মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০২২

যখন আমি ছিলাম না কোথাও


যখন আমি ছিলাম না কোথাও





কৌশিক বাজারী



আমার বাবা বরাবর চা-দোকানি।

মাঝে একবার মুদি খানার দোকান দিয়েছিল। আমি যখন চার কেলাস তখনি সেই দোকান উঠে যায়। পরপর তিনবার চুরি হয় সেই দোকানে । একবার উপরের খোড়ো চাল সরিয়ে, একবার তালা ভেঙে আর একবার রাত্তিরে তালা না লাগিয়েই বাবা শুতে চলে গিয়ে ছিল । বাবা প্রায়ই রাত্তিরে দোকানে তালা লাগাতে ভুলে যেত। কখনো বেদম ঠাট্টার মতো তালার সাথেই সারারাত ঝুলে থাকত চাবির গোছা । আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বাবা কে নিয়ে আমাদের সামনেই হাসি ঠাট্টা করত । তবে এই দোকান বন্ধের কারণ হয়ত চুরি নয়।

   …দোকানে খদ্দের এসেছে, চার আনার পোস্ত আর আট আনার সরষের তেলের জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে । বাবা নেই । তিনি তখন মুদি-দোকান ছেড়ে বহুদূর পৃথিবীর উল্টোপিঠ কিউবায় । সেখানে অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে একজন সরকারি এ্যাটর্নি, ফিদেল কাস্ত্রো, একলা পথ হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছয় এক পার্কের ভিতর । বাতিস্তার স্বৈরশাসন উপেক্ষা করে অবদমনের চুড়ান্তে পৌঁছে সে হঠাৎই বিস্ফোরিত হয়, বাবা তখন তার ঠিক পাশটিতেই । এক পড়ন্ত বিকেলে পার্কের বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন তিনি, সমুদ্র তিরের পামগাছ গুলি আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল । আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সেই দু:সাহসী ভাষণ শুনতে পথচলতি মানুষের ভিড়ে ভেঙে পড়ে পার্কের পাঁচিল । আর বাবা তখন, সম্ভবত, সেই ভিড়ের মধ্যেই পোজিশান নিচ্ছিল গেরিলা যুদ্ধের । এদিকে সেই খদ্দের চারানার পোস্তের খোঁজে অন্য দোকানে পাড়ি দেয় । আর পিছনে দোকানের ভিতর জ্বলন্ত কুপির আলোয় আলোচনা চলছে তেভাগার স্থানীয় বাঁধগাবা আন্দোলন কতখানি সফল হল…।

গল্প হত সেসব পুরনো উত্তপ্ত দিনের:

--বাঁধগাবার কী খবর জিতেশ? উখ্যানে রেড্ হব্যেক শুনলম...

--হ, কিন্তক আর একটা সমস্যা হইচে দাদা...

--ব্যাপার কী গো...?

--কাল সন্ধ্যায় মিটিন আছে মনসাতলা মন্দিরের পেছুনে, বটতলে...নন্দীদা থাইকব্যেক, তুমাকেও যেতে বল্যেচে...

--কিন্তু উদিকের খবর কী?

--গতমাসে নন্দীদা আর বাঁধগাবার কমরেডরা পূবদকের জঙ্গলে বাঁধপাড়ে তিনখানা ওয়ান-সাটার রেখে আইছিল, মাটিতে পুঁতে, যাতে ইদিক থেকে এ্যাটাক হ্যলে জঙ্গলে লুকিই পড়ে একটা জবাব দিয়া যায়...

--হ, সেকথা ত শুন্যেছিলম...

---এখন বর্ষার জলের পর জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে...কীষ্টবাঁধের মুয়ান ভেঙে জল হো-হো করে বেরিই যাচ্চে, সারা জঙ্গল জলে জলাময়...বন্দুকগুলা খুঁজে পাওয়া যাচ্চে নাই...

.....


   ...বাতিস্তার স্বৈরশাসনের মতো বাবার দোকান ভেতরে ভেতরে দুর্বল হতে থাকে। আর দোকানের কুপির আঁধার ঘিরে জমে ওঠে সান্ধ্য মজলিস্ ; “বল ত হে গোপেশ্বর—এই পথিমি যদি এ্যাত বড় হয়, থাইলে ( মহা শূন্যের দিকে ইঙ্গিত ক’রে) এই ফাঁক টা কত বড়?” – বাবার মুদিখানা মহাশূন্যে এক বাতিল উপগ্রহানুর মতো ভেঙে পড়ে ।

   সেই সময় আমার বছর পঁয়তাল্লিশের বাবা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে সাইকেল চড়ে কোথায় কোথায় চলে যেত। যামিনী জেঠু, সন্তোষ জেঠু, ত্রিভঙ্গ জেঠু এদের সাথে আলোচনা চলত কিসের যেন? ওরা সবাই এক স্বপ্নালু বর্ণময় নদীতে একটা নৌকা ভাসানোর কথা বলত । আর আলোচনা করত সম্ভাব্য ঝড়ে হাল ধরে থাকা এক অনুদ্দিষ্ট কান্ডারীর কথা । আর আমার বাবা, যার বাস্তব জগত বলে কোনোদিন কিছু ছিলো না কখনো, সে তার স্বপ্ন জগতের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আরো হ্যালুসিনেশনের দিকে চলে যেতে থাকে...। উপার্জনহীন দীর্ঘ দুপুরগুলিতে বাবা টিনেরচালের কোঠায় কাটিয়ে দিত সারা দুপুর আর বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে উপহার দেওয়ার আগে আরো একবার পড়ে নিত ‘আঁখের স্বদ নোনতা’ হয়ে যাওয়ার বহুল পঠিত সেই কাহিনী ।


-- বাবার এইসব গল্পগুলি রয়ে গেল। বানানো গল্পগুলি, রঙ চড়ানো গল্পগুলি।  সোভিয়েতের পতন বাবা বিশ্বাস করেনি। কাস্ত্রোর মৃত্যু বাবা বিশ্বাস  করেনি। শুধু নন্দীগ্রামএর পর বাবা চুপ হয়ে গিয়েছিল। একবার শুধু বলেছিল--চাষীর ছেলা চাষ না করলে তরা খাবি কী? বাবা আর কোনো বানানো বিপ্লবের গল্প বলত না, শুধু ছোটবেলার গ্রামের গল্প বলত বুবুকে। বাবার জ্যাঠাকে মধ্যরাতে নিশিতে ডেকে নিয়ে যাওয়ার গল্প বলত।নিশির ডাকে বাবার জ্যাঠামশাই মাঝরাতে উঠে সেঁউতি খুলে কাঁধে গামছা ফেলে চলে গিয়েছিল পাঁচ মাইল দূরের  রুখা ক্ষেতে। খালের জল সেঁউতি দিয়ে সেচ করেছিল দুজনে। একদিকে বাবার জ্যাঠামশাই, অন্যদিকে সেঁউতিতে পা রেখে তার রামুকাকা। অন্ধকারে কেউ কাউকেই দেখতে পায়না। অঘ্রানের হিম নক্ষত্রের আলোয় দুই ছায়া মূর্তি জল সেচে করে যায় সারারাত। রুখা ক্ষেত উপচে পড়ে বাবার গল্পের ভেতর। ছোট্ট বুবু হাঁ করে শোনে গল্প, সে জানে বহুবার শোনা এই গল্প। আমিও বহুবার শোনা গল্প শুনি আনমনে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে। দুপুরের রোদ এলিয়ে আসে আমাদের ছাদের কার্নিশে।   গল্পের শেষে ভোরবেলা রামুকাকা দূর থেকে দেখতে পায় বাবার জ্যাঠা   ক্ষেতের আলের  উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষেত জলে ভেসে যাচ্ছে! 

 খুব ধীরে দিন বদলে যায়। যে দিনবদলের কথা ছিল তার থেকে অন্যতর দিকে দিন বদলে যেতে থাকে। গ্রাম শহর মানুষ মন আত্মা বদলাতে থাকে।  রুখা টাঁড় বাঁকুড়ার মাটির তলা থেকে হাজার হাজার গ্যালন জল উপরে উঠে আসে। মাটির তলা শূন্য হচ্ছে ক্রমশ। মফস্বলি সন্ধ্যার অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠছে বেমানান আলোয়। রাজদরবারের ধু-ধু অন্ধকার মাঠ অকারণ আলোকিত হয়ে ওঠে।  শ্মশানের ঝোপঝাড় আলোকিত হয়ে উঠছে। আলোর ভেতরে এক অচেনা অন্ধকারে    আমাদের আত্মক্ষয়ের ভাঁড়ার পূর্ণ হতে হতে উপচে ওঠে। একলা ভুতে পাওয়া মানুষগুলি অল্প আঁধারের খোজে লুকিয়ে শহর ছাড়িয়ে চলে যায় আরো আরো ভেতরের দিকে। 

   এই যে শহর দেখছিস এখন, আগে পুরোটাই ছিল বনবিষ্ণুপুর। শাল আঁকড় আর চাকলদার বন, লালবাঁধ পেরিয়ে আর যাওয়ার উপাই নাই, এত ঘন, মোল গামারের বন। ওইদিকে এরোড্রম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরর মহড়ার এয়ারস্ট্রিপ। বাবা তার পুরনো দিনের গল্প শুরু করে--

...আমার বাবার বালক বয়সের কথা।  তখন সে সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে। তার বাবা থাকে সুদুর কলকাতা শহরে। সেখানে এক সওদাগরী অফিসের হিসাব লেখক । একমাসে দুমাসে একবার বাড়ি আসে। এই বিষ্ণুপুরের ভাড়া বাড়ি থেকে দেশের বাড়ি মেঠানাগ্রামে যায় দাদা-ভাইদের সাথে দেখা করতে, তখন এই ছেলেটিকেও সঙ্গে নেয় কখনো। যুবতী স্ত্রী কলাবতীকেও সঙ্গে নেয়। দেশের বাড়ি থেকে ভাই গরুরগাড়ি পাঠায়। কখনো সেই গাড়ির সঙ্গে আসে বাল্য-বিধবা বোন। বালকটির পিসি। পিসি এলেই আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় বালকটিকে। আদর করে ডাকে ‘পরি’। ‘অ পরি, অ পরিয়া, ওরে অলাওঠা কোথায় গেলি রে...’—এইসব তার পিসির সুবচন। পরির শুনতে ভালো লাগে। দেশেরবাড়ি গেলে তার আর আসতে মন চায় না। সেখানে লেখাপড়া নাই, ইস্কুল নাই, চারিদিকে আদিগন্ত ধু-ধু টাঁড়, বাড়ির পিছনে জঙ্গল, ক্ষেত খামার আর কাকাতো ভাইয়েরা। সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা।

