুরু করেছে নিজের ঠিকানায়। বিলুপ্ত টেলিফোন বুথের যুগ তখনও আসেনি। অপেক্ষা সেই ছাপার অক্ষরে আত্মরতির মতো নিজনাম টুকু দেখার। আজ তা বহুদূরের জীবন বলে মনে হয়।  তবু সেদিনের সেই শুরু ছিল একটা অপেক্ষা। 


    শৈশবের প্রবল জৈষ্ঠের দুপুরে পিসিমনি এসে দাঁড়ালো উঠোনে, ছোটো ভাই কোলে, সেই হঠাৎ আগমনের আনন্দ,  সে এক আনন্দ! যুবা বয়সের বন্ধু আসবে বিকেলে,  বহুদিন পর, তার জন্য অপেক্ষা এক আনন্দ। আর সেই,  অনিশ্চিত, যাকে আমি চিনি না, যে সেই শৈশবকাল থেকে আমার সঙ্গী, সে কি কোনো মানুষ? কোনো নারী, কোনো মহাপ্রলয়,  কোনো ঘটনা? আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। শুধু জানি সে আসবে একদিন। এসে বলবে,  মাধব, তোমার কথার ভেতর দুদণ্ড বসলাম, এবার চলে যাচ্ছি। সেই এক ঝিমধরা উপত্যকা, যার জন্য আমি প্রথম,  কোনো একদিন মধ্যরাতে খাতার সামনে বসে  পড়েছিলাম।  তখন কৈশোর বিদ্ধস্ত হচ্ছে...     "

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

কথোপকথন : স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত ও কৌশিক বাজারী

কথোপকথন :  

স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত ও কৌশিক বাজারী ।

 

 

(আমাদের এই কথোপকথন পর্যায়টি  ঘটেছিল কয়েকবছর আগে। স্বর্ণেন্দুর একটি কবি সম্মান প্রাপ্তি উপলক্ষে,  একটি পত্রিকার সম্পাদক বন্ধুর অনুরোধে।  ঘটনাচক্রে তা আর প্রকাশিত হয়নি। আমার গুগুল ড্রাইভে থেকেই গেছে কথাবার্তাগুলি। মনে হল ব্লগে তুলে বন্ধুদের পড়তে দিই। তাই...

--কৌশিক বাজারী)




কৌশিক বাজারী :

আচ্ছা, স্বর্ণেন্দু, শুরু করি তাহলে ? প্রশ্ন তো একটাই সকলে করে, কেন কবিতা লেখো? ত একজন এর উত্তরে বলেছিলেন সিনেমা বানাতে পারিনা, ছবি আঁকতেও পারি না, অগত্যা কবিতা! গান গাইতে পারলে হয়ত কবিতা লেখার প্রয়োজন হতই না আর...। তোমার ব্যাপারটা কী? মানে ভিউটা, একটু বল, অন্য কারো কথা না, তোমার কথা, কীভাবে এসে পড়লে এই জগতে?


স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত:

কেন কবিতা লিখি, এবং কীভাবে এসে পড়লাম এ জগতে, দুটো প্রশ্ন দু-রকম হলেও, এখানে বোধহয় একটি প্রশ্নেরই বাতাবরণ গড়ে তুলেছে ।  এই যে কেন লিখি কবিতা,বা কবিতা লিখে কী হতে পারে এর উত্তর ভাবতে গিয়ে, যেগুলো মনে আসছে, কবিখ্যাতি, সবার মাঝে থেকেও সবার থেকে আলাদা, বা বিশিষ্ট হয়ে ওঠা, বা তুমি যেভাবে বললে, আর অন্যকিছু পারিনা বলেই কবিতা লেখা ইত্যাদি, এগুলো সবই আসলে খুব পরিণত বয়সের চিন্তা, তাই এই ধরনের উত্তর থেকে দূরে থাকতে চাইছি । দূরে থাকতে চাইছি কারণ,  আমি প্রথম যেদিন কবিতা লিখেছিলাম, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন আর এভাবেই নির্ধারিত হয়ে গেল আমার পরবর্তী জীবনের গতিপ্রকৃতি, সেদিন কি আর বুঝতাম এতসব কিছু্র মানে, কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনাটি তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, সেই কবিতা লিখে ফেলাটি ! সেদিনের প্রথম কবিতার আমি-ই তো আজও এগিয়ে চলেছে একটি পরিণতির দিকে, বিরামহীন । কবিতা কেন লেখে সেদিন বোঝার বয়স ছিলো না, কিন্তু না থেমে লিখে যেতে যে চাইতাম তা জানি, কারণ প্রতিদিন সন্ধেবেলা ঠাকুর প্রণামের সময়, আমার একটাই ছিল নিয়মিত প্রার্থনা, যে আমি যেন লেখক হয়ে উঠতে পারি !

