মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

লাল দোপাট্টা মলমল কা : এণাক্ষী রায় (একটি ছোটগল্প)

লাল দোপাট্টা মলমল কা

ম্যাকোর বাড়ির মেয়েদের দু’পয়সায় সূর্য ঠিকরে যেতে যেতে বুকের ওপর নেমে আসে দু’দুটো চাঁদ। সুদ কষার অঙ্ক থেকে আতঙ্ক ছড়ালেও, অঙ্কবইতে মাসিক শব্দটি ঘিরে গোল দাগ পড়ে নটরাজ পেন্সিলের। টুং টুং শব্দে সাইকেল বেজে যায়। ঠাকুর ঘরের ঘণ্টাধ্বনি থেকে আলাদা সেই শব্দের ওপর ম্যাকোর গলা চড়ে। বজ্জাত, খচ্চর, বোকাচোদা।
ওরা চার বোন, চার সুন্দরী। সীমা, রিনা, শীলা আর নীলা।

রূপছায়া সিনেমা হলে একের পর এক রূপকথা খুলে যায় ব্যালকনির পাঁচসিকার টিকিটে। লাভ স্টোরির কুমার গৌরবের আদল যেন চোখে মুখে মেখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বেপাড়ার ছেলেরা। ম্যাকোদের বাড়ির দাওয়ায় সাইকেল নিয়ে আসে কুমার গৌরব। শীলা নীলা দুজনের মধ্যেই একঢাল চুলে বিজয়েতার ছায়া, বড়দি সীমা ওরফে রেখার মুখে ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন, তার প্রত্যেকটি বোরোলীনের ফোঁটার নিচে একেকটা ব্রণর আভাস লুকানো থাকে মুখ জুড়ে। শীলা কিম্বা নীলার চলাচলের পথে লাল রঙের নিচু সাইকেলে কানে ওয়াকম্যানের তার-গোঁজা কুমার গৌরবের ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে। সাইকেলটা দেখতে দেখতে হেলিকপ্টার হয়ে নেমে আসে মাঠ ঘাট পেরিয়ে শীলা নীলাদের দাওয়ায়। ম্যাকো চেঁচায়। লাভস্টোরি লাভস্টোরি। নদীর ধারের ভ্রমণে বিজয়েতার পিঠে গেঁথে যাওয়া কাঁটা মুখ দিয়ে তুলে নেয় কুমারগৌরব। শীলার মিষ্টি মুখের দিকে অপলক চাইতে চাইতে বলে –
এক হাতকড়ি মে বান্ধুঙ্গা তুঝে।
ঘাড় কাত ক’রে মিষ্টি হেসে বিজয়েতা বলে –
ফির?
- ফির হাম দোনো কো কোই আলগ নেই কর সাকতে।
- দুনিয়া বড়ে জালিম হ্যায়। চলো ভাগ চলে।
- চলো
দুহাত বাড়িয়ে বিজয়েতা দৌড়ে আসে
- ম্যায় আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি আয়ি
- আ যা। কুমারগৌরব হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় শূন্যে।

রূপছায়া সিনেমাহল থেকে বেরিয়ে আসা একেকটা মুখে তখন রূপকথা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ভোরের শিশিরের মতন। ন্যাপথলিনে মোড়া সোয়েটারগুলো রোদে বেরতে না বেরতেই শীলার রঙবেরঙের পঞ্চতে রোদ্দুরের ওম লেগে যায়। কুমার গৌরবের নিচু লাল সাইকেল হেলিকপ্টার হয়ে তখন বাতাসে। শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়া আর আটকাতে পারে না কেউ।

শীলার বিজয়েতা হয়ে যাওয়ার খবরের পর, বড়দির ফোঁটা ফোঁটা বোরোলীন শুকিয়ে গেলেও একাধিক অমিতাভ বচ্চনরা ভিড় ক’রে থাকে। বড়দির কোঁকড়ানো ঘাড় অব্দি চুল, সাপের ফণার মতো রোদ মেখে নিলে। কমলালেবুর খোসা ছাড়ায় একেকজন অমিতাভ। দেখা এক খোয়াব কি হ্যায় সিলসিলে হুয়ে পার হয়ে খুন খারাপি রঙ ছুঁয়ে দেয় ভরাট গলার গান, রঙ বরসে ভিগে চুনারিবালি রঙ বরসে...