   সেবার তার বাবার ছুটি ফুরিয়ে গেল। তখন পরি  আরো ছোটো । কলকাতায় নাকি বোমা পড়েছে। সব লোক পালাচ্ছে সেখান থেকে। তখন পরির বাবা কলকাতা গেল এক ফাঁকা ট্রেনে। কলাবতী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদলো কদিন। পরিকে নিয়ে দেশের ঘরে থেকে গেল আরো কদিন। তার পর সেও ফিরে গেল বিষ্ণুপুরে নিজের সংসারে। আরো কদিন পরে পরি তার পিসির সাথে মেঠানাগ্রাম থেকে এক ভোরবেলা হেঁটে পাড়িদিল বিষ্ণুপুরের দিকে। সঙ্গে আরো দুই ভাই, একজন কাকাত ভাই সুবিমল আর একজন পরির নিচের জন। ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লে হেঁটে বিষ্ণুপুর পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাবে। প্রায় দশ-বারো ক্রোশের পথ। পরির পিসি মনে মনে ভাবে—সাইরেন বাজার আগে লিশ্চয় গামারবনীর জঙ্গল পার হয়ে যেতে পারব। ছোটো ছেলা-পুলা গুলা সাইরেনের কিছুই জানে নাই। মুখে বলে—‘চ রে সব, পা চলিয়ে চ...’। কিন্তু পিসি যা ভয় ছিল তাই ঘটল। ছেলা গুলা একটানা বেশী পথ হাঁটতে পারে নাই, মাঝে মাঝে থামতে হয়। গামারবনীর জঙ্গলে পৌঁছতে অনেকটা বেলা হয়ে গেল। 

  সেই সময়টা চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় । ভারতবর্ষ সেই যুদ্ধ দেখেনি, তবু সেই ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত অখ্যাত গ্রামের এক বাল্য বিধবা বুড়ি তার শিশু সঙ্গীগুলি নিয়ে যুদ্ধের মাঝে পড়ে গেল। যুদ্ধের মহড়া চলছে গামারবনী এরোড্রমে। প্রতিদিন সকাল নটায় সাইরেন বাজে। আশেপাশের গাঁ, বন জঙ্গলের মানুষ সাবধান হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সাইরেন বাজার পর এইবার সেখানে শুরু হবে যুদ্ধের মহড়া। সাইরেন থামলেই ঝাঁকে ঝাঁকে উড়োজাহাজ গুলো আকাশে উড়বে আর জঙ্গলের মধ্যে শুরু হবে গুলি বর্ষণ। 

   সেই সাইরেন বেজে উঠতেই তিনটে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে পিসি আতান্তরে পড়ে যায়। ফাঁকা শুনশান জনমানবহীন সেই গভীর শাল জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাচ্চা তিনটাকে জড়িয়ে ধরে পিসি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়—আর বোধয় ঘরে ফেরা হল নাই রে। বাল-বিধবা পিসি নিজের জন্যে কাঁদে না, কাঁদে অবোধ বাচ্চা গুলার জন্যে। এই বিশাল জঙ্গলের ভিতর কে তাকে রক্ষা করবে ভেবে পায় না। 

   এমন সময় ঈশ্বর প্রেরিত দেবীর মতো, নাকি দুজন কষ্ঠি পাথরের দেবীই ! সাঁতালমেয়ের বেশে  জঙ্গল ভেদ করে সেখানে উপস্থিত হল। তখনো সাইরেন বেজে যাচ্ছে, কানে ঝিঁ-ঝিঁ ধরার মতো অবস্থা সকলের। তারা এসে পিসিকে সান্তনা দেয়। বলে—কাঁদিস না, আমাদের সাথে আয়। যেমন যেমন বলব, তাই তাই করবি। তুরা তিন জন তিন দিকে থাকবি, ভাবিস না, যুদ্ধুখেলা শেষ হলে তুদের আবার এক করে দুব...। তারা পিসি আর বাচ্চাগুলো এক এক জনকে এক একটা গাছের কোটোরে লুকিয়ে রাখে। জঙ্গলের মধ্যে কোথায় বিশালাকৃতি গাছগুলো আছে, কোথায় মাথার উপর ছাদের মতো তাদের ডালপালা মেলা, কোথায় একটা গাছ আরেকটার উপর হেলে পড়ে মধ্যিখানে খোঁদল তৈরী করেছে, সব তাদের নখদর্পনে। পিসিদের সেইসব নানান স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তারা বলে যায়—নড়িস না, যেমন আছু, তেমন থাকবি। এই বলে তারা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন থামে। কিছুক্ষণ পুর্ণ স্তব্ধতার পর শুরু হয় একটানা গোঁ-গোঁ আওয়াজ। মাথার উপর সূর্যের আলো আড়াল করা ডালপালা মেলা জঙ্গলের ছাদ। কিছুই দেখা যায় না। বোঝা যায় আগুনের পাখিগুলো আকাশে উড়েছে। এইবার শুরু হয় গোলা বর্ষন, একটানা, গাছের পাতা খসে পড়ছে। ছোটো, মাঝারি ডাল ভেঙে পড়ছে চারদিকে। আর মাটিতে গভীর ক্ষত করে ধুলো উড়িয়ে এসে পড়ছে গোলা। পরি আর পিসি একটা গাছের কোটোরে বসে দেখছে, মৃত্যু পাশ দিয়ে গম্ভীর মুখে চলে যাচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে। তার পায়ে পায়ে তছনচ হচ্চে জঙ্গল।…

  কতদিন আগের গল্প এইসব? আমার মা তখন কোথায়? আমার জন্মের হাওয়া কোথায় কোন অনিশ্চিতের ভেতর থমকে আছে কেউ জানেনা। অথচ ছিল নিশ্চয় কোথাও। কারণ ভবিষ্যৎ একমাত্র নিশ্চিত এক ঘটনা। যা ঘটবার জন্য আগাম প্রস্তুত হয়ে থাকে। 

    কারন ওই ঘটনার থেকে কিছুদূরে, অন্য এক গ্রামের মাঠের কিনারে তখন দাঁড়িয়ে এক বালিকা।    গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ‘মোহরী—মোহরী’ বলে ডাক নামে ডেকে ডেকে ফেরে । মোহরীর বাবা তাদের মাজুরিয়া গ্রামের লাগোয়া জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে খামারের মাঠে আগুন জ্বালায়, কোনো হেমন্তের সন্ধাবেলা আকাশ লাল হয়ে ওঠে সেই আগুনের আঁচে। 

   সম্বৎসরের চাষ শেষ হয়ে গেছে। বাঁকুড়ার রুক্ষ মাটিতে বছরে একবার মাত্র ঐ চাষ-আবাদ। এখন হেমন্তের মাঠ খাঁ খাঁ শূন্য । গ্রাম থেকে বহুদুর, রেললাইন পার হয়ে ধান-ক্ষেত। মোহরীর বাবা নিজে হাতে টাঁড় জমি কেটে বানিয়েছে চাষ-জমি। জমির পাশেই একটা শীর্ণ ঝোরা। ঝির ঝির সারা দিন জল বয়ে যায়। সেই জল সেঁউতি ছেঁচে চাষ হয়। শীতের শুরুতেই ঝোরা শুকিয়ে যায়। পড়ে থাকে মোটা দানার বালি। কেটে নেওয়া ধানের গুছি শুকিয়ে শক্ত হয়ে থাকে ক্ষেত জুড়ে। পায়ে লাগলে পা কেটে যায়। এখন আর চাষী পরিবার গুলির কোনো কাজ নেই তেমন। শীতের সব্জি কোথাও বা ফলে উঠছে মাঠে মাঠে। সেও সামান্যই । রান্না-চালায় ঘরোয়া লাউয়ের লতা ফেনিয়ে উঠছে কারো। 

    মোহরীর বাবা কাঠগুলি অর্ধদগ্ধ মাটি চাপা দেয় । একসপ্তা মাটি চাপা থাকার পর সেই কাঠ-পোড়া কাঠকয়লা গরুর গাড়িতে বোঝাই করে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। সঙ্গে শুকনো খাবার—চিড়ে, মুড়ি, গুড় আর গমের ছাতু...। বলদ দুটির জন্য খড় ক’আঁটি। প্রথমে উত্তরে পাঁচ ক্রোশ মতো পথ পেরিয়ে বিষ্ণুপুর বাজার। বাজার পেরিয়ে, পুরনো শহরের একমাত্র লালমাটির পথ ধরে পূবে সে রাস্তা সোজা চলে গেছে কামারপুকুর জয়রামবাটি পারহয়ে দ্বারকেশ্বরের তীর অবধি। বিষ্ণুপুরের বাজার পেরোলেই দুপাশে ঘন শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। সন্ধার আগে এই জঙ্গল পার হয়ে যেতে হবে। দাঁতাল শুয়োর আর চিতাবাঘের ভয় বেশী এই জঙ্গলে। বিষ্ণুপুর পার হয়ে মোহরীর বাবা লণ্ঠনের আলো জ্বেলে নিয়ে গাড়ির নিচে আংটায় ঝুলিয়ে দেয়। পূবে কাঠকয়লার চাহিদা ভালো । যেতে হবে বহুদূর গাঁয়ের হাট গুলিতে, দ্বারকেশ্বরের তীর অবধি, ঐ পার আরামবাগ। নদী পার হয়ে ঐ পথে সোজা চলে যাওয়া যায় গঙ্গার পাড় অব্দি, ঐপারে দক্ষিণেশ্বর।  সেখানে সারা বছর বড় বড় নৌকা চলে।  সে অনেক দূরের পথ। মৌহরীর বাবা যায় দ্বারকেশ্বরের পার অবদি, শীতে-গ্রীষ্মে মানুষ হেঁটে পার হয় এই নদী, বর্ষায় জলের তোড় এসে সেই পায়ে চলা পথ ভেঙে দেয়, তখন নদীতে বান আসে, খেয়া চলে। 