সুতরাং লিখি, এবং লিখে যে যাচ্ছি এটা সত্য । কিন্তু কেন লিখি ? আজকের আমি সেদিনের আমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেদিনের আমি আজকের আমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু কেউ কাউকে এর প্রকৃত উত্তর বলে দিতে পারছে না!


কৌশিক :

হ্যাঁ, একটা অন্তর্গত সুরবোধ, যা কারো কারো ভেতরে বেজে ওঠে! সেটাই তোমার কথা থেকে বোঝা গেল। হয়ত খুব শিশুকাল থেকেই । তবে সবাই হয়ত দীর্ঘকাল বহন করতে পারেনা সেই সুর, হয়ত পারিপার্শ্বিক এর চাপ তাকে নষ্ট করে । অবশ্য এতে কোনো অসুবিধা বোধ হয় না । অর্থাৎ বিষয়টা একেবারেই ভেতরের, অন্তরের একটা রহস্যময় জগত, যার নাগাল সচেতন মন পায়না, তাইতো ?



স্বর্ণেন্দু :

এই কয়েকদিন আগে একটা পুরানো ডায়েরি খুঁজে পাই, এই ডায়েরি থেকে আমার লেখালিখির প্রথমদিকের একটা ঘটনা, সামান্যই সে ঘটনা, মনে পড়ে যায়! সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন, সে সময়ের ডায়েরি এটি । কবিতা লিখতাম, এবং কবিতার নিচে, কবির নাম লেখা হয় যেখানে, উলটো পালটা নাম লিখে রাখতাম, নিজের নাম লিখতাম না । আমি ব্যতীত অন্য কেউ যদি আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত জীবনটির খোঁজ পেয়ে যায়, এমন একটি সংকোচের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এই বিভিন্ন নামের আড়াল খুঁজে নেওয়া । ক্রমে আর এই সংকোচটি থাকল না । আমার যে একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে, সেখানে আমি স্বাধীন, আমার কথাগুলি, ভাবনাগুলি  একান্তভাবে আমারই, আমার ভাবনাগুলি আমার মতো করে ব্যক্ত করতে পারি, এগুলি সবাইকে জানাতে আর সংকোচ থাকল না । তাই কবিতার নিচে নিঃসংকোচে যেদিন প্রথম লিখে দিতে পারলাম নিজের নাম, সংকোচ বিসর্জনের থেকেও সেদিন আমার কাছে বেশী করে গুরুত্ব পেল যা, তা হল একান্ত ব্যক্তিগত ও স্বাধীন এক জীবন যাপনের ইচ্ছে! তোমার প্রথম প্রশ্নের হয়তো এটিও আর একটি উত্তর, একটা স্বাধীনতা বোধ, আমরা সকলে যা প্রত্যাশা করি, তা আমি এখানে সবচে বেশী অনুভব করে থাকি । তাই এখন এটি শুধু আর অন্তরের রহস্যময় জগতের ব্যাপার থাকল না,  বাইরের একটি কারণও খুঁজে পাওয়া গেল বোধহয়, তোমার এই দ্বিতীয় প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ।


কৌশিক :

দেখ, ব্যক্তিগত জীবন যাপনের বোধ, একটা বয়সের পর আসেই । প্রকাশেচ্ছা, নিজেকে উপস্থাপন, সেটা আবার কিঞ্চিত আলাদা । অর্থাৎ আমারও কিছু বলার আছে, বলতে চাই, এই ইচ্ছা । সকলেই হয়ত পথ খুঁজে পায়না । তবু খোঁজটা থাকে আজীবন । আচ্ছা তুমি কবিতায় মূলত কী বলতে চাও? এবং আরো বড় কথা হল, কিছু কি আড়াল করতে চাও? প্রশ্ন কি ঠিক করতে পেরেছি?