শীতকালীন একঘেয়ে বৃষ্টিতে আকাশ বাতাস জুড়ে অন্ধকার নেমে এলে নীলার মনখারাপে বেতাবী রঙ লেগে যায়। টুংটুংওয়ালার ছেলেটা অনেকটা সানি দেওলের মতো তাকায় আজকাল। বিজয়েতা থেকে অমৃতা সিং হতে হতে পার করতে হয় মাত্র দুটো বছর। পাহেলগাওঁয়ের খামারবাড়ি থেকে সাঁ ক’রে নেমে যাওয়া নদীটা নেমে আসে পলাশতলির মাটিতে। চিলেকোঠার ওপর থেকে, আ যা আ যা বলে চিৎকার করলে, তিন বার ফিরে আসে বাতাস, সেই সঙ্গে কানে আসে টুং টাং ধ্বনি।
টুংটুং টুংটুং শব্দ হলে নিজেকে আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখা যায় না।। টুংটুং করতে করতে শব্দটা এক সময় থেমে যায়। তখন যেন একটা স্বস্তি, কিছুটা সময় পেয়ে যাওয়ার। শব্দটা আবার সচল হতে হতেই দৌড় দৌড়। পৌঁছনো চাই শব্দের কাছে। ঠিক ঠাকুরঘরের বড় পিতলের ঘণ্টাটার মতো এর ঘণ্টাটা। দুপুরগুলো পলাশতলি রোডের মতো দীর্ঘ হয়ে যায় ছুটির দিনগুলোয়। ঠিক সেই সময় ঘণ্টার শব্দে পূজাপার্বণের কথা মনে পড়ে না। চারদিকে কিরিকিরি করা গোল সূর্যের মতো দু’পয়সা, ছ’কোণা তিন পয়সা, পেলেই দে ছুট। কদাচিৎ চারকোণা পাঁচ পয়সাও পেয়ে গেলে, হাতে স্বর্গরাজ্য এসে ধরা দিয়ে যায়। সেই পবিত্র ঘণ্টাধ্বনি থামিয়ে দিতে দু’পয়সার সূর্যালোকই যথেষ্ট।
ঘন্টাওয়ালা মাথা থেকে নামায় কাচের বাক্স। ঘাড়ের থেকে নামিয়ে আনে বাঁশের মোড়ানো স্ট্যান্ড। সেটা অদ্ভুত কায়দায় খুলে যায় মোড়ার মতো। তার ওপর সেই বাক্সটা। বাক্সটার মাথার ওপর বসানো লোহার শিকে গোঁজা সাদা কাগজের টুকরোগুলোই আসল। দু’পয়সায় দুটি কাগজ ছেঁড়ার অনুমতি পাওয়া যায়। দু’পিঠ- সাদা সেই কাগজগুলো ভেজানো হয় বাক্সের ওপরেই। বোতল থেকে সামান্য জল ছিটিয়ে তার ওপর চেপে ধরলেই ফুটে ওঠে সংখ্যা। ১ ২ ৩ ৪। যার যত সংখ্যা, তার হাতে ঘণ্টাওয়ালা ধরিয়ে দেবে ততগুলোই ঢ্যাপের মোয়া। হাল্কা, ফুরফুরে, মিষ্টি। ম্যাকো চেঁচায়। এমা দুই দুই দুই। এমা তিন তিন তিন। ম্যকো চেঁচায়। খচ্চর, তুই খচ্চর, বোকাচোদা। ঘরের পাশে ওদের কাঁচা নালায় পেচ্ছাবের গন্ধ বাতাস ভারি ক’রে রাখে। টুংটুংওয়ালার চোখে সানি দেওলের হাসি।
- জিনে কে লিয়ে দো বখত কে রোটিই কাফি। আগর পেয়ার হ্যায় তো সমঝ সব কুছ হ্যায়।
- ফির ভি তুম বড়ে বাপ কে বেটি। মেরে পাস কুছ ভি নেহি হ্যায়। সোচ লো।
- পেয়ার দৌলতসে নেহি বনতি। মেরি জান।
- চলো সাদি কর লে
- চলো।
নদীটায় সরাৎ করে নেমে যাওয়া কাঠের পাটাতনে খুলে রাখা থাকে জামা কাপড়, দোপাট্টা। সাঁতার-পোশাক পরে নদীতে নামে অমৃতা সিং আর সানি দেওল।

ভেঙ্গে পড়া জমিদারি থেকে অবশ্য কোনও হুংকার আসে না আমজাদ অথবা শাম্মি কাপুরের। সেখানে চুরুটের বদলে, পড়ন্ত জমিদারির ধিকি ধিকি আয় থেকে বেরিয়ে পড়তে থাকে নিষ্ফল ধোঁয়া। পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দেওয়া দুই পুরুষের বদহজমের ঢেকুর তোলে একতলা বাড়িটি। সবটাই যেন গা-ছাড়া। স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া সংস্কার, রুচি, শালীনতা।
মেজদি রিনার চকচকে ফর্সা মুখ থেকে আলো পিছলে পড়ে। গালের কালো আঁচিল সে-আলো বাড়িয়ে দেয় হাজারগুণ। রিনার আঁচিল ঘিরে সারাদিন ভিড় করে লোকজন। সেখান থেকে কয়েকটি তির তুলে নেয় বড়দি সীমা। আরও দু’একটি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ে যায়। রিনার সুদূর নিমগ্ন গান বেয়ে উঠে আসতে গিয়ে পিছলে পড়ে কেউ কেউ। সুরের রেশ তার কালো চুলের মতো এলো করে দেয় রিনা। তার চোখে স্বপ্ন লেগে থাকে। মাটির অনেক ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে সে সুরের কাছে পৌছে যায়। এক এক সকালে ঘিরে ধরে আলো। নীল মেঘের ফাঁক দিয়ে বরফের পাহাড় দেখা গেলে মনে পড়ে, ওরা কোনও দিন শহরের গণ্ডি পেরয়নি। মেজদি রিনার ওই পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কোনও অমিতাভ মিঠুন নয়। সে অপেক্ষায় থাকে রাজপুত্তুরের। তার যাবতীয় প্রেম ঘনিয়ে ওঠে ম্যাকোকে ঘিরে। ম্যাকো ডাকে খেতে দে খেতে দে। রিনার আদরে আদরে বিপর্যস্ত ম্যাকো বলে খচ্চর। খচ্চর শব্দটা দু রকম করে বলতে পারে ম্যাকো। প্রেমে আর রাগে। কাউকে বলে দিতে হয় না কখন কোনটা।