   মোহরীর বাবার যাওয়া আসা প্রায় ১৪/১৫ দিনের পথ। গাড়ি ছেড়ে দিলে মোহরী বাবার পিছু পিছু গাঁয়ের কিনার পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে থাকে । বলদ-গরু দুটির গলার ঘন্টার টুং-টাং দুরে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেলে, সে ধুলো খেলতে খেলতে ঘরে ফিরে আসে...।

    ধুলো পায়ে বাড়ি ফিরে এসে মোহরী দেখে তার বড় দিদি এসেছে। মায়ের পাশে বসে গল্প করছে হাত নেড়ে নেড়ে। বড়দিকে কত সুন্দর দেখতে। তার ধপধপে ফর্সা চেহারার মাঝে কত গল্প । সব শ্বশুর বাড়ির গল্প। বড়দির বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়েই । গাঁয়ের নাম ঘুঘুডাঙা। ঐ যে গাঁ ছাড়িয়ে ধু-ধু ডাঙা জমি পেরিয়ে  মিলিটারি রাস্তা, ঐ রাস্তাদিয়ে কিছুদুর হেঁটে গেলেই ঘুঘুডাঙা। চারদিকে বাঁশের জঙ্গল আর কয়েকটি মাত্র মাটির ঘর। বাবার গরুরগাড়ি এতক্ষণে মিলিটারি রাস্তা ধরে ঘুঘুডাঙা পেরিয়ে যাচ্ছে।

   মোহরী বাবার কাছে গল্প শুনেছে। ক’বছর আগেও এই রাস্তা দিয়ে কত মিলিটারি ট্রাক যেত আসত। ঐ দুরে, জঙ্গলের মধ্যে গামারবনিতে উড়োজাহাজের আড্ডা। যুদ্ধের মহড়া চলত । এরোপ্লেন গুলো আকাশে উড়ত । মোহরীও দেখেছে সেসব। এখন যুদ্ধ নাকি থেমে গেছে। সাহেবরা চলে গেছে, আর আসবে না। এখন ঐ মিলিটারি রাস্তা দিয়ে বাবা গরুরগাড়ি নিয়ে যায়। দিদি বাপের বাড়ি আসে...। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে বিষ্ণুপুর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে চৌকানের জঙ্গলে যে এরোড্রম, সেই পর্যন্ত। এই রাস্তা ধরে বাবা চলে যাবে বিষ্ণুপুর অবদি, তারপর জয়রামবাটীর কাঁচা পথ...। 

এদিকে আমার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গিয়ে জুড়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়, যেখানে আমি কোথাও নেই! অথচ ঘটনা বহমান।  ওই গামারবনীর রাস্তায় খেই হারিয়ে ফেলছে অন্য একটি ঘটনা। আমার বাবার শিশুকাল। যোগাযোগহীন দুটি চরিত্র স্থান আর কালের কিঞ্চিৎ তফাতে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, তারা আরো কয়েক বছর ব্যবধানে জুড়ে যাবে আজীবনের মতো। আর হাওয়ার ভেতর থেকে এই পৃথিবীতে, এই দেশ গাঁয়ে   আমার জন্মের সম্ভাবনা আরো মূর্ত হয়ে উঠবে কয়েক দশক পর। 

 সেই সূদূর ভবিষ্যতে আমি ডায়েরিতে লিখে রাখব নিচের কথাগুলি--


 "...আমার মায়ের বালিকাবেলা সাদাকালো গরুগুলি খুলে দিয়ে বিচুলি খাওয়ায় । গ্রামের মেয়েরা তাকে  মোহরি মোহরি ব’লে ডাক নামে ডেকে ডেকে ফেরে । আগামী অঘ্রাণে তার  কোথাকার কোন্ এক পাত্রের সাথে বিবাহের সবকথা স্থির হয়ে আছে ...। 

   সেখানে কোথাও কোনো কল্পনার আধারে আমি দ্রবীভুত নই । আমার বাস্পটুকুও ভেসে নেই কোনো সুচতুর গম্ভীর বাতাসে । সেইখানে , চুড়ান্ত সংশয়ের মধ্যথেকে একবার পরিস্ফুট হয়ে, বালিকার দুই বুকে ভাঁজ করে রেখে দেব এইসব পান্ডুলিপি গুলি...

   ভবিষ্যতে পুনরায় শুষে নেব, লিখে রাখব ব’লে…"



(রচনাটি পঙ্কজ চক্রবর্তী সম্পাদিত 'সর্বনাম' পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতা লিখি এমতো গল্প পরিচিত মহলে প্রচলিত আছে যেহেতু,  পঙ্কজ আমাকে লেখালিখির গোড়ার কথা সম্পর্কে একটা গদ্য লিখতে বলে। আমি চালাকি করে আমার অসম্পূর্ণ এবং পরিত্যক্ত  একটা উপন্যাসের কিছু অংশের একটা কোলাজ বানিয়ে দিয়ে দিই। তবে এটাই আমার যাবতীয়,  সে লেখালিখি বা মুছে ফেলার,  যাইহোক না, গোড়ার কথা। এটা আমি বিশ্বাস করি।) 

 

বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

কালের কল্লোলের সাক্ষাৎকার

 কালের কল্লোলের সাক্ষাৎকার




(পূর্ব মেদিনীপুর থেকে প্রকাশিত 'কালের কল্লোল' নামে একটি পত্রিকাতে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল গতবছর। সম্পূর্ণ কথোপকথনটি ই-মেলে সংঘটিত হয়। কথা হয়েছিল পত্রিকার প্রতিনিধি অনিমেষ সাউ-এর সঙ্গে। অনিমেষকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানাই)



অনিমেষঃ 

 মাধবী কে ? কবিতা থেকে গল্পে তাঁর যাতায়াত কেমন প্রশ্রয় পায় আপনার কাছে।

কৌশিকঃ

* তুমি বোধয় 'মাধবী বাগান'এর কথা বলছ। 'মাধবী' শব্দটি কবিতায় আর গল্পে একেবারেই আলাদা ভাবে এসছে। গল্পে 'মাধবী বাগান' নামগল্পটি পড়লেই বোঝা যাবে,  এটা আমার ছোটবেলা।  একেবারেই আমার ছোটবেলার সেই ঘরের বর্ণনা, যেখানে সদর দরজার উপরে মাটির পাঁচিলের মাথায় ছিল সেই বিশাল মাধবীলতার ঝাড়। এ খুব বলার মতো কোনো বিরাট ব্যাপার কিছুই নয়। অনেকের বাড়িতেই থাকে, আছে। কিন্তু কারো কারো শৈশবের কিছু চিহ্ন আজীবন মনে থেকে যায়, যা ছেড়ে যায় না। আমার হল এই সেই মাধবী বাগান। আর কবি কবি লোকেরা কেমন হয় জানোতো নিশ্চয়, নিজের মাটির ঢেলাটিকেও এত্তটা গ্লোরিফাই করে সোনার মতো বাড়িয়ে বলে। তো এ হল সেই বাড়িয়ে বলা। 

কবিতায় মাধবী আছে? আচ্ছা মাধবী ফুল আছে বোধহয়। ওটা কিছু না, ওটা ওই ফুল তারা চাঁদ নিয়ে বাঙালির কবিতা আরকি।


অনিমেষঃ 

 "বকুল ডালের আঙ্গুল" কাব্যগ্রন্থের  দুটো লাইন এরকম-

"এই সেই অনামিকা, কাঠের আঙুল। / গতজন্মে বকুলের শীর্ণ শাখা ছিল।"

আপনার কবিতায় পুনর্জন্ম গত ভাবনার উৎস অভিমুখ ঠিক কীরকম। 

কৌশিকঃ

* দেখো, আলাদা ভাবে কবিতায় তো কিছু নয়, পূর্বজন্ম বা পুনর্জন্ম একটা মিথ। আমাদের রামায়ণ, মহাভারত আদি পুরাণগুলিতে,  এছাড়া নানা গল্পে মানুষ এই ধারণাটি লালন করে এসছে বহুকাল যাবৎ। পরবর্তীতে  আধুনিক শিক্ষার ধারণায় পূর্বজন্ম স্বীকার করা হয় না। আধুনিক কালে শুধু কেন, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও বলা হচ্ছে এই দেহ পঞ্চভূতের সমাহার। যা মৃত্যুর পর সেই পঞ্চভূতেই বিলীন হয়।    কথা সেটা নয়, কথা হল আমরা,  এই জীবিত  মানুষ, সেই বিলীন হয়ে যাওয়া কতটা মেনে নিতে পারি? অনেকাংশেই পারিনা। এই না-পারা থেকেই রয়েছে আত্মার অবিনশ্বরতার ধারণা। প্রিয়জনের মৃত্যু সহনীয় হয়ে ওঠে এই অবিনশ্বরতার ভেতর দিয়ে। মানুষ নিজের না-থাকাটুকুও সেই পূর্বজন্মের দিকে ঠেলে দিয়ে শান্তি পেতে চায়। এই ভালবাসার সংসারকে সে  ইনফিনিটির দিকে নিয়ে যায়। তাই নিয়েই কাব্য কবিতা উপকথার জন্ম হয়ে আসছে যুগে যুগে।  একদিকে বিশ্বাস করছি মৃত্যুর পর কিছু নেই, অন্যদিকে এই আমার না-থাকাকে মেনে নিতে না পেরে পুনর্জন্মের দিকে চালিত হই। এই ত নিয়তি।


অনিমেষঃ 

 আপনি ব্যবহারিক সময় ও আয়ুকে কবিতার কাল চিন্তার অনুষঙ্গে এনেছেন কখনো কখনো।  কিরকম ভাবে দেখেছেন তা আমরা কবিতায় পাই।  এই কালের গর্ভে ঢুকে যাওয়ার পথ আপনার কাছে ঠিক কিরকম। 