স্বর্ণেন্দু :

নিজের কথা নিজের মুখে বলার সংকোচটি সহজাত হলেও, আমরা আত্মজীবনী লিখি । কারণ, আত্মজীবনী প্রথমত নিজের চোখ দিয়ে নিজেকেই দেখা, দেখতে দেখতে নিজেকে জানা ও বোঝা, অন্য আর পাঁচজনকে জানানো ও বোঝানোর ব্যাপারটি অনেক পরে আসে । আত্মজীবনী রচনার মতো আমার কাছে কবিতা লেখাও আসলে নিজের চোখ দিয়ে নিজেকেই দেখা, নিজেকে বোঝা, যদি কিছু বলার বিষয় থাকে সে বলাটাও নিজেকেই বলা । আমার কবিতা কিছু বলতে চায় না, যদিও কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলাই যায় । যে অনুভূতিগুলির কথা, হঠাত হঠাত উদ্ভাসনগুলির কথা কাউকে বলা যায় না, অথচ নিজেকে বলতে কোনো বাধা নেই, লেখার ছলে সেগুলি নিজেকেই বলে ফেলা হয় আসলে । কারণ সেগুলি না লিখলে, না বললে, চিরকালের জন্য অধরাই থেকে যেত তারা, সেগুলি-ই  আমার কবিতা, তারপরেও আরো অনেক অনেক অধরা থেকে যায়, সবগুলোকে তো আর কবিতায় ধরতে পারি না! কিন্তু একজনের সব কথাই তো আর নিজেকে বলার জন্য হতে পারে না, আমারো কিছু কথা আছে যা অপরকে বলা যায় বা বলতে চাই । সে সকল কথার জন্য আমি গদ্য লিখি, সেখানে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে চাই, আমার বক্তব্যটি সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে চাই ।


কৌশিক :

আচ্ছা, ধরো, পৃথিবীতে এক বিশাল বিপর্য্যয় ঘটে গেছে! আনবিক যুদ্ধে, বা মহাশূন্য থেকে খসে পড়া গ্রহাণু সংঘাতে মানব সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে! কেউ নেই । বা থাকলেও কোথাও, তুমি তা জানোনা । একা, পোশাকহীন, ঠাঁইহীন ঘুরে বেড়াচ্ছ।
ধরা যাক,প্রকৃতি খাদ্য যোগাচ্ছে ।

কবিতা লিখবে ?



স্বর্ণেন্দু :

চূড়ান্ত সংকটের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষ শিল্পের সম্মুখীন হয়, এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যায় । কিন্তু তুমি যদি জিজ্ঞেস করতে প্রচণ্ড বৈভব, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও আমি কবিতা চর্চা চালিয়ে যেতে পারবো কী না, তার উত্তর দেওয়া আমার ক্ষেত্রে আরো কঠিন হত, আমাদের সামনে তেমন দৃষ্টান্তও খুব একটা আছে বলে মনে হয় না । এ প্রসঙ্গে, এই মুহুর্তে মনে পড়ছে, মোয়াজ্জাম বেগ এর কথা । আমেরিকা অধিকৃত কিউবার গুয়ান্তানামো উপসাগরের তীরে অবস্থিত কুখ্যাত ডিটেনশন ক্যাম্পে, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে, মোয়াজ্জাম বেগ তিনবছর বিনা বিচারে কারারুদ্ধ ছিলেন । অকথ্য, অবর্ণনীয় মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে  তাঁকে এখানে কাটাতে হচ্ছিল যখন, কবিতা লেখা শুরু করেন! এই  কারাগারের ভিতরের অবস্থা, মানব সভ্যতা শেষ হয়ে যাওয়ার যে কথা তুমি বলেছ, তার চেয়েও খারাপ বই ভাল নয় । হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভিতরেও যে কবিতা লেখেন নি কেউ, ব্যাপারটি আদৌ এমন নয়! বেগ এর বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয় নি, শেষপর্যন্ত তিনি মুক্তি পান ।

এক সাক্ষাৎকারে কবিতা লেখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হোলে, মোয়াজ্জাম বেগ বলেছিলেন...‘I liked writing poetry, but having said that, poetry is something I only discovered in Guantánamo, and it was solitary confinement that produced that response in me.’ বাস্তবিকই এক বিচ্ছিন্ন কারাগারে তিনি প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন, সম্পূর্ণভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় । মুক্তির পরে, আরও কবিতা লিখতে চান কী না জিজ্ঞেস করা হোলে, তিনি বলেন...‘It’s sad, because it means that I need that isolated environment to write, and I can’t do it in just any situation’।



কৌশিক :

আমার প্রশ্নের মূল জায়গাটা, স্বর্ণেন্দু, একটু আলাদা ছিল, একটু নয়, পুরোটাই, হয়ত আমি বোঝাতে পারিনি, আসলে বৈভব না অভাবের প্রশ্ন নয় এটা, আমি বলতে চেয়েছি পৃথিবীতে একা একজন মানুষের কথা, যার কথা শোনার জন্য আর কেউ নেই তার সামনে, সেই তখন, যখন কবিতা বা যেকোনো শিল্প আর কাউকে দেখানোর বা শোনানোর নেই, কী করবে সে? যদি তুমি হও সেই ব্যক্তি, কী করবে ?