এই সব সত্যি ঘটনাগুলো পরপর সাজালেও যে- ছবিটা স্পষ্ট নয়, সেটা হল পড়ন্ত এক জমিদার বাড়ির সিঁদ কেটে ঢুকে পড়া অসহায়তা। বিষদাঁত ভেঙ্গে নেওয়া সাপের মত এ-বাড়ির পুরুষেরা একের পর এক জমি বিক্রি করে যায়। একটু একটু করে নিঃশেষ হতে থাকে একটা প্রজন্ম। জমিদারবাড়ির ছেলেরা বাসের কন্ট্রাক্টরি করে। কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। কাঠের চুলায় ভাত চাপায় পড়ন্ত জমিদার গিন্নি। গিন্নির ফাঁদি নথ নাড়ানো তিরস্কার, ফসিল হয়ে যায়। সোনার সুতোয় কাজ করা পুরনো বেনারসি বিক্রি ক’রে কেনে লিপস্টিক, পাউডার। একেক খণ্ড জমি বিক্রির পর ওরা মাংস ভাত খায়, মাছ খায় পর পর সাত আট দিন। বাড়ন্ত চেহারাগুলোয় জৌলুস ওঠে। বড়দির পাতলা ঠোঁটে অন্য বাড়ির কনে সাজানোর আলো। বোরোলীনের ফোঁটায় দুপুরগুলো সাজিয়ে বসে মাঠে। উল বোনে। লম্বা ঝুলের সোয়েটার।
সাইকেল আরোহীরা সব শহরের বাইরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে। চার বছর পরপর বদল হয় মুখ। চার বছর পর পর নতুন আশ্বাস। বড়দি সীমার থেকে ক্রমশ বয়সে ছোট হয়ে আসে সাইকেল আরোহীরা। রিনারও বয়স ছাড়ায়। রাজপুত্তুরের জন্য অপেক্ষায় থাকে রিনা। তার কাঁধে চড়ে ঘোরে ম্যাকো।
সন্ধে থেকে আধো অন্ধকার হয়ে থাকে মফস্বলের পাড়াগুলো। নীলার বেতাবী মিটে যাওয়ারও পর একদিন। কয়ামত সে কয়ামত অব্দি দীর্ঘ হয়ে যায় কমলাপুর জঙ্গল। রিনার গানের রেশ আর দূরের আবছায়া পাহাড় মিশে যেতে যেতে কনকনে হিম পড়ে পলাশতলির মাঠে। একেকটা গানের সঙ্গে আছড়ে পড়ে একেকটা সময়। বায়স্কোপের চৌকো ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে পড়ে হারিয়ে যাওয়া একপাটি জুতো। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে পাহাড় স্পর্শ করিতে ইচ্ছে হয় রিনার। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সীমার প্রস্তাবে, কোনও এক সাইকেল-আরোহীর উৎসাহী অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলে– “যেতে পারি কিন্তু ও আমাকে টাচ করবে না!"

পাহাড়ে যাওয়ার আগে একটা একটা করে নদী পেরতে হয়। নদীর মনখারাপ থেকে শীতের সকালে উঠে আসে ধোঁয়া। সাদা গাউনের ওপর লাল দোপাট্টা জড়িয়ে চুল বাঁধে মেজদি রিনা। সকাল থেকে বিকেল একটাই রঙ হয়ে থাকে মেঘলাদিনে। যেন দীর্ঘ একটি বিকেল থেকে রাত নামে। অন্ধকার ঘনায়।
অন্ধকার ভালোমতো ঘনালেও ম্যাকোর চিৎকার চুপ করে থাকে। ওপাশের বাড়ির পুজোর ঘণ্টা থেমে যায়। এ-পাশের বাড়ির পরীক্ষার পড়া শোনা যায়। ম্যাকোর গালাগাল চুপ করে থাকে।
অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। সাইকেলের সমবেত ঘর্ষণ থেমে গেলে, মেয়েটি দৌড়াতে থাকে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে, নদীর চরটা যেন বড় বেশি দীর্ঘ। জলের কাছে পৌঁছাতে চায় মেয়েটা। জল সরেই যায় ক্রমাগত দূরে ...
নদীর ওই পারে আবছায়া পাহাড়ে তখন একটা দুটো করে জ্বলে উঠছে আলো।