কৌশিকঃ

* কাল বা সময় জিনিসটা বেশ মজার মনে হয় জানো! পৃথিবীতে কাল মানে সকাল, বিকাল,  সন্ধ্যা, দিন,রাত্রি,  মাস, বছর, নানাভাবে তাকে ভাগ করা। আবার দিনকে প্রহরে ভাগ করেছিল মানুষ। দণ্ড,  পল, মুহূর্তে ভাগ করা হল।  আধুনিক সময়  আবার একই নিয়মে ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডে ভাগাভাগি। তো এ সবই আমাদের কাল যাপনের সুবিধার্থে। এ হল খণ্ডিত কাল। অথচ এই পৃথিবীর বাইরে যে মহাজগৎ সেখানে এর কানাকড়ি  দাম নাই। কোনো কাজ নাই তার। সেখানে এক মহা গম্ভীর বিরাজ করছে। যাকে মহাকাল ছাড়া আর কিছু দিয়ে কল্পনা করা যায় না। আবার এই মহাকাল, বা মহাজাগতিক সময় আমাদের এই দিন আনি দিন খাই জীবনে এসে মিশে যায় কখনো কখনো, যখন হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলা আকাশে তাকাই। দেখি,  অসংখ্য নক্ষত্র আলোকবর্ষ দূর থেকে আলো নিয়ে এসে পড়ছে রোজ রাত্রে আমাদের পৃথিবীতে । যার অনেকগুলিই হয়ত নেই। নিভে গেছে বহুকাল আগে। তবু তার ছেড়ে যাওয়া আলো আরো অনেকদিন ধরে পৃথিবীতে এসে পড়বে। এ এক পরম আশ্চর্য আমার কাছে,  যেন  চাক্ষুষ টাইম মেশিন! যা নেই তাকে প্রত্যক্ষ করছি। হাজার বছর    আগের আলো এই চর্মচোক্ষে তাকিয়ে দেখছি। কাল, দেশ ভেঙ্গে যাচ্ছে। এগুলো আমার মতো একজন অতি সাধারণ লোক যখন ভাবে, এইসব দেখে, তখন ভ্যাবাচেকা মেরে যাই।   এসব লিখে রাখার ক্ষমতা তো নেই। আমরা আমাদের সামান্য আয়ু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তো সেটুকুই হয়ত কোনো কবিতায় তোমার চোখে পড়েছে কোথাও।


অনিমেষঃ 

জাতিস্মর আমাদের কাছে একটা মিথ। জাতিস্মর বিষয়টি আপনার কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে। যেমন "বকুল ডালের আঙ্গুল" কাব্যগ্রন্থের তিন নম্বর কবিতায় লিখছেন "আমার জাতিস্মর দিন জেগে ওঠে"। আপনার কাছে এটা কতটা সত্যি। 

* দেখো, ওই লাইনটার কথা ছেড়ে দাও। কবিতায় তো কত কি এসে যায়, কীভাবে, তা কেউ জানেনা। তো এই মিথও কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে করি। যদিও অনেক 'সত্য ঘটনা' রূপী গল্প রয়েছে।  তা কতদূর সত্যি জানিনা। আবার বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে! এটাই রহস্য! এই যে কল্পনা, এর মধ্যে একটা কবিতার মতো রহস্য রয়েছে। আগে পুনর্জন্ম বিষয়ে যে কথাগুলি বললাম, এখানে তার চুড়ান্ত রূপ যেন। শুধু পুনর্জন্মের ভেতর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই নয়, বরং আরো একধাপ এগিয়ে তার কল্পনা গতজন্মের স্মৃতিকেও জুড়ে দিল।  তার পূর্ব স্মৃতি, পূর্ব নাম, ঠিকানা,  সংসার সমস্ত মিলে এক জটিল রহস্য তৈরি হল কথাকারদের কলমে। 

এসব তো ব্যক্তিগত কিছু নয়, তাই আমার কাছে কতটা সত্য বা মিথ্যা তা বিষয়ই নয়। বরং বলতে পারো সেই অলীক সত্যটিকে ধরে নিয়ে একটা ইমেজারি রচনার চালাকি মাত্র এই কবিতা।


অনিমেষঃ 

আপনার  অনেক কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব স্পষ্ট । তবুও তার একটা বাহিরানা আছে । আপনি কি মনে করেন , কবিতা আপনার কাছে আত্মজীবনী হয়ে উঠছে? 

কৌশিক

* তুমি যে অর্থে আত্মজীবনী বলছ, সে অর্থে, আমার মনে হয়,  প্রত্যেক কবিতাই কবির আত্মজীবনীর অংশ। প্রতিটি ছবিই শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি। তাছাড়া আলাদা করে জীবন থেকে খুলে নিয়ে কোনো আর্টফর্ম তো হয় না। একেবারেই হয় না নয়, হয়। সেই জীবন বর্জিত সৌখিন আর্ট কেন হয় আমি জানিনা। আসলে  সবটাই  প্রচণ্ড সম্পর্কিত, পরস্পরের সাথে, জীবনের সাথে। যদি সেটা না হয়, তাহলে কোথাও ত্রুটি রয়ে গেছে ধরতে হবে।   হ্যাঁ, তোমার প্রশ্নের সূত্র ধরে বলি, আমি ডায়েরির মতো করে লেখা বাড়ির কথাও দু'একটা ক্ষেত্রে কবিতা হিসেবে বইয়ে তুলে দিইছি কখনো । বাবার কথা আছে একটা লেখায়--'আমার বাবা বরাবর চা-দোকানী, মাঝে একবার মুদিখাখানার দোকান দিয়েছিল...' এটা একেবারেই ডায়েরির মতো গদ্যে লেখা। তুমি যাকে বলছ 'আত্মজীবনী হয়ে ওঠা'।  তাই হয়ত।   


অনিমেষঃ 

আপনার কবিতা লেখার বয়স প্রায় 25 বছর হতে চলল। সাহিত্য চর্চায় মফস্বল তুলনামূলক সংকীর্ণ জায়গা। বিশেষতঃ সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। আপনার অবস্থান সেখানে ঠিক কিরকম  উপলব্ধি করেন। 

কৌশিকঃ

* এই ধারণাটি কি স্বতসিদ্ধ?   মানে ঠিক কোন পথে এই সিদ্ধান্তে এসে পড়া গেল?  তাহলে কি সাহিত্যের প্রশস্ত জায়গা বড় শহরগুলিই? সেখানে উদাসীনতার বিপরীতে সকলেই খুব সাহিত্য সচেতন?  এই দেখো, কথাটি উল্টে নিতেই দেখা গেল ধারণাটি স্বতসিদ্ধ ত নয়ই বরং বেশ গোলমেলে। এবার বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি বইয়ের নাম দেখা যাক। 

১. তিতাস একটি নদীর নাম (লেখক তিতাস পারের গণ্ডগ্রামের মানুষ।  লিখছেন সেখানকার মালো সম্প্রদায়ের মানুষের কথা)

২. ঢোঁড়াই চরিত মানস (পটভুমি বিহারের, মফস্বল, সেই নিম্নবর্গের মানুষের কথা। 

৩. আরণ্যক, ৪. পথের পাঁচালী, ৫. এবং সর্বশেষ যদি দেখি,  তিস্তা পারের বৃত্তান্ত। লেখক পরে কলকাতাবাসী,  কিন্তু লিখছেন তার ফেলে আসা জীবন, সেই মফস্বল। যে স্মৃতি তাকে আজীবন ছেড়ে যাচ্ছে না। 

যাইহোক। ধারণাটি স্বতসিদ্ধ নয় এটুকুই বলার। আর সাহিত্য শিল্প যাই বলো, সেটার জন্য নিজের জীবনটুকু দরকার হয় শুধু, যা আরো আরো জীবনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।  একটা আস্ত জীবন, তার  আনন্দ, হাসি, কান্না, বেদনা, আর অল্প অবসর--ব্যাস। 


অনিমেষঃ 

অর্থাৎ আপনার ক্ষেত্রে এই ধারণার কোন প্রভাব নেই বা পড়ে না । 

কৌশিকঃ

* না। একেবারেই না। শুধু আমার ক্ষেত্রে বলি কেন, আমি মনে করি কারো ক্ষেত্রেই পড়ার কথা নয়। এটি কোনো বিষয়ই নয়।


#  ব্যক্তি মানুষের মুখের ভাষা, আর কবিতার ভাষা। এই দুটি ভাষার মধ্যকার ব্যবধান বা দূরত্ব ঠিক কী রকম বলে আপনার মনে হয়। 


এটা নিয়ে আমার কিছু বলতে যাওয়া মূর্খামি হতে পারে। গুণীজনেরা অনেকেই এই বিষয়ে অনেক কথা বলে গেছেন। এখন বলা হচ্ছে মানুষ তার জন্মভাষার মধ্যে দিয়েই ভাবনার জগতে প্রবেশ করে। এটা একটা আজন্ম অভ্যেস।   তবু, আমি মনে করি  আমাদের ভাবনার  কোনো ভাষা নেই। ভাবনা মূলত এক অলৌকিক ভিস্যুয়াল।  তার ধ্বনি ও রঙ নিয়ে  সে এক বোবা জগত। বোবা, অথচ মুখরিত।  মূক মানুষের যেমন অগাধ কথা সারাজীবন চাপা থেকে যায়, সে সব কথা কোনোদিন আর তার বলা হয়ে ওঠে না, এও খানিক তেমন।  তবু ভাবনার ভাষাহীন যে ভ্যিসুয়াল তাকে লিপিতে রাখতে গিয়ে বারবার হতাশ হতে হতে তার সবচে কাছাকাছি পৌঁছনোর নামই হয়ত নির্মাণ। 

   একদিকে এই হতাশা মূলত ভাবনার অবাধ অসীমত্ব আর অন্যদিকে ভাষার অল্পপরিসরের সীমার চিরকালীন  দ্বন্দ। যেখানে ভাবনাকে কেটে ছেঁটে অনন্যোপায় আঁটিয়ে নিতে হবে।  

এইটুকু বলে কি কিছু বোঝানো গেল?


# সমসাময়িক বেশকিছু বাংলা কবিতায় বা আমাদের পূর্বের কিছুটা সময়ে, বাংলা কবিতা র কিছু ক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতার অভিযোগে দুষ্ট। সে ক্ষেত্রে কি ভাষার ব্যবধান কাজ করে না? 