স্বর্ণেন্দু :

তুমি পাঠকহীনতা কে গুরুত্ব দিতে চেয়েছ, আমি গুরুত্ব দিয়েছি সংকটটাকে । সেদিক থেকে দেখলে, একজন লেখকের সামনে আর যখন কোনো পাঠক নেই, এটিও আর এক ধরনের সংকট ! লেখকের সংকট । সেদিকেই হয়তো আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ এগিয়ে চলেছে, যা অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, এমন একদিন এগিয়ে আসছে যখন কেউ আর সাহিত্য পাঠ করবে না । তখন এটা শুধু  একজন লেখকের সংকট হতে যাবে কেন, সভ্যতারই তো সংকট এটা !

তুমি একেবারে ব্যক্তি আমার কথা জানতে চেয়েছ— যে আমি কী করব তখন— আর সত্যি-ই তা আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছি আমার আগের উত্তরে । একটি কাল্পনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলতে যাওয়া মানে, আরও বেশী করে সেই কল্পনারই আশ্রয় নিতে যাওয়া, আমি কিছুতেই বুঝতে পারব না, সে কল্পনা কতদূর প্রকৃত বাস্তবকে অনুসরণ করছে । তাই সেই প্রশ্ন থেকে মুখ ঘুরিয়ে চারপাশটাকে দেখে নিতে চেয়েছি, যে প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে কী কী ঘটে থাকে, সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছি । আর একটি কথা বলা হয় নি, সম্পূর্ণ আইসোলেশনের মধ্যে সেই কয়েদি কবিরা, নুড়ি দিয়ে, কাঁকর দিয়ে, কারাগারের দেওয়ালে মেঝেতে কবিতা লিখত । কারণ, প্রথম প্রথম লেখার কোনো সরঞ্জাম ছিল না তাদের । দেওয়ালে, মেঝেতে লেখা কবিতাগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যেত দেওয়াল থেকে, মেঝে থেকে, একটি পাঠকেরও মুখ দেখতে পেত না সেগুলি যেমন, কোনো পাঠক পড়বে এমনটা ভেবেও নিশ্চয় লেখা হত না কবিতাগুলি ! সুতরাং লেখা যায়, একেবারে নিজের জন্যও লেখা যায় তাহলে ! লেখা যখন যায়, আমিও কবিতাই লিখব তখন, একা একাই মুছে দেব সেগুলি , কারণ বেঁচে থাকা ব্যতীত অন্য কোনো কাজই তো রইল না আর ।




কৌশিক :

খুব সুন্দর বলেছ স্বর্ণেন্দু ! সত্যিই ত, নিজেকেই নিজে বলে যাওয়া এইসব কথা! কবিতায় ছবিতে গুহাশিল্পে, প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে, ‘সুতনুকা নামে সেই দেবদাসী’ অজ্ঞাত কোনো কবি যাকে পাথুরে লিপিতে প্রেম জানিয়ে ছিল হাজার সহস্র বছর আগে! তাহলে ভাই এই পুরস্কার খ্যাতি যশ এর সঙ্গে কোথায় কোন সম্পর্কে তুমি যুক্ত করবে আজকের শিল্পকে ? কিছু আলোকপাত কর দেখি এর উপর ?


স্বর্ণেন্দু :

এই বিষয়টি, এমন কী জগতের কোনো বিষয়ের ওপরেই, যথাযথ আলোকপাত করবার মেধা ও পাণ্ডিত্য আমার নেই । এখন ঘটনাচক্রে তুমি প্রশ্নদাতা আর আমি উত্তরদাতা, উল্টোটিও হতে পারত । আমাকে এখানে কিছু বলতে হচ্ছে, যদিও বলার আগে, বলার সময়ে, এবং বলার পরেও সেই ‘বলা’ নিয়ে সংকোচ কিছুটা হলেও থেকেই যাচ্ছে। থাকবেও ।