দেহ ঘষ্টে ঘষ্টে রাত্রি নামে শুকনো কাশবনে। চারদিকে ভয়াবহ সব আওয়াজ। শেয়ালের ডাক। মেয়েটি আকাশের দিকে তাকায়। কত তারা আকাশে, কিন্তু কত দূরে। কোনও আলোই এই গভীর বনে এসে পৌঁছায় না। এক ফোঁটা আলোর জন্য মেয়েটা ঘষ্টে যায় নিজেকে। জলের কাছাকাছি, জীবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চায়।
আলো, আলো, অন্ধকারে শুধু আলোর কথা ভাবে। মাথার ওপরে কোনও চাঁদ নেই। সিগারেটের টুকরোগুলো জ্ব’লে-নিভে দূরে সরে গেছে। অন্ধকারের রঙ বদলায়। বদলাতে থাকে। জলের কলকল ধ্বনি তীব্র হয়। অন্ধকার থেকে ফুঁড়ে ওঠা কাশে আটকানো লাল দোপাট্টা ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ে মেয়েটির ওপর। ঝরে পড়ে একটি আলোক বিন্দুও।
স্পষ্ট হতে থাকে সেই মেয়ে। তার পরনের সাদা গাউন সাদা পতাকার মতো ঝুলতে থাকে শুকনো কাশবনে। দ্যাখে অনেক দূরের পাহাড়ের আলোকবিন্দুকে। আলো একটার থেকে আরও বিন্দু হয়ে যায়। দূরের পাহাড় থেকে উপড়ে আসা আলো হাজার হাজার জোনাকি হয়ে ঘিরে ধরতে চায় মেয়েটিকে। গোটা পাহাড়টাই আলো সমেত এগোতে থাকে যেন। কুয়াশা সরিয়ে সকাল এলে চোখে পড়ে ওর ফর্সা চকচকে গালে তীব্র কালো তিল, জোনাকির আলোর মতো জ্বলে উঠছে।
অনেকটা দূরে মফস্বল শহরে তখন ম্যাকোর সবুজ পালকে ছিন্নভিন্ন রোদ। পাশের নারকেল গাছের গোড়ায় ঘাড় মটকানো টিয়াটাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ায় সবুজ পালক উড়ছে। আর কাশবনে...
হাওয়ামে উড়তা যায়ে লাল দোপাট্টা মলমল কা। 

বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬

মাতৃমুখী (বাঁকড়ি ভাষায় লেখা একটি ছোটগল্প। কলেজস্ট্রীট পত্রিকায় প্রকাশিত)

মাতৃমুখী

কৌশিক বাজারী



আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ ।
সাইকেলে যেতে যেতে সারা পথ সে অং বং নানান কথা ভেবে ভেবে প্যাডেল ঘুরায়, শুকনা শীতের পথে লাল মিহি ধুলা উড়ে উড়ে যায় । তার হইলদা পাজামা আরঅ লাল হয়ে যায় বাঁকুড়ার মাটির আল-পথে , হাওয়াই চপ্পল মিহি ধুলায় ঢেকে যায় । পথ-জুড়ে আধ-মাইল লম্বা গরুর পালের মধ্যে পড়ে দিশাহারা হয়ে তার চুল পয্যন্ত ধুলায় মাখামাখি হয়ে যায় । সাইকেল ঠেলে লিয়ে কিছুদূর যায়, আবার চাপে,--এই হল তার পথ। ফাঁকা ধূ-ধূ দ্বারকেশ্বরের বালি ঠেলে ঐ পারে আরো পাঁচ মাইলটাক লাল-ধুলার পথ পেরিয়ে তবে পাকারাস্তা । সেই বড় রাস্তা ধরে আরঅ দু কিমি পথ পেরালে বিষ্টুপুর বাজার । ফাঁকা রাস্তায় হঠাৎ চেনা কেউ ডেকে তার সাড়া পায় নাই। লোকে তাকে আড়ালে বলে ক্ষ্যাপা। বলে; আটিস মানুষ । পঞ্চানন তখন আতাল পাতাল ভাবে , কি যে ভাবে, সে নিজেই জানে নাই। ভাবে; তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা, হারিয়ে যাওয়া বাপের কথা । ভাবে ; তারা কি আজঅ বেঁচে আছে! সেই তার দু-বছর বয়সে পালিয়ে যাওয়া মায়ের সামনে এই পঞ্চাশ বছর পর যদি দাঁড়ায় ? মা কি চিনবেক ? একটা বহুদিনের হইলদা হয়ে যাওয়া ছবি ছিল পালিয়ে যাওয়া মায়ের ফেলে যাওয়া টিনের তোরঙের ভিতর । বাপ আর মা। তারকেশ্বরে বেড়াতে গিয়ে ফটোঅলার কাছে তুলা ছবি । কাকি জেঠির সংসারে, তাদের মাটির বাড়ির উপরের কোঠার জঞ্জালের ভিতর হঠাৎ আবিস্কার করা সেই ফটো, লুকানো অতীতের অন্ধকার ছায়ায় সে লুকিয়ে দেখেচে অনেকদিন। কল্পনায় সেই হলুদ হয়ে যাওয়া ঝাপসা মায়ের মুখটায় দেখে সে ।