* এও ওই একই কথা। আসলে ভাবের ব্যাবধান। প্রতিটি মানুষের ভাবনা জগৎ আলাদা। মূলত একজনের ভাবনা-জগৎ গড়ে ওঠে তার বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিক, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা,  আর প্রকৃতির উপর। একজনের ভাবনা জগৎ যখন আমার ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় তখন আমি তার সঙ্গে সেই ভাবে রিলেট করতে থাকি। যখন মেলে না, তখন আরেক ভাবে। তবে কবিতায় দুর্বোধ্যতা দুরকমই  হয় বলে মনে হয়, ভাষাগত আর ভাবগত। ধরা যাক শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। তার কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ রয়েছে। কেন? 

   'একজন মানুষ তথা কবির ভাবনা জগৎ কীপ্রকার জটিল আবর্তের খনি তা সেখানে তলিয়ে যাবার আগে বোঝার উপায় নেই।    তা কখনো ধরার বা বোঝার ঘটনা থাকে না আর, যতক্ষণ না সেই ভাবনাগুলি ভাষায় অনুবাদের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাষায় অনুদিত মহৎ কবিতাগুলি  হয়ত বোঝা যেতে পারে।  শম্ভু রক্ষিত কোনোদিন সেই চেষ্টার ধারেপাশে না গিয়ে উল্টোদিকে গেলেন। তিনি তার ভাবনাগুলি ভাষার সীমার প্রান্তে রেখে ছেপে দিলেন। তিনি ভাবনাকে কেটে ছেঁটে ভাষায় আঁটানোর চেষ্টা না করে এক অন্যপ্রকার ভাষা নির্মান করলেন। যা আমাদের পরিচিত ভাষাগণ্ডির বাইরে এক অদ্ভুত    জগত। যা আমরা ধরতে পারি না। বাংলা কবিতায় দেশি বিদেশি ইং ফার্সি হিন্দি মাগধী পালি সহ এমন সব শব্দ বসালেন যা ভাষাভূমিকে বন্ধুর প্রান্তর করে পাঠককে একা ছেড়ে দিলেন। আমার খুব সন্দেহ হয় ! না সন্দেহ নয়,  এ সত্যিই, শম্ভু রক্ষিতের কবিতায় এমন প্রচুর শব্দ আছে যা এই পৃথিবীর নয়।  তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই শব্দ অন্য কোনো জগতের'

শম্ভু রক্ষিতকে নিয়ে লেখা একটা গদ্যের অংশ তুলে দিলাম। যাতে বিষয়টা বোঝা যায়। 


# আপনার কি মনে হয় না , শম্ভু রক্ষিত উপেক্ষিত মূলত দুর্বোধ্যতার কারণে?

*  দেখো, আমি যেটা মনে করি, যদিও তা-ই সঠিক বলে দাবী করার কোনো মানে হয় না, সেটা হল,  এই যে আমাদের সমস্ত কিছুকে বুঝে নিতে চাওয়ার আকুতি, সেটা তো সবসময় সম্ভব হয় না। কারণ আমাদের বোধ্য জগতের বাইরেও একটা, অথবা একাধিক, জগত রয়েছে। কেউ কেউ সেই  আপাত দুর্গম জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন হয়ত। সকলে তা পারেন না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সেই বহু যুগ ধরে সারা পৃথিবীতে দু'দল মানুষের ঝগড়া। তো    আমরা সেই ঈশ্বরকেও 'মূর্তি' বানিয়ে ছাড়া পূজা করতে পারিনা। অথচ ভাব-জগত বিমূর্ত।    'মূর্ত ভাবনা' বলে কিছু হয় না। ভাবনা মাত্রই বিমূর্ত । আর যেহেতু শিল্প মাত্রই ,সে যে কোনো মাধ্যমই হোকনা, তা মানুষের ভাবনারই বহি:প্রকাশ যেহেতু, সেহেতু শিল্প 'বিমূর্ত' হতে বাধ্য ।কোনো একেমেবদ্বিতীয়ম ধ্রুব অর্থ তার হতে পারেনা কখনো ।অথচ আমরা যা ভাবি, তাকে 'মূর্ত' বলেই ভাবি ! এ আমাদের আজীবন লালিত অভ্যাসের সংস্কার বা সংকট মাত্র। আমরা বাঙালীরা যা ভাবি, 'বাঙলাতেই' ভাবি ! অথচ 'ভাষা' সেও এক বিমূর্ত প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়।  ওই যে, জীবনানন্দ বলেছেন না-  'কোনো এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে', তাকে ভাষায় প্রকাশ করা,সম্পূর্ণত, এতই সহজ নয় !জৈবিক প্রয়োজনের কথা গুলি আমরা যে ভাষায় প্রকাশ করি , সেই একই ভাষায় হৃদয়ের গভীর ভাবটি প্রকাশ কখনোই সম্ভব যে নয় তা আমরা জেনেছি, আর জেনেছি বলেই, ভাষাকে করে তুলেছি তীক্ষ্ণধার সূক্ষ্ণ, তবু ততখানি সূক্ষ্ণ  বোধহয় আজো সম্ভব হয়নি,যা হলে ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। তাই ভাব ্প্রকাশের নিত্য নতুন ভাষা আজো প্রকাশিত হয়ে চলেছে --- 

কবি শম্ভু রক্ষিত হয়ত তেমনই একজন কবি। যিনি সেই নতুনতর কাব্যভাষা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তার লেখায়। যেকারণে আমাদের প্রচলিত কাব্যভাষায় অভ্যস্ত মন তাকে দুর্বোধ্য ঠাউরেছি।   এ চেষ্টা অনেকেই করেছেন,  করছেন, কখনো শিল্পীর হাতে পড়ে তা কবিতা হয়ে উঠছে,  কখনো বে-হাতে পড়ে শুধুই কায়দা হয়ে থেকে যাচ্ছে। 


# বিশেষত ষাটের দশকের পর থেকে কবিতাকে দশক ধরে পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। নব্বইয়ের পরে এই  ধারণা আরও প্রকট হয়েছে। কবিতার পর্যায়ক্রমিক বিভাজনে  এই দশক ভিত্তিক চিন্তাভাবনা  আপনার মনে কতটা প্রশ্রয় পায়। 

* আসলে এটা নিয়েও এত বেশি কথা হয়েছে চারদিকে যে নতুন করে কিছুই বলার নেই। বরং কবির জন্ম সালটি জানলে কাজ হয় কিছুটা।  অর্থাৎ কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।  বাকি সব বাতুলতা। একটা দশকেই যদি কবির জীবৎকাল সীমাবদ্ধ হত তাহলে কিছু বলার ছিল না। তা তো নয়। যাকে সত্তরের  কবি বলা হচ্ছে তিনি কেন  সত্তরের? এর সঠিক উত্তর কিছু নেই।   নব্বইয়েও তিনি ছিলেন। এখনো তিনি লিখছেন।  সম্পূর্ণ জীবৎকালটিই তিনি ধরে রাখছেন তার কাজের মধ্যে। কবির উত্থানের সময়টিই যদি তার নিজস্ব দশক ধরা হয় তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। আজীবন কবি কি সেই দশকটিতেই বন্দী রইলেন? এটা নিয়ে আর ভাবিনা। 


# আপনার মনে হয় না এই দশক ধরে চিন্তাভাবনা আসলে দুর্বল কবিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটা প্রয়াস। 

* 'দুর্বল কবি' বলে কিছু হয় না। হয় ''কবি' নয়ত 'কবি নয়'। কবি মানেই যে সে তাড়া তাড়া কবিতা লিখবে,  তাও নয়। কবি একটা বিশেষ ভাবের মানুষ আরকি। হয়ত সে ভ্যান রিক্সা চালায়, অথবা সফটওয়্যার বানায়, কিম্বা বেশ্যা, যে কেউ,  যাদের মাথার ভেতরে  এক অলীক জগত রয়েছে। 

যাইহোক,  তোমার প্রশ্ন অনুযায়ী বল্লে, বলতে হয়,   আমি এই বিষয়টি ভেবে দেখিনি, মানে,  কেউ টিকে থাকার জন্য চালু করেছে কিনা। আমার মনে হয়,  যারা বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে একাদেমিক গবেষণা করেন এটা তাদের হাত ধরেই এসছে সম্ভবত। বিষয়টি তাদেরই কাজের জায়গা।   ও নিয়ে কবিদের না ভাবলেও চলে।  



# আপনার কবিতার ঋতুবদল ঠিক বলব না, অনেকটা পরিবর্তন এসেছে "মাধুরীর সঙ্গে কেউ নেই" কাব্যগ্রন্থের। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা। এই পরিবর্তনের পেছনের গল্পটা ঠিক কি রকম। 

* নিজের লেখালিখি নিয়ে আমার খুব ভাবনাচিন্তা নেই। এই অতি আবাল লেখালিখি নিয়ে বলতেও সংকোচ লাগে। কি বলি বলতো? ঋতুপরিবর্তন সম্পর্কে যেটুকু বলার তা হল পৃথিবী ঘুরছে, উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ণ ঘটছে আর ঋতু পাল্টে যাচ্ছে। সেম কেস। একেকটা ফেজ পাল্টে যায় তো সময়ের সঙ্গে,  মানুষের ভাবনা চিন্তার গতিও পাল্টায়। সেই পরিবর্তনের প্রভাব তার কাজের মধ্যে পড়ে।  এটুকুই। সেই হিসেবে জীবনের বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তন থাকারই কথা। এক সরলরেখায় চলবে না এটাই স্বাভাবিক।       এই বইটা সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় এটা একজন নারীর বয়ান। যে বলছে সে পুরুষ নয়।