এবার কাজের কথায় আসি,শিল্পচর্চা করে কেউ কেউ পুরস্কার খ্যাতি ও যশের অংশীদার হয়ে ওঠেন এটি ঠিক, তা বলে শিল্প চর্চার লক্ষ্য কখনোই পুরস্কার খ্যাতি বা যশ হতে পারে না । আবার, শিল্প চর্চার সরাসরি ফল হিসেবেও এগুলোকে দেখা যায় না, বাংলাভাষায় লিখে কজনই বা আর পুরস্কার খ্যাতি বা যশের মুখ দেখেন! কেউ কেউ দেখেন, এটিও একরকম সত্য, কিন্তু এই সত্যের জন্য অপর সত্যগুলো মূল্যহীন হয়ে যায় না । এই পুরস্কার খ্যাতি যশকে গ্রহণ করবার ধরনের মধ্যেও তারতম্য দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ তিনটি-ই পেয়েছিলেন, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো অসূয়া নেই, সহনশীলতা রয়েছে । আজকের সময়ের কেউ তা পেলে,  এ বিষয়টিকে আবার এতটা উদার দৃষ্টিতে দেখতেও পারি না । অবশ্য তার জন্য কিছু যাবে আসবে না, এই পাওয়া না-পাওয়া, দেওয়া না-দেওয়া, ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক এবং-অথবা রাজনৈতিক খেলাটি চলতেই থাকবে ।

কিন্তু কথা হল, এইসব বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা আমাদের জন্য কতটা জরুরি ? আলোচনার মাঝে তারা হঠাত এসে ঢুকে পড়ছে যখন, তাদের একটি প্রভাব রয়েছে আমাদের চিন্তায়, কথাবার্তায়, এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই আর । এইসব প্রভাব থেকে যত দূরে রাখতে পারবেন একজন নিজেকে, ততটাই গভীর ও একাত্ম হয়ে উঠবেন তিনি, আমার এটুকুই বিশ্বাস । আবার দেখ, আমরা যে সকল কবি-লেখকের সঙ্গে ঘর করি, আমি জানি তুমিও, তাঁদের সিংহভাগই তো পুরস্কার খ্যাতি ও যশের বাইরে থেকেই সারাজীবন শিল্পচর্চা করেছেন, বা এখনও করছেন । এর জন্য তাঁদের শিল্পচর্চায় তো কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি, তাঁদের গ্রহণ করতেও আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি, আমরাই তো খুঁজে খুঁজে গিয়েছি তাঁদের কাছে । শিল্পীর থেকে, শিল্পর থেকে, কোনো পুরস্কার-ই কখনো বড় হতে পারে বলে আমার মনে হয় না ।



কৌশিক :

দেখ স্বর্ণেন্দু, এখানে আমারও একটা কথা বলার ছিল, আমার মতামত এখানে যদিও বেশি কাম্য নয়, তবু যেহেতু এটা প্রথাগত সাক্ষাতকার নয় তেমন, দাদা - ভাই এর কথোপকথন বলা যায়, তাই তোমার কথার সূত্রে বলি-- প্রথমত এই পুরস্কার শব্দটাই আমার কাছে খুব ফিউডাল গন্ধযুক্ত মনে হয় । যেকোনো কবিশিল্পী বিজ্ঞানী অর্থাৎ সৃজনশীল মানুষকে পুরস্কৃত করার কিছু থাকে না । কেইবা তাকে পুরস্কৃত করতে পারে! আমরা শুধুমাত্র তাকে সম্মান জানাতে পারি । নত হতে পারি তার কাছে, যে প্রকৃতই কল্যানের কাজে ব্রতী, এটুকুই ।




স্বর্ণেন্দু :

সুন্দর বলেছ, কৌশিকদা । এই বিষয়ে তোমার একটি লেখাও ছিল, মনে আছে আমার, লেখাটি খুব ভাল লেগেছিল । যাই হোক, কাজের শেষে সম্মান বা স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার আসে, তাই এসব কথাবার্তা প্রকৃত অর্থেই শেষের কথা, শেষ নিয়ে কথা । আমরা এখন শুরুর দিকে আছি, কবিতায় আছি, কবিতা নিয়েই কথা বলি চলো —


কৌশিক:

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন। এই যে কবিতার বিবর্তন, চর্যাপদ থেকে, বৈষ্ণবকাব্য, মঙ্গলকাব্য হয়ে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পেরিয়ে বিনয় গৌতম বসু বা চৌধুরীদের সময়ে এসে পৌঁছল বাংলা কবিতা, এবং এখন প্রবহমান, এই প্রবাহে সমকালীন ধারাটিকে কোথায় রাখবে? নিজেকে এর মাঝে কোথায় আবিষ্কার করতে চাও? কিছু বলবে?