পঞ্চানন কর্মকার, তার বাপের দিয়া নাম । এখন তার বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে যায় । পঞ্চাননের বাবারা তিন ভাই , তাদের কামারশালে লোহার কাজ ছিল নাই । ছিল কাঁসার কাজ। কাঁসার চাকতি আসত বিষ্টুপুরের গোলাদারের ঘর থেকুন । তারা অর্ডার দিত কাঁসার বাসনের । বাসন বলতে শুধু থালা । কাঁসার চাকতি পিটিয়ে থালা বানানো ছিল তাদের ঘরোয়া ব্যাবসা । পঞ্চাননের বাবা কাঙাল কামার ভাইদের মধ্যে মেজ । থালা তৈরি হয়ে গেলে থালার চারপাশে ফুল, লতা, পাতা আঁকা ছিল তার কাজ, এই কাজটা গাঁয়ে তার মতন আর কেউই পাত্তো নাই, উসব হাতুড়ির ভোঁতা কাজ তার পোষাত নাই, বিষ্টুপুরের বাজারেও কাঙাল কর্মকারের মিনা করা লাল-কালো ফুলকাটা থালার আলাদা কদর ছিল সেকালে। কামার পাড়ার অন্যরাও থালা বাটি বাসন-কুসনের আঁকা-জুকার কাজটা কাঙালকে দিয়েই করাতো। সবাই জানত কাঙাল একজন আটিস –সে থালায় ফুল কাটে, আর সইন্ধা হলেই তার দল বল লিয়ে চলে যায় দ্বারকেশ্বরের চড়ায়, শ্মশানকালীর মন্দিরে। সিখেনে তাদের মজলিশ বসে । কেত্তন গায় কাঙাল, তখন সে রাধা। কীষ্ট-ভাবে ভিভোর । তার সংসারে মন নাই । বৌ-টা দু বছরের ছেলাটারে রেখে সেই যে চলে গেল্যাক, তারপর থেকে কাঙাল উদাস হয়ে গেল আরঅ, ফুল-লতা-পাতার আড়ালে কাঙাল বৌ-এর মুখ আঁকত, ল্যাংটা ছেলাটা পাশে বসে বসে দেখত বাপের হাতের অস্তাদি। মাতৃমুখি ছা-টা কে দেখলে ভিতরটা হু-হু করে উঠত কাঙালের...। সেই ছেলা-- পঞ্চানন কর্মকার ।

উসব বহুদিনকার ঘটনা, পঞ্চাননের আবছা মনেও পড়েনাই আর । কাঁসার বাসনের দিন-কাল আর নাই । পঞ্চানন যখন ইস্কুলে, তখনি বাপটা বিবাগী হয়ে গেল । জেঠি খুড়িদের হাতে মানুষ। কাকা কিছুদিন পয্যন্ত ব্যাবসাটা চালিয়ে ছিল, এখন কাকার এক ছেলা টুকটাক কাজ করে, তবে শুধু কাঁসার কাজে আর ঘর চলে নাই , সাথে একটা পানের গুমটি চালায় । ইস্টিলের বাসন বাজারে আসার পরে পরেই কাঁসার বাজার নামতে নামতে শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু বিয়া, মুখেভাতের কাজঘর ছাড়া আর কাঁসার বাসনের কাটতি নাই । পঞ্চানন বাপের হাত পেয়েছিল, সেও আটিস। বিষ্টুপুর বাজারের মডান-আট-এ কাজ করে সে । সাইনবোড় আঁকা, ঘর সাজানো, বিয়াঘরের গাড়ি সাজানো ইসবের কাজ। সাইনবোড়ে মেয়া মানুষের ছবি গুলান পঞ্চাননের হাতে খোলতায় হয় ভাল, মালিক ছকরা তাকে দিয়ে ইসব কাজ গুলানই করায় । তা এইসবে তার চলেও যায় । ঘর-উঠান ভাগ হয়ে গেছে বহুদিন, তার বাপ যিখ্যানে কাঁসার থালায় ফুল কাটত বসে, সেটা এখন কাকার ছেলার ভাগে । একফালি ভাগের ঘরের লাগোয়া পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনি দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে লিয়েচে পঞ্চানন। একটায় ছেলা দুটা লেকাপড়া করে, লোকজন এলে বসতে দেয়, সে আর তার বৌ অন্যটায়, রাত্তে ঘুমায় । পঞ্চানন সকালে বেরিয়ে যায় সাইকেল লিয়ে বিষ্টুপুর ।

আজ নদীর নামোতে এসে পঞ্চানন দেখে পূব আকাশে সাঁজ-বিকালের পারা একটা লাল মেঘ । লালমেঘ বিকালের মতন ক্যানে !! ভাবতে ভাবতে পঞ্চাননের মন খারাপ হয়ে যায় । তার এই স্বভাবের জন্যি বৌ তাকে খোঁটা দেয়, বলে; মেয়ালি পারা লোক । অথচ তার এই মন খারাপটা সত্যি। হয়ত অকারণ, তবু পঞ্চানন সাতসকালে একটা ভর-ভত্তি বিকালের মনখারাপ লিয়ে নদীর নাবাল থেকে উঠে আসে...