# আচ্ছা, আপনার প্রথম কলকাতা আসা -

* হ্যাঁ,  তখন খুব ছোট,  পাঠশালের ছাত্র। আমার অনুপুঙ্খ মনে আছে সেসব কথা। কিন্তু তার আগে আমার বিনীত এবং বিস্মিত প্রশ্ন-- কেন? মানে কেন এই প্রশ্ন? অথবা কেন বিশ্বের সবচে বড় ব-দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন নয়? যা আমি দেখিনি।  কেন  উত্তরের বিশাল কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, যার সামনে দাঁড়ালে  মানুষ নত হয়,  উদার হয়ে যায় শুনেছি ।  কেন গৌড় নয়? কেন মেদনীপুর নয়,  পুরুলিয়ার টাঁড় প্রকৃতি নয়? কেন এমন কি শান্তিনিকেতনও নয়? কেন কলকাতা ভ্রমণের কথা?  অবশ্য কলকাতাও এক্টা ঐতিহাসিক  স্থান, অন্তত বৃটিশ শাসনের যুগের তিনশ বছরের ইতিহাসের একটা বিশাল অংশ এখানে ছড়িয়ে আছে। যা আমি সব জানিনা। আর কলকাতা গেলে আমি যেখানে বারবার যাই সেটা ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম। সেই কেলাস ফোরে প্রথম দেখি। এত বড় মিউজিয়াম    তারপর আর কোথাও দেখিনি।    যাইহোক, এই প্রশ্নটির সঠিক অর্থ হয়ত আমি বুঝিনি। 


# আর college street 

* কেলাস ফোরের প্রথম স্মৃতিতে কলেজ স্ট্রিট নাই। সত্যি বলতে জীবনে দুবার পাতিরাম আর তিনবার ধ্যানবিন্দু গেছি। কলেজস্ট্রিট বলতে আমার এটুকুই অভিজ্ঞতা। আর আমি একেবারেই পড়ুয়া নই। বরাবর ফেল করা ছাত্র। সেই কেলাস ফোরেও পড়তাম না। আর এখনও তোমার সাক্ষাৎকারে ফেল করছি।  


# মফস্বলের জীবন আপনার কাছে কতটা প্রাধান্য পায়.. আর তা কিভাবে আপনার কবিতায় ঢুকে পড়ে। 

* ওই যে একটা প্রশ্ন ছিল, কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব...। তো সেখানেই বলা হয়ে গেছে, প্রত্যেকেই যা কিছু কাজ করে তা তার জীবনের থেকে আলাদা কিছু নয়। খুলে দেখানো যায় না। এই প্রশ্নটিও  প্রায় একই। আমার জন্ম বেড়ে ওঠা সবই বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর নামের এই শহরটিতে। এর চারপাশের ল্যাটেরাইট মাটি। শাল মহুয়ার জঙ্গল,  যা বর্তমানে ফাঁকা হয়ে ইউক্যালিপটাসের প্ল্যান্টেশন,    মল্ল রাজাদের প্রাচীন সব মন্দির, আরো আরো পুরো একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর জৈন  মন্দিরগুলি দ্বারকেশ্বরের তীরে, এই সমস্ত ভাঙা ইতিহাস,  ভাঙা বর্তমান হয়ত আমার ভেতরে ঢুকে গেছে জন্মসূত্রেই। একে ত আলাদা করা যায় না কোনো ভাবেই। একই ভাবে যিনি কোনো বড় শহরে জন্মেছেন, বাস করেন, তার ভেতরে জন্মসূত্রেই নাগরিকতা বেড়ে ওঠে,  তার কাজের ভেতরেও সেই প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। আবার এসব ছাড়িয়ে  চিন্তার একটা কমন স্পেস গড়ে ওঠে, যেখানে সমস্ত বাংলা এক।  কলকাতা, বাঁকুড়া, আসাম, ত্রিপুরা, ঢাকা, চাঁটগাঁ যেখানে একসঙ্গে শ্বাস নিতে পারে-- এর একটা সামগ্রিক ইতিহাস রয়েছে, ভাষা রয়েছে, আচার অনুষ্ঠান  রয়েছে যা এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে বেঁধে রাখে। একই সঙ্গে প্রত্যেকেই আলাদা এবং এক।  আমিও তাই।



# আপনার প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন।

* কে প্রতিষ্ঠানের বাইরে? আমি! না তো।  সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র এই তিন প্রতিষ্ঠান আমাদের যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তার বাইরে যাবার সামর্থ কই। আমাদের যা কিছু করার এর মধ্যে থেকেই করতে হয়। নিজের মতামত, নিজের ভাবনা সেও কি আমার একান্ত?  নাকি  সংসার, সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে সেসব? রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব? এই নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে আমি আমার কথাটুকু কতটা বলতে পারছি? গিলে ফেলতে বাধ্যই বা হচ্ছি কতটা। তার চেও বড় কথা আমি যা ভাবছি,  তা আমারই ভাবনা কিনা। এই ভাবনা কেউ ভেবে রেখেছিল আগেই,  আমি শুধুই তাতে লিপ দিচ্ছি না তো?   আমি যা ভালো বা মন্দ বলছি তা কতটা আমার নিজস্ব? নাকি এই অনুভবও নিয়ন্ত্রিত। এগুলো যখন ভাবি তখন বুঝতে পারি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ভাবনা   বলেও কিছু নেই। সমস্তই এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে বেরোতে পারিনি।  


# আপনার  লেখায় কি রাষ্ট্রীয় রাজনীতি প্রভাব ফেলে? 

* আমি দু চার লাইন লিখে ফেলেছি বলে আমাকে এই প্রশ্নটা করা গেল। এবার ধর,  যে লেখেনা? আঁকে না, গান করে না,  শুধু টিকে থাকে,  কাজ করে, ঘুমোয় আর সংসার প্রতিপালন করে,  মানে এই ঢপের কবি বাজারের বাইরে যারা, তাদের কাছে প্রশ্নটা কীভাবে রাখা যায় ভাবছি। 

...

রাষ্ট্র নামে প্রতিষ্ঠানের থাবার বিষয়টি হয়ত আমি আগের প্রশ্নের উত্তরে বোঝাতে পারিনি।  ঘটনা হল আমি যে চাল কিনি, ভাত খাই, তার দাম রাষ্ট্র বেঁধে দেয়, আমি পাঠশাল থেকে ইস্কুল কলেজে যে বই পড়েছি তা রাষ্ট্র বেঁধে দিয়েছিল। আমি কোন পথে হাঁটব আর কোন পথে হাঁটব না তা তখনই ঠিক হয়ে গেছে। 

এইবার আমি ভাত খেয়ে প্রেমের কবিতা লিখতে বসি, মৃত্যু বিষয়ক ঔদাসীন্য লিখি, মহাকাল লিখি-- তা সেখানে রাষ্ট্রের প্রভাব আছে কিনা ভেবে দেখিনি। 


# সমসাময়িক কবিতায় প্রচুর ভাঙচুর হচ্ছে। হয়েছেও। সমসাময়িক কবিতার সঙ্গে আপনার পরিচয় কেমন। 

* অপরূপ ভাবে ভাঙা গড়ার চেয়েও মূল্যবান কখনো-সখনো-- এরকম একটা কথা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন না?   

সে যাইহোক। হঠাৎ করে কিছু ভাঙা যায় বলে আমার মনে হয় না। সমস্ত ভাঙনেরই একটা ইতিহাস থাকে। একটা নির্দিষ্ট পথ থাকে আড়ালে। এটা আমার বিশ্বাস। সেই ভাঙন সমসময়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করা খুব কঠিন।। যেমন একজন মানুষের জীবনে ভাঙচুর আসে, তার ছাপ পড়ে তার মুখে,  চেহারায়, তুমি হয়ত অনেকদিন পর তাকে দেখলে হঠাৎ রাস্তায়। সেই চেহারা আমূল বদলে গেছে। দেখে চমকে উঠলে। অথচ দেখো, তার কাছের মানুষেরা সেই তিল তিল চেহারার বদল  টেরই পেলোনা। তো সেটা দুদিনে হয়নি। আর ভাষার বদল হল আরো দীর্ঘ একটা প্রসেস। প্রজন্ম পেরিয়ে যায়।  তাই সমসাময়িক কবিতায় হঠাৎ করে খুব ভাঙচুর হচ্ছে এমনটা মনে করি  না। জোর করে ভেঙে ফেলতে চাইলে এ্যাবনর্মাল কিছু একটা হবে। হয়েছেও সেসব।   সেইসব কায়দার ব্যাপার মূল ভাষাপথে থাকে না,  পরে তা সরে যায়। 

আর মোদ্দা কথা হল ভাষা আলাদা একা কোনো বিষয় নয়,  তার কাজ তো ভাবকে ধারণ করা। আগেও এ নিয়ে কথা হল। তাই যেটা বলার তা হল,  ভাব বা কনসেপ্টস যখন ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়ায়, সে তখন তার মতো ভাষার খাপ বানিয়ে নেয়। কনসেপ্টস ছাড়া ভাষা ভাঙার খেলা ওই সুদোকু খেলা মাত্র। সমসাময়িক লেখার ক্ষেত্রে দুটোই আছে।   থাকার কথা আরকি।


#  মূলত আপনি একজন কবি, তো আমার প্রশ্ন, একজন কবির কতটা দায় থাকে , তার কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। 

* এইটা বেশ কঠিন প্রশ্ন। কবির আদৌ দায় থাকে কিনা তার লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁচানোর তা তো ভেবে দেখিনি কখনো। কিন্তু কবিরা খুব উৎসাহের সঙ্গে তার লেখাটি পাঠকের গোচরে আনতে উদগ্রীব, এটাই দেখে আসছি। সেটা তার দায় থেকে নাকি খ্যাতি যশের আকাঙখা থেকে সেটা কে জানে! আমরা যখন লেখালিখি শুরু করি, সেটা ৯৪/৯৫ সাল নাগাদ, তখন একটা খুব ঊচ্ছাস ছিল লেখাটি প্রকাশের। দায় নয়, বরং নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখার লোভ। কালে কালে আর নিজের নাম দেখে সেই ঢেউ জাগে না। সে যাইহোক, তখন প্রকাশ মাধ্যম এত সহজ ছিল না। এখন সামাজিক মাধ্যমে যে কেউ সদ্যজাত লেখা কয়েক হাজার পাঠকের সামনে রেখে দিচ্ছে। সরাসরি    পাঠক-যোগ ঘটছে। এ পরিবর্তিত সময়। কিন্তু সেও কি দায় থেকে? না বোধয়। আর কবিতার প্রত্যক্ষ সামাজিক দায়  কতটা, সে বিষয়েও আমার কোনো ধারণা নেই। তবু এইসব লেখাগুলি,(আমার লেখার কথা বলছি না শুধু) সৎ লেখাগুলি, সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে। (সৎ বা অসৎ সমকালে বোঝা দুষ্কর) যা দলিল হিসেবে ভবিষ্যৎ বুঝে নেবে রাখবে নাকি ফেলে দেবে। তাই বন্ধুবান্ধব দু-পাঁচ জনের হাতে সেই লেখা ছড়িয়ে রেখে দেওয়া ভাল।   এই আরকি।