স্বর্ণেন্দু :

প্রবাহ, প্রবহমান, ধারা এই শব্দগুলি মিলেমিশে, আমি একটি জলধারার ছবিকেই দেখতে পাচ্ছি এখানে । বাংলা কবিতার ধারা, বিরামহীন গতিতে এগিয়ে চলা একটি নদীর বয়ে যাওয়ার মতো, চর্যাপদের পদকর্তারা যেমন, একেবারে আমাদের সময়ের গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী প্রমুখ সে ধারায় সামিল রয়েছেন, তুমি বলেছ । তাহলে সমকালীন ধারাটিকেও তো সে প্রবাহেরই অন্তর্গত করে দিলে তুমি ! এখন সমকালীন ধারা বলতে যদি গৌতম বসু বা চৌধুরীর  পরবর্তী সময়ের লেখালিখির কথা বলতে চাও, তাহলেও আমি একই কথা বলব, যে এটিও সে প্রবাহেরই অন্তর্গত রয়েছে । তোমার এই প্রশ্নটি আমাকে এমন একটি ছবির সামনে পৌঁছে দিল আসলে ।

বাংলাকবিতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে জুড়ে থাকার সৌজন্যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমিও যে একেবারে ভাবিনি এমন নয়, কিন্তু আমার ভাবনার ছবিটি সামান্য আলাদা । সেখানেও প্রবাহ আছে, তার প্রবহমানতা নিয়েই আছে, ধারাও আছে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একটি জলধারা নেই, একাধিক, বলা ভাল যতজন কবির কথা আমরা ভাবতে পারি ঠিক ততগুলি জলধারাই এখানে রয়েছে । একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত হয়ে, একক ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যে যার নিজের পথটিকে গড়তে গড়তে, ভাঙতে ভাঙতে, এগিয়ে চলেছে । আজ আমার যা মনে হয়, কবিতার যাত্রা বা একজন কবির যাত্রা আসলে এক  নিঃসঙ্গতার যাত্রা, একাকিত্বের যাত্রা । এখানে রবীন্দ্রনাথ একটি জলধারা, জীবনানন্দ আর একটি, বিনয় মজুমদার আরও একটি, এবং এভাবেই গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী প্রমুখ, এক একজন এক একটি একক ও বিচ্ছিন্ন জলধারা, সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন নিজ নিজ লক্ষ্যে অবিচল  থেকে । জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে বইলেন, বিনয় মজুমদার তবুও কিছুটা জীবনানন্দমুখি বয়ে গেলেন, এবং এমন ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে, থাকবে । সময় যত এগুবে, প্রকৃত কবি যাঁরা সেই জলধারাগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠবে, বলা বাহুল্য যে, অন্যান্যগুলি ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকবে । কিন্তু এমনভাবে একটি বিন্দু থেকে উৎসারিত বিভিন্নমুখি জলধারার কথা ভাবলাম কেন ? ভাবলাম, কারণ এমনটি ভেবে নিতে পারলে, বাংলাকবিতার বিভিন্নমুখি স্বরগুলোকে যেমন সহজে চিহ্নিত করা যায়, তেমনই একটি নির্দিষ্ট সময়খণ্ডের মধ্যে যুগপৎভাবে উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট মানের কবিতা কিভাবে রচিত হতে পারে, এই দ্বন্দ্বটির একটি সহজ সমাধানে পৌঁছে যাওয়া যায় । জীবনানন্দ বাংলা কবিতার ভাষা, ভাবনা ও পরিধিকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন, বিনয় মজুমদার, আলোক সরকার, বীতশোক ভট্টাচার্য প্রমুখ যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন, তারপরে লিখতে এসেছেন এমন অনেক কবি, এইসব মহৎ কবিদের মাথার ওপর তুলে রাখলেন ঠিকই কিন্তু একইসঙ্গে লেখায়, ভাবনায় ও ভাষায় অতি তরল, অতি সাধারণ থেকে যেতে পারলেন সহজেই এবং এর জন্য কোনো আত্মপীড়াও অনুভব করলেন না, এমন একটি আপাত বিপরীতমুখি বাস্তবকেও মেনে নিতে আর অসুবিধা হয় না তখন । এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়, যে কোনো একজন মহৎ কবি আসলে একজন ব্যর্থ কবিও । যে দায়বোধ থেকে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নতুন করে তুলতে চান, অনুসরণীয় করে তুলতে পারেন, সেই দায়বোধ, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন না সহজেই । তাঁর লেখা নয়, তিনি, তাঁর এই দায়বোধ, খুব কম ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় হয়ে ওঠে, বা হয়ে ওঠে না বললেই চলে, তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ থেকে যান । তাই বাংলা কবিতা, বা বিশ্বে যে কোনো ভাষার কবিতার বিবর্তনকে একরৈখিক, সদা অগ্রসরমান কোনো সরলরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভবপর নয় বোধহয় ! 