***


উত্তরের দ্বারকেশ্বর থেকে সোজা উঠে এসে যে রাস্তাটা বিষ্টুপুরের ভিতর ঢুকেচে, ছোটো নদীর পুল পার হয়েই সেই রাস্তায় একটা চৌ-মাথা। এটা সোনামুখী মোড় । চা-দোকান, সাইকেল সারাই , ট্রাকের গ্যারাজ আর ট্রাক-ড্রাইভারদের লাইন-হোটেলে জায়গাটা সকাল থেকেই ভীড় হয়ে থাকে আজকাল । পূবে কইলকাতা ১৫০ কিমি, পশ্চিমে বাঁকুড়া সদর, উত্তরে সোনামুখী,দূর্গাপুর আর দক্ষিণে সোজা বিষ্টুপুর বাজার মাত্র ২কিমি । দ্বারকেশ্বরের দিক থেকে যে লোকটা সাইকেলে আনমনে রাস্তা পার হচ্ছিল, সে দেখে নাই কিছুই, কইলকাতার দিক থেকে একটা ট্রাক রাস্তার মাঝ বরাবর তার সাইকেল ঘেঁষে পার হয়ে পশ্চিমে বাঁকুড়ার দিকে চলে যায় ধুলা উড়িয়ে। চা-দোকানের , লাইন-হোটেলের, সাইকেল-সারাই-এর লোকজন হৈ-হৈ করে ওঠে । মোড়ের শিরিশ গাছের মাথায় বসে থাকা একটা ধূসর কাক তার রোজকার অভ্যস্ত উপর-তলা থেকে দেখে; লোকটা ঘাবড়ে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার মাঝ-বরাবর, আর লাল ধুলা-মাখা পিচের উপর নিপাট পড়ে যায়। কাকের দল কা-কা- হাহাকারে উড়ে যায় মিনিসিপালটির ভাগাড়ের দিকে। লোকজন দৌড়ে এসে তাকে ধরা ধরি করে হোটেলের দড়ির খাটিয়ায় শুয়িয়ে দেয়, জলের ঝাপটা দেয় মুখে, লাল ধুলা মাখা পা ধুয়িয়ে দেয় একজন, মাথায় কপালে জল দেয় , তার ভিজা মাথার চুল থেকে লাল ধুলা মাখা জল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা । লোকটা নড়ে না । তার বুকের হাপর নড়ে না । এমন সময়, সকাল আটটায়, তার মাথার উপর একটা লাল সাঁজ-বিকালের মেঘ নদীর দিক থেকে এসে থামে। তার মুখ গম্ভীর । থমথমা... ।

......


বিষ্টুপুর মহকুমা হাসপাতালে আনা হলে গম্ভীর ডাক্তার বাবু বুকে নল ঠেকিয়ে সামনের ভীড়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়; বাড়ির কেউ আছেন ? -- কেউ নাই । পকেটে কাগজ-পত্ত কিছু পাওয়া গেছে ?—উত্তর নাই... ।
এরপর একটা অজ্ঞাতপরিচয়-লাশ হতে হতে শেষবার ঘুরে দাঁড়ায় লোকটা...
শিবপদর ভাইরাভায়ের পেটে পাথর । হাসপাতালে ভত্তি আজ তিনদিন। হাসপাতালের সামনে বটতলে বসে সে বিড়ি টানছিল। কৌতুহলে ভীড়ের দিকে উঘু মেরে চমকে উঠে শিবপদ । ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে, চেঁচিয়ে উঠে ; পঞ্চানন ! ইত আমাদের গাঁয়ের পঞ্চানন-আটিস !
ডাক্তারবাবু চশমার ভিতর থেকে বলেন; ফোন আছে? বাড়িতে খবর দিন একটা, আর আমার সাথে আসুন...
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ বুক-পকেটের দড়ি বাঁধা মোবাইল ফোন বার করে পঞ্চাননের কাকাতো ভাই নিতাই কর্মকারকে ফোনে ধরে ।
আটিস-পঞ্চাননের খবরটা আধ-ঘন্টার ভিতর গাঁয়ে চাউর হয়ে যায় । একটা প্রায় অজ্ঞাতপরিচয় হতে যাওয়া লাশ তার বৌ, ছেলা আর গাঁয়ের-লোকদের ফিরে পায় আরবার।

.......

--ভালকরে দেখ , চিনতে পার ?

বিষ্টুপুর হাসপাতালের বারান্দায় কুকুর আর রুগীর লোকজনের ভীড় যাতায়াতের পাশে টিনের স্টেচারে শোয়ানো ময়লা সাদা কাপড়ে ঢাকা মুখটা খুলে দেয় লোকটা । ঘাড় হেলে আছে একপাশে । মাথায় চুলে লাল ধুলা মাখামাখি । কপালের পাশে জল শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে । সমীর দেখে তার বাবার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিলটা ঠিক সেরকম, যেমন বাবা ঘরে ঘুমিয়ে থাকার সময় । তার ভিতরটা আবার হু-হু করে ওঠে । চোখ ঠেলে জল বেরিয়ে আসে ... কোনো কথা না বলে সে তার বাবাকে সনাক্ত করে ।