#  মুদ্রিত পত্রিকার পাশাপাশি virtual magazine গুলো বাংলা সাহিত্যে ধিরে ধিরে প্রাধান্য রাখতে শুরু করেছে। lockdown এর পর এই virtual magazine আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আপনার কাছে মূদ্রিত পত্রিকা ও virtual magazine কিরকম প্রাধান্য পায়। 

* পড়ার ক্ষেত্রে কিছুদিন আগেও ওয়েব ম্যাগাজিনগুলোতে অসুবিধা হত। মন বসতো না পুরনো অভ্যাসের জন্য। এখন ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসই তো ব্যাপার, আর কিছু না।  এখন বহুদিন কোনো ছাপা পত্রিকা আসেও না বিশেষ। আসে না মানে, ধর আমাদের সেই প্রথম লেখালিখির যুগে, তখন চিঠিপত্রের যুগ। রোজ এক তাড়া চিঠি আর পত্রিকা আসতো ঘরে,  পিওন চেনা হয়ে যেত। চেনা বন্ধুর পত্রিকা,  অচেনা পত্রিকা। মোবাইলফোন বলে কিছু নেই। হলুদ ডুমবাতির যুগ। এখন সেটা বদলে গেছে। রোজ কিছু না কিছু লিংক আসে।  ওয়েব ম্যাগাজিনের। ব্যাপারটা এই রকম আরকি। 

তবে কি জানো! ছাপা বই পত্রিকা ছুঁয়ে হাতে নিয়ে একটা স্পর্শ সুখ হয়। কোনো কোনো বই বা পত্রিকার প্রতি ধীরে একটা মায়া তৈরি হয়। পুরনো হয়। হলদেটে হয়ে যায়। তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে খুলে দেখি। দেখি ১৯৯৮ সাল। কবিতায় কোনো এক বন্ধুর নাম। যে মারা গেছে বহুদিন। আবার মলাট উল্টে রেখে দিই তাকে। বন্ধুকে। এই মায়া,  এই স্পর্শ, ওয়েবে নেই। 


# আজকের তরুণ কবিদের স্বাধীনতা ও কবিতার স্থায়িত্ব নিয়ে আপনার মতামত ঠিক কিরকম। 


* তরুণের স্বাধীনতা মানে কী? একটু বুঝিয়ে বল প্রশ্নটা?



# বাংলা কবিতার জগতে কী কাব্য অনুশাসন তৈরি হয়? আপনার অভিজ্ঞতায় তা ঠিক কিরকম। 


* আমার অভিজ্ঞতা যদি বলতে হয় তাহলে বলব  এসব বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। কোনো বাঁধা ধরা পত্রিকায় কখনোই লিখিনি। প্রথম থেকেই যেহেতু স্বভাব কুঁড়ে তাই বড় মেজো লিটিল ম্যাগগুলোতেও কখনো পাঠানো হয়নি। দু একটা জায়গায় ডাক পেলে কখনো পাঠিয়েছি। মূলত বন্ধুবান্ধবদের পত্রিকায়। এখনো তাই। সুতরাং যা হয়েছে আপাত স্বাধীন মতেই হয়েছে। কোনো অনুশাসন ছিল না, অন্ত্যত আমার ক্ষেত্রে। 

এবার বাংলা কবিতার জগতে কাব্য অনুশাসন তৈরি হয় কিনা সেটা আলাদা ব্যাপার। এটা কেউ নিজে না চাইলে হয়না বোধহয়। সাধারণত বিখ্যাত কবিদের সঙ্গ লাভের মোহ, একটু নামডাকের ইচ্ছে, তা কার না আছে বল? তো এই থেকেই অনেক সময় নতুন যারা লিখতে আসে, কোনো     দাদা দিদির সঙ্গে ভিড়ে যায়।  অনেক ক্ষেত্রেই তার বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। একটা তীব্র  আত্মবোধ না থাকলে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বেরোনো মুশকিল। আর এটা না থাকলে নিজের কাজ করাও যায় না। 

সে যাইহোক, শেষ পর্যন্ত একা হয়ে যেতে না পারলে সম্ভবত কবিতাকে পাওয়া যায় না। একা হলেও যে পাওয়া যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।  তবে ভিড়ের ভেতর হয় না এটা নিশ্চিত। এর মানে কিন্তু এই নয় যে কবি কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন কেউ। সে তো সংসার, সমাজ, লেনদেন,  বাজারের দর দাম সমস্ত কিছুর মধ্যেই থাকতে হয়। আলাদা করে কবির ভিড়ে আর কেন যাওয়া।

ভালো থেকো অনিমেষ। শুভ হোক জগতের।


...

রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

 দাহ্যমাধুকরী : একটি আলোচনা

কৌশিক বাজারী





   এই সময়, মূলত এক দর্শন 

-বিরহিত কাল। দর্শন বিরহিত সময় তার চিহ্নগুলি পরিস্ফুট করে চলেছে দশকের পরদশক জুড়ে। গানে, গল্পে, কবিতায়, আচারে, বিচারে এক অসুর-দর্শন। অসুর যেহেতু সর্বদা ছদ্মবেশী, যেহেতু তার মোহময়ী রূপ আমাদের আত্ম-বিমোহিত করে রাখে সর্বদা, আমরা ভুলে যাই তার প্রকৃত স্বরূপ। তার ভিতরের শয়তান নীরবে আমাদের অন্তরাত্মা গ্রাস করে চলে। তার ছলা কলায় আমরা বিমোহিত হয়ে পড়ি আর শয়তান সেই সুযোগে আমাদের নিদ্রিত স্বপ্নেরভিতরে হানা দেয়। আত্মার বাগান তছনছ করে দিয়ে আমাদের ভেতরে ভেতরে হত্যা করে রাখে ।

   না, এ কোনোরূপকথার গল্প নয়। এ হল আমাদের ঘটমান-বর্তমান-ইতিহাস। সেখানে যেহেতু দর্শন নেই, তাই জাগলিং রয়েছে। জীবনে প্রকৃত কাব্যের অভাবে, রসের অভাবে, সময় অতিবাহিত করবার ছলে আমরা জাগলিং এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি একদা আর এখন সেই জাগলিংকেই প্রকৃত আর্ট ভেবে নিয়ে জীবনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নইলে জীবন মানে যে জাগলিং নয় কখনোই, সে তো আমরা জানি।

   এইসব কথাগুলো মনে পড়ল কবি বন্ধু সপ্তর্ষি বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘দাহ্য মাধুকরী’ পাঠ করতে গিয়ে। দাহ্য মাধুকরী পাঠ করতে গিয়ে মনে হল—এ জীবন হারিয়ে ফেলেছি। এর সাথে আর সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এই তছনছ আত্মানিয়ে তবু কোথাও তার সঞ্জীবনী শক্তি আমাদের সুপ্ততাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়, হয়তো, সে কারণেই এই আলোচনার প্রবঞ্চনা।

      হয়তো সে প্রবঞ্চনার কথা সপ্তর্ষিরও একান্ত অনুভব। যা তার কবিতার ছত্রে ছত্রে কবি ও পাঠক উভয়কেই ছত্রখান করে দেয়। কবিতা শুধুই আর শব্দের মায়াজালে আবদ্ধ থাকেনা, অথবা শুধুই কনটেম্পোরারিও হয়ে উঠতে চায় না। তা একাধারে যেমন সমসাময়িক, অন্যদিকে তেমনি সময়কে পেরিয়ে বহুদূর চলে গিয়ে পথ হারিয়ে কোনো গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে । হয়তো সেই গ্রাম আর সমকালে নেই, সেই প্রেম, যা বহুদিন আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা তাকে কবিতায় পুনরায় প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠি ।


তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি এদেশেও নদী ছিল এক—

অনেক নৌকা ছিল, হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়শালে ঘোড়া ছিল আর—

তুলোর পুতুল হেন সংখ্যাতীত পরী ছিল ছদ্মবেশী উদাসী রাজার,

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি আমিই ছিলাম সেই ছদ্মবেশীরাজার সারথি ?...

ভাঙা রথ আছে আজো তবে

হারিয়ে গিয়েছে সেই নদী...

 

এখন কিছুই নেই এই দেশে তবু

তুমি কী বিশ্বাস করবে যদি বলি তুমি ছিলে সে দেশের পলাতকারাজকন্যা আর

আমারই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে তুমি

খুলে দিয়েছিলে কবে বুনোফুলে গাঁথা এই সাতনরী হার ?



   কবিতাটি পাঠ করেমনে হবে বুঝি কোনো দীর্ঘ কবিতারি অংশ! না এটি গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ কবিতা । তবু ,যদি শিল্পকে জীবনেরই প্রতিরূপ বলে ধরে নিই, তবে তো এ কবিতা এক দীর্ঘ-দীর্ঘ কবিতার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। হ্যাঁ তাই, কবি সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করছেন, এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেই সঙ্গে তা পাঠকেরও আত্মজীবনীই। জীবন বর্জিত অধুনাকাব্য-গড্ডালিকার বিরুদ্ধে এ এক বিষণ্ণ মুচকি হাসি যেন বা । 

   তাহলে আরো একটি কবিতা পাঠ করা যাক । একেবারে অনাধুনিক পদ্ধতিতে লেখা এক অশ্রু।


আসিল আষাঢ় মাস ধারা খরতর।

সীমানার বেড়া খানি যবে পড়ো পড়ো

দড়িদড়া বাঁশ হাতে রামপ্রসাদ সেন

বেড়া বন্ধিবার কাজে মেয়েরে ডাকেন।

কন্যা বলে, ‘যাও বাবা, আসিতেছি আমি’

রামপ্রসাদ সেন আজ নিজেই ঘরামি।।


( ভাবা যায় ! এই ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত এক কবিতায় কবিএই সব শব্দ-বাক্য-আঙ্গিক ব্যবহার করছেন! যা আমরা বহু পিছনে ফেলে এসেছি কালের নিয়মেই। সেই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাবটি আজ আর ফিরে পাওয়ার উপাই নেই ।  তাহলে কেন এই 'অনাধুনিক' প্রয়াস? )

 

বেড়া বাঁধা কর্ম চলে, সঙ্গে চলে গান।

কন্যা আসি দড়িদড়া পিতারে যোগান।।

কিয়ৎক্ষণ পরে কন্যা উঠি যায় চলে।।

তখনি কন্যার কণ্ঠ সাধকেরে বলে

‘এ’ত দেখি বেড়া বাঁধা শেষ হল প্রায়

 কে তোমারে দড়ি দড়া দিয়েছে জুগায় ?’