বাংলা কবিতায় আমার নিজের অবস্থান নিয়ে আমাকে নিজেকেই বলতে বলছ ? শুধু এটুকুই বলতে পারি, তা বলার মতো সময় এখনও তৈরি হয় নি । যে বিন্দুর কথা আমি আগে বললাম, যেখান  থেকে বিভিন্ন জলধারা উৎসারিত, আমি সে বিন্দুর মধ্যেই কোথাও একটা রয়েছি, নিজস্ব একটি পথ খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি, এটুকুই বলতে পারি ।     



কৌশিক:

খুব সুন্দর বলেছ স্বর্ণেন্দু। আরেকটা কথা বলে আমরা আপাতত শেষ করব। এই যে এত কবি। কেউ কেউ মুখ্য, আর সকলেই ত আমরা গৌণ।আবার এর মধ্যেই কেউ হয়ত ভবিষ্যতের মুখ হয়ে উঠবে। ইতিহাস অন্যদের মনে রাখবে না। সেই গৌণ আমাদের কী অবদান রয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায়? থাকছে কিছু? কী মনে হয় তোমার?



স্বর্ণেন্দু :

তোমার প্রশ্নের উত্তরে আসছি, তার আগে, একটু ঘুরে আসি । আমি একজনকে চিনি, যিনি এমন এক রাজনৈতিক দলের কর্মী, যে দলের প্রভাব একসময়ে থাকলেও, এখন তা অনেকটাই ম্লান । কিছু প্রাচীনস্বভাবী মানুষ নিজেদের বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে এই দলটি এখনও করেন আমাদের এই মফঃস্বল শহর এলাকায়, আমি লক্ষ্য করি, ইনি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন । দারিদ্র রয়েছে, নিজের একমাত্র মেধাবী সন্তানের চিকিৎসার জন্য সর্বস্ব খুইয়েছেন, তারপরেও তিনি নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের জায়গায় স্থির । একদিন সকালে দেখি, এই মানুষটি আরও সামান্য কয়েকজনের সঙ্গে, ক্ষমতাসীন সরকারের নানা অপকর্মের বিরোধিতায় একটি স্ট্রিটকর্নারে পরিবেশিত গণসংগীতে গলা মেলাচ্ছেন, যিনি মাত্র আগেরদিন সন্ধ্যায় অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত নিজের একমাত্র সন্তানকে দাহ করে ফিরেছেন শ্মশান থেকে ।

প্রশ্নটি আত্মজৈবনিক, কারণ ‘সকলেই তো আমরা গৌণ’, বা, ‘সেই গৌণ আমাদের কী অবদান—’ এই পর্যবেক্ষণ ও আত্মজিজ্ঞাসায় ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ শব্দদুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । আজীবন যে কাজটার জন্য আমরা নিজেদের উৎসর্গ করি, বা যে কাজটা নিয়ে থাকি, তার আদৌ কোনো তাৎপর্য থেকে যাচ্ছে কিনা, এমন একটি সংশয়, মনের অবচেতনে হলেও ক্রিয়াশীল থাকে । সন্তান যেমন জন্মদাতার পরিচয়কে বহন করে, এই কাজটির মধ্য দিয়ে আমি থেকে যাব কিনা, কাজটির প্রতি যেভাবে সততা ও আন্তরিকতা থাকে, এই সংশয়টিও সমভাবে ক্রিয়াশীল থাকে । এইটির মতো, যে কোনো আত্মজিজ্ঞাসার আশু সমাধানে পৌঁছে যাওয়া প্রায়শই একটু জটিল, কারণ নিজেকে নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে যা-কিছু ভাবনা আমাদের, সেগুলি বেশিরভাগ সময়ই সংশয়ে আচ্ছন্ন ! আর তখনই, আপন হতে বাহির হয়ে বাহিরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যদি সামান্যও একটু দিশা পাওয়া যায় !  