--নাম কি ?
--সমীর কর্মকার।
--বাবার নাম ?
--পঞ্চানন কর্মকার ।
--বয়স ?
--??
-- বাবার বয়স কত হইছিল ?
-- ৫৩-৫৪ ।
-- আর কে কে আছে ঘরে ?
সমীর পাশে দাঁড়ানো ইস্কুলে পড়া ছোটো ভাই ছোটনকে দেখায় । বলে; ঘরে মা আছে ।
হাসপাতালের ক্লার্ক চশমা তুলে একবার সামনের ভীড়টার দিকে দেখে লেয়।
--এদের সঙ্গে বড় মানুষ কে আছে ?
-- এই যে স্যার..
পঞ্চায়েতের কেরানি শিবপদ এগিয়ে আসে ।
--শুনুন, লাশ ফাড়াই হবেক, তারপর ডাক্তার বাবু সাট্টিফিকেট সই করবেক। অপঘাতের মড়া, বুঝতেই ত পাচ্ছেন, থানার সাট্টিফিকেট লিয়ে আসবেন। তবে বডি পাবেন । এখন ঘরে চলে যাওয়ায় ভাল, সবাইকার থাকার দরকার নাই । আর সব ঠিকঠাক হলে কাল সকালেই বডি পেয়ে যাবেন । এই যে দাদা, আপনি ইখেনে একটা সই করুন ত...


সমীর কলেজে পড়ে । ভাত খেয়ে সকাল সকাল রেডি হচ্ছিল। বেলার দিকে খবরটা পেয়ে তার অসাড় পা-দুটা কাঁপছিল বাবুই পাখির মতন, দাঁড়াতে পারছিল নাই । ঘর-ভিত্রে মা বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল । কাকিমা সারাক্ষণ মায়ের পাশেই ছিল। শিবপদকাকা আর নিতাইকাকা বাইরেটা সামলেছে । সে আর ছোটন সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে । এখন নিজেকে অনেকটা সামলে লিয়েছে সমীর, যেন্ এক বেলাতেই সে অনেকখানি বড় হইয়ে গেছে...। ছোটনের সবে আট কেলাস । তার শুকনা চোখ দুটা ফুলে আছে অবেলায়। ভায়ের দিকে তাকাতেই সমীরের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে আবার...



***


...সে নদীর নামোতে এসে আজো একবার উপ্রের দিকে চায় । ভাবে, এই পথেই কি তার ঘর ? রাতের কালো আকাশে ইধার থেকে উধার অবদি সাদা ধুঁয়ার মতন ছায়াপথ । প্রথম শীতের পরিস্কার আকাশটা তারায় ছেয়ে আছে । নদীর সরু জলের ধারা পা ডুবিয়ে পার হয় । উপারে গাঁয়ের আলো দেখা যায় বিন্দু বিন্দু । আজ কি একটু দেরী হয়ে গেল ? ঠান্ডা জলে পায়ের চেটা ডুবতেই শরীরটা কেমন হালকা হইয়ে যায় তার । সে ভাবে, মরণের পর শরীরের আর কুনু ভার থাকে নাই... নিজের ভাবনায় সে নিজেই ভয় পায় ।

রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে । গ্রামদেশে শীতের সাড়ে আটটা অনেক রাত । গাঁয়ের রাস্তার উপরে নিমতলার চাতাল, সিমেন্টে বাঁধানো । বহু পুরনো বিশাল নিম গাছটার ডাল-পালা মেলা ঝাঁকড়া মাথা অন্ধকার হয়ে আছে । নিমায়ের সদরের ডুমবাতির আলো এসে পড়েছে পথ পেরিয়ে নিমতলা চাতালে । সেই আধো-অন্ধকারে কামার পাড়ার লোকজন, শিবপদ, গাঁয়ের আর কয়েকজনের একটা দল বসে ছিল, তারা কেউ পঞ্চাননের কথা ভাবছিল, কেউ মানুষের অন্তিম নিয়তির কথা ভেবে নিঝুম বসেছিল, কেউ শুধুই বিড়ি টানছিল। সমীর একবার ওদের চা দিয়ে গেছে কিছু আগে । শিবপদ প্রথম লক্ষ করে লোকটাকে , সাইকেল থেকে নামছে , সেই ধুলা মাখা গা, লালচে হয়ে যাওয়া পাজামা, ধুলি ধুসর পা। ঘরে ঢুকার আগে একবার নিমতলার জটলার দিকে অবাক হয়ে চায় লোকটা, রাস্তার আলোয় তার ডান ভুরুর উপরে কালো আঁচিল দেখা যায়! পঞ্চানন ! শিবপদ থমকায়, যারা বসেছিল সহসা উঠে দাঁড়ায়, যে লোকটা বিড়ি টানছিল তার হাত পুড়ে যায় –পঞ্চানন ! নিতায়ের সদরের ডুমবাতি হাওয়ায় দপদপ করে উঠে কেরাসিন লম্ফর মতন নিমে যায়, আবার জ্বলে উঠে । শিবপদর গলার রা বন্ধ হয়ে গেছল, কুনু রকমে বলতে পারে-পঞ্চাদা ! এইসময় সমীর দুয়ারের বার হতে যেয়ে সামনে পঞ্চননকে দেখে প্রথমত কাঠ হয়ে যায়, তারপর বাবা বলে মাটিতে বসে পড়ে ।ঘরে ভিতরে ততক্ষণে খবর গেছে, সমীরের মা, পঞ্চাননের বৌ পাগলের মতন আধখুলা কাপড়ে সদরদুয়ারের চৌকাঠে এসে বসে পড়ে –আর এসব দেখে রীতিমত বিরক্ত ও ক্লান্ত পঞ্চানন ক্রমশ আরো ক্লান্ত হয়ে ওঠে।

আজ সকালে বিষ্টুপুর বাসস্ট্যান্ডে সাইকেল রেখে সে গেছল বাঁকুড়া সদর । কেরাণীবাঁধ বাইপাশে একটা ওয়ালিং এর কাজ ছিল । দুতলা ঘরের দেয়ালে শাড়ির দুকানের বিজ্ঞাপণ। মিনুশাড়ি পরা মেয়া-মানুষের দুতলা সাইজের ছবি । তিনদিনের কাজ । আটিস পঞ্চানন ভেবেছিল আজ আউট-লাইনটা সেরে রাইখবেক । দেরী হল একটু, দুটা বাস মিস্। এর মধ্যে কি এমন হল সে ভেবে তল পাই নাই...।

দিনভর উপাসী, চোখ-মুখ কালো হয়ে যাওয়া পঞ্চাননের বৌ খুব মিহি সুরে জিগ্গাসে
—‘হ্যাঁ গা, তুমি ফিরে আসতে পাল্লে থালে? ফিরে আসা যায় সিখ্যান থাকতে!’
পঞ্চানন রাগে, দুখে: বৌ-এর দিকে চায় ।


......


পঞ্চানন সমস্ত শোনে আর অবিশ্বাসে, ভয়ে, শিহরণে কেঁপে কেঁপে ওঠে । সমীরের দিকে ফিরে অস্ফুট ধমকের মতন বলে ; নিজের বাপ কে চিনতে লারলি আজ পয্যন্ত... !
শিবপদ আর গাঁয়ের আরো যারা সঙ্গী ছিল তারা পঞ্চানন কে বোঝায়; উয়ার দুষ কিছু নাই, উ ত ছেলা-মানুষ, আমরাও ভুল কল্লম ক্যামনে, বুঝতে লারচি রে ভাই...।

***

.... এদিকে পঞ্চাননের ঘর থেকে অনেক দুরে, মহকুমা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের সেই লোকটা পুনরায় অজ্ঞাতপরিচিতির দিকে চলে যায় । সে তার ভুল সন্তান, বৌ, পরিজন আর গাঁয়ের লোকদের সঙ্গ হারায় । পরিত্যক্ত, দাবিহীন, নি:সহায় লাশ হয়ে শাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে আবার শুয়ে পড়ে , লাশকাটা ঘরের অন্য বাসিন্দারা পাথরের মতন চোখে চায়, তাদের চোখে অশ্রু নাই , শুকনা, বরফ...
...সার রাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকে ভোর-রাতে এই রকম একটা স্বপ্ন দেখে পঞ্চানন বিছানায় উঠে বসে । টিনের বালতি থেকে গেলাসে জল ডুবিয়ে খায় । সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও আজ তার ঘুম নাই চোখে । ভাবে; থাইলে কে সেই জন ? হুবহু আমারি মতন ? কুথা থেকে তার আগমন ছিল ? কুথায় বা গমন ? পঞ্চাশ বছরের জীবনে তার সাথে একবার মুখামুখি দেখা হল কৈ ? একবার কি দেখা হওয়া নিয়তি ছিল নাই ? তবে, সে কি আমিই ? সে আমি এখন কুথায় ? কুন সাদা কাপড়ের নিচে শুয়ে আছি কার অপেক্ষায় ?

আমার হারিয়ে যাওয়া মা কি তারও মা ? আমার বিবাগী বাপের খবর ছিল তার কাছে ?
সে কি আমার মাতৃমুখী দোসর কুন ?
মা কি জানে ? খবর পেয়েছে ?

পঞ্চানন উতলা হয়ে ভাবে; একবার যাওয়া দরকার । সেই মৃত অজ্ঞাতপরিচয়ের কপট অপরিচয় খুলে ফেলা দরকার । সে দরজা খুলে একটা অতিজাগতিক ভোরবেলার ভিতর বেরিয়ে আসে । দেখে ভোরের আকাশে সুয্যদেব উদিত হয়েছেন । এখন কুথায় তবে তিনি অস্তমিত ? সিখেনে কি সাঁজ-বিকালের পারা লাল মেঘ ছড়ানো রয়েছে ? সিখানে তার হইলদা, ঝাপসা, কীটে-খাওয়া কিশোরী মাতৃমুখের কাছে ফিরে আসছে তার মাতৃমুখী সন্তান । একটু উদাসীন, ক্ষ্যাপাটে, তার মাথার চুলে লাল ধুলা জলে মাখামাখি, কানের পাশ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে। মায়ের আঁচল মুছে দিবেক বলে তার ধুলা মাখা মাথা নিচু হয়ে আসে...
পঞ্চানন ঘুমন্ত বৌ আর ছেলাদের রেখে সাইকেল লিয়ে নদীর নাবালে নেমে আসে, তখন পুবদিক জাগ্রত হচ্চে , লাল হচ্চে আকাশ …