    পরবর্তী গল্পটি আমাদের সবারি জানা যেহেতু তাই সেই অংশটি, কবিতায় বাকি গল্পটি, এক্ষেত্রে অনুদ্ধৃত থাক, ক্ষতি নেই। আমরা বরং কবিতাটির একেবারে শেষ প্রান্তে কবির নিজস্ব অনুভবটুকু দেখেনিই। আর তার আগে জানিয়ে দিই—কবিতাটির নাম ‘মীথ’


হায়, জানি, সত্য নয় এসব কাহিনী।

তবু যেন মনে হয় কন্যাটিরে চিনি।

রাজপুত্র ছেড়েছিল তারি ডাকে ঘর

তারি তরে ডিঙা বায় চাঁদ সদাগর

সে আমার বন্ধঘরে খোলা জানালাটি

তারি স্পর্শে গর্ভবতী অহল্যা এ মাটি

কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার

মীথ্ গুলি মর্মে তাই আসে বারম্বার।


   এইবার আমরা মূলজায়গায় এসে উপনীত হলাম—‘কবির কল্পনা কন্যা, ভক্তি জনতার’। হয়তো এটাই মূল কথা এই রচনাটির। এবং এই সত্যে উপনীত হতে যেন ঐ অনাধুনিক ভাষা-স্টাইল আমাদের অনেক খানি দ্রুত আগিয়ে দেয় গন্তব্যে। আর মিথোলজি বোধহয় সমকালীন ভাষায় খোলেও না ভালো।

   সপ্তর্ষির কবিতার একটা মূল জায়গা হল, তার কবিতার ভেতর একটা অতি সূক্ষ্ম নিহিত গল্প থাকে, থাকেই।  এখন প্রশ্ন হল এত এত গল্প কাহিনী  কবিতার পক্ষে খুব ভারবাহী, হানি-কারক হয়ে যাচ্ছে না? কারণ কবিতাকে হতে হবে নির্মেদ,সূক্ষ্ম, বিদেহী আত্মার প্রায়—এমন মত পোষণ করেন কেউ কেউ।হয়তো তাই। এতদিনের কাব্য যাত্রার পথ অতিবাহিত হয়ে আমরা যেখানে এসে আজ পোঁছেছি সেখানে কবিতা আরো সূক্ষ্ম হবে, এটাই অভিপ্রেত। তবে সেই সূক্ষ্মতা কী কায়ায় নাকি মায়ায়? সেখানে গল্প থাকবে না কি ? হাজার হাজার বছর আগের কাব্যের ভিতরে যে সকল কাহিনী প্রবহমানছিল, তার মুছে যাওয়া আবছা স্মৃতির মতো? -- থাকবে না সেই সূক্ষ্ম মায়া?

   যেহেতু আমাদের আদি-কাব্যগুলি থেকে শুরু করে আধুনিকতার গোড়া অবধি সমস্ত সাহিত্যই কাব্যের আধারে। কাব্য বলতে এখানে পদ্য বোঝানো হচ্ছে না, কাব্যই । যে কাব্যের মধ্যে রয়ে গেছে আবহমান মানব-জীবন-ইতিহাস। মানুষের মৃত্যুর পরেও মানব থেকে যাওয়ার ইতিহাস। সেইগল্প। যা পাঠকের মনকে অতি সহজেই জারিত করে তোলে। 

     আর আধার বিহীন, অ-মূর্ত কবিতা ? তাও থাকবে । একদিকে তেত্রিশ-কোটি দেবতার রূপ-বিগ্রহ, অন্যদিকে অরূপ। কিন্তু সরল-সহজ, অল্প বোকা, আবেগ প্রবণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা মদ,মাৎসর্য, ঐশ্বর্য্য, কামের বশবর্তী হয়ে পথে পথে ছুটে মরে, তাদের জন্য তো নয় সেই অরূপের পথ । সে পথ সাধকের হতে পারে। আমাদের আপাতত কাব্যের সেই পরম রসে পৌঁছতে একটুখানি মূর্তির প্রয়োজন হয়। আধারের। হ্যাঁ, যা আমরা সহজেই পেয়ে যাই সপ্তর্ষির কবিতায়। যা মূলত তার ক্লাসিক মুড্ ।


আমাকে হত্যা করে আমারই ফেরার পথে ফেলে গেছে কেউ,

পাহাড়ি গ্রামের সন্ধ্যা কুয়াশায় সূচীভেদ্য হলে

আমারই শবের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমি

থমকে দাঁড়িয়ে দেখি চাঁদের কুহকে

ছেয়ে গেছে উপত্যকা, টিলা আর চালাঘর গুলি—

এবং হত্যাকারী, সে’ও পায়ে পায়ে

চুপে এসে দাঁড়িয়েছে আমারই কিনারে...

   

   সপ্তর্ষির কবিতায়এই হল আমাদের অসময় । আমাদের চূড়ান্ত ঘটমান-ইতিহাস। যেখানে শবদেহ একটি চরিত্র, যার কিনারেএসে দাঁড়িয়েছে নিহত ও হত্যাকারী। আর আকাশে, চাঁদের কুহকে ছেয়ে গেছে উপত্যকা—এটুকুই কবিতা, এটুকুই গল্প!

   একদিন কবি গৌতম বসুর সাথে এক ফোনালাপে কথা হচ্ছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস’ প্রসঙ্গে তিনি বললেন—“দেখ,প্রেম ছাড়া, ভালবাসা ছাড়া কিছু হয় না। মানুষের প্রতি এই যে অকৃত্রিম ভালবাসা, টান, এটাই ‘তিতাস’। তাঁকে(অদ্বৈত) চেষ্টা করতে হয়নি। তিনি শুধু মনের কথা বলেগেছেন” । আর সেখানেই উপন্যাসটিও কবিতা হয়ে উঠেছে। তো, মূল কথা হল প্রেম। বৈষ্ণব প্রেমে যেমন বলা হয়েছে ,আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ছেড়ে কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রিতীর কথা । সেই মহাপ্রেমও নয়।  এ হল অতি সাধারণ জাগতিক প্রেম। মানুষের প্রতি ভালবাসা। এই জগৎকে, আপন মাটিকে  ভালবাসা। প্রেম, যা না হলে সৃষ্টি হয় না । আর কবি তাই সদম্ভে সেইসব অতিদূর ঈশ্বরকে দূরেই সরিয়ে রেখেছেন।

 

সেইসব দেবতাকে বিশ্বাসে নিরস্ত থাকি আমি

চোখের কাছে বা দূরে কোনোদিন দেখিনি যাদের...

সেই অর্থে প্রকৃতই ধর্মচ্যুত আমি—

 

অথবা


পাথরের গায়ে মাথা কুটে 

রাত যায়, কালরক্ত ছুটে...

বালক পাথর ছুঁড়ে মারে—

ঢেউ ভাঙে জলে, অন্ধকারে...

কে ছুঁড়েছে পথ থেকে তুলে

পাগলের মাথাতে পাথর ?

ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর

দেবতাও ব্যাথাতে কাতর...

 

হে দেবতা কবে তুমি ক্রোধে

তুলে নেবে নিজেও পাথর ?

 

   কবির অন্তরাত্মা, তার ক্রোধ, বিষন্নতা, ও অসহায়তা কবিতার ভেতর এত দিনের চেনা দেবতার বিনির্মাণ ঘটিয়ে দেয়। এতদিন যে নিরপেক্ষ, স্থবির দেবতার কথা আমরা জেনেছি, এ সে নয়। মায়ানমার,বাংলাদেশ, গাজা, --সমস্ত পৃথিবীর পাগলের মাথাতে পাথর, (‘পাগল’ অর্থে যে ‘কবি’, সে তো মহাকবি শিখিয়েই গেছেন!) ‘ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে আর’ কবি তার সমস্ত অসহায়তা নিয়ে মাথা কুটে মরে।

          এই কাব্যগ্রন্থের ভেতর ইতস্তত ভ্রমণের পর যখন পাঠক তার তোরণদ্বারের নিচ দিয়ে নিষ্ক্রমণ করবেন, যদি প্রবেশের পথে বেখেয়ালে ভুলেগিয়ে থাকেন, তাহলে আরেকবার তোরণের বাহির হয়ে ঘাড় তুলে দেখে নিন, সেখানে কি লেখাছিল--


নিরুপায় এসব অক্ষরে

এঁকে তুলি একটি ঠিকানা—

ঘুমঘোরে ছুঁয়ে গেছি তবু

মানচিত্র হয়নি’তজানা...

অগস্ত্য-গমন-পথ নয়

মৌন এক ছোটো পথ রেখা

হয়তো বা কিছু দূরে গেলে

সাঁকো এক যেতে পারে দেখা।

আজো সে সাঁকোটি খুঁজে মরি,

ঝুলি ভরে দাহ্য মাধুকরী ।।


(দাহ্য মাধুকরী : সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।। আদম প্রকাশনীর পক্ষে বন্ধুবর গৌতম মণ্ডল ।। প্রচ্ছদ:  কবি স্বয়ং। বছর সাতেক আগে আলোচনাটি লেখা। ধ্যানবিন্দু পত্রিকাতে প্রকাশিত। আজ ব্লগে তুলে রাখলাম।)