এই যে মানুষটির কথা বললাম আমি, তিনিও আসলে একজন গৌণ-মানুষ ! ইতিহাস লেখা হবে, এখনের রাজনীতি আগামীর ইতিহাস-পাঠকের পড়ার বিষয় হবে, তারপরেও এই মানুষটি কোনোদিনও ইতিহাস তো অনেক দূর, ইতিহাসের ফুটনোটেও উল্লেখিত হবেন না । এমন অনেক অসংখ্য গৌণ-মানুষ আবিশ্ব ছড়িয়ে রয়েছে । কিন্তু তা বলে, যে আদর্শ সততা আন্তরিকতা নিয়ে এই মানুষটি আজও বেঁচে থাকেন, নিঃস্বার্থভাবে আজও মানুষের কথা ভাবেন, পাশে দাঁড়ান, নিজের সীমিত ক্ষমতা ও পরিসরে এক-একটি আন্দোলন সংগঠিত করেন,  তার কোনো অবদানই কি থাকবে না ?  এই প্রশ্ন নিজেকে কর, এর একটি উত্তর পাবে, সেখান থেকে আবার নিজের প্রশ্নে ফিরে এস, উত্তরটাকে মিলিয়ে নাও ।

আসলে যে ইতিহাস রচিত হয়, সমাজ-রাজনীতি-সাহিত্য সবক্ষেত্রেই, তা মূলত ‘ঘটনা’-র ইতিহাস, ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে, কখনো ব্যক্তিকে কেন্দ্রে রেখে, অবদানের কথা আসে সেখানে । কিন্তু লিখিত হওয়া উচিত ছিল তো ‘অবদান’-এর ইতিহাস, তাই নয় কি ? অবদানকে কেন্দ্রে রেখে, ব্যক্তি বা ঘটনার কথা উঠে আসবে সেখানে ! এভাবে, অবদানের ইতিহাস লেখা হলে, ইতিহাস রচনার খোলনলচেই বদলে যাবে হয়তো ! তখন তথাকথিত ক্ষমতাশীল, বিখ্যাত, এমন অনেকেই বাদ চলে যাবেন, এবং এইসব গৌণ মানুষজনের অনেকেই সেখানে এসে সহজেই ঢুকে পড়বেন । পদ্ধতি যেখানে একপেশে, একরোখা, সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ, সেখান থেকে বড় কিছু আশা করা উচিত নয়, তা নিয়ে ভেবেও সময় নষ্ট করা উচিত নয় ।

কবিতা আমাদের সঙ্গে আছে বলে জীবনটা এখনও একঘেয়ে বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি বরং মূল্যায়িত হতে পেরেছে । এই লেখালিখির কারণে তবুও কিছু বড় মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি, বন্ধু পেয়েছি, বন্ধু হয়েছি, এটাই তো অনেক ।  


কৌশিক:

হ্যাঁ, স্বর্ণেন্দু। একদম তাইই। আমি আরেকটা কথা ভাবি, প্রকৃত অর্থে কবি, তথা সাধক, এক শতাব্দীতে অল্পই জন্মান। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ,  জীবনানন্দ, বিনয় এরকম যারা,  পথ প্রদর্শক। যারা একটা ভিন্ন মার্গ দেখান ভিন্ন ভিন্ন সময় কালে। বাকি রইলাম আমরা, যারা সেই সেতু বন্ধনের কাঠবেড়ালি। অল্প সাধ্য অল্প শক্তি নিয়ে বয়ে চলেছি বাংলা কবিতার ধুলো।  যা কিন্তু কম নয়! আবার বেশিও নয়। কিন্তু বড্ড প্রাণের কাজ। একজন কৃত্তিবাস থেকে একজন মাইকেলের মাঝে রয়ে গেছে অসংখ্য গৌণ কবি।  তারাই ধারক, যারা না থাকলে, ভাষা প্রকৃত অর্থে মৃত্যুর দিকে যায়। খুব ভাল হল তোমার সঙ্গে কথা বলে। অনেক ভালবাসা। ভাল থেকো। 


স্বর্ণেন্দু :

সত্যিই প্রাণের কাজ এটি আমাদের, খুব সুন্দর বললে তুমি । যাইহোক, কথায় কথায় অনেক বিষয় উঠে এল, ভাবলাম সেগুলি নিয়ে, তুমি ভাবনাগুলি উস্কে দিলে, আমারো ভালো লাগল কৌশিকদা । তুমিও ভালো থেক, ভালোবাসা